১৩ বৎসর বয়সে তাঁর
মৃত্যুবরণ করলে, তাঁর মা আর্থক সঙ্কটে পড়ে যান। এই সময় তিনি জ্বালানির কাঠ সংগ্রহ
করে বাজারে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মাকে সাহায্য করতেন। ১৭০৪ খ্রিষ্টাব্দে উজেবেক
দস্যুরা কোরাসান অঞ্চলে হামলা করে। এরা বহু লোককে হত্যা করে এবং নাদির ও তাঁর মাকে
দাস হিসেবে বিক্রয়ের জন্য নিয়ে যায়। বন্দী দশায় তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। পরে নাদির
ছাড়া পেয়ে ১৭০৮ খ্রিষ্টাব্দে খোরাসনে ফিরে আসেন।
এই সময় ইরান সাফাভিদ রাজবংশের সুলতান হুসাইনের শাসনাধীন ছিল। এদের রাজত্ব
আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সুলতান হুসাইনের রাজত্বকালে আফগানিস্তানের
কান্দাহার প্রদেশের ঘিলজাই উপজাতি বিদ্রোহ ঘোষণা করলে, সুলতান হুসাইন গুর্গিন খানকে
বিদ্রো দমনের জন্য পাঠান। এরপর বিদ্রোহীদের নেতা মুহাম্মদ হোটাকি সরাসরি তাঁর সৈন্য
নিয়ে সুলাতান হুসাইনের বাহিনীকে আক্রমণ করে। ১৭২২ খ্রিষ্টাব্দে উভয় বাহিনী গুলনাবাদ যুদ্ধক্ষেত্রে মুখোমুখি হন।
এই যুদ্ধে মুহাম্মদ হোটাকি জয়লাভ করেন এবং খোরাসানের সিংহাসন অধিকার করেন। এই সময়
মাসাহাদের আফগান গভর্নর মালেক মাহমুদের কাছে নাদির শাহকে বন্দী হিসেবে পাঠানো হয়।
মালেক মুহাম্মদ এই সময় বিদ্রোহের জন্য নিজেই একটি সৈন্যদল তৈরি করছিলেন। এই সৈন্যদলে
নাদির শাহ স্থান লাভ করতে সমর্থ হন এবং ধীরে ধীরে তাঁর নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেন।
সুলতান হুসেইনের পুত্র শাহ তাহমাস্প দ্বিতীয় নিজেকে সুলতান হিসেবে ঘোষণা দেন। কিন্তু
তাঁর দুর্বল সেনাবাহিনী নিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়ে, তিনি কাজার গোত্রের
কাছে আশ্রয় নেন। এই গোলামালের সুযোগ নিয়ে অটোমান এবং রাশিয়া ইরানের বিশাল অংশ
অধিকার করে বসেন। এই অবস্থায় তাহমাস্প ও কাজার গোত্র প্রধান ফাথ আলি খান নাদেরকে
যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং সেনাবহিনীর কিছু অংশ পরিচালনার দায়িত্ব দেন। যুদ্ধে নাদির শাহ
অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেন। তিনি অল্প দিনের মধ্যে ইরানের হস্তচ্যুত বিশাল অংশ দখল
করতে সক্ষম হন। ১৭২৬ খ্রিষ্টাব্দে পারশ্য সম্রাট শাহ তাহমাস্প নাদির শাহকে
সেনাপ্রধান হিসেবে নির্বাচন করেন। এই সময় ইসপাহান নগরী আফগান শাসকের অধীনে ছিল।
১৭২৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইস্পাহান আক্রমণের উদ্দেশ্য যুদ্ধাযাত্রা করেন। হেরাতের কাছে
উভয় বাহিনী মুখোমুখী হয়। এই যুদ্ধে আফগান সেনাপতি আবদালি আফগান পরাজিত হন। এরপর
নতুন শাহ ঘুলজাই আফগান নাদির শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। ১৭২৯ খ্রিষ্টাব্দের
সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত ডামঘান যুদ্ধে ঘুলজাই আফগান পরাজিত হন। এরপর নভেম্বর মাসে
মুরখাকোর্টের যুদ্ধে পুনরায় নাদির শাহ তাঁকে পরাজিত করেন। এই জয়ের ফলে ইরান থেকে
আফগানরা চিরতরে বিদায় নেয়। ডিসেম্বর মাসে নাদির শাহ ইস্পাহান নগরীকে পারশ্য সম্রাট
শাহ তাহমাস্পের হাতে অর্পণ করেন। পুরস্কার স্বরূপ তিনি খোরাশান-সহ বেশ কয়েকটি
প্রদেশের গভর্নর পদ লাভ করেন। এই সময় তিনি সম্রাট শাহ তাহমাস্পের বোনকে রাজিয়া
বেগম সাফাফিকে বিবাহ করেন।
১৭৩০ খ্রিষ্টাব্দে নাদির শাহ অটোমানদের দখলকৃত ইরানি ভূমি জয় করেন। এই সময় আব্দালি
আফগান বিদ্রোহ করে মাসাদ অবরোধ করেন। নাদির দ্রুত এই বিদ্রোহ দমন করেন। এই সময়
নাদিরে ক্ষমতা প্রভূত বৃদ্ধির কারণে সম্রাট শাহ তাহমাস্প ঈর্ষান্বিত এবং ভীত
হয়ে পড়েন। নাদির শাহ যখন অন্যত্র যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন, সেই সময় সম্ভবত তিনিও নিজেকে
দক্ষ প্রমাণ করার জন্য আর্মেনিয়ার ইয়েরেভান নগরী দখল করেন। কিন্তু অটোমানদের পাল্টা
আক্রমণে নাদিরের উদ্ধারকৃত অঞ্চল হারান। এই সময় তাব্রিজের বিনিময়ে আর্মেনিয়া এবং
জর্জিয়ার অধিকার ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে নাদির রাজধানীতে ফিরে আসেন
এবং তাহমাস্পকে ক্ষমতাচ্যূত করে তাঁর নাবালক পুত্র আব্বাস তৃতীয়কে সিংহাসনে বসান।
পরে তিনি আব্বাস তৃতীয়ের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্য পরিচালনা শুরু করেন। এরপর তিনি
অটোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার উদ্যোগ। ১৭৩৩ খ্রিষ্টাব্দের এক যুদ্ধে অটোমান
সেনাপতি টোপাল ওসমান পাশা, নাদির শাহের বিরুদ্ধে জয় লাভ করেন। পরে তিনি একটি বিশাল
বাহিনী নিয়ে টোপাল ওসমান পাশার বাহিনীকে আক্রমণ করেন। এই আক্রমণে টোপাল ওসমান পাশা
পরাজিত ও নিহত হন। এর ফলে বাগদাদ ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের উপর নাদির শাহ কর্তৃত্ব
স্থাপিত হয়। ১৭৩৫ খ্রিষ্টাব্দে বাঘাভার্ডের যুদ্ধে অটোমানদের বিরুদ্ধে একটি বিরাট
জয় পান। এর ফলে ইরান হারানো আর্মেনিয়া এবং জর্জিয়া দখলে আনতে সক্ষম হন। ১৭৩৫
খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে গাজা অঞ্চলে রাশিয়ার সাথে সামরিক চুক্তি হয়। এই চুক্তির
ফলে রাশিয়া তার অধিকৃত ইরানের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে। এর ফলে
ইরানের উত্তরাঞ্চল এবং ককেশাস অঞ্চল নাদির শাহের অধিকারে আসে।
নাদির শাহের এই সাফল্যের পর, ইরানের মানুষ তাঁকে সম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি
তোলেন। এ বিষয়ে সম্রাট
শাহ তাহমাস্পের কাছে প্রস্তাব রাখা হলে, তিনি জানান যে, দেশের সকল মানুষ যদি চায়,
তাহলে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি আছেন। এরপর ১৭৩৫ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে
জনগণের কাছে বিষয়টি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। ১৭৩৬ খ্রিষ্টাব্দের জনমত
অনুসারে নাদির শাহ পারশ্যের নতুন সম্রাট হওয়ার রায় পায়। এরপর ১৭৩৬ খ্রিষ্টাব্দের
মার্চ মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে সিংহাসন লাভ করেন।
১৭৩৮ খ্রিষ্টাব্দে নাদির আফগানিস্তানের কান্দাহার জয় করেন। এই সময় তিনি কান্দাহারের
কাছে একটি নতুন নগরী তৈরি করেন। নগরটির নাম দেওয়া হয় নাদেরাবাদ। এরপর তিনি ভারতের
মোগল সাম্রাজ্যের দিকে নজর দেন। এই সময় মোগল সাম্রাজ্যের দ্বাদশ সম্রাট
মুহাম্মদ শাহ
(১৭০২-১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দ) দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত
ছিলেন। তবে নানা অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে
মুহাম্মদ শাহের
রাজশক্তি অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় ছিল। এছাড়া শিখ, মারাঠা শক্তি প্রবল হয়ে উঠেছিল।
এই অবস্থায় আফগানিস্তানের পলাতক বিদ্রোহীরা ভারতে
মুহাম্মদ শাহের
কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। নাদির শাহ এ সব বিদ্রোহীদেরকে তাঁর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য
অনুরোধ জানালে,
মুহাম্মদ শাহ
তা প্রত্যাখ্যান করে। এই অবস্থায় নাদির শাহ ভারতে আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। প্রথম
দশায় নাদির শাহ গজনী, কাবুল, পেশোয়ার, সিন্ধু এবং লাহোর দখল করে। এই সময়
মুহাম্মদ শাহ
প্রায় ৩ লক্ষ সৈন্য নিয়ে নাদির শাহের মুখোমুখী হয়।
১৭৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই ফেব্রুয়ারি কর্নালের যুদ্ধে 
মুহাম্মদ শাহের বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। নাদির শাহ দিল্লীতে
শান্তিপূর্ণভাবে প্রবেশ করেন এবং
মুহাম্মদ শাহকে বন্দী করেন। এই সময় গুজব ওঠে যে, যুদ্ধে নাদির শাহ
মৃত্যুবরণ করেছেন। এই গুজবে স্থানীয় জনগণ উৎফুল্ল হয়, নাদির শাহের সেনাবাহিনীকে
আক্রমণ করে। প্রাথমিভাবে এই আক্রমণে প্রায় ৯০০ ইরানি সৈন্য নিহত হয়। এরপর ক্ষুব্ধ
নাদির শাহ প্রতি আক্রমণের নির্দেশ দেয়। নাদির শাহের সৈন্যরা প্রায় সাত ঘণ্টা ব্যাপী
দিল্লীতে হত্যাযজ্ঞ চালায়। এই আক্রমণে প্রায় ২০ থেকে ৩০ হাজার দিল্লীর সাধারণ
নাগরিক নিহত হয়। এছাড়া প্রায় ১০,০০০ নারী ও শিশুকে বন্দী করে। পরে এদেরকে দাস হিসেবে
পারশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এই ঘটনার জন্য
মুহাম্মদ শাহ নাদির শাহের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সৈন্যদের থামানোর
আবেদন করেন। পরে নাদির শাহ সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেন তিনি প্রথমে মোগল রাজ
কোষগারের চাবি গ্রহণ করে, সমুদয় সম্পদ হস্তগত করেন। পরে
মুহাম্মদ শাহের সাথে সন্ধি চুক্তি করেন। এই চুক্তি অনুসারে আফগানিস্তান
ইরানের অধীনে চলে যায়। এবং বাৎসরিক ৫০ লক্ষ টাকা কর দিতে সম্মত হয়।
এর বাইরে নাদির শাহ দিল্লী ত্যাগের আগে ধনবান ব্যক্তিদের সঞ্চিত সম্পদ হস্তগত করেন
এবং মোগল ময়ূরসিংহাসনটি সাথে করে নিয়ে যান। তিনি প্রায় ৭০০ হাতি, ৪ হাজার উট এবং
১২০০০ ঘোড়া লুণ্ঠন করে নিয়ে যান। এছাড়া ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে, মোগল
সম্রাটের কন্যা জাহান আফরোজ বানু বেগমকে পুত্রবধু করে ইরানে নিয়ে যান।
নাদির শাহ যখন এই অভিযানে যান, তখন তিনি তাঁর পুত্র রেজা কোলি মির্জার হাতে ইরানের
শাসন তুলে দিয়ে যান। রেজা কোলি ভালোভাবে এই দায়িত্ব পালন করেন। পরে সংবাদ আসে
যে, যুদ্ধে নাদির শাহ মৃত্যুবরণ করেছেন। এরপর রেজা কোলি ইরানের ক্ষমতা দখলের
উদ্যোগ নেন। প্রথমে তিনি প্রাক্তন সম্রাট তাহমাস্প শাহ, আব্বাস তৃতীয়-সহ এবং
তাঁর পরিবারে সকলকে হত্যা করেন। এই সংবাদ শোনার পর রেজা স্ত্রী (তাহমাস্প শাহের বোন)
আত্মহত্যা করেন। নাদির শাহ ভারত থেকে দিল্লীতে ফিরে সব শুনে পুত্রের উপর খুবই
বিরক্ত হন। তারপরেও তিনি ট্রান্সোক্সিয়ানা অঞ্চলে অভিযানের সময় রেজাকে সাথে নেন।
১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি উজবেকিস্তানের খিভার খানাতে দখল করেন। নাদির শাহ চেয়েছিলেন
যে তাঁর পুত্র রেজা চেঙ্গিশ খানের উত্তর-সূরী উজবেক শাসনকর্তার বড় মেয়েকে বিবাহ
করুক। কিন্তু রেজা এই বিয়েতে অসম্মতি জানালে, তিনি নিজেই তাঁকে বিবাহ করেন।
বেশ কয়েক বছর আগে এক রাশিয়ার ককেশাস অঞ্চলের দাঘেস্তানে অভিযানের সময় তাঁর বড় ভাই
ইব্রাহিম কোলি নিহত হয়েছিলেন। এর প্রতিশোধের জন্য তিনি এই অঞ্চলে অভিযানে বের হন।
পথে মাজান্ডেরানের জঙ্গলের ভিতরে দিয়ে যাওয়া সময় আততায়ীর নিক্ষিপ্ত গুলোতে সামান্য
আহত হন। তিনি ধারণা করেন যে, এই হত্যা প্রচেষ্টার পিছনে তাঁর পুত্রের হাত ছিল।
এই ঘটনার পর তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তারপরেও তিনি ককেশাস অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে
বহু জায়গা দখল করতে সক্ষম হন। এরপর তিনি তেহরানে ফিরে আসেন এবং পুত্রের বিরুদ্ধে
হত্যার অভিযোগ তোলেন। রেজা এই বিষয়ে অস্বীকার করলেও নাদির শাহ রেজার দুই চোখ অন্ধ
করে দেন।
নাদির শাহ আরব সাগরে আধিপত্য বিস্তারের জন্য নৌবাহিনী গড়ে তোলেন। তিনি
মাজান্ডারানের জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ জাহাজ বুশরাতে নিরমাণ করেন। এই সময় তিনি
ত্রিশটি জাহাজ ভারত থেকে ক্রয় করেছিলেন। ১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই জাহাজগুলোর
সাহায্যে বাহরাইন দ্বীপে অভিযান চালিয়ে তা আরবদের কাছ থেকে দখল করে নিয়েছিলেন।
১৭৪৭ খ্রিষ্টাব্দে খোরাশানে অভিযান চালিয়ে কুর্দিশ বিদ্রোহীদের দমন করেন। এই বছরের ২০ জুন তিনি খোরাশানে আততায়ীর হাতে নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর রাজত্ব লাভ করেছিলেন তাঁর ভাইয়ের ছেলে আলি কোলি।
তাঁর স্ত্রী: রাজিয়া বেগ সাফাভি এবং চেঙ্গিশ খানের উত্তর-সূরী উজবেক শাসনকর্তার বড় মেয়ে, মারিয়া তেরেসা।
সন্তান: রেকা কোলি মিরজা,
মোরতএজা মির্জা, ইমাম কোলি মির্জা, যোশেফ ভন সেমলিন।
সূত্র: