সহজিয়া বৈষ্ণব মতে- সাধনার প্রথম
স্তরে নামকে আশ্রয় করে সাধনার একাগ্রতা বৃদ্ধি করতে হয়। বৈষ্ণব মতে এরূপ নাম কীর্তন হলো-
রাধাকৃষ্ণের নাম জপ। সাধনার এই স্তরকে বলা হয় প্রবর্ত। এই অবস্থায় গুরুকে আশ্রয়
করে, সাধুসঙ্গ করে প্রবর্ত অধ্যায় শেষ করতে হয়। রাধারমণ সাধনার প্রাথমিক স্তর
অতিক্রম করে, আত্মদর্শনে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। এই সূত্রে তিনি রচনা করেছিলেন
দেহতত্ত্বের গান। এই স্তরের সাধনার জন্য গুরুর প্রয়োজন হয়। তাই রাধারমণ গুরু হিসেবে
বেছে নিয়েছিলেন সহজিয়া বৈষ্ণব মতের রঘুনাথ স্বামীকে।
সাধনার এই স্তর শেষে, গুরুর অনুমতি নিয়ে শুরু করেন সাধক স্তর। এটি সধানার দ্বিতীয়
স্তর। এই স্তরে ধ্যানের মধ্য দিয়ে সাধনা করতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে ভাবটাই
প্রাধান্য পায়। সাধনার এই স্তরে নিজেকে নারী ভেবে কামের ভিন্নরূপ সম্পর্কে অবগত হতে
হয়। এর দ্বারা সাধক পুরুষ ও নারী সত্তার কামের রূপ সম্পর্কে জানতে পারেন। তাছাড়া সাধক কাম
থেকে নিজেকে মুক্তও করতে পারেন। শুধু তাই নয় এই স্তরে ষড়রিপু বশ করাই সাধনার
অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই সূত্রে ত্যাগ করতে হয় হিংসা, নিন্দা, লোভ, কাম,
ক্রোধ ও মায়া ইত্যাদি। এক্ষেত্রে গুরুই হন একমাত্র পথপ্রদর্শক। রাধারমণও এই সাধনার জন্য
গুরুর শরণাপন্ন হয়েছিলেন। তাঁর বহুগানে সাধনমার্গের বিষয় ছাড়াও গুরু ভক্তি এবং
গুরুসাধনার কথা পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, রাধারমণ দ্বিতীয় স্তরের সাধনার
জন্য নলুয়ার হাওর সংলগ্ন নির্জনস্থানে গিয়েছিলেন।
এই স্তর অতিক্রম করার পর তিনি তৃতীয় স্তরের সাধনার উপযোগী হয়ে উঠেছিলন। তৃতীয়
স্তরের এই সাধনাকে বলা হয় সিদ্ধ অবস্থা। এই অবস্থার দুটি আশ্রয় রয়েছে। এর একটি হলো
প্রেম, অপরটির নাম রস। এই স্তরে কামকে জয় করতে হয়। এবং শেষ পর্যায়ে নায়িকা গ্রহণ
করে সাধনমার্গের উচ্চস্তরে গমন করতে হয়। কামকে বশীভূত করে কামভাবহীন নায়িকা
গ্রহণ করে সাধনার পথে অগ্রসর হতে হয়। এই সাধনাকে সিলেটের ভাষায় বলা হয়- 'মাইয়া
সাধন'। রাধারমণের গানে 'মাইয়া সাধন'-এর উল্লেখ উদাহরণ পাওয়া যায়। যেমন-
সহজিয়া বৌদ্ধ দর্শন এবং সহজিয়া বৈষ্ণব
দর্শন মতে, দেহের ভিতরে গুরু লুকিয়ে আছে। তাই মানুষগুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে দেহগুরুর
সাধনা করতে হয়। দেহের কামচেতনাকে বশ করে দেহের মধ্য দিয়ে অধরাকে মানুষকে ধরার
সাধনাই হলো দেহের গুরুর সাধনা। রাধারমণ গানে তৃতীয় স্তরের
সাধনার কথা পাওয়া যায়।
রাধারমণের গানকে গান কেউ কেউ বাউলাঙ্গের বা বাউল গান
বলে থাকেন। মূলত রাধারমণের ধর্মবিশ্বাসের সাথে বাউল দর্শনের কিছুটা মিল
থাকলেও,
তাঁর গান ছিল সহজিয়া বৈষ্ণব দর্শনকে কেন্দ্র করেই। তাই গানের শ্রেণিকরণে, তাঁর
গানকে সহজিয়া বৈষ্ণব গান বলাই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়।
রাধারমণ সিলেটের আঞ্চলিক গান
ধামাইল আসরের জন্য কোন গান রচনা করেন নি। তিনি ভাবের ঘোরে
গান রচনা করতেন সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্মাদর্শনে। রাধাকৃষ্ণবিষয়ক গান হিসেবে, সিলেটের
ধামাইল শিল্পীরা তাঁর বহু গান ব্যবহার করেছেন। মূলত রাধারমণের গানের পরিচয় হওয়া উচিৎ 'রাধারমণের গান' হিসেবেই।
তাঁর গানকে
ধামাইল গান হিসেবে বিবেচনা করলে সাধক রাধারমণকে অমর্যাদা করা
হয়।