কাজী মোতাহার হোসেন
(১৮৯৭-১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দ)
পরিসংখ্যানবিদ, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ।

১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে জুলাই কুষ্টিয়া (তখনকার নদীয়া জেলার মহকুমা) জেলার কুমারখালি থানার লক্ষ্মীপুর গ্রামে তাঁর মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলার পাংশা উপজেলার বাগমারা গ্রামে। তাঁর পিতা কাজী গওহরউদ্দীন আহমদ ছিলেন সেটেলমেন্টের আমিন। মায়ের নাম তাসিরুন্নেসা।

তাঁর শৈশব কেটেছে ফরিদপুরের বাগমারায়। মেধাবি ছাত্র হিসাবে বৃত্তি নিয়ে ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে নিম্ন প্রাথমিক ও ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে কুষ্টিয়া মুসলিম হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা পাস করার পর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। কিছুদিন পর এই কলেজ ত্যাগ করে রাজশাহী কলেজ ভর্তি হন এবং এই কলেজ থেকে ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন।

১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ বিএ পরীক্ষায় বাংলা ও আসাম জোনে প্রথমস্থান অর্জন করে মাসিক ৩০ টাকা বৃত্তিলাভ করেন।

১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। এই সময়ে তিনি কলকাতার তালতলা নিবাসী মোহাম্মদ ফয়েজুর রহমানের কন্যা সাজেদা খাতুনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন । ঢাকা কলেজ থেকে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম স্থান নিয়ে পাশ করেন। উল্লেখ্য, ঢাকা কলেজে ছাত্র থাকাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ডেমনেস্ট্রেটর হিসেবে চাকরি শুরু করেন এবং ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে সহকারী প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান।

১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে নিখিল ভারত দাবা প্রতিযোগিতা আয়োজনের ব্যাপারে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। উল্লেখ্য উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবে ১৯২৯ থেকে ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানে তিনি একক চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। বাংলাদেশে দাবা খেলার পথিকৃৎ হিসেবে তাকে সম্মানিত করা হয়। দাবা খেলায় তার অনন্য অবদানের কথা স্মরণ করে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের উদ্যোগে কাজী মোতাহার হোসেন স্মৃতি আন্তর্জাতিক দাবা প্রতিযোগিতা নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয়।

১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে কাজী আব্দুল ওদুদ, সৈয়দ আবুল হোসেন ও আবুল ফজলের সাথে তিনি "মুসলিম সাহিত্য সমাজ" গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে তিনি কিছুকাল 'শিখা' নামক পত্রিকা সম্পাদনা করেন।

১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে পরিসংখ্যান বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন। একই সাথে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে বিষয়ে পাশা করেন। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে পি.এইচ.ডি করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল '
Design of Experiments'।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে
 তমুদ্দিন মজলিস নামক একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হলে, তিনি এর সাথে জড়িয়ে পড়েন। এই বছরের ১৫ই সেপ্টেম্বর এই সংগঠন প্রচার করে, 'পাকিস্তানের রাষ্ট্র-ভাষা বাংলানা উর্দু?' নামক একটি পুস্তিকা। এই পুস্তিকায় প্রধান প্রবন্ধকার ছিলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান কাজী মোতাহার হোসেন।

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানে এম.এ কোর্স চালু হয় এবং তিনি এই নতুন বিভাগে যোগ দেন। এছাড়া তিনি গণিত বিভাগেও ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন।

১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পরিসংখ্যান বিভাগের রিডার পদ পান। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই বিভাগের অধ্যাপক হন।
১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে মাওলানা ভাসানী আয়োজিত কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলনে সভাপতি হন।
১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান সরকার তাঁকে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ উপাধিতে ভূষিত করে।
১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তবে পরিসংখ্যান বিভাগে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের বিরোধিতার মুখে ঢাকায় রবীন্দ্র-জন্মশত বার্ষিকী পালনে সাহসী ভূমিকা পালন করেন।
১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউটের তিনি প্রথম পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রবন্ধসাহিত্যের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান।
১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালি-সংস্কৃতি খর্ব করার জন্য রেডিও-টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধের যে পদক্ষেপ নিয়েছিল তার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদজ্ঞাপন করেন।
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে অনারারি
(Professor Emeritus) অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়।

১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে বিজ্ঞান ও কলা বিষয়ে অবদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে ডি.এস.সি ডিগ্রি দ্বারা সম্মানিত করে।
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে সম্মানিত করে।

১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে বিজ্ঞান চর্চায় অসাধারণ অবদানের জন্য দেশের 'স্বাধীনতা পুরস্কার' লাভ করেন।
১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের ৯ অক্টোবর তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

কাজী মোতাহার হোসেনের উল্লেখযোগ্য রচনা।
সঞ্চয়ন (প্রবন্ধ সংকলন) ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দ
নজরুল কাব্য পরিচিতি ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দ
সেই পথ লক্ষ্য করে ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দ
সিম্পোজিয়াম ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দ
গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দ
আলোক বিজ্ঞান ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ
নির্বাচিত প্রবন্ধ ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দ
প্লেটোর সিম্পোজিয়াম (অনুবাদ) ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দ।

সূত্র: