মুনীর
চৌধুরী, আবু নয়ীম মোহাম্মদ
একজন বাংলাদেশী শিক্ষাবিদ, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক, ভাষাবিজ্ঞানী এবং শহীদ
বুদ্ধিজীবী।
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে নভেম্বর, ঢাকা বিভাগের মানিকগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন।
উল্লেখ্য, তাঁর পৈত্রিক নিবাস ছিল নোয়াখালি। তাঁর পিতা খান বাহাদুর আবদুল হালিম
চৌধুরী ছিলেন ইংরেজ আমলের সরকারী কর্মচারী। চাকরির সূত্রে তাঁর পিতা মানিকগঞ্জে
ছিলেন। তিনি ছিলেন চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। তাঁর অগ্রজ ছিলেন
কবীর চৌধুরী।
প্রখ্যাত মঞ্চ-অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার তাঁর অনুজা।
মুনীর চৌধুরী ১৯৪১
খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল (বর্তমান ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম
বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করেন। এরপর তিনি তাঁর পিতার ইচ্ছায়, আলীগড়
মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয়
বিভাগে আইএসসি পাস করেন এবং এই বৎসরেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি ভাষায় ভর্তি
হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণকালে তিনি সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন।
১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হলের সেরা বক্তা হিসেবে প্রোভোস্ট্স কাপ জেতেন।
এই সময় তিনি রবিগুহ, দেবপ্রসাদ, মদন বসাক ও সরদার ফজলুল করিম-এর অনুপ্রেরণায় কমুনিষ্ট পার্টিতে যোগদান করেন। একই সাথে সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, অচ্যুত গোস্বামী ও অজিতগুহের সাথে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। বাম রাজনীতির সাথে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ততার কারণে তাঁকে সলিমুল্লাহ হল থেকে বহিস্কার করা হয়। একই কারণে পিতার আর্থিক সাহায্য থেকেও তিনি বঞ্চিত হন। এসময় তিনি ঢাকা বেতার কেন্দ্রের জন্য নাটক লিখে আয় করতেন।
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইংরেজিতে অনার্স পাশ করেন দ্বিতীয় শ্রেণীতে । এই বৎসরে
অনুষ্ঠিত 'নিখিল বঙ্গ সাহিত্য
প্রতিযোগিতা'য় সর্বাধিক সংখ্যক পুরস্কার জেতেন।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মাস্টার্স পাস করেন। এই বৎসরের ৬ই ডিসেম্বর ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে যে প্রথম ছাত্রসভা হয়, তাতে তিনি
বক্তৃতা করেন।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতায় অনুষ্ঠিত কমিউনিষ্ট পার্টির সম্মেলনে যোগদান করেন।
ঢাকায় কমিউনিষ্ট পার্টির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন। এই বৎসরেই
প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি খুলনার ব্রজলাল কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।
সেখানে তিনি কিছুদিন বাংলাও পড়িয়েছিলেন। ঐ বছর মার্চে তিনি ঢাকায় এসে
রাজনৈতিক তৎপরতার কারণে গ্রেপ্তার হন, তবে রাজনীতি না করার প্রতিশ্রুতিতে ছাড়া
পান। এই বছর তিনি লিলি মীর্জাকে বিয়ে করেন।
১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকার জগন্নাথ কলেজে যোগ দেন এবং সে বছরই আগষ্ট মাসে ইংরেজির অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে নিযুক্তি লাভ করেন।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে গিয়ে পুলিশের
বাধার সম্মুখীন হন এবং আহত হন। ২৬শে ফেব্রুয়ারি শিক্ষকদের প্রতিবাদ সভা আহ্বান করতে
গিয়ে তিনি গ্রেফতার হন এবং এই কারণে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এসময় প্রায় দুই বছর তিনি
দিনাজপুর ও ঢাকা জেলে বন্দী জীবনযাপন করেন। বন্দী অবস্থায় ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে
ফেব্রুয়ারি কারাবন্দীদের অভিনয়ের জন্য লেখেন কবর নামের একাঙ্কিকা।
উল্লেখ্য ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে বামপন্থী রণেশ দাশগুপ্ত জেলখানাতে ২১ ফেব্রুয়ারি
উৎযাপনের লক্ষে মুনীর চৌধুরীকে একটি নাটক লেখার অনুরোধ জানান। এই অনুরোধের ভিত্তিতে
তিনি নাটকটি রচনা করেন। এই সময় কারাবন্দী অধ্যাপক অজিত গুহের কাছ থেকে তিনি প্রাচীন ও মধ্য যুগের বাংলা
সাহিত্যের পাঠ গ্রহণ করেন এবং কারাগারে থেকেই ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলায় প্রাথমিক এম এ
পরীক্ষা দেন ও প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
১৯৫৪
খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসলে তিনি কারাগার থেকে
মুক্তি পান। যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে গেলে, তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫৪
খ্রিষ্টাব্দে নিরাপত্তা বন্দী থাকা অবস্থায় তিনি এমএ শেষ পর্ব পরীক্ষা
দিয়ে তিনি কৃতিত্বের সাথে বাংলায় মাস্টার্স ডিগ্রী পাস করেন। এই বৎসরের ১৫ই
নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।
১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে জানুয়ারিতে মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের প্রচেষ্টায় বাংলা বিভাগে
খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলা বিভাগে
সার্বক্ষণিক চাকুরি লাভ করেন। এপ্রিল মাসে তিনি বাংলার প্রভাষক হিসেবে চাকুরি
স্থায়ী করেন। এই বৎসরের শেষ দিকে রকাফেলার বৃত্তি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান
এবং ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্বে আরও একটি
মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। সে বছর সেপ্টেম্বরে দেশে ফিরে আসেন।
১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত পূর্ববঙ্গ সরকারের ভাষা-সংস্কার কমিটির রিপোর্টের অবৈজ্ঞানিক ও সাম্প্রদায়িক বিষয়বস্তুর তীব্র সমালোচনা করে মুনীর চৌধুরী পূর্ববঙ্গের ভাষা কমিটির রিপোর্ট আলোচনা প্রসঙ্গে একটি দীর্ঘ ভাষাতাত্ত্বিক প্রবন্ধ লেখেন। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে এপ্রিল প্রবন্ধটি বাংলা একাডেমীতে পঠিত হয়। কিন্তু মুসলিম ধর্মবিশ্বাসে আঘাতের অভিযোগে সামরিক সরকারের কাছে তাঁকে কৈফিয়ৎ দিতে হয়।
১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী রীডার পদে নিযুক্ত হন।
এই বৎসরে তাঁর রচিত রক্তাক্ত প্রান্তর নাটক প্রকাশিত হয়।
১৯৬৩-৬৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক নাট্যগোষ্ঠীর উদ্যোগে ও তাঁর
পরিচালনায় বেশ কয়েকটি নাটক মঞ্চস্থ হয়। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন
ভ্রমণ করেন।
১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা বিভাগের রীডার পদে নিয়োগ পান।
১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে কেন্দ্রীয় বাঙলা উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে বাংলা
টাইপরাইটারের জন্য উন্নতমানের কী-বোর্ড উদ্ভাবন করেন, যার নাম মুনীর অপ্টিমা।
An Illustrated Brochure on Bengali Typewriter (1965) শীর্ষক পুস্তিকায় তিনি
তাঁর পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করেন এবং এই নতুন টাইপরাইটার নির্মাণের লক্ষ্যে বেশ
কয়েকবার পূর্ব জার্মানিতে যান।
১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে রেডিও ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান প্রচারে পাকিস্তান
সরকারের নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ করেন।
১৯৬৭-৬৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে বাংলা বর্ণমালা ও বানান-পদ্ধতির সংস্কার প্রচেষ্টার
প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে প্রবন্ধ লেখেন এবং পরবর্তীতে এ
বিষয়ক বিতর্কে সক্রিয় অংশ নেন।
১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান সরকার বাংলা বর্ণমালাকে রোমান বর্ণমালা দিয়ে
সংস্কারের উদ্যোগ নিলে তিনি এর প্রতিবাদ করেন।
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে মুহম্মদ আবদুল হাই অকালে মৃত্যুবরণ করলে তাঁর স্থানে
তিনি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হন।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত একটি ভাষাতাত্ত্বিক সম্মেলনে যোগ দিতে যান। মার্চ
মাসে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে আসেন। এর কিছুদিন পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়।
এর আগে
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে সে আন্দোলনের সমর্থনে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ
খেতাব বর্জন করেন। এসময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আদেশে মে-জুন মাসে
ইংরেজি বিভাগের প্রধান হিসেবে এবং জুলাই মাস থেকে কলা অনুষদের ডীন হিসেবে কাজ করেন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর 'ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যাঞ্চেলর, খ অঞ্চলের সামরিক আইন-প্রশাসক ও পূর্ব পাকিস্তান
গভর্নর' লেফট্যান্ট-জেনারেল টিক্কা খান এক সতর্কবাণীতে তাঁকে 'ভবিষ্যৎ
রাষ্ট্রবিরোধী কর্মে লিপ্ত না থাকতে নির্দেশ দেন। ১৪ই ডিসেম্বর মুনীর চৌধুরীকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীদের সহযোগী
আল-বদর বাহিনী তাঁর বাবার বাড়ি থেকে অপহরণ করে ও সম্ভবত ঐদিনই তাঁকে হত্যা
করা হয়।
পুরস্কার
১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমী নাট্য পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে মীর মানস প্রবন্ধ সংকলনের জন্য দাউদ
পুরস্কার
১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে পাক-ভারত যুদ্ধ সম্পর্কে লেখা সাংবাদিকতাসুলভ রচনা-সংকলন-এর জন্য সিতারা-ই-ইমতিয়াজ উপাধি লাভ করেন।
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি
নাটক
রক্তাক্ত প্রান্তর (১৯৬২)
চিঠি (১৯৬৬)
কবর (১৯৬৬)
দণ্ডকারণ্য (১৯৬৬)
পলাশী ব্যারাক ও অন্যান্য (১৯৬৯)
অনুবাদ নাটক
কেউ কিছু বলতে পারে না (১৯৬৯); জর্জ বার্নার্ড শ-র
You never can tell-এর বাংলা
অনুবাদ।
রূপার কৌটা (১৯৬৯); জন গলজ্ওয়র্দি-র
The Silver Box-এর বাংলা অনুবাদ।
মুখরা রমণী বশীকরণ (১৯৭০); উইলিয়াম শেক্স্পিয়ারের
Taming of the Shrew-এর
বাংলা অনুবাদ।
প্রবন্ধ গ্রন্থ
ড্রাইডেন ও ডি.এল. রায় (১৯৬৩, পরে তুলনামূলক সমালোচনা গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত)
মীর মানস (১৯৬৫)
রণাঙ্গন (১৯৬৬); সৈয়দ শামসুল হক ও রফিকুল ইসলামের সাথে একত্রে।
তুলনামূলক সমালোচনা (১৯৬৯)
বাংলা গদ্যরীতি (১৯৭০)
অন্যান্য
An Illustrated Brochure on Bengali Typewriter (1965)
১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা একাডেমী থেকে আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায়
চার খণ্ডে মুনীর চৌধুরী রচনাবলী প্রকাশিত হয়। প্রথম খণ্ডে (১৯৮২) মৌলিক
নাট্যকর্ম, দ্বিতীয় খণ্ডে (১৯৮৪) অনুবাদমূলক নাট্যকর্ম, তৃতীয় খণ্ডে (১৯৮৪)
সমালোচনামূলক গ্রন্থাবলি এবং চতুর্থ খণ্ডে (১৯৮৬) ছোট-গল্প, প্রবন্ধ, পুস্তক
সমালোচনা ও আত্মকথনমূলক রচনা প্রকাশিত হয়।
সূত্র :
মুনীর চৌধুরী রচনাবলী। বাংলা একাডেমী। জুন ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দ।