রাজা মানসিংহ তোমর
১৪৮৬-১৫১৬ খ্রিষ্টাব্দ।
ভারতের মধ্যপ্রদেশের রাজপুত জাতিগোষ্ঠীর রাজবংশের গোয়ালিয়রের রাজা, সঙ্গীতজ্ঞ।
এঁর পিতার নাম কল্যাণমাল তোমর। ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দে
তিনি রাজত্ব লাভ
করেন। এই সময় দিল্লির সিংহাসনে ছিলেন
বহুলুল্ লোদী।
ঘটনাক্রমে
বহুলুল্ লোদী
গোয়ালিয়র আক্রমণ করেন ১৪৮৯ খ্রিষ্টাব্দে। এই আক্রমণের
সূত্রপাত হয়েছিল জৌনপুরের সুলতান মামুদ শাহের
সূত্রে। ১৪৫১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর সিংহাসন লাভের সময় জৌনপুরের শাসক মাহমুদ শাহ দিল্লি আক্রমণ
করেছিল। এই যুদ্ধে মাহমুদ শাহ পরাজিত হয়ে ফিরে আসেন।
মামুদ শাহের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র ও পৌত্রের আমলেও দিল্লির সাথে জৌনপুরের বিরোধ ও সংঘাত অব্যাহত থাকে। শেষ পর্যন্ত
১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দে হুসেন শাহ শার্কীকে বিতাড়িত করে বহুলুল জৌনপুর দখল করতে সক্ষম হন।
এরপর হুসেন শাহ শার্কী রাজা মানসিংহ তোমরের কাছে আশ্রয় নেন। এরপর হুসেন শাহকে আশ্রয়
দেওয়ার কারণে
বহুলুল্ লোদী
গোয়ালিয়র আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষের যুদ্ধের শেষে মানসিংহ পরাজয় মেনে নেন এবং প্রচুর
অর্থ সম্পদ প্রদানের মাধ্যমে সন্ধি হয়। গোয়ালিয়র অভিযানের পরে বহলুল অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কিছুদিনের মধ্যে
মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর
দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন, তাঁর তৃতীয় পুত্র নিজাম খাঁ (সিকান্দার
লোদী)।
১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লী থেকে আসা কিছু বিদ্রোহীকে মানসিংহ
আশ্রয় দেন। এই কারণে সিকান্দার
লোদী গোয়ালিয়রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। যুদ্ধের শুরুতে, ১৫০১ খ্রিষ্টাব্দে সিকান্দার
লোদী গোয়ালিয়র রাজ্যের ধোলপুর আক্রমণ করলে, ধোলপুরের শাসক বিনয়ক দেব
গোয়ালিয়রে পালিয়ে যান। এরপর সিকান্দার
লোদী গোয়ালিয়র অভিমুখে অগ্রসর হন। সুলতানের বাহিনী চম্বল নদী পার হওয়ার
পর, সেনাবাহিনীর ভিতরে কলেরা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে যুদ্ধ যাত্রা স্থগিত করা
হয়। এই সংবাদ পাওয়ার পর, মানসিংহ তার ছেলেকে বিক্রমাদিত্যকে সন্ধির প্রস্তাব পাঠান।
এই সন্ধিতে মানসিংহ বিদ্রোহীদের সুলতানের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বলেন এবং বিনিময়ে
ধোলপুর ফিরে পাওয়ার কথা বলেন। সিকান্দার
লোদী এই প্রস্তাবে রাজী হলে, সন্ধি সম্ভব হয়।
১৫০৪ খ্রিষ্টাব্দে সিকান্দার
লোদী পুনরায় মানসিংহের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা শুরু করেন। যুদ্ধের শুরুতে তিনি
পূর্ব গো্য়ালি্য়রের মান্দ্রিয়াল দুর্গ দখল করেন। এবারেও সৈন্যদের পেটের পীড়ার কারণে
দিল্লীতে ফিরে আসতে বাধ্য হন। এরপর সিকান্দার
লোদী গোয়ালিয়রের নিকটবর্তী আগ্রাতে নতুন নগর স্থাপন করেন। এরপর তিনি ধোলপুর
অধিকার করে গোয়ালিয়রের দিকে অগ্রসর হন। ১৫০৫-১৫০৬ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে গোয়ালোয়রের
আশ-পাশের অঞ্চল দখল করে কর আদায় শুরু করেন। কিন্তু গোয়ালিয়র দুর্গ দখল করতে সক্ষম
হলেন না। এই সময়, মানসিংহের সৈন্যরা সিকান্দারের সৈন্যদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ
শুরু করেন। এরপর তাঁর সৈন্যরা দিল্লী ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
১৫০৭ খ্রিষ্টাব্দে সিকান্দার
লোদী গোয়ালিয়রের নিকটবর্তী উদিতনগর দখল করে, নারওয়ার অবরোধ করেন। ১৫০৮
খ্রিষ্টাব্দে নাওয়ার দখল করার পর, এখানকার শাসনের দায়িত্ব দেন রাজ সিং কাচ্ছওয়াহার-কে।
এরপর সিকান্দারের সৈন্যরা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে লাহার অবরোধ করে।
এই অঞ্চল দখলের পর স্থানীয় সকল বিদ্রোহীদের দমন করে। এরপর কয়েক বছর সিকান্দার
লোদী রাজ্যের নানা বিষয়ের সমস্যা সমাধানে মনোযোগ দেন। এরপর ১৫১৬
খ্রিষ্টাব্দে সিকান্দার লৌদী গোয়ালিয়র দখলের উদ্যোগ নিলে, অসুস্থার কারণে তা বাতিল
হয়ে যায়। এই বছরেএ মানসিংহ তোমর মৃত্যবরণ করেন।
মানসিংহ তোমরের একাধিক স্ত্রী থাকলেও রানি মৃগনয়না ছিলেন প্রধান রানি। এই রানি
ছিলেন গুজারা নামক স্থানীয় নৃগোষ্ঠীর কন্যা। এই কারণে তাঁকে অন্যান্য রানি ও অভিজাত
ব্যক্তিরা সম্মান অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। এই অবস্থা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য তিনি
রাজাকে অনুরোধ করে, পৃথক মহল তৈরি করিয়েছিলেন। এই মহলের নাম ছিল গুজারা মহল।
রাজা মানসিংহ তোমরের রাজত্বকাল ছিল প্রায় ৩০ বছর। এই রাজত্বকালের খুব অল্প সময়ই
স্বস্তিতে ছিলেন। রাজ্যের অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং দিল্লীর লোদী রাজবংশের শাসকদের
কারণে তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। তারপরেও ভারতের বহু সুলতান ও রাজাদের মধ্যে অনন্য
স্থান অধিকার করে আছেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে অসামান্য অবদান রাখার জন্য।
মানসিংহের ভারতীয় সঙ্গীতে অবদান
মানসিংহ নিজে সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। তাঁর রাজসভায় বিশিষ্ট সভাগায়করা স্থান পেয়েছিলেন।
বিভিন্ন গ্রন্থাদি থেকে তাঁর রাজসভার যে সকল সভাগয়কদের নাম পাওয়া যায়, তা হলো-
- আবুল ফজলের
আইন-ই-আকবর গ্রন্থে মতে- সভাগায়করা ছিলেন ছিলেন- বকসু, মচ্ছু এবং ভন্নু (ভানু)
- ফকীরুল্লার রচিত
রাগ দর্পণ গ্রন্থ মতে সভাগায়ক ছিলেন- বকসু, ভানু, পাণ্ডোয়া, মামুদ, কিরণ,
লোহঙ্গ
- মীর্জা খাঁ-এর রচিত
'তুহফাতুল হিন্দ' গ্রন্থ মতে সভাগায়ক ছিলেন- ভানু, পাণ্ডোয়া, বকসু এবং লোহঙ্গ
মানসিংহের রাজ দরবারে
এসব সভাগায়করা যে গান করতেন, তা তিনি লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। এই সংকলনের নাম দেওয়া
হয়েছিল- 'মানকতুহল'। এই গ্রন্থের অনুবাদ করেছিলেন ফকীরুল্লাহ। এই গ্রন্থে মোট ৬টি
শুদ্ধ রাগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো- ভৈঁরো, মালকোষ, হিন্দোল, দীপক, শ্রী
ও মেঘ।
সুলতান আলাউদ্দিনের সময়, আদি ধ্রুবাগানের সূত্রে ধ্রুপদের যে কাঠামো তৈরি হয়েছিল,
মানসিংহ তার একটি সুনির্দিষ্ট রূপতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁর সভাগায়কদের সাহায্য নিয়ে।
তাঁর রাজসভার প্রধান গায়ক ছিল বকসু। এই বকসু এবং মাহমুদ নতুন ধরনের ধ্রুপদ গাওয়া
শুরু করেছিলেন। সে সময়ে গোয়ালিয়রের পথে পথে শ্রমজীবী মেয়েরা জীবিকা অর্জনের জন্য
ধ্রুপদের মতো করে, বীরগাঁথা পরিবেশন করতো। সেই সুরে আদলে বকসু ও মাহমুদ গান বেঁধে,
শাস্ত্রী রাগ ও তালে উপস্থাপন করে, অভিজাত শ্রেণি প্রথমে মেয়েদের গান হিসেবে
তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা শুরু করে। বকসু মানসিংহ তোমরের রাজ দরবারে থাকার সময়- দুই বা
তিন তুকের ধ্রুপদ রচনা ও পরিবেশন করতেন। কিন্তু পরে গুজরাটের বাহাদুর শাহের দরবারে
চারতুকের ধ্রুপদ রচনা করেছিলেন।