ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়নভ লেনিন
(১৮৭০-১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে)
মূল নাম ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়নভ
(Vladimir Ilyich Ulyanov)। ছদ্মনাম লেনিন। তবে বিশ্বজুড়ে লেনিন নামেই সর্বাধিক পরিচিত।

মার্ক্সবাদী রাজনীতিবিদ, রাশিয়ার বলশেভিক দলের অন্যতম নেতা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান। এছাড়া মার্কসবাদ-লেলিনবাদ তত্ত্বের প্রবক্তা।

১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে এপ্রিল রাশিয়ার সিমবির্স্ক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ল্যা নিকোল্‌যেভিচ্ ছিলেন বিদ্যালয় পরিদর্শক। তাঁর মায়ের নাম মারিয়া আলেক্সান্ড্রাভনা উলিয়ানভা। তাঁর ভাইবোনেরা ছিলেন-

চার বছর বয়সের লেনিন

জন্মের কয়েকদিন পর তিনি খ্রিষ্টধর্মানুসারে বাপ্তাইজ হন। এই সময় তাঁর ডাক নাম দেওয়া হয় ভোলোদাই (Volodya)। ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে লেনিনের পিতা মৃত্যুবরণ করেন। এই সময় তাঁর মা একাই সন্তানদের প্রতিপালন করেন। এই সময় লেনিনের বড় ভাই জার সম্রাটের বিরুদ্ধে সংগঠিত গোপন বিপ্লবী দলের সদস্য ছিলেন। জার সম্রাট আলেক্সান্ডার তৃতীয়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার কারণে, তাঁর ফাঁসি হয়।

১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লেনিন কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। এই সময় তিনি ছাত্রদের নিয়ে বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিবাদ সভায় উপস্থিতির কারণে মাত্র তিন মাসের মাথায় তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। জার সম্রাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে তাঁর বড় ভাইয়ের ভূমিকার কথা বিবেচনা করে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ঝুঁকি নিতে চান নি বলেই, তাঁকে সামান্য কারণে বহিষ্কার করা হয়েছিল।

১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সামারা যান। এই সময় কাল মার্কসের ডাস ক্যাপিট্যাল পরে তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হন। পরে তিনি ব্যাপক জনসংযোগ এবং মার্ক্সবাদী দর্শন প্রচারের মাধ্যমে  রাজনৈতিক নেতা হয়ে উঠেন। এই সময় তিনি স্থানীয় অন্যান্য মার্ক্সবাদীদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এরপর সামারা থেকে তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গে চলে আসেন এবং সোস্যাল ডেমোক্র্যাটস নামক মার্কসবাদী দলের সাথে যুক্ত হন। তাঁর মূল কাজ ছিল দলের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের ভিতরে বিপ্লবী গ্রন্থাদি বিতরণ করা।

১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পাস করেন। তিনি সামারাতে এসে আইন ব্যবসা শুরু করেন। পরে তিনি ১৮৯৩ খ্রিষ্টব্দে তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য সেন্ট পিটার্সবার্গ চলে আসেন। এই সময় সাম্যবাদ এবং বিল্পবী আদর্শের কর্মী হিসেবে নাদেঝদা ক্রুপস্কায়া (১৮৬৯-১৯৩৯, খ্রিষ্টাব্দ,
Nadezhda Krupskaya) এক নামক তরুণী বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। পিটার্সবার্গে অবস্থানকালে ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে লেনিনের সাথে পরিচয় হয়। পরে তিনি লেনিনের জীবনসঙ্গিনী হয়েছিলেন।

১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে দলের সিদ্ধান্ত অনুসারে ইউরোপীয় শ্রমিক আন্দোলন গ্রুপ 'শ্রমমুক্তি'-র সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর তিনি সুইজারল্যান্ড, জার্মানি ও ফান্স ভ্রমণ করেন। এই সূত্রে তৈরি হয়েছিল শ্রমিকদের নিয়ে 'সংগ্রাম সংঘ' নামক সংগঠন।

১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে 'সংগ্রাম সংঘ'-এর নেতৃত্বে পিটার্সবার্গে সুতাকল শ্রমিকদের একটি ধর্মঘট সংঘটিত হয়। এই আন্দোলনে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি শ্রমিক অংশ নেয়। ফলে জার সরকার ডিসেম্বরের মাসের গোড়ায় লেনিনসহ দলের অধিকাংশ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে।  গ্রেফতারের পরে তাঁকে পিটাসবুর্গ জেলে পাঠানো হয়। এই সময় জেলের ভিতরেই থেকেই তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকেন। এই সময় তিনি জেলের বাইরে  অবস্থিত কমরেডদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন এবং চিঠিপত্র ও পুস্তিকা লিখে। এসব লেখা তিনি তা বাইরে পাঠাতেন সংগোপনে। এই জেলে বসেই তিনি রচনা করেছিলেন মার্কসবাদী দলের প্রথম খসড়া কর্মসূচী। এছাড়া বিপ্লবী দলিলপত্র, বই লিখতেন পত্রপত্রিকার লাইনের ফাঁকে ফাঁকে দুধ দিয়ে। ফলে সহজে তা চোখে পড়তো না। কিন্তু কাগজটা আগুনে গরম করলেই তা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠত। সে সময়ে বিপ্লবীদের এই প্রক্রিয়ায় লেখাটা সাধারণ নিয়মে দাঁড়িয়েছিল। জেলে থাকালীন সময়ে তিনি রুটি দিয়ে দোয়াত বানাতেন, আর সরু নিবের সাহায্যে দুধকে কালি বানিয়ে লিখতেন। অনেক সময় হঠাৎ পরিদর্শক এলে, তিনি লেখাগুলো সঙ্গে সঙ্গে গিলে ফেলতেন। লেনিন তাঁর একটি পত্রে লেনিন পরিহাস করে বলেছিলেন 'ছয়টি দোয়াত আজ খাওয়া গেল'।

লেনিনে এ সকল কাজে সন্দিহান হয়ে, কর্তৃপক্ষ ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই ফেব্রুয়ারি পূর্ব সাইবেরিয়ার এক নির্জন স্থানে ৩ বৎসরের জন্য নির্বাসিত করে। পরে ক্রুপস্কায়াকে এখানে নির্বাসিত করা হয়। এই নির্বাসনকালে তিনি রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ -সহ ৩০টি পুস্তক রচনা করেছিলেন। এই সময়েই তিনি রাশিয়ার শোষিত শ্রমিক ও সর্বহারা শ্রেণির মানুষদের নিয়ে একটি দল গঠনে উদ্যোগী হন।

১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ -নামক গ্রন্থটি। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে জানুয়ারি মাসে তাঁর নির্বাসনের মেয়াদ শেষ হয়। মুক্তির পর তিনি পস্কোভ শহরে বসবাস করা শুরু করেন। এরপর তিনি বিপ্লবী প্রচারে জন্য একটি সংবাদপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেন। এই উদ্দেশ্য তিনি ইউরোপের বিভিন্ন শহরের ঘুরে বেড়ান। তিনি ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানীর লিপজিগ শহরে যান। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দর ১লা ডিসেম্বর জার্মানির লিপজিগ শহর থেকে তাঁর উদ্যোগে প্রথম প্রকাশিত হয় 'ইস্ক্রা' নামক পত্রিকা। ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জার্মানির মিউনিখ শহরে কাটান। এই সময়ে 'ইস্ক্রা' মিউনিখ থেকে প্রকাশিত হতো। ১৯০২-০৩ খ্রিষ্টাব্দে লণ্ডন, ১৯০৩-০৫ খ্রিষ্টাব্দে জেনেভাতে কাটান।

লণ্ডনে থাকার সময় তিনি রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ওয়ার্কার্স পার্টির
(RSDWP) গঠিত হয়। এই সময় তিনি রাশিয়ার লেনা নদীর নামানুসারে নিজের ছদ্মনাম রাখেন 'লেনিন'। অচিরেই তিনি এই দলের উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে RSDWP-এর দ্বিতীয় অধিবেশনে অধিকাংশ সদস্য লেনিনের মতকে সমর্থন করেন। ফলে দলটি দুই ভাগে বিভাজিত হয়ে যায়। লেলিনপন্থী বড় দলটি বলশেভিক নামে পরিচিতি লাভ করে। অন্য দিকে ছোট দলটির নাম হয় মেনশেভিক।

বলশেভিক দলটি ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে গণসংগঠনে পরিণত হয়। এই সময় তাঁকে প্রবলভাবে সাহায্য করেছিলেন  আলেকজান্ডার বগদানভ। এই বছরের ২২ জানুয়ারি (রবিবার) জারসম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাসের শাসনের বিরুদ্ধে একটি বিক্ষোভ। উল্লেখ্য দ্বিতীয় নিকোলাস রাশিয়ার সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছিলেন, ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১লা নভেম্বর। তৎকালীন ফাদার গাপনের নেতৃত্বে একটি বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এই মিছিলে জনগণের উপর জারের রক্ষীবাহিনী বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে। এর ফলে শত শত লোক নিহ্ত হন। এই ঘটনাটিকে বলা হয় রক্তাক্ত রবিবার
(Bloody sunday)। এই ঘটনা থেকেই সূত্রপাত হয়- রুশ বিপ্লব-এর।

রক্তাক্ত রবিবারের ঘটনার পর সমগ্র রাশিয়ার বড় বড় শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়। হরতাল এবং অবরোধে সমগ্র রাশিয়া স্থবির হয়ে পড়ে। এই সময় রাশিয়ার রাজনীতিবিদগণ এবং শ্রমিকরা পার্লামেন্ট শাসনের দাবি জানান। একই সাথে কৃষকরা স্থানীয় জমিদারদের কাছ থেকে নিজেদের জমি দখলে নিয়ে নেন। ঘটনাটি চূড়ান্তরূপে জার সম্রাটের বিরুদ্ধ চলে যায় সেনা বিদ্রোহের মাধ্যমে। বিশেষ করে রাশিয়ার শক্তিশালী নৌ-বাহিনীর একটি নৌ-যুদ্ধ জাহাজের সৈনিকরা জার শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এই অবস্থার ভিতরে রাশিয়ার অন্যতম শহর সেন্ট পিটার্সবার্গের শ্রমিকরা 'সোভিয়েত কাউন্সিল' গঠন করেন। এঁরা শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি, ন্যায্য মজুরি এবং অধিকার নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। এই অবস্থা সামাল দিতে জার সম্রাট যখন হিমসিম খাচ্ছিল, সেই সময় রুশ-জাপান যুদ্ধে রুশ বাহিনীর যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার সংবাদ রাশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। মূলত রুশবাহিনীর এই পরাজয় ঘটেছিল ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি। এই যুদ্ধে রাশিয়ার প্রায় ৯০ হাজার সৈন্য নিহত হয়। এই পরাজয়ের কারণে সম্রাট নিকোলাসের জনপ্রিয়তা ব্যাপক হ্রাস পায়। ফলে নিকোলাস ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে সীমিতাকারে পার্লামেন্ট শাসন ব্যবস্থা 'দুমা' প্রবর্তনের ঘোষণা দেন। এই ব্যবস্থা করে সম্রাট নিকোলাস দ্বিতীয়, তাঁর নিজের পদটা ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

বিপ্লবের এই প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠার পর, ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের  ২৮ জুন অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফ্রার্ডিনেন্ডের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। এই যুদ্ধের এক পক্ষ ছিল অস্ট্র্রিয়া, জার্মানি এবং তৎকালীন অটোমানরা (বর্তমান তুরস্ক)। অপর পক্ষে ছিল (মিত্রপক্ষ) ব্রিটেন, ফ্রান্স রাশিয়া, জাপান এবং ইতালি। এ যুদ্ধে জোরপূর্বক সাধারণ কৃষকদের সম্পৃক্ত করা হয়। যুদ্ধ প্রশিক্ষণ-ছাড়া এসকল সৈন্যদের অধিকাংশই যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ হারায়। ১৯১৪ থেকে ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ২০ লাখ রুশ সৈন্য নিহত এবং ৫০ লাখেরও বেশি আহত হয়। রাশিয়ার জনগণ এই ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির জন্য জারকে অভিযুক্ত করে।এছাড়া রুশ সরকার যুদ্ধের ব্যয় বহন করার জন্য প্রচুর কাগুজে নোট (রুবল) বাজারে ছাড়ে। এর ফলে বাজারে মুদ্রাস্ফীতি দেয়। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে রাশিয়া মুদ্রাস্ফীতি প্রায় চারগুণ বৃদ্ধি ও আয়। এই সময় কৃষকদেরকে অতি উচ্চমূল্যে কৃষি সামগ্রী ক্রয় করতে হতো, অন্য দিকে মধ্যস্বত্তভোগীদের অসাধুতায় উৎপাদিত পণ্য কম দামে বিক্রয় করতে হতো। কম দাম পাওয়ার কারণে সাধারণ কৃষকরা  তাদের উৎপাদিত পণ্য মজুদ করতে শুরু করেছিল। একই সাথে তাঁরা উৎপাদন প্রক্রিয়াকে হ্রাস করতে বাধ্য হয়েছিল। এর ফলে শহরাঞ্চলে খাদ্যের সংকট অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির ফলে কলকারখানায় মজুরী বৃদ্ধির দাবীতে আন্দোলন শুরু করেছিল। এর ফলে রাশিয়ায় ব্যাপক ধর্মঘট শুরু হয়।

এই অবস্থায় লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিক দল প্রথম বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটায় ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই মার্চ মাসে। প্রথম বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ার জার শাসিত সম্রাজ্য ভেঙে পরেছিল। এই সময় বিপ্লবীরা জার রাজাতন্ত্রের শেষ সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাসকে উৎখাত করে একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করে। এই সরকার গঠিত হয়েছিল বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের পরিবর্তে রাশিয়া প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এই সময় অস্থায়ী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রিন্স লভোভ। দ্বিতীয় পর্যায়ে এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন সমাজতন্ত্রী আইনজীবী এবং সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী আলেকজান্ডার কেরেনস্কি। ক্ষমতায় আসার পর তিনি বহু গুরুত্বপূর্ণ আইন পাস করেছিলেন কেরেনস্কি। এর মধ্যে ছিল ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, পুরনো বংশগত পদবি বিলুপ্ত করা, নারীদের সমানাধিকার ইত্যাদি। কেরেনস্কি ছিলেন একজন দুর্দান্ত বক্তা। সেকারণে তিনি সাধারণ মানুষকে তাঁর স্বপক্ষে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

এরপর পূর্ণাঙ্গ সমাজতান্ত্রিক আদর্শে রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট বলশেভিক পার্টি এই অস্থায়ী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। এই সময় লেনিন জার্মানে আত্মগোপন করে ছিলেন। আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হলে, তিনি ৩রা এপ্রিল জার্মান থেকে রাশিয়ায় চলে আসেন। রাশিয়ায় পৌঁছে তিনি তাঁর অন্যতম সহযোগী ট্রটস্কিসহ একটি র্‌্যালিলিতেও যোগ দেন তিনি। যদিও এই সময় লেনিনের আগমনকে কেন্দ্র করে রাশিয়ায় বলশেভিক পার্টি বিরোধী দলগুলো বিক্ষোভ করেছিল। কিন্তু লেলিন  অস্থায়ী সরকারের পদত্যাগ দাবিতে অনড় থেকে আন্দোলন পরিচালনা করতে থাকেন। লেনিনের এমন আকস্মিক উত্থানে কেরেনস্কি ক্ষুব্ধ ও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাই তিনি লেনিনকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেন। কিন্তু লেলিন ফিনিশ রেলওয়ে কর্মীর ছদ্মবেশ নিয়ে ফিলন্যান্ডে পালিয়ে যান লেনিন।

এরপর জেনারেল কর্নিলভের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থান  হয়। এই অভ্যুত্থানের পর যুদ্ধরত বহু সৈনিক বলশেভিকদের পক্ষে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করে। এই ঘটনায় উজ্জীবিত হয়ে বলশেভিকরা চূড়ান্ত বিপ্লবের প্রস্তুতি নেয়। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই নভেম্বর পেত্রোগাদের নেভা নদীর একটি জাহাজ থেকে বলশেভিক দলের পক্ষ থেকে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন বিপ্লবের ঘোষণা দেন। ওই দিনই বলশেভিকরা  পেত্রোগাত দখল করে নেয়। এই সময় রাষ্ট্রের বহু গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও প্রতিষ্ঠান বিপ্লবীদের দখলে চলে যায়। এর মাধ্যমে ধীরে ধীরে বলশেভিকরা সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া গড়ে তোলার পথে অগ্রসর হয়। এই সময়  প্রতিবিপ্লবী ওয়াট গার্ডরা বিভিন্ন স্থানে তখন বলশেভিকদের যুদ্ধ চালিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত চূড়ান্তরূপে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় বলশেভিক দল। বলশেভিকদের এই বিজয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায় রাশিয়ায়। এর ভিতর দিয়ে রুশ বিপ্লব পরিসমাপ্তি ঘটে।

রুশ বিপ্লব -এর পরে লেনিন কাউন্সিল অফ পিপলস কমিসার্সের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এর অর্থই হলো তিনি সাধারণ মানুষ থেকে একটি বিশাল দেশের সর্বক্ষমতার অধিকারী হয়ে যান। রাষ্ট্র পরিচালনার তাঁর কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তারপরে সহজাত প্রজ্ঞার দ্বারা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁকে বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিকাঠামো সৃষ্টির জন্য তিনি ব্যাংক, শিল্প ও ভূমির জাতীয়করণ করেন। এরপর তিন ব্রেস্ত-লিতভস্ক
(Brest-Litovsk) চুক্তির মাধ্যমে জার্মানি ও অন্যান্য ক্ষমতাশালী দেশগুলোর সাথে একটা সমঝোতায় এসেছিলেন। যদিও এর মাধ্যমে রাশিয়া নিজস্ব অনেক অঞ্চল হারিয়েছিল। কিন্তু বাইরের এবং ভিতরে শত্রুদের মোকাবেলার জন্য লেনিনের প্রাথমিকভাবে শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি এবং দলীয় শক্তি সঞ্চয়ের অবস্থা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই চুক্তির পাশাপাশি তিনি সাবেক জার সরকারের কোন ঋণ নতুন সরকার পরিশোধ করবে না বলে ঘোষণা দেন।

স্বাভাবিকভাবে তৎকালীন রাশিয়ার অভিজাত ও ধনী সম্প্রদায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে এরা নানাভাবে লেনিনের অপসারণের চেষ্টা করেছিলেন। এই সূত্রে এঁরা লেলিনের রেড আর্মির সাথে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এই সময় রাশিয়ার কৃষকরা লেলিনের পাশে ছিলেন। একই সাথে ব্যাপক সহযোগিতা করেছিলেন বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষ। তিনি কারখানার শ্রমিকদের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেনি। এই দিক থেকে অভিজাত ও ধনী সম্প্রদায়ের কাছে ছিল বিপুল অর্থ আর তাদের পেটোয়া বাহিনী ছিল মাত্র।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য, লেলিনি চেকা
(Cheka: Russian Secret Police) গঠন করেন।  ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে ষড়যন্ত্রকারীরা লেলিনকে হত্যার চেষ্টা করে। এই চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর স্তালিনের পরামর্শে লেনিন 'Red Terror' নামে একটি প্রোগ্রাম হাতে নেন। প্রোগ্রামটির উদ্দেশ্য ছিলো বিপ্লববিরোধীদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা। এই সূত্রে সেপ্টেম্বর মাসে মস্কোতে বিপ্লববিরোধীদের একটি তালিকা করা হয়। লেনিন এই তালিকা অনুমোদন করেন। এ তালিকা অনুসারে ২৫ জন সাবেক মন্ত্রী, সরকারি চাকরিজীবী আর ৭৬৫ জন হোয়াইট গার্ডকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে শেষদিকে দলের দুইজন উঁচু সারির নেতা লেভ কামানেভ ও নিকোলাই বুখারিন রাশিয়ান সিক্রেট পুলিশ চেকার অন্যায্য কর্মকাণ্ড সীমিত করার চেষ্টা করেন। লেনিন পলিটব্যুরোর (সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটি) মাধ্যমে তাদেরকে বাধা দেন। শুধু তাই নয়, তিনি চেকার ক্ষমতাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া পর্যন্ত উন্নীত করেন। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর নাগাদ চেকার লেবার ক্যাম্পে প্রায় ৭০,০০০ আসামী ছিলো। লেনিনের ভাষায় তারা ছিলো জনগণের শত্রু।

রাশিয়ায় ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়। এই দুর্ভিক্ষ প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষ মারা যায়। এক্ষেত্রে অবশ্য লেনিনের বেশি কিছু করার ছিলো না। কারণ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়া বিধ্বস্ত হয়েছিল এবং ১৯১৭ থেকে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে রাশিয়া প্রায় নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল। এই অরাজকতা সৃষ্টির কারণে খ্রিষ্টান চার্চগুলোর মদদ ছিল। তাই তিনি ২৬৯১ জন পাদ্রি
(Priest), ১৯৬২ জন সন্ন্যাসী (Monk) আর ৩৪৪৭ জন নানকে (Nun) ফাঁসিতে ঝোলান। সব মিলিয়ে ১৯১৭-২৩ সালের মধ্যে আনুমানিক ১০ লক্ষ মানুষ 'Red Terror' প্রোগ্রামের কারণে মারা যায়।

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের পরে লেনিন নজর দেন তাঁর নিজের সরকার ব্যবস্থার দিকে। গৃহযুদ্ধের সুযোগে নতুন নতুন এজেন্সি আর ব্যুরো দেশের ভিতরে গড়ে উঠছিলো। একই সাথে রাশিয়ার প্রশাসন এক বিশাল আমলাতন্ত্রিক অবস্থায় চলে গিয়েছিল। এই আমলাদের আবার নিয়ন্ত্রণ করতেন তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর জোসেফ স্তালিন। আবার স্তালিনের প্রতিপক্ষ ছিলেন ট্রটস্কি। লেনিনের স্বাস্থ্যের অবনতির সুযোগে এই দুইজন রাষ্ট্র ও দলের ক্ষমতা দখলে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলেন। এই দুইজনের মধ্যে তিনি স্তালিনকে যোগ্য বিবেচনা করেছিলেন। যদিও লেনিন তাঁর সরকারের ভিতরের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও চলমান অনিয়মগুলো বন্ধের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পুরোপুরি সফল হতে পারেন নি।

১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ফলে তিনি দৈনন্দিন সরকারি কাজগুলো ঠিকভাবে করতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ক্রুপস্কায়ার মস্কোর কাছে গোর্কিতে একটি অবসর জীবন কাটাতে থাকেন। শেষের দিকে তাঁর কথা বলার শক্তিই ছিল না।

১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে ২১ জানুয়ারি শেষবারের মতো হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।