মুহাম্মদ শাহ, মোগল সম্রাট
(১৭০২-১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দ)

১৭০২ খ্রিষ্টাব্দের ৭ আগষ্ট জন্মগ্রহণ করেন।  তাঁর পিতার নাম জাহান শাহ। মায়ের নাম ফখরন-উন-নেসা বেগম। ১৭১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই সেপ্টেম্বর, একাদশ সম্রাট শাহজাহান দ্বিতীয় -এর মৃত্যুর পর সাইদ ভ্রাত্রীদ্বয় মুহাম্মদ শাহকে সিংহাসনে বসান। এই সময় তাঁর রাষ্ট্রীয় নাম হয়- আবুল-ফাতাহ নাসির-উদ-দিন রোশান আখতার মুহাম্মদ শাহ। দিল্লীর লালকেল্লায় আনুষ্ঠানিকভাবে সিংহাসন প্রদানের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছিল।

এই সম্রাটও সাইদ ভ্রাত্রীদ্বয়ের হাতের পুতুল ছিলেন। বারবার সম্রাট পরিবর্তনের সূত্রে রাজ্যের প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়েছিল। রাজ্যের ঐক্য ধরে রাখার জন্য, মুহাম্মদ শাহ, অন্যান্য সকল ধর্ম ও জাতির মানুষের প্রতি উদার মনোভাব দেখানো শুরু করেন। তা সত্তেও রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ দেখা দেয়। সাইদ ভ্রাত্রীদ্বয় এ সকল বিদ্রোহ দমনে সচেষ্ট হন। কিন্তু দরবারের অন্যান্য সদস্যদের ষড়যন্ত্রে তাঁদের সেকল প্রচেষ্ট ব্যর্থ হয়। রাজস্ব আদায়ে বিঘ্ন ঘটায়, সৈন্যরা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় দরবারের প্রভাবশালী সদ্স্যদের ষড়যন্ত্রে ১৭২০ খ্রিষ্টাব্দে উভয় ভাই নিহত হন।

এরপর মুহাম্মদ শাহ পুরোপুরি রাজ্যের ক্ষমতা লাভ করেন। ১৭২১ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ শাহ, নবম মোগল সম্রাট
ফররুখশিয়েরের কন্যাকে বিবাহ করেন।

১৭২২ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারি, মুহাম্মদ শাহ, আসাফ জাহ-কে প্রধান উজির পদ প্রদান করেন। কিন্তু আসাফ জাহ-কে যথেষ্ঠ গুরুত্ব না দেওয়া, তিনি উজির পদ ত্যাগ করেন। এরপর মুহাম্মদ শাহ তঁকে আওরঙ্গাবাদের সেনাদলের অধিপতি হিসেবে যোগদান করেন। এরপর ১৭২৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে দাক্ষিণ্যাত্যের বিদ্রোহী সুবেদার মুবারিজ খানকে দমন করার জন্য। এই যুদ্ধে মুবারিজ খান পরাজিত ও নিহত হলে, আসাফ জাহ দাক্ষিণ্যাত্যের দায়িত্ব পান। ১৭২৫ খ্রিষ্টাব্দ হায়দ্রাবাদে নিজাম-প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

তিনি তবে তাঁর প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ দেখা দেয়। তাঁর রাজত্বকালে বাংলা, বিহার এবং অযোধ্যা স্বাধীন হয়ে যায়। অন্যদিকে মারাঠারা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই পর্যায়ে আগ্রার নিকটে জাঠরা, পাঞ্জাবে শিখরা এবং রোহিলাখণ্ডে আফগানরা মোগল সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই পর্যায়ে পারশ্যের সম্রাট নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করে।

১৭৩৮ খ্রিষ্টাব্দে
নাদির শাহ আফগানিস্তানের কান্দাহার জয় করেন। (১৭০২-১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দ) দিল্লীর সিংহাসনে  অধিষ্ঠিত ছিলেন। তবে নানা অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে মুহাম্মদ শাহের রাজশক্তি অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় ছিল। এই অবস্থায় আফগানিস্তানের পলাতক বিদ্রোহীরা ভারতে মুহাম্মদ শাহের কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। নাদির শাহ এসব বিদ্রোহীদেরকে তাঁর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানালে, মুহাম্মদ শাহ তা প্রত্যাখ্যান করে। এই অবস্থায় নাদির শাহ ভারতে আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। প্রথম দশায় নাদির শাহ  গজনী, কাবুল, পেশোয়ার, সিন্ধু এবং লাহোর দখল করে। এই সময় মুহাম্মদ শাহ প্রায় ৩ লক্ষ সৈন্য নিয়ে নাদির শাহের  মুখোমুখী হয়।

১৭৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই ফেব্রুয়ারি কর্নালের যুদ্ধে  মুহাম্মদ শাহের বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। নাদির শাহ  দিল্লীতে শান্তিপূর্ণভাবে প্রবেশ করেন এবং মুহাম্মদ শাহকে বন্দী করেন। এই সময় গুজব ওঠে যে, যুদ্ধে নাদির শাহ মৃত্যুবরণ করেছেন। এই গুজবে স্থানীয় জনগণ উৎফুল্ল হয়, নাদির শাহের সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করে। প্রাথমিভাবে এই আক্রমণে প্রায় ৯০০ ইরানি সৈন্য নিহত হয়। এরপর ক্ষুব্ধ নাদির শাহ সৈন্যদের প্রতি-আক্রমণের নির্দেশ দেয়। নাদির শাহের সৈন্যরা প্রায় সাত ঘণ্টা ব্যাপী দিল্লীতে হত্যাযজ্ঞ চালায়। এই আক্রমণে প্রায় ২০ থেকে ৩০ হাজার দিল্লীর সাধারণ নাগরিক নিহত হয়। এছাড়া প্রায় ১০,০০০ নারী ও শিশুকে বন্দী করে। পরে এদেরকে দাস হিসেবে পারশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এই ঘটনার জন্য মুহাম্মদ শাহ নাদির শাহের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সৈন্যদের থামানোর আবেদন করেন। পরে নাদির শাহ সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেন তিনি প্রথমে মোগল রাজ কোষগারের চাবি গ্রহণ করে, সমুদয় সম্পদ হস্তগত করেন। পরে মুহাম্মদ শাহের সাথে সন্ধি চুক্তি করেন। এই চুক্তি অনুসারে আফগানিস্তান ইরানের অধীনে চলে যায়। এবং বাৎসরিক ৫০ লক্ষ টাকা কর দিতে সম্মত হয়।

এর বাইরে নাদির শাহ দিল্লী ত্যাগের আগে ধনবান ব্যক্তিদের সঞ্চিত সম্পদ হস্তগত করেন এবং মোগল ময়ূরসিংহাসনটি সাথে করে নিয়ে যান। তিনি প্রায় ৭০০ হাতি, ৪ হাজার উট এবং ১২০০০ ঘোড়া লুণ্ঠন করে নিয়ে যান। এছাড়া ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে, নাদির শাহ মোগল সম্রাটের কন্যা জাহান আফরোজ বানু বেগমকে পুত্রবধূ করে ইরানে নিয়ে যান।

এই ঘটনার পর মোগল সম্রাটের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। এই অবস্থাকে আরও তীব্রতর সঙ্কটের সৃষ্টি করে আফগান আফগানিস্তানের শাসক আহম্মদ শাহ আব্দালি। ১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দের আফগানিস্তান আহমাদ শাহ দুররানি ভারত আক্রমণ করেন। কিন্তু ১৬ এপ্রিল মুহাম্মদ শাহ মৃত্যুবরণ করেন। এরপর মোগল সাম্রাজ্যের ১৩তম সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে বসেন- আহমদ শাহ।

স্ত্রী: সাহিহা মহল, কুডসিয়া বেগম, ফতেহপুরি মাহা, রওশানাবাদি মাহা।
সন্তানাদি: শাহরিয়ার শাহ বাহাদুর, আহমদ শাহ বাহাদুর, তাজ মুহাম্মদ, বাদশাহ বেগম, জাহান আফরুজ বানু বেগাম, হজরত বেগম।


সূত্র: