হিউয়েন সাঙ
খুব ছোটবেলা তিনি কনফুসিয়াস-এর দর্শনে অনুরক্ত হয়ে পড়েন। তার ভাই বোনদের মতই হিউয়েন সাঙ তাদের বাবার কাছ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা ও ধর্মীয় দীক্ষা লাভ করেন। এই সময় তাঁর বড় ভাই চেন সু বৌদ্ধ ধর্মের অনুরক্ত হয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়ে যান। হিউয়েন সাঙ বড় ভাইয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, বৌদ্ধ ভিক্ষু হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। কিন্তু তাঁর বাবা এতে সম্মত হন নি। ৬১১ খ্রিষ্টাব্দে তার বাবার মৃত্যু হলে তিনি লুয়াং প্রদেশে জিংতু বুদ্ধ আশ্রমে তার ভাইয়ের সাথে প্রায় পাঁচ বছর কাটান।
৬১৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে যখন চীনের সুই
সম্রাজ্য ভেঙে পড়ে, তখন তিনি এবং তার ভাই তাং সম্রাজ্যের রাজধানী চ্যাংগানে
পালিয়ে যান। এখানে একটি বৌদ্ধ আশ্রমে প্রায় দুই বছর অতিবাহিত করেন।
৬২২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একজন পূর্ণ বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়ে ওঠেন। এই সময় তিনি বৌদ্ধ ধর্ম
সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার জন্য ভারতবর্ষ ভ্রমণের উদ্যোগ নেন। এর প্রস্তুতির
জন্য, তিনি তাং সম্রাজ্যের রাজধানীতে চলে যান এবং সেখানে সংস্কৃতি ভাষার উপর
পড়ালেখা শুরু করেন।
৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে একটি স্বপ্ন দেখে ভারত
যাত্রার প্রতি আকর্ষণ তীব্রতর হয়। ঐ সময়ে তাং সম্রাজ্যের সাথে তুর্কীদের যুদ্ধ
চলছিল। তাই তাং রাজা তাইজং সকল নাগরিকদের বিদেশ যাত্রা নিষেধ করে দিয়েছিলেন।
কিন্তু হিউয়েন সাং ইউমেনে শহরের সদর দরজার বৌদ্ধ প্রহরীদের বুঝিয়ে শহর থেকে
বেরিয়ে হতে সক্ষম হন। তারপর তিনি ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে কুইংঘি প্রদেশে আসেন। এখান থেকে
গোবি মরুভূমি পার হয়ে ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে তুর্পান পৌছান। যেখানে তিনি বৌদ্ধ রাজার
সাথে দেখা করেন। রাজা তাঁর ভ্রমণের উদ্দেশ্য জানতে পারে, তাঁকে কিছু মূল্যবান
জিনিষপত্র এবং যাত্রার জন্য রসদ উপহার দেন।
তুর্পান থেকে আরো পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে তিনি ইয়ানজি ও কুচা হয়ে কিরজিকিস্তান পৌছান
এবং সেখানে তিনি তুর্ক খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই সময় তুর্ক খানের সাথে তাং
সম্রাজ্যের বিবাদ মিটে গিয়েছিল। ফলে তুর্ক খান তাঁকে ভ্রমণে সাহায্য করেছিলেন। এরপর
কিরগিস্তান থেকে বর্তমান উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে পৌছান। সেখান থেকে আরো
পশ্চিমে পার্সিয়া নিয়ন্ত্রিত সমরখন্দ শহরে পৌছান। সমরখন্দে তিনি কিছু ধ্বংশ হয়ে
যাওয়া বৌদ্ধ স্থাপনা দেখে তিনি বিস্মিত হন। এখান থেকে তিনি পশ্চিমের আমু দরিয়া এবং
তিরমিজ ভ্রমণ করেন। সেখানে তিনি প্রায় এক হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুর সাথে সাক্ষাৎ করেন।
এরপর তিনি খুন্দুজ শহরে যান। সেখানকার প্রিন্স তার্দুর অন্ত্যষ্টিক্রিয়া দেখার
জন্য কিছুকাল অবস্থান করেন। সেখানেই তিনি ধর্মসীমা নামে এক বিখ্যাত বৌদ্ধ ভিক্ষুর
সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেন। সদ্য মৃত প্রিন্স তার্দুর উপদেশেই তিনি পরবর্তীতে
আফগানিস্তানের নব বিহার পরিদর্শন করেন। এই বিহারে তিনি অনেক বৌদ্ধ মঠ এবং মহাবিশ্ব
গ্রন্থের অনুসারী প্রায় তিন হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষু দেখতে পান। এই বিহারে কিছুদিন
কাটিয়ে তিনি আদিনপুর (বর্তমান জালালাবাদ) যান। এরপর আদিনপুর ত্যাগ করে তিনি খাইবার
পাস হয়ে তৎকালীন গান্ধার রাজ্যের রাজধানী পেশাওয়ারের দিকে রওনা হন। যাওয়ার পথে
তিনি অনেক বৌদ্ধ মঠ এবং স্তূপ দেখতে পান।
পেশাওয়ারে তখন বৌদ্ধদের জন্য সুসময় ছিল না। এখানে তিনি কনিষ্ক স্তূপ পরিদর্শন
করেন। থেকে তিনি সোয়াত উপত্যকা ভ্রমণ করেন। সেখানে তিনি প্রায় ১৪ শত পরিত্যাক্ত
বৌদ্ধ মঠ দেখতে পান। তাঁর মতে যেখানে পূর্বে প্রায় আঠারো হাজার ভিক্ষু বসবাস
করতেন। সোয়াত উপত্যাকা দিয়ে তিনি সিন্ধু নদ পারহয়ে কাশ্মীরে আসেন ৬৩১
খ্রিষ্টাব্দের দিকে। কাশ্মীরে বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘাসের সাথে মিলিত হন। উল্লেখ্য সংঘাস
ছিলেন পণ্ডিত ব্যক্তি। এখানে ৬৩২ থেকে ৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অন্যান্য
ভিক্ষুদের সাথে মাহাযান অধ্যয়ন করে কাটান। এরপর তিনি লাহোর ও মতিপুরের দিকে রওনা
দেন। এই অঞ্চলের মঠ ও স্তূপ পরিদর্শনের পর তিনি ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে পাঞ্জাবের জলন্ধরে
আসেন। এখান থেকে মথুরা ভ্রমণ করেন। এই অঞ্চল ভ্রমণের পর তিনি গাঙ্গেয় উপত্যাকায় চলে
আসেন এবং ৬৩৫ খ্রিষ্টাব্দে গঙ্গানদীর তীরবর্তী প্রায় সকল বৌদ্ধ মঠ ও স্তূপ পরিদর্শন
করেন।
৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনী এবং নির্বাণ স্থান কুশীনগর পরিদর্শন করেন। এরপর বারাণসী, বৈশালী, পাটালীপুত্র এবং বুদ্ধ গয়া ভ্রমণ করেন। এরপর বিহারের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন এবং এখানে প্রায় দুই বৎসর যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, সংস্কৃত ভাষা নিয়ে লেখাপড়া করেন।
এখান থেকে ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বঙ্গদেশের
পুণ্ড্রবর্ধন রাজ্যের রাজধানী পুণ্ড্রনগর (বাংলাদেশের মহাস্থানগর) ভ্রমণ করেন। তিনি বর্তমান নওগাঁ-এর সোমপুর মহাবিহারও
পরিদর্শন করেন। সে সময়ের বঙ্গদেশ সম্পর্কে তিনি যে তথ্য লিপিব্ধ করেন, তা থেকে জানা
যায়−
দেশটির পরিসীমা ছিল প্রায় ৪০০০
লি (ছয় লি-তে এক মাইল) এবং এর রাজধানীর পরিসীমা প্রায় ৩০ লি। তিনি দেশটিকে
ঘনবসতিপূর্ণ এবং সবধরনের খাদ্যশস্যে সমৃদ্ধ দেখতে পান। এদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে
প্রাপ্ত সুস্বাদু 'পানাসা ফল' (কাঁঠাল) বিশেষভাবে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি
পুণ্ড্রবর্ধন সম্পর্কে আরও বলেন, 'এখানকার মানুষ বিদ্যার কদর করে। প্রায় বিশটি
সংঘারামে তিন হাজারের মতো পুরোহিত মহাযান ও হীনযান মতবাদ অধ্যয়ন করে। এখানে প্রায়
১০০টি দেবমন্দির (ব্রাহ্মণ্য) রয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক রয়েছে
দিগম্বর নির্গ্রন্থ (জৈন); রাজধানী থেকে প্রায় ২০ লি পশ্চিমে অবস্থিত 'পো-শি-প'
সংঘারাম; এখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুর সংখ্যা প্রায় ৭০০, তাঁরা মহাযান মতে আইন বিধান
অধ্যয়ন করেন। পূর্ব ভারতের অনেক খ্যাতিমান পুরোহিত এখানে বসবাস করেন। এখান থেকে
অদূরবর্তী এক বিহারে 'কোয়ান-তাজ-সাই বোধিসত্ত্ব'-এর (অবলোকিতেশ্বর) একটি মূর্তি
আছে। এর ঐশী প্রজ্ঞার নিকট দুর্জ্ঞেয় কিছুই নয়। দূর-দূরান্তের লোকজন উপবাস ও
প্রার্থনার মাধ্যমে তাঁর স্তব করে।
বঙ্গদেশ ভ্রমণ শেষে, তৎকালীন কামরূপের বৌদ্ধ রাজা ভাস্করবর্মণ-এর নিমন্ত্রেণে, রাজধানী প্রাগ্জ্যোতিষপুর (বর্তমান গৌহাটি) ভ্রমণ করেন। পথে তিনি ৯০০ লি প্রশস্ত নদী পার হন। ধারণা করা হয়, এই নদীটি করোতোয়া।
এরপর রাজা হর্ষবর্ধনের আমন্ত্রণে কনৌজ-এ আসেন। এরপর তিনি অন্ধ্রপ্রদেশের অমরাবতী এবং নাগার্জুনকোণ্ডা বিহার ভ্রমণ করেন। এরপর পাহলভীদের রাজধানী কাঞ্চী ভ্রমণ করেন। এরপর খাইবার পাস দিয়ে ভারত ত্যাগ করেন। ৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চীনে ফিরে যান। ৬৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সূত্র:
History of San Zang