তমদ্দুন মজলিস

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে গঠিত তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান।  ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকার সিদ্দিক বাজারের 'লিলি কটেজে' সংস্কৃতিমনা অধ্যাপক, সাহিত্যসেবী ও বুদ্ধিজীবীদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় প্রাথমিকভাবে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরির কথা আলোচিত হয়। এরই সূত্র ধরে, এর কয়েকদিন পর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম-এর ১৯ নম্বর আজিমপুরের (ঢাকা) বাসায় অপর একটি সভা আহ্বান করা হয়। এই সভার আহ্বায়ক ছিলেন আবুল কাসেম। এই সভায় চূড়ান্তভাবে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের তৈরির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সর্বসম্মতিক্রমে এই সংগঠনের নাম রাখা হয়- 'তমদ্দুন মজলিস'। ১৯৪৭ সালের ২রা সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হয়। এর সম্পাদক নির্বাচিত হন অধ্যাপক আবুল কাসেম। সংগঠনের শুরুর দিকে এর সদস্য ছিলেন তখনকার এস এম হলের ভিপি সৈয়দ নজরুল ইসলাম (স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি), এসএম হলের সমাজসেবা সম্পাদক শামসুল আলম, ফজলুর রহমান ভূঁইয়া, একেএম আহসান, কবি মোফাখখারুল ইসলাম, আব্দুল খালেক (পরে পুলিশের আইজিপি), রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক নুরুল হক ভূঁইয়া।

প্রথম দিকে এর অফিস ছিল ১৯ নম্বর আজিমপুরের অধ্যাপক আবুল কাসেম-এর বাসা। পরে এর অফিস রশিদ বিল্ডিংয়ে স্থানান্তর করা হয়।

শুরু থেকেই এই প্রতিষ্ঠান তদানীন্তন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে তাদের মতামত দেওয়া শুরু করে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই সেপ্টেম্বর এই সংগঠন প্রচার করে, 'পাকিস্তানের রাষ্ট্র-ভাষা বাংলা
না উর্দু?' নামক একটি পুস্তিকা। এই পুস্তিকায় প্রধান প্রবন্ধকার ছিলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন  এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাতের সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ। ওইদিন বিকালেই তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে সরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজের (বর্তমান- ঢাকা কলেজ) ছাত্রাবাস নূপুর ভিলায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও উর্দু করা হোক শীর্ষক এক ঘরোয়া সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ভাষা আন্দোলনের কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করার লক্ষ্যে এই সেমিনারের একটি ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হয়। এই সেমিনারে সভাপতিত্ব করেছিলেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। সেমিনারে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, প্রিন্সিপালন ইব্রাহিম খাঁ, কবি জসীম উদ্দীন, অধ্যাপক কাজী আকরাম হোসেন, অধ্যাপক শামসুল হক, শাহেদ আলী, সাংবাদিক সানাউল্লাহ নূরী।

[বাংলা ভাষার পক্ষে প্রকাশিত তমদ্দুন মজলিশের পুস্তিকা অংশ]
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের যুদ্ধ দলিলপত্র: প্রথম খণ্ড। পৃষ্ঠা: ৪৯।

সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সভা আয়োজনের মাধ্যমে, এই সংগঠন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার প্রাথমিক প্রচেষ্টা  গ্রহণ করে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই নভেম্বর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের সংবর্ধনা উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষার প্রশ্নে বিশিষ্ট জনের মতামত নেওয়া হয়। বলা বাহুল্য সভার সবাই বাংলার পক্ষে মত দেয়।

১২ই নভেম্বর সংগঠনের অপর একটি সভা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে। এই সভাতেও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তীব্রভাবে প্রকাশ করা হয়। এই সভায় তৎকালীন মন্ত্রী পরিষদের কয়েকজন বাংলার স্বপক্ষে মত দেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হবিবুল্লাহ বাহার, বেসামরিক সরবরাহ মন্ত্রী নূরুল আমীন, কৃষিমন্ত্রী সৈয়দ মো. আফজাল। ১৪ই এপ্রিল সংগঠনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে শতাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তির স্বাক্ষরিত একটি স্মারকলিপি পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের কাছে পেশ করা হয়।

২৭শে নভেম্বর করাচিতে শুরু হওয়া পাকিস্তানের প্রথম শিক্ষা সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ফজুলর রহমান উর্দুকে দেশের লিংগুয়া ফ্রাংকা (সাধারণ ভাষা) করার প্রস্তাব করেন। মূলত এই দাবি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার প্রচেষ্টা ছিল। ফজলুর রহমানের বক্তব্যের প্রতিবাদে ৪ঠা ডিসেম্বর মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির কাছে হাজার হাজার লোকের স্বাক্ষর সম্বলিত স্মারকলিপি পেশ করে তমদ্দুন মজলিস। ৫ই ডিসেম্বর অধ্যাপক আবুল কাসেমসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক ও ছাত্র মিছিল নিয়ে পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের বাসভবনে (বর্ধমান হাউজ) যান। সেখানে তখন মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক চলছিল। ঐ বৈঠকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান তারা। সন্ধ্যায় আলোচনাশেষে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি মাওলানা আকরম খাঁ ঘোষণা করেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা চাপানোর চেষ্টা হলে পূর্ব-পাকিস্তান বিদ্রোহ ঘোষণা করবে এবং আমি সে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেব।

৬ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্রসভার আয়োজন করে তমদ্দুন মজলিস। এইস সভার সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম। সভাশেষে একটি মিছিল বের করা হয় এবং মিছিলটি সচিবালয়ের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করে। এদিনই সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে 'পূর্ব-পাকিস্তানের শিক্ষা সমস্যা' শীর্ষক সভায় আকরম খাঁ উর্দুর সাথে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে বক্তব্য রাখেন।

১২ই ডিসেম্বর এক দল লোক বাস ও ট্রাকে চড়ে উর্দুর পক্ষে স্লোগান দিতে দিতে মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের (বুয়েট) ছাত্রাবাসে হামলা চালায়। এর প্রতিবাদে মিছিল করেন বাংলা ভাষা আন্দোলনকারীরা। তারা শিক্ষামন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করেন এবং পলাশী ব্যারাকের কাছে পথসভা করেন। দাবীর মুখে শিক্ষামন্ত্রী মিছিলে শরীক হন এবং দাবী মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে হামলার প্রতিবাদে ও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৩ই ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি অফিসে ধর্মঘট পালিত হয়। ফলে সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সরকার। সেই সাথে সরকার ১৫ই ডিসেম্বর থেকে ১৫ দিনের জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদ, অমৃত বাজার, যুগান্তর, আনন্দবাজারসহ ভাষা আন্দোলনের পক্ষের পত্রিকাগুলোকে পূর্ব-বাংলায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।

৩০শে ডিসেম্বর রশিদ বিল্ডিংয়ে তমদ্দুন মজলিসের সভায় একটি সভায়, ভাষা আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য- একটি উপ কমিটি গঠন করার প্রস্তাব করা হয়। সেই সূত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক নুরুল হক ভূঁইয়াকে সভাপতি করে 'তমদ্দুন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা সাব-কমিটি' গঠিত হয়। পরবর্তীতে এটিই 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' নামে পরিচিতি লাভ করে।

রাষ্ট্রভাষার বিরোধী পক্ষের লোকেরা, পশ্চিম পাকিস্তানীদের মদদে, ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে জানুয়ারি রশিদ বিল্ডিংয়ে মজলিস অফিসে হামলা ও ভাংচুর করে। এদের অংশগ্রহণ করেছিল পুরান ঢাকার উর্দুভাষীদের একাংশ। এই সময় একাধিকবার হামলার শিকার হন অধ্যাপক আবুল কাসেম। বলিয়াদী প্রেসে হ্যান্ডবিল ছাপাতে গিয়ে কসাইটুলীতে বন্দি হন মজলিস কর্মী সিদ্দিক উল্লাহ। সে সময় তাঁকে হত্যা করার উদ্যোগ নিলে, তিনি কোনোক্রমে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। এই অবস্থায় পুলিশ রশিদ বিল্ডিংয়ে অবস্থিত তমদ্দুন মজলিসের অফিসটি তালাবন্ধ করে দেয়। ফলে ২৫শে জানুয়ারি তমদ্দুন মজলিস অফিস, ১৯ আজিমপুরে অধ্যাপক আবুল কাসেমের বাসায় স্থানান্তর করা হয়।

তমদ্দুন মজলিসের এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়, পাকিস্তানের গণপরিষদের অধিবেশন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত-এর প্রতিবাদ। পাকিস্তানের গণপরিষদের অধিবেশনে উর্দু ও ইরেজির সাথে বাংলাকেও গণপরিষদের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব করেন তিনি। এই সময় তিনি সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এই প্রস্তাবটি প্রত্যাখিত হওয়ায়, ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ভাষা সংগ্রাম পরিষদ ও পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ১১ই মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদ দিবস ও ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পূর্বদিনের আন্দোলনের সূত্র ধরে, ২৯শে ফেব্রুয়ারি, সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মঘট পালিত হয়। সরকারের প্ররোচনায় পুলিশ মিছিলে লাঠিচার্জ করে এমন অনেক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে। এই সময় আন্দোলনকারীদের বিশেষভাবে সমর্থন দেয় তমদ্দুন মজলিস। ১১ই মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদ দিবস ও ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২৯ ফেব্রুয়ারি দুই সংগঠনের প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট পালিত হয়। এতে পুলিশ লাঠিচার্জ ও কয়েকজনকে আটক করলে ১১ মার্চ ধর্মঘটের পাশাপাশি হরতাল পালনেরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১ মার্চ তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক আবুল কাসেম, পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম লীগের কাউন্সিল সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান, মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদ এবং এসএম হলের ভিপি আবদুর রহমান চৌধুরী ধর্মঘট-হরতাল সফল করার আহ্বান জানিয়ে যুক্ত বিবৃতি দেন।

২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে তমদ্দুন মজলিস এবং মুসলিম ছাত্রলীগের এক যৌথসভা হয়। এই সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন ও সম্প্রসারিত করা হয়। পরিষদে এই দুই সংগঠনের বাইরেও অন্য দলীয় পরিচয়ের ব্যক্তিদের যুক্ত করা হয়। এটিই দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বা প্রথম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নামে পরিচিত। সম্প্রসারিত পরিষদের আহ্বায়ক হন শামসুল আলম এবং যুগ্ম-আহবায়ক হন আবদুল মান্নান। এই সভা থেকে ১১ই মার্চ এই ধর্মঘট আহ্বান করে এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে তাঁর সাহসী ভূমিকার জন্য সভায় ধন্যবাদ জানানো হয়। ১১ই মার্চ সকালে ছাত্রদের একটি দল রমনা পোস্ট অফিসে গেলে তাদের গ্রেফতার করা হয়। ছাত্রদের একটি দল রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সচিবালয়ের সামনে নবাব আবদুল গণি রোডে পিকেটিংয়ে অংশ নেয়। আন্দোলনকারীরা গণপরিষদ ভবন (জগন্নাথ হলের মিলনায়তন, যা পরবর্তী সময়ে ধ্বসে পড়েছিল), প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন বর্ধমান হাউস (বর্তমান বাংলা একাডেমী), হাইকোর্ট ও সচিবালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে অফিস বর্জনের জন্যে বাঙালী কর্মীদের আহ্বান করতে থাকে। এক সময় পুলিশ আন্দোলনকারীদের উপর লাঠিচার্জ করে। পুলিশের লাঠিচার্জে অধ্যাপক আবুল কাসেম-সহ অনেকে আহত হন। ছাত্র-জনতার উপর পুলিশের লাঠিচার্জের খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে সেক্রেটারিয়েট এলাকা বিক্ষুদ্ধ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা খাদ্যমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ আফজল ও শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদকে পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে। এ বিক্ষোভ দমনের জন্য সরকার সেনাবাহিনী তলব করে। পূর্ব পাকিস্তানের কর্মরত তৎকালীন  অফিসার কম্যান্ডিং ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খান (পরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি) এবং মেজর পীরজাদার অধীনে একদল পদাতিক সৈন্য নিয়োগ করেন এবং স্বয়ং গণপরিষদে গিয়ে খাজা নাজিমুদ্দিনকে বাবুর্চিখানার মধ্য দিয়ে বের করে আনেন। বিকেলে এর প্রতিবাদে সভা অনুষ্ঠিত হলে, পুলিশ সভা পণ্ড করে দেয় এবং কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, রওশন আলম, রফিকুল আলম, আব্দুল লতিফ তালুকদার, শাহ্ মোঃ নাসিরুদ্দীন, নুরুল ইসলাম প্রমুখ। উল্লেখ্য ওই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন নঈমুদ্দিন আহমদ।

১১ তারিখের এ ঘটনার সূত্রে ১২ থেকে ১৫ মার্চ ঢাকাতে ধর্মঘট পালন করা হয়। আন্দোলনের তীব্রতার মুখে ১৫ মার্চ খাজা নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আবুল কাশেম, কামরুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুর রহমান চৌধুরী প্রমূখ অংশগ্রহণ করেছিলেন। আলোচনাসাপেক্ষে দুই পক্ষের মধ্যে ৮টি বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে সরকারের এ নমনীয় আচরণের প্রধান কারণ ছিল ১৯ মার্চ জিন্নাহ্‌'র ঢাকা আগমন। তাঁর আসার পূর্বে পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও শান্ত করার জন্য নাজিমুদ্দিন চুক্তিতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবিটি তখন পর্যন্ত মেনে নেয়া হয় নি। চুক্তিতে আন্দোলনের সময় গ্রেফতারকৃত বন্দিদের মুক্তি, পুলিশের অত্যাচারের নিরপেক্ষ তদন্ত, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম ও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া, সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ইত্যাদি বিষয়াবলী অন্তর্ভুক্ত ছিল। চুক্তির শর্ত অনুসারে ১৫ মার্চেই বন্দীদের মুক্তি দেয়া হয়। ফলে সাময়িকভাবে পরিস্থিতি শান্ত হয়। ১৯শে মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম গভর্ণর জেনারেল কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা আসেন। ভারত বিভাগের পর এটাই ছিল তার প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফর। ২১শে মার্চ: রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যান)  কায়েদে আজমকে গণ-সংবর্ধনা দেওয়ার আয়োজন করা হয়। সেখানে তিনি একটি বক্তব্য রাখেন।  তিনি ভাষা আন্দোলনকে পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক ভাষা নির্ধারিত হবে প্রদেশের অধিবাসীদের ভাষা অনুযায়ী। কিন্তু দ্ব্যর্থহীন চিত্তে ঘোষণা করেন "উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়"। একই সাথে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, "জনগণের মধ্যে যারা ষড়যন্ত্রকারী রয়েছে, তারা পাকিস্তানের শত্রু এবং তাদের কখনোই ক্ষমা করা হবে না"। জিন্নাহ্‌'র এ বিরূপ মন্তব্যে তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে উপস্থিত ছাত্র-জনতার একাংশ। উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা - এ ধরণের একপেশে উক্তিতে আন্দোলনকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এই সময় তমদ্দুন মজলিস এক ঘোষণায় এর প্রতিবাদ করে।

পরবর্তী সময়ে সরকার নানা কৌশলের মাধ্যমে আন্দোলনকে নমনীয় করতে সক্ষম হয়। কিন্তু প্রচারণা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নকে তমদ্দুন মজলিস জাগিয়ে রাখে।

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আবারো রাজপথের আন্দোলনের শুরু হলে, সেখানে তমদ্দুন মজলিস বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। ২১শে ফেব্রুয়ারিতে সংগ্রাম পরিষদের নেতারা যখন ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিলের বিরোধিতা করেছিল, তখনও মিছিলের পক্ষে সম্মতি দিয়েছিল মজলিসের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। ঢাকার বাইরে এই আন্দোলনকে সংগঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল এই সংগঠন। যে কারণে ২১-২২ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর তমদ্দুন মজলিসের অফিস ও অধ্যাপক কাসেমের বাসায় পুলিশ তল্লাশি করে। সে সময় আবুল কাসেমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। ফলে তিনি প্রায় দুই মাস আত্মগোপন করে ছিলেন। জিন্নাহ্'র ঢাকা ত্যাগের পর ছাত্রলীগ এবং তমুদ্দন মজলিসের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে তমুদ্দন মজলিসের আহ্বায়ক শামসুল আলম তার দায়িত্ব মোহাম্মদ তোয়াহা'র কাছে হস্তান্তর করেন। শুরু দিকে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে তমুদ্দন মজলিস অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছিল।

তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার উর্দু হরফে বাংলা লেখার প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। পরে তমদ্দুন মজলিস ও ছাত্রলীগ সহ বিভিন্ন সংস্থার প্রবল প্রতিবাদের মুখে সরকার এ প্রচেষ্টা থেকে বিরত হতে বাধ্য হয়। এর কিছুদিন আগে বা পরে, পূর্ব বাংলা সরকারের পক্ষ থেকে ভাষা সমস্যার ব্যাপারে একটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে মাওলানা আকরাম খানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি গঠন করা হয়।

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে জানুয়ারি, পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকা সফরে আসেন।  নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানের এক জনসভায় দীর্ঘ ভাষণ দেন।পল্টনের এক জনসভায় বক্তৃতা দেওয়াত এক পর্যায়ে তিনি ঘোষণা করেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচারিত তাঁর ভাষণে তিনি আরো উল্লেখ করেন যে কোনো জাতি দু'টি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারেনি। উল্লেখ্য, খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার সব দাবী দাওয়া মেনে নিয়ে সংগ্রাম পরিষদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। তাঁর নতুন ঘোষণাকে সাধারণ মানুষ প্রতারণমূলক এবং বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে চিহ্নিত করে। এই সময় তমুদ্দিন মজলিস, আওয়ামী লীগ, তৎকালীন ছাত্রলীগ, যুবলীগ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র প্রতিনিধিসহ নতুন করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই নতুন সংগঠনের কনভেনর হন মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা কাজী গোলাম মাহবুব।

পরবর্তী সময়ে এই সংগঠনটিই সাংগঠনিকভাবে আন্দোলনের সক্রিয় কার্যকম থেকে সরে আসে। এরপর সংগঠন ক্রমান্বয়ে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।


তথ্যসূত্র :