প্রতিমা
ঠাকুর
লেখিকা, কবি, চিত্রশিল্পী এবং নৃত্যবিশারদ ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্রবধু এবং রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী।
১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেষেন্দ্রভূষণ
চট্টোপাধ্যায়। মায়ের নাম বিনয়িনী দেবী। মাত্র ১১ বছর বয়সে প্রতিমার বিয়ে হয়
গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটবোন কুমুদিনীর ছোট নাতি নীলানাথের সাথে। গঙ্গায় সাঁতার
কাটতে গিয়ে জলে ডুবে নীলানাথের মৃত্যু হয়। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী,
ছোট প্রতিমাকে দেখে তাকে নিজের পুত্রবধূ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু
মৃণালিনীর অকালমৃত্যুর ফলে তা সম্ভব হয় নি। এরপর রথীন্দ্রনাথের বিলেত থেকে
ফিরলে, তার সাথে রবীন্দ্রনাথ প্রতিমার আবার বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। তিনি সমাজ
সংস্কারকে অগ্রাহ্য করে প্রতিমা এবং রথীন্দ্রনাথের বিয়ে দেন। এই বিয়ে ছিল
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রথম বিধবা বিবাহ।
কর্মজীবন তিনি রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর স্বামীর সাথে বিশ্বভারতী এবং শান্তিনিকেতনের
নানা কাজে নিজেকে নিয়োগ করেছিলেন। তিনি নানারকমের কারুশিল্প প্রবর্তনে এবং
রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য পরিকল্পনায় সহযোগিতা করতেন। তিনি একজন ভালো চিত্রশিল্পীও
ছিলেন। তিনি কিছুদিন ইতালীয় শিক্ষক গিলহার্ডির কাছে ছবি আঁকা শিখেছিলেন।
বিয়ের
অল্প পরে শান্তিনিকেতনে মেয়েদের প্রথম অভিনয় লক্ষ্মীর পরীক্ষাতে তিনি ক্ষীরির
চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তিনি শান্তিনিকেতনে মেয়েদের নাচ শেখাবার ব্যবস্থা করেন।
রবীন্দ্রনাথের বাল্মিকীপ্রতিভা এবং মায়ার খেলায় তিনি নাচে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের তিনিই ছিলেন প্রধান উৎসাহী। তাঁর আগ্রহে রবীন্দ্রনাথ
চিত্রাঙ্গদা বা পরিশোধ নিয়ে নৃত্যনাট্য রচনার পরিকল্পনা করেন। তিনি প্রথমে
বর্ষামঙ্গলের দু'একটি নাচে রূপ দেওয়ার পর, তিনি রবীন্দ্রনাথকে পূজারিনী কবিতার
নৃত্যনাট্যরূপ লিখে দেওয়ার অনুরোধ করেন। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে মেয়েদের দিয়ে
সেটি অভিনয় করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এরপর রবীন্দ্রনাথ লিখলেন নটীর পূজা। প্রতিমা
দেবী অনেক পরিশ্রমের মাধ্যমে শান্তিনিকেতনের মেয়েদের দিয়ে সেটি অভিনয় করান। এই
নাটকে শ্রীমতীর ভূমিকায় নৃত্যাভিনয় করেছিলেন নন্দলাল বসুর মেয়ে গৌরী।
১৩৩৭ খ্রিষ্টাব্দে 'নবীন' অভিনয়ের সময় অধিকাংশ নাটকের পরিকল্পনা করেছিলেন প্রতিমা
দেবী। প্রায় চোদ্দ বছর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা
নৃত্যনাট্যের একটি স্থায়ী রূপ দিতে সমর্থ হন। চিত্রাঙ্গদার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে
তিনি নাচের তৈরি করেছিলেন চণ্ডালিকা।
নাচের
ক্ষেত্রে তিনি
পোশাক-পরিচ্ছদ এবং মঞ্চ-সজ্জাতেও তিনি শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য বজায়
রেখেছিলেন। তিনি শেষের দিকে মঞ্চসজ্জার পরিকল্পনা ছবি এঁকে রাখতেন। তিনি কলাভবনের
শিল্পীদের দিয়ে নাচের ভঙ্গি আঁকিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। তিনি মায়ার খেলা নাটকেরও
নতুন রূপ দিয়েছিলেন। গল্পগুচ্ছের ক্ষুধিত পাষাণ ও দালিয়া, কথা ও কাহিনীর সামান্য
ক্ষতি প্রভৃতি গল্পগুলিকে ট্যাবলো ধরনের মূকাভিনয় আকারে রূপায়িত করেছিলেন।
প্রতিমা কল্পিতাদেবী ছদ্মনামে প্রবাসী পত্রিকাতে অনেক কবিতা লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ
তাঁর এই কল্পিতাদেবী ছদ্মনামটি ঠিক করে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কখনো কখনো তাঁর
কবিতাগুলিকে সংশোধন করে দিতেন। তাঁর গদ্য রচনাগুলিতে লিপিকার বিশিষ্ট ভঙ্গি চোখে
পড়ে। তাঁর রচিত স্বপ্নবিলাসী পড়ে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়ে লেখেন মন্দিরার উক্তি।
প্রতিমা দেবী রচিত নির্বাণ বইটিতে রবীন্দ্রজীবনের শেষ বছরের ঘটনার বর্ণনা পাওয়া
যায়। স্মৃতিচিত্র বইটিতে অবনীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথের কথা আছে। এছাড়া এতে
বাড়ির মেয়েদের কথা এবং উৎসবের কথা। নৃত্য বইটিতে শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারার
বিষয়ে লিখেছিলেন। চিত্রলেখা তাঁর রচিত কবিতা এবং কথিকার সংকলন।
তিনি শান্তিনিকেতনে নারীশিক্ষা এবং নারীকল্যাণের দিকেও নজর রাখতেন। তিনি মেয়েদের
নিয়ে আলাপিনী সমিতি গঠন করেছিলেন। এই সমিতিতে অভিনয় এবং গান হত। তাঁর ব্যবস্থাপনায়
আশ্রম থেকে মেয়েরা গ্রামে গিয়ে গ্রামের অশিক্ষিতা মেয়েদের স্বাস্থ্যকর খাবার
তৈরি, শরীরের যত্ন, হাতের কাজ প্রভৃতি বিষয় শেখাতেন।
প্রতিমা ঠাকুরের গ্রন্থাবলি
নির্বাণ। ১ বৈশাখ ১৩৪৯। বিশ্বভারতী।
রবীন্দ্র-জীবনের শেষ
বৎসরের বিবরণ।
চিত্রলেখা। আশ্বিন ১৩৫০। বিশ্বভারতী।
গল্প ও কবিতা সংকলন।
নৃত্য। ২৫ বৈশাখ ১৩৫৬। বিশ্বভারতী।
স্মৃতিচিত্র। আশ্বিন ১৩৫৯। সিগনেট প্রেস।
সূত্র
:
স্মরণ প্রতিমাদেবী। বিশ্বভারতী পত্রিকা। ২৫বর্ষ সংখ্যা ৩। মাঘ-চৈত্র ১৩৭৫।
সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান। প্রথম খণ্ড। জানুয়ারি ২০০২।