রুশ বিপ্লব
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়ার জার শাসনের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত বিপ্লবকে রুশ বিপ্লব নামে অভিহিত করা হয়। এই বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় জার রাজতন্ত্রের শাসনের অবসান হয় এবং সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান হয়।

জার রাজতন্ত্রের শেষ সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাসের শাসনামলে সম্রাটের অনুচর, রাজকর্মচারী এবং অভিজাত শ্রেণি দ্বারা শাসিত এবং শোষিত হওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগের ভিতরে কোনোমতে জীবন-যাপন করতো। এর বিরুদ্ধে সামান্য প্রতিবাদ করলেও জেল বা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো। এদের ভিতরে কৃষক এবং শ্রমিকরা অত্যাচারিত হতো সবচেয়ে বেশি। অনেক সময় যুদ্ধের জন্য সাধারণ মানুষের উপর কর বৃদ্ধি করা হতো। এছাড়া বড় ধরনের যুদ্ধে তরুণদের জোর করে যুদ্ধে পাঠানো হতো।

নানা ধরনের উৎপীড়নের মানুষ অসিহষ্ণু হয়ে উঠেছিল। আর এই অত্যাচারী মানুষদেরকে প্রতিবাদে উজ্জীবিত করেছিল বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দলগুলো। এই সূত্রে রাশিয়াতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল যুগান্তরকারী 'রুশ বিপ্লব'।

এ‌ই বিপ্লবের সূচনা ঘটেছিল ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জানুয়ারি (রবিবার) জারসম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাসের শাসনের বিরুদ্ধে একটি বিক্ষোভের সূত্রে। উল্লেখ্য দ্বিতীয় নিকোলাস রাশিয়ার সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছিলেন, ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১লা নভেম্বর। তৎকালীন ফাদার গাপনের নেতৃত্বে একটি বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এই মিছিলে জনগণের জারের রক্ষীবাহিনী বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে। এর ফলে  শত শত লোক নিহ্ত। এই ঘটনাটিকে বলা হয় রক্তাক্ত রবিবার
(Bloody sunday)

এই ঘটনার পর রাশিয়ার বড় বড় শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়। হরতাল এবং অবরোধে সমগ্র রাশিয়া প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। এই সময় রাশিয়া রাজনীতিবিদগণ এবং শ্রমিকরা পার্লামেন্ট শাসনের দাবি জানান। একই সাথে কৃষকরা স্থানীয় জমিদারদের কাছ থেকে নিজেদের জমি দখলে নিয়ে নেন। ঘটনাটি পুরোপুরি জার সম্রাটের বিরুদ্ধে চলে যায় সেনা বিদ্রোহের মাধ্যমে। বিশেষ করে রাশিয়ার শক্তিশালী নৌ-বাহিনীর একটি নৌ-যুদ্ধ জাহাজের সৈনিকরা জার শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। এই অবস্থার ভিতরে রাশিয়ার অন্যতম শহর সেন্ট পিটার্সবার্গের শ্রমিকরা 'সোভিয়েত কাউন্সিল' গঠন করেন। এরা শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি, ন্যায্য মজুরি এবং অধিকার নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। এই অবস্থা সামাল দিতে জার সম্রাট যখন হিমসিম খাচ্ছিল, সেই সময় রুশ-জাপান যুদ্ধে রুশ বাহিনীর যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার সংবাদ রাশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। মূলত রুশবাহিনীর এই পরাজয় ঘটেছিল ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি। এই যুদ্ধে রাশিয়ার প্রায় ৯০ হাজার সৈন্য নিহত হয়। এই পরাজয়ের কারণে সম্রাট নিকোলাসের জনপ্রিয়তা ব্যাপক হ্রাস পায়। ফলে নিজের নিকোলাস ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে সীমিতাকারে পার্লামেন্ট শাসন ব্যবস্থা (দুমা) প্রবর্তনের ঘোষণা দেন।

বিপ্লবের এই প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠার পর, ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের  ২৮ জুন অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফ্রার্ডিনেন্ডের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। এই যুদ্ধের এক পক্ষ ছিল অস্ট্র্রিয়া, জার্মানি এবং তৎকালীন অটোমানরা (বর্তমান তুরস্ক)। অপর পক্ষে ছিল (মিত্রপক্ষ) ব্রিটেন, ফ্রান্স রাশিয়া, জাপান এবং ইতালি। এ যুদ্ধে জার সম্রাট জোরপূর্বক সাধারণ কৃষকদের সম্পৃক্ত করেছিল। যুদ্ধ প্রশিক্ষণ-ছাড়া এসকল সৈন্যদের অধিকাংশই যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ হারায়। ১৯১৭ পর্যন্ত ২০ লাখ রুশ সৈন্য নিহত এবং ৫০ লাখেরও বেশি আহত হয়। রাশিয়ার জনগণ এই ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির জন্য জারকে অভিযুক্ত করে। এছাড়া রুশ সরকার যুদ্ধের ব্যয় বহন করার জন্য প্রচুর কাগুজে নোট (রুবল) বাজারে ছেড়েছিল। এর ফলে বাজারে মুদ্রাস্ফীতি দিয়েছিল অস্বাভাবিকভাবে। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে রাশিয়া মুদ্রাস্ফীতি প্রায় চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই সময় কৃষকদেরকে অতি উচ্চমূল্যে কৃষি সামগ্রী ক্রয় করতে হতো, অন্য দিকে মধ্যস্বত্তভোগীদের অসাধুতায় উৎপাদিত পণ্য কম দামে বিক্রয় করতে হতো। কম দাম পাওয়ার কারণে সাধারণ কৃষকরা  তাদের উৎপাদিত পণ্য মজুদ করতে শুরু করেছিল। একই সাথে তাঁরা উৎপাদন প্রক্রিয়াকে হ্রাস করতে বাধ্য হয়েছিল। এর ফলে শহরাঞ্চলে খাদ্যের সংকট অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির ফলে কলকারখানায় মজুরী বৃদ্ধির দাবীতে আন্দোলন শুরু করেছিল। এর ফলে রাশিয়ায় ব্যাপক ধর্মঘট শুরু হয়।

এই অবস্থায় বলশেভিক নামক সমাজতান্ত্রিক দল প্রথম বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটায় ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই মার্চ মাসে। প্রথম বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ার জার শাসিত সম্রাজ্য ভেঙে পরেছিল। এই সময় বিপ্লবীরা জার রাজাতন্ত্রের শেষ সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাসকে উৎখাত করে একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করে। এই সরকার গঠিত হয়েছিল বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের পরিবর্তে রাশিয়া প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এই সময় অস্থায়ী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রিন্স লভোভ। দ্বিতীয় পর্যায়ে এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন সমাজতন্ত্রী আইনজীবী এবং সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী আলেকজান্ডার কেরেনস্কি। ক্ষমতায় আসার পর তিনি বহু গুরুত্বপূর্ণ আইন পাস করেছিলেন কেরেনস্কি। এর মধ্যে ছিল ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, পুরনো বংশগত পদবি বিলুপ্ত করা, নারীদের সমানাধিকার ইত্যাদি। কেরেনস্কি ছিলেন একজন দুর্দান্ত বক্তা। সেকারণে তিনি সাধারণ মানুষকে তাঁর স্বপক্ষে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

এরপর পূর্ণাঙ্গ সমাজতান্ত্রিক আদর্শে রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিক পার্টি এই অস্থায়ী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। এই সময় লেনিন জার্মানে আত্মগোপন করে ছিলেন। আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হলে, তিনি ৩রা এপ্রিল জার্মান থেকে রাশিয়ায় চলে আসেন। রাশিয়ায় পৌঁছে তিনি তাঁর অন্যতম সহযোগী ট্রটস্কিসহ একটি র্‌্যালিলিতেও যোগ দেন তিনি। যদিও এই সময় লেনিনের আগমনকে কেন্দ্র করে রাশিয়ায় বলশেভিক পার্টি বিরোধী দলগুলো বিক্ষোভ করেছিল। কিন্তু লেলিন  অস্থায়ী সরকারের পদত্যাগ দাবিতে অনড় থেকে আন্দোলন পরিচালনা করতে থাকেন। কিন্তু তাঁর বিপক্ষে মিছিল  বের হলে, লেনিন পুনরায় ফিনল্যান্ডে আত্মগোপন করেন।

এরপর মধ্যে জেনারেল কর্নিলভের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থান  হয়। এই অভ্যুত্থানের পর যুদ্ধরত বহু সৈনিক বলশেভিকদের পক্ষে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করে। এই ঘটনায় উজ্জীবিত হয়ে বলশেভিকরা চূড়ান্ত বিপ্লবের প্রস্তুতি নেয়। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই নভেম্বর পেত্রোগাদের নেভা নদীর একটি জাহাজ থেকে বলশেভিক দলের পক্ষ থেকে লেনিন বিপ্লবের ঘোষণা দেন। ওই দিনই বলশেভিকরা  পেত্রোগাত দখল করে নেয়। এই সময় রাষ্ট্রের বহু গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও প্রতিষ্ঠান বিপ্লবীদের দখলে চলে যায়। এর মাধ্যমে ধীরে ধীরে বলশেভিকরা সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া গড়ে তোলার পথে অগ্রসর হয়। এই সময়  প্রতিবিপ্লবী ওয়াট গার্ডরা বিভিন্ন স্থানে তখন বলশেভিকদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত চূড়ান্তরূপে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় বলশেভিক দল। বলশেভিকদের এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায় রাশিয়ায়। এর ভিতর দিয়ে রুশ বিপ্লবের পরিসমাপ্তি ঘটে।