জয়নুল আবেদীন
প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী

১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে ডিসেম্বর বর্তমান কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন
(সরকারি নথিপত্রে তাঁর জন্ম তারিখ অবশ্য ১৮ই নভেম্বর, ১৯১৪)। বাবার নাম তমিজউদ্দিন আহমেদ এবং মা জয়নাবুন্নেছা। বাবা ছিলেন পুলিশের সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর। তিনি ছিলেন পিতামাতার দ্বিতীয় সন্তান এবং জ্যেষ্ঠ পুত্র। চাকরির সুবাদে তাঁর তমিজউদ্দিন কেন্দুয়া, মিঠামইন ও শেরপুর থানা ঘুরে শেষ পর্যন্ত ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেন।

 

১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে শেরপুর রামরঙ্গিনী এম.ই. স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পাশ করার পর, ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত  লেখাপড়া করার পর, ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে নবম ভর্তি হন ময়মনসিংহ মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে বন্ধুদের সাথে কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখার জন্য যান। সেখান থেকে ঘুরে আসার পর পড়াশুনায় মন বসাতে পারছিলেন না কোনভাবেই। এই কলেজের টানেই তিনি ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা জুলাই কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হন। এই স্কুলে প্রথম বর্ষে (১৯৩২-৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর শিক্ষক ছিলেন বলাইচন্দ্র দাস। দ্বিতীয় বর্ষে (১৯৩৩-৩৪ খ্রিষ্টাব্দে) তিনি শিক্ষক হিসেবে পান রিসেন মিত্রকে। এই সময় তিনি যে সকল ছবি আঁকেন তাঁর কিছু নমুনা জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। এর ভিতরে 'শম্ভুগঞ্জ ঘাট' ও 'শম্ভুগঞ্জ ব্রিজ' ছবি এঁকেছিলেন ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে। এই বৎসরের আরও দুটি ছিল শ্রমজীবী সাধরণ মানুষের ছবি।

তৃতীয় বর্ষে (১৯৩৪-৩৫ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর শিক্ষক ছিলেন মনীন্দ্রভূষণ গুপ্ত। এই বৎসরে তাঁর আঁকা দুটি ছবি জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। এর একটি মানুষের অন্যটি দৃশ্যপটের। চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ বর্ষ (১৯৩৫-৩৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর্যন্ত তাঁর শিক্ষক ছিলেন বসন্তকুমার গাঙ্গুলি। এই সময় শুরু হয় তাঁর ফাইন আর্ট পর্ব। এই বৎসরে তাঁর আঁকা ১টি ছবি জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে।

১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে শেষ বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্তি পান।
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসের ড্রইং এ্যান্ড পেইন্টিং ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন
এবং নিখিল ভারত চিত্র প্রদর্শনীতে গভর্নরের স্বর্ণপদক লাভ করেন।

 

দুর্ভিক্ষ, ১৯৪৩

১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের বাংলার দুর্ভিক্ষ শুরু হওয়ার পরপরই তিনি তাঁদের ময়মনসিংহের বাড়িতে ফিরে যান। সেখানে দুর্ভিক্ষের যে মর্মান্তিক দৃশ্যাবলি দেখতে পান এবং ব্যথিত চিত্তে কলকাতায় ফিরে আসেন। এই সময় দুর্ভিক্ষের স্কেচ করতে থাকেন। ওই বছরেই দুর্ভিক্ষ নিয়ে কলকাতায় তিনি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন।
 

১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা নিবাসী তৈয়ব উদ্দিন আহমদের কন্যা জাহানারা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন৷

১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে দুটো স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলো, তারপর জয়নুল পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে তিনি, আরমানিটোলায় অবস্থিত নর্মাল স্কুলে আর্ট শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকাতে প্রদেশের প্রথম আর্ট স্কুল, গভর্নমেন্ট ইন্সটিটিউট অব আর্টস প্রতিষ্ঠার যাবতীয় পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। এবং তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই বৎসরই এদেশের প্রথম আর্ট স্কুলের প্রতিষ্ঠা। এই স্কুলের নাম দেওয়া ‘গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস’৷ এই ইনস্টিটিউটকে গড়ে তোলার গুরুদায়িত্ব হিসেবে তিনি অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন।


১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সরকারি বৃত্তি নিয়ে এক বছরের জন্যে ইংল্যান্ডে যান। সেখানে অবস্থানকালে তিনি বিভিন্ন চারুকলা-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। এই সময় তিনি সেখানে তাঁর নিজের শিল্পকর্মের প্রদর্শনীও করেন। তাঁর কাজ ইংল্যাণ্ডের বিদগ্ধজনের অকুণ্ঠ প্রশংসা অর্জন করে। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যাণ্ড থেকে ফিরে এসে, তিনি এদেশের স্থানীয় শিল্প-ঐতিহ্যের সাথে পাশ্চাত্যের আধুনিক শিল্প-আন্দোলন ও কৌশলাদির সমন্বয় সাধনে ব্রতী হন। এই ধারায় তিনি যে ছবিগুলো আঁকেন, তাঁর ভিতরে উল্লে‌খযোগ্য ছবি হলো ‘দুই মহিলা’ (গোয়াশ, ১৯৫৩), ‘পাইন্যার মা’ (গোয়াশ, ১৯৫৩) ও ‘মহিলা’ (জলরং, ১৯৫৩)।

 

ফসল মাড়াই, ১৯৬৩

১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত আর্ট স্কুলকে একটি চমৎ‍কার আধুনিক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করেন। পরবর্তীকালে এটি পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় এবং স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। আরও পরে মহাবিদ্যালয়টি সরকারি নিয়ন্ত্রণেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হস্তান্তরিত হয় এবং এর বর্তমান পরিচয় চারুকলা ইনস্টিটিউট নামে। এই বছরের ৫অক্টোবর ঢাকার হাটখোলার তারাবাগে কবি সুফিয়া কামালের বাসভবনে যাত্রা শুরু করেছিল শিশু সংগঠন
কচিকাঁচার মেলা। এই সময়ে শিশুদের ছবি আঁকা শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি।

১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে গণঅভ্যুত্থানের বিজয়কে প্রকাশ করেন 'নবান্ন' নামক ছবিতে।

 

১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে যে বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি হয়, তাঁদের স্মরণে তৈরি করেন 'মনপুরা' ছবি। এই বৎসরে তিনি আরব লীগের আমন্ত্রণে মধ্যপ্রাচ্যের সমর ক্ষেত্রে যান। সেখানকার আল-ফাতাহ গেরিলাদের সাথে চলে যান যুদ্ধফ্রন্টে। ওই যুদ্ধক্ষেত্র থাকাকালে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি আঁকেন, তাঁর সেসব ছবির প্রদর্শনী হয় একাধিক আরব দেশে।

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলা একাডেমীর সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই পদে বহাল থাকেন। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর অন্যতম উপদেষ্টা মনোনীত হন। এই বৎসরেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়াস্থ ‘কংগ্রেস ফর ওয়ার্ল্ড ইউনিটি’র সদস্য নির্বাচিত হন এবং বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় অধ্যাপক হন এবং আমৃত্যু এই পদে অধিষ্ঠিত থাকেন।
 

সংগ্রাম, তেলরং ১৯৭৬

১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই মার্চ সোনার গাঁও-এ তিনি 'বাংলাদেশ লোকজ চারু ও কারুকলা ফাউণ্ডেশান' স্থাপন করেন। এই বৎসরেই ময়মনসিংহে নিজের চিত্রকর্মের একটি সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করেন।

 

১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে মে ফুসফুসের ক্যান্সারে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

 

পরিবার :
স্ত্রীর নাম : জাহানারা বেগম
সন্তানাদি :  জ্যেষ্ঠ পুত্র সাইফুল আবেদিন (টুটুল) স্থপতি।
                 দ্বিতীয় পুত্র খায়রুল আবেদিন (টুকুন), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল বিষয়ে এম.এ
                কনিষ্ঠ পুত্র মঈনুল আবেদিন (মিতু) প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পানি-সম্পদ প্রকৌশল বিদ্যায় স্নাতক।


সূত্র: