[বাংলা ভাষার পক্ষে প্রকাশিত তমদ্দুন মজলিশের পুস্তিকা অংশ]সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সভা আয়োজনের মাধ্যমে, এই সংগঠন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার প্রাথমিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই নভেম্বর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের সংবর্ধনা উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষার প্রশ্নে বিশিষ্ট জনের মতামত নেওয়া হয়। বলা বাহুল্য সভার সবাই বাংলার পক্ষে মত দেয়। ১২ই নভেম্বর সংগঠনের অপর একটি সভা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে। এই সভাতেও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তীব্রভাবে প্রকাশ করা হয়। এই সভায় তৎকালীন মন্ত্রী পরিষদের কয়েকজন বাংলার স্বপক্ষে মত দেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন− স্বাস্থ্যমন্ত্রী হবিবুল্লাহ বাহার, বেসামরিক সরবরাহ মন্ত্রী নূরুল আমীন, কৃষিমন্ত্রী সৈয়দ মো. আফজাল। ১৪ই এপ্রিল সংগঠনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে শতাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তির স্বাক্ষরিত একটি স্মারকলিপি পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের কাছে পেশ করা হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের যুদ্ধ দলিলপত্র: প্রথম খণ্ড। পৃষ্ঠা: ৪৯।
২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে তমদ্দুন মজলিস এবং মুসলিম ছাত্রলীগের এক যৌথসভা হয়। এই সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন ও সম্প্রসারিত করা হয়। পরিষদে এই দুই সংগঠনের বাইরেও অন্য দলীয় পরিচয়ের ব্যক্তিদের যুক্ত করা হয়। এটিই দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বা প্রথম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নামে পরিচিত। সম্প্রসারিত পরিষদের আহ্বায়ক হন শামসুল আলম এবং যুগ্ম-আহবায়ক হন আবদুল মান্নান। এই সভা থেকে ১১ই মার্চ এই ধর্মঘট আহ্বান করে এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে তাঁর সাহসী ভূমিকার জন্য সভায় ধন্যবাদ জানানো হয়। ১১ই মার্চ সকালে ছাত্রদের একটি দল রমনা পোস্ট অফিসে গেলে তাদের গ্রেফতার করা হয়। ছাত্রদের একটি দল রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সচিবালয়ের সামনে নবাব আবদুল গণি রোডে পিকেটিংয়ে অংশ নেয়। আন্দোলনকারীরা গণপরিষদ ভবন (জগন্নাথ হলের মিলনায়তন, যা পরবর্তী সময়ে ধ্বসে পড়েছিল), প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন বর্ধমান হাউস (বর্তমান বাংলা একাডেমী), হাইকোর্ট ও সচিবালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে অফিস বর্জনের জন্যে বাঙালী কর্মীদের আহ্বান করতে থাকে। এক সময় পুলিশ আন্দোলনকারীদের উপর লাঠিচার্জ করে। পুলিশের লাঠিচার্জে অধ্যাপক আবুল কাসেম-সহ অনেকে আহত হন। ছাত্র-জনতার উপর পুলিশের লাঠিচার্জের খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে সেক্রেটারিয়েট এলাকা বিক্ষুদ্ধ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা খাদ্যমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ আফজল ও শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদকে পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে। এ বিক্ষোভ দমনের জন্য সরকার সেনাবাহিনী তলব করে। পূর্ব পাকিস্তানের কর্মরত তৎকালীন অফিসার কম্যান্ডিং ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খান (পরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি) এবং মেজর পীরজাদার অধীনে একদল পদাতিক সৈন্য নিয়োগ করেন এবং স্বয়ং গণপরিষদে গিয়ে খাজা নাজিমুদ্দিনকে বাবুর্চিখানার মধ্য দিয়ে বের করে আনেন। বিকেলে এর প্রতিবাদে সভা অনুষ্ঠিত হলে, পুলিশ সভা পণ্ড করে দেয় এবং কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, রওশন আলম, রফিকুল আলম, আব্দুল লতিফ তালুকদার, শাহ্ মোঃ নাসিরুদ্দীন, নুরুল ইসলাম প্রমুখ। উল্লেখ্য ওই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন নঈমুদ্দিন আহমদ।
১১ তারিখের এ ঘটনার সূত্রে ১২ থেকে ১৫ মার্চ
ঢাকাতে ধর্মঘট পালন করা হয়। আন্দোলনের তীব্রতার মুখে ১৫ মার্চ খাজা নাজিমুদ্দিন
সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আবুল কাশেম,
কামরুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুর রহমান চৌধুরী প্রমূখ
অংশগ্রহণ করেছিলেন। আলোচনাসাপেক্ষে দুই পক্ষের মধ্যে ৮টি বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি
স্বাক্ষরিত হয়। ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে সরকারের এ নমনীয় আচরণের প্রধান কারণ ছিল ১৯
মার্চ জিন্নাহ্'র ঢাকা আগমন। তাঁর আসার পূর্বে পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও শান্ত করার
জন্য নাজিমুদ্দিন চুক্তিতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা
দেয়ার দাবিটি তখন পর্যন্ত মেনে নেয়া হয় নি। চুক্তিতে আন্দোলনের সময় গ্রেফতারকৃত
বন্দিদের মুক্তি, পুলিশের অত্যাচারের নিরপেক্ষ তদন্ত, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম ও
রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া, সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ইত্যাদি
বিষয়াবলী অন্তর্ভুক্ত ছিল। চুক্তির শর্ত অনুসারে ১৫ মার্চেই বন্দীদের মুক্তি দেয়া
হয়। ফলে সাময়িকভাবে পরিস্থিতি শান্ত হয়। ১৯শে মার্চ পাকিস্তানের
প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম গভর্ণর জেনারেল কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা আসেন।
ভারত বিভাগের পর এটাই ছিল তার প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফর। ২১শে মার্চ: রমনা
রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) কায়েদে আজমকে গণ-সংবর্ধনা দেওয়ার আয়োজন
করা হয়। সেখানে তিনি একটি বক্তব্য রাখেন। তিনি ভাষা আন্দোলনকে পাকিস্তানের
মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি
বলেন পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক ভাষা নির্ধারিত হবে প্রদেশের অধিবাসীদের ভাষা অনুযায়ী।
কিন্তু দ্ব্যর্থহীন চিত্তে ঘোষণা করেন—
"উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়"। একই সাথে তিনি
সতর্ক করে দিয়ে বলেন, "জনগণের মধ্যে যারা ষড়যন্ত্রকারী রয়েছে, তারা পাকিস্তানের
শত্রু এবং তাদের কখনোই ক্ষমা করা হবে না"। জিন্নাহ্'র এ বিরূপ মন্তব্যে
তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে উপস্থিত ছাত্র-জনতার একাংশ। উর্দুই হবে
পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা - এ ধরণের একপেশে উক্তিতে আন্দোলনকারীরা ক্ষুব্ধ
হয়ে ওঠে। এই সময় তমদ্দুন মজলিস এক ঘোষণায় এর প্রতিবাদ করে।
পরবর্তী সময়ে সরকার নানা কৌশলের মাধ্যমে আন্দোলনকে নমনীয় করতে সক্ষম হয়। কিন্তু
প্রচারণা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নকে তমদ্দুন
মজলিস জাগিয়ে রাখে।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আবারো রাজপথের আন্দোলনের শুরু হলে,
সেখানে তমদ্দুন মজলিস বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। ২১শে ফেব্রুয়ারিতে সংগ্রাম পরিষদের
নেতারা যখন ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিলের বিরোধিতা করেছিল, তখনও মিছিলের পক্ষে সম্মতি
দিয়েছিল মজলিসের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। ঢাকার বাইরে এই আন্দোলনকে সংগঠিত করতে
সক্ষম হয়েছিল এই সংগঠন। যে কারণে ২১-২২ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর তমদ্দুন মজলিসের অফিস
ও অধ্যাপক কাসেমের বাসায় পুলিশ তল্লাশি করে। সে সময় আবুল কাসেমের বিরুদ্ধে
গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। ফলে তিনি প্রায় দুই মাস আত্মগোপন করে ছিলেন।
জিন্নাহ্'র ঢাকা ত্যাগের পর ছাত্রলীগ এবং তমুদ্দন মজলিসের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়,
যেখানে তমুদ্দন মজলিসের আহ্বায়ক শামসুল আলম তার দায়িত্ব মোহাম্মদ তোয়াহা'র কাছে
হস্তান্তর করেন। শুরু দিকে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে তমুদ্দন মজলিস অগ্রগামী ভূমিকা
পালন করেছিল।
তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার উর্দু হরফে বাংলা
লেখার প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। পরে তমদ্দুন মজলিস ও ছাত্রলীগ সহ বিভিন্ন সংস্থার
প্রবল প্রতিবাদের মুখে সরকার এ প্রচেষ্টা থেকে বিরত হতে বাধ্য হয়। এর কিছুদিন আগে
বা পরে, পূর্ব বাংলা সরকারের পক্ষ থেকে ভাষা সমস্যার ব্যাপারে একটি বিস্তারিত
ব্যাখ্যা জানতে মাওলানা আকরাম খানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি গঠন করা হয়।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে জানুয়ারি, পাকিস্তানের
তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকা সফরে আসেন। নাজিমুদ্দিন পল্টন
ময়দানের এক জনসভায় দীর্ঘ ভাষণ দেন।পল্টনের এক জনসভায় বক্তৃতা দেওয়াত এক পর্যায়ে
তিনি ঘোষণা করেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচারিত
তাঁর ভাষণে তিনি আরো উল্লেখ করেন যে কোনো জাতি দু'টি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমৃদ্ধির পথে
এগিয়ে যেতে পারেনি। উল্লেখ্য, খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ মার্চ
রাষ্ট্রভাষা বাংলার সব দাবী দাওয়া মেনে নিয়ে সংগ্রাম পরিষদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর
করেছিলেন। তাঁর নতুন ঘোষণাকে সাধারণ মানুষ প্রতারণমূলক এবং বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে
চিহ্নিত করে। এই সময়
তমুদ্দিন মজলিস,
আওয়ামী লীগ,
তৎকালীন ছাত্রলীগ, যুবলীগ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের
ছাত্র প্রতিনিধিসহ নতুন করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই নতুন
সংগঠনের কনভেনর হন মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা কাজী গোলাম মাহবুব।
পরবর্তী সময়ে এই সংগঠনটিই সাংগঠনিকভাবে আন্দোলনের সক্রিয় কার্যকম থেকে সরে আসে। এরপর সংগঠন ক্রমান্বয়ে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
তথ্যসূত্র :