ধামাইল
বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ ও আসামের বরাক
উপত্যাকার লোক নৃত্যগীত বিশেষ।
সাধারণত বিবাহ, গৃহপ্রবেশ, অন্নপ্রাসন, হোলি, রাসমঙ্গল যাত্রা ইত্যাদি মাঙ্গলিক
অনুষ্ঠানে দলগতভাবে ধামাইল গান পরিবেশিত হয়ে থাকে। বিশেষ করে হিন্দু বিবাহ উপলক্ষে
বিবাহ-পূর্ব রাত্রি বা অধিবাস রাত্রিতে ধামইল গানের আসর বসে। অনেক সময় বিয়ের পাকা
দেখা, কন্যার আদ্যস্নান, গায়ে হলুদ, ফুলচন্দন, বাসি বিবাহ, চতুর্মঙ্গল অনুষ্ঠানেও
ধামাইল গান ও নাচ পরিবেশন করা হয়।
ধামাইল গান বলা হলেও, প্রকৃতপক্ষে ধামাইল আসরে নাচ ও গান করা হয়। এই নাচে সামনে
মাথা নিচু করে ও উপরে মাথা তুলে ঝুঁকে পর্যায়ক্রমে করতালি দিয়ে ঘুরে ঘুরে সরল
পদক্ষেপে ও ছন্দে নাচা হয়। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় ধামাইল গানের করতালিকে বলা হয়
‘থাপরি’ বলে। এর গানের সুরে পাওয়া যায়, কীর্তন ও ভাটিয়ালি অঙ্গ। তবে এই গানে
ভাটিয়ালির দীর্ঘ সুরেলা টান নেই এবং কীর্তনের মতো তালফেরতা, বা জটিল ছন্দ নেই।
'ধামাইল' শব্দের অর্থ নিয়ে নানা ধরনের মত রয়েছে। যেমন-
সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা 'ধামা' শব্দের অর্থ ভাব বা আবেশ। ভক্তি ও প্রেমের ভাবাবেশে এই গান পরিবেশিত হয় বলে এর নাম ধামাইল। এর অর্থ হতে পারে ভক্তি ও প্রেমের ভাবাবেশের গান।
ধামা শব্দের অপর একটি অর্থ হলো উঠান। অনেকে মনে করেন, এই গান বাড়ির বড় উঠানে দলগতভাবে পরিবেশিত হয়। এই অর্থের ধামাইল-এর অর্থ দাঁড়ায় উঠানের গান।
সিলেটের বিভিন্ন বাড়িতে অবসর মুহুর্তে গল্পগুজবের মুহূর্তকে বলা হতো ধুম্বইল। কালক্রমে এই গল্পগুজবের আসর মেয়েদের গান নাচের আসরে পরিণত হয়। অনেকে মনে করেন এই ধুম্বইল কালক্রমে ধামাইল গানে পরিণত হয়।
সিলেটের
আঞ্চলিক এই লোক গানের উৎকর্ষ রূপ দেন রাধারমণ দত্ত। বর্তমানে অধিকাংশ ধামাইল গানের
আসরে ব্যবহার করা হয় রাধারমণ দত্তের গান। এ ছাড়া এই আসরে পরিবেশন করা হয় মহেন্দ্র
গোসাই, দীনশরৎ প্রমুখ গীতিকারদের গান পরিবেশন করা হয়।
বড় ধরনের ধামাইল গানের আসরে, বিষয় পরম্পরা রক্ষা করা হয়। এক্ষেত্রে আসর শুরু করা
হয়- প্রার্থনা সঙ্গীত দিয়ে। এই অংশে গায়িকারা আসরের দর্শকদের কাছে- তাঁর ত্রুটির
আগাম ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এই সূত্রে গায়িকারা ভক্তিভাবে কৃষ্ণ, গুরুজনদের প্রতি
ভক্তিপ্রদর্শনমূলক গান পরিবেশন করেন। এরপর গায়িকারা গানে ও নাচে কৃষ্ণ, সরস্বতী,
আসরে আহ্বান করেন। কোনো কোনো গানে বিষ্ণুর দশাবতরকে স্মরণ করা হয়।
মূলত
প্রার্থনা, ভক্তি ও আহবান অংশ শেষ হলে, ধামইল গায়িকারা নাচে গানে কৃষ্ণের রূপ ও
মহিমা বর্ণনা করেন। এছাড়া এই অংশে শ্রীরাধার হয়ে গায়িকারা কৃষ্ণর রূপ সংকীর্তন
করেন। এছাড়া শ্রীকৃষ্ণের বাঁশীর সুরে রাধা কিভাবে প্রেমাবেগে তাড়িত হন, তা একটি
বিশেষ অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রাত্রি গভীর হলে গায়িকারা রাধিকার প্রেমানুভব
ধারণ করে কৃষ্ণ-বিচ্ছেদের যাতনা নাচে-গানে প্রকাশ করেন।
ধামাইলে আসরের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হিসেবে রয়েছে দূতী সংবাদ। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের
মতই এই অধ্যায়ে রাধাকৃষ্ণের দূতী হিসেবে বড়ায়ি থাকে। এছাড়া 'কোকিল সংবাদ' পরিবেশন
করা হয় দূতী অধ্যায় হিসেবেই। এক্ষেত্রে ধামাইল শিল্পীরা নেচে গেয়ে, রাধার মনের কথা
কোকিলের কাছে ব্যক্ত করেন। একই সাথে রাধা তার মনের ব্যথা শ্রীকৃষ্ণকে জানানোর জন্য
অনুরোধ করেন। এছাড়া পরিবেশিত হয়, রাধাকৃষ্ণের অভিসারের গান, যমুনাবিলাস অঙ্গের
জলভরা অধ্যায়ের গান, কুঞ্জ সাজানির গান, দীর্ঘ বিরতীর পর রাধাকৃষ্ণের সাক্ষাতকে
বর্ণনা করা হয় সাক্ষাত খেদের-গান, রাধাকৃষ্ণের মিলনের গান। ধামাইল আসরের রাত্রি
শেষে পরিবেশন করা হয় প্রভাতী খেদের গান।
বিবাহ উপলক্ষে অনেক সময় ধামাইল গানের আসরে বসে বরের বাড়িতে। এই সময় মেয়েরা গায়
জামাইকে নিয়ে নানা রকমের গান করে। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য গান হলো জামাই স্নানের গান।
আবার বিবাহোত্তর সময়ে বর অন্যত্র গেলে, তার আগমনের প্রত্যাশ্যায় কনে বাড়িতে
পরিবেশিত হয় ধামাইল গান।
কোনো কোনো ধামাইল গানে পরিবেশন করা হয়- ব্যাঙ্গাত্মক, হাসিরসাত্মক, সমাজ-সচেতনামূলক গান। সিলেটি ভাষায় একে বলা হয় আউট গান।
ধামাইল গানের আসরে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় মরমী কবি রাধারমণ দত্ত-এর গান। উল্লেখ্য, রাধারমণ দত্ত ধামাইলের আসরের জন্য গান রচনা করে নি। মূলত তিন ভাবের ঘোরে, গান রচন করতেন মুখে মুখে। সেই লিখে নিতেন তাঁর শিষ্যরা, একই ভাবে তাঁর কাছ থেকে শিখেও নিতেন।