সুচিত্রা
সেন
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত
তিনি মোট ৬১টি ছবিতে অভিনয় করেন।
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই এপ্রিল ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির (অধুনা
বাংলাদেশের অন্তর্গত) পাবনা শহরের
গোপালপুর মহল্লার
হেমসাগর লেনে
জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর
পিতা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন
স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মায়ের নাম ইন্দিরা দেবী। তিনি গৃহবধূ বধু
ছিলেন। সুচিত্রা
ছিলেন পরিবারের পঞ্চম সন্তান ও তৃতীয় কন্যা। ডাক নাম রমা। তবে বাবা ডাকতেন কৃষ্ণা
নামে।
সবার উপরে (১৯৫৩)। উত্তম-সুচিত্রা |
পাবনা শহরের মহাখালী পাঠশালার পাঠ শেষ করে, তিনি পাবনা গার্লস স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পাক-ভারত বিভাজনের সময় এঁদের পুরো পরিবার কলকাতায় চলে যান। এই সময় ঢাকার বিশিষ্ট শিল্পপতি আদিনাথ সেনের পরিবারও কলকাতায় আশ্রয় নেন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে আদিনাথ সেনের পুত্র দিবানাথ সেনের সঙ্গে রমা'র বিয়ে হয় এবং স্বামীর পদবী অনুসারে তাঁর নাম হয় 'রমা সেন'। বিলেত ফেরত দিবানাথ সেনকে সংসারী করার জন্যই, রমার সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন তাঁর একমাত্র কন্যা মুনমুন সেন।
দিবানাথের মামা বিমল রায় ছিলেন সেকালের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা। বিমল রায় তাঁকে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তাঁর শ্বশুরকুলের অন্যান্য সবাইকে প্রস্তাব দেন। পরে তাঁর শ্বশুর এবং স্বামীর রাজি হলে তিনি চলচ্চিত্র অঙ্গনে পা রাখেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে 'শেষ কোথায় ছবি'র মাধ্যমে তাঁর চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ছবিটি মুক্তি পায় নি। এই ছবিতে তাঁর নাম পাল্টে 'সুচিত্রা' রাখা হয়। স্বামীর পদবী অনুসারে তাঁর পুরো নাম হয় 'সুচিত্রা সেন'।
সপ্তপদী (১৯৬১)। উত্তম-সুচিত্রা |
১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তি
পাওয়া প্রথম ছিল 'সাড়ে চুয়াত্তুর'। এই ছবিতে নায়ক ছিলেন
উত্তম কুমার।
১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দি ভাষায় নির্মিত 'দেবদাস' ছবিতে দীলিপকুমারের বিপরীতে অভিনয়
করেন। এই ছবির জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ নভেম্বর তাঁর স্বামী দিবানাথ সেনের মৃত্যু হয়।
১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তি পায় তাঁর শেষ ছবি 'প্রণয় পাশা'। এই ছবিতে নায়কের চরিত্রে ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এরপর তিনি চলচ্চিত্র থেকে অবসরগ্রহণ করে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। এরপর তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের সেবায় ব্রতী হন।
২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি 'দাদাসাহেব ফালকে' সম্মাননা পান। কিন্তু সশরীরের এই পুরস্কার নিতে হবে, এই কারণে তিনি এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।
২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই জানুয়ারি ভারতীয় সময় সকাল ৮টা ২৫ মিনিট নাগাদ কলকাতার বেল ভিউ হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সুচিত্রা সেনের মৃত্যু হয়।
উত্তম-সুচিত্রা জুটি
বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে উত্তম-সুচিত্রা জুটিকে এখনো শ্রেষ্ঠ জুটি হিসেবে বিবেচনা
করা হয়। একসময় কলকাতার চলচ্চিত্র পাড়ায় উত্তম-সুচিত্রা জুটি ছাড়া সে সময় কোনো ছবি
‘হিট’ হবে, এটা ভাবা নির্মাতারা ভাবতে পারতেন না। এক পর্যায়ে সাধারণ মানুষ ভাবতে
শুরু করে, চলচ্চিত্রের মতো বাস্তবেও হয়তো তারা একই সম্পর্ক ধারণ করেন। ১৯৫৪
খ্রিষ্টাব্দে একটি পোস্টার ঝড় তোলে উত্তম-সুচিত্রার সংসার জীবনে। সুচিত্রার সই দেয়া
ওই পোস্টারে লেখা ছিল 'আমাদের প্রণয়ের সাক্ষী হলো অগ্নিপরীক্ষা'। ভারতীয়
পত্রিকাগুলোর খবর, সেই পোস্টার দেখে
উত্তম কুমারের স্ত্রী গৌরিদেবী ভেঙে পড়েন।
অন্যদিকে সুচিত্রাকেও সন্দেহ করতে শুরু করেন স্বামী দিবানাথ এবং অভিনয় ছেড়ে দিতেও
চাপ দেন। কিন্তু অন্তত ১০টি ছবিতে এই জুটি চুক্তিবদ্ধ ছিলেন বলে, অভিনয় ছাড়া সম্ভব
হয় নি। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে
উত্তম কুমার তাঁর প্রযোজিত 'হারানো সুর' ছবিতে নায়িকা
হওয়ার প্রস্তাব দিলে সুচিত্রা বলেছিলেন, 'তোমার জন্য সব ছবির ডেট ক্যান্সেল করব।”
একদিন সুচিত্রা সেনের বালিগঞ্জের বাসায় এক পার্টিতে দিবানাথের আক্রমণের মুখেও পড়তে
হয় উত্তমকে। এরপর থেকেই দিবানাথের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে সুচিত্রার। এক সময়
শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আলাদা থাকতে শুরু করেন দক্ষিণ কলকাতার নিউ আলিপুরে।
তাঁর অভিনীত সর্বশেষ ছবি
‘প্রণয় পাশা’ মুক্তি পায় ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে।
এরপর আকস্মিকভাবেই চলে যান
লোকচক্ষুর অন্তরালে। এরপর প্রথম তিনি আড়াল ছেড়ে বাইরে আসেন মহানায়ক
উত্তম কুমারের
মৃত্যুর পর। মাঝরাত পর্যন্ত বসে ছিলেন তার মরদেহের পাশে। সুচিত্রা শেষ জনসম্মুখে
আসেন ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে, তাঁর গুরু ভরত মহারাজের মৃত্যুর পর। দীর্ঘ ২৬ বৎসর অভিনয়
জীবনে তিনি মোট ৬১টি ছবিতে অভিনয় করেন। এর ভিতরে ৩১টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন
উত্তম কুমারের বিপরীতে।
পরিবার :
স্বামী :
দিবানাথ সেন।
সান্তান : একমাত্র কন্যা মুনমুন সেন। অভিনেত্রী।
নাতনী : রিয়া সেন ও রাইমা সেন। অভিনেত্রী।
চলচ্চিত্রের তালিকা
শেষ কোথায় (১৯৫২)। মুক্তি পায় নি।
সাত নম্বর খেয়াড়ি (১৯৫৩)। মুক্তি পায় নি।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য (১৯৫৩)। মুক্তি পায় নি।
সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩)
কাজরি (১৯৫৩)।
সদান্দের মেলা (১৯৫৪)
ওরা থাকে ওধারে (১৯৫৪)
গৃহপ্রবেশ (১৯৫৪)
এটম বোম (১৯৫৪)
ঢুলি (১৯৫৪)
মরণের পারে (১৯৫৪)
বলয় গ্রাস (১৯৫৪)
অন্নপূর্ণার মন্দির (১৯৫৪)
অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪)
সাঁঝের প্রদীপ (১৯৫৪)
দেবদাস (১৯৫৫)
শাপমোচন (১৯৫৫)
সবার উপরে (১৯৫৫)
সাজঘর (১৯৫৫)
মেজো বৌ (১৯৫৫)
ভালোবাসা (১৯৫৫)
সাগরিকা (১৯৫৬)
ত্রিযামা (১৯৫৬)
আমার বৌ (১৯৫৬)
শিল্পী (১৯৫৬)
একটি রাত (১৯৫৬)
শুভরাত্রি (১৯৫৬)
হারানো সুর (১৯৫৭)
পথে হল দেরি (১৯৫৭)
জীবনতৃষ্ণা (১৯৫৭)
চন্দ্রনাথ (১৯৫৭)
মুসাফির (১৯৫৭) [হিন্দি]
চম্পাকলি (১৯৫৭) [হিন্দি]
রাজলক্ষী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮)
সূর্য তোরণ (১৯৫৮)
ইন্দ্রাণী (১৯৫৮)
দীপ জ্বেলে যাই (১৯৫৯)
চাওয়া পাওয়া (১৯৫৯)
হসপিটাল (১৯৬০)
স্মৃতিটুকু থাক (১৯৬০)
বোম্বাই কা বাবু (১৯৬০) [হিন্দি]
সারহাত (১৯৬০) [হিন্দি]
সপ্তপদী (১৯৬১)
সাথীহারা (১৯৬১)
বিপাশা (১৯৬২)
সাত-পাকে বাঁধা (১৯৬৩) [এই ছবির জন্য মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তিনি
শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন]
উত্তর ফাল্গুনী(১৯৬৩) ( ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দিতে পুনঃনির্মিত হয়েছে মমতা নামে)
সন্ধ্যাদীপের শিখা(১৯৬৪)
গৃহদাহ (১৯৬৭)
কমললতা (১৯৬৯)
মেঘকালো (১৯৭০)
ফরিয়াদ (১৯৭১)
নবরাগ (১৯৭১)
আলো আমার আলো (১৯৭২)
হারমানা হার (১৯৭২)
দেবী চৌধুরানী (১৯৭৪)
শ্রাবণ সন্ধ্যায় (১৯৭৪)
প্রিয় বান্ধবী (১৯৭৫)
আঁধি (১৯৭৫)
দত্তা (১৯৭৬)
প্রণয় পাশা (১৯৭৮)
পুরস্কার ও সম্মাননা
১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দ। তৃতীয় মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী।
চলচ্চিত্র সপ্তপদী
১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দ। ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী পুরস্কার মনোনীত মমতা
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ। পদ্মশ্রী চলচ্চিত্র শিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য
১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দ। ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী পুরস্কার মনোনীত আঁধি।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দ। বঙ্গবিভূষণ চলচ্চিত্রে সারা জীবনের অবদানের জন্য।