১.১১
মন ও মনোজগৎ
স্বয়ম্ভূ আত্মার পরিচালক অংশ হলো আমি। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সব কিছু 'আমি'র কাছে প্রকাশ পায়, 'আমি' সিদ্ধান্ত নেয় সে অনুভূতি অনুসারে কি করবে। 'আমি' ইচ্ছা করলো− গান শুনবে বা শুনবে না। অর্থাৎ 'আমি'র মন নামক অংশে এই ইচ্ছা জাগ্রত হবে। এরূপ মনে নানা ধরনের ইচ্ছা জাগ্রত হতে পারে। এই ইচ্ছা কার্যকর করা উচিত কি অনুচিত মন তার ধার ধারে না। এই বিচারে মন স্বেচ্ছাচারী। কিন্তু 'আমি' স্বেচ্ছাচারী নয়। 'আমি'র ইচ্ছায় প্রাথমিকভাবে যে ভাবনাই জাগ্রত হোক না কেন, 'আমি' তা বিচার করতে বসে। এই বিচারে যে জয় যুক্ত হয়, 'আমি' তা-ই করে। ফলে মন দ্বৈত-সত্তার ভূমিকা নেয়। এক্ষেত্রে আমির ভূমিকা হয়ে উঠে আদালতের মতো। মনের স্বেচ্ছাচারী ভাবাবেগ এবং তাকে অভিজ্ঞতার আলোকে বিচার করার ইচ্ছা, উভয়ই একটি অখণ্ড মনের দুটি অংশ হিসেবে প্রকাশ পায়। 'আমি' মনের উভয় অংশ নিয়ে ভালোমন্দের তুলনামূলক বিচারে বসে। 'আমি'র ইচ্ছাতেই এই কার্যক্রম চলতে থাকে। ফলে 'আমি'র আর একটি ইচ্ছা আগের ইচ্ছার কাতারে এসে হাজির হয়। আবার সবশেষে 'আমি' কোনটি গ্রহণ করবে, তার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই সিদ্ধান্ত দ্বারা চালিত হয়। এর ফলে মনের আরও একটি অংশের সৃষ্টি হয়। এই কারণে মন বলে যে সত্তাকে উল্লেখ করা হয়, তা অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইচ্ছার সমন্বিত অখণ্ড অংশ হিসেবে উপস্থাপিত হয়। এই কারণে মন বড়ই জটিল। এক্ষেত্রে 'আমি'কে দক্ষ বিচারকের ভূমিকায় থাকতে হয়। কখনো কখনো মন সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। ফলে ইচ্ছা বা মনের অস্থিরতার ভিতর দিয়ে 'আমি' অসহায় হয়ে পড়ে। একটি 'আমি' অন্য কোনো 'আমি'র সাহায্য নিতে পারে। এটাও মনের অংশ হয়ে যায়। 'আমি' মস্তিষ্কের স্মৃতিভাণ্ডার থেকে অভিজ্ঞতাকে উত্তোলন করে। উল্লেখ্য 'আমি' যে স্মৃতি ভাণ্ডার থেকে অভিজ্ঞতা তুলে আনার ইচ্ছা করে, তাও মনের আর একটি অংশ। এক্ষেত্রে 'স্মৃতি' দুটি দশায় কাজ করে।
মানুষের বোধ, ধারণা,
বিচার সিদ্ধান্ত ইত্যাদির সূত্রে তৈরি হয় মনোজগৎ। এই মনোজগতের রাজধানী মস্তিষ্ক। জৈবিক
উপদান দিয়ে তৈরি স্থাপত্য উপকরণ। তাতে শক্তি জোগায় জৈবিক শক্তি। আর এই জগতের
প্রশাসন বা পরিচালন কর্মকাণ্ড চলে স্বয়ম্ভূ আত্মার পরিচালক 'মন' দিয়ে। পরস্পরের
সমন্বয়ে চলে মনোজগৎ।
যে দেহকে আশ্রয় করে মনোজগৎ গড়ে উঠে, তার সাথে যুক্ত থাকে জীবন ধারণের ভাবনা এবং একই
সাথে জীবন-যাপনের ভাবনা। জীবন ধারণের জন্য মানুষকে নজর দিতে দেহের কলকব্জার দিকে।
আর জীবন যাপনের হলো সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা। জীবন ধারণের জন্য— জীবনহরণকারী হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার, বৃক্কের অসুস্থতা সবই যেমন মনোজগতকে তাড়িত
করে, তেমনি অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের মতো মৌলিক মানবিক চাহিদাগুলোও মনোজগৎকে ব্যস্ত
রাখে। তাই মনের রোগ সারিয়ে তোলার জন্য মনিবিজ্ঞানীদের দেহের জীবন-ধারণের উপকরণগুলোর
খবর রাখতে হয়। জীবন-ধারণের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত, কিন্তু পৃথক ভাবনা হলো
জীবন-যাপন। হৃদযন্ত্রের বিকার নিয়ে চিকিৎসক ভাবেন জীবন-ধারণকে সচল রাখার জন্য,
কিন্তু প্রেমিককে দেখে প্রেমিকার মনে যে সপ্রেম হৃদযন্ত্রে কম্পন জাগে, সেখানে শল্য
চিকিৎসক নিরুপায়। হৃদ-কম্পনের এই রোগ জীবন-ধারণের অংশ নয়, জীবন-যাপনের অংশ। ব্যর্থ
হৃদয়ে কেউ যখন জীবনধারণের আশা ত্যাগ করে আত্মহননের কথা ভাবেন, তখন তার চিকিৎসক হন
মনোবিজ্ঞানী। এক্ষেত্রে মনোচিকিৎসককে সুন্দর জীবন-যাপনের ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে
জীবন-ধারণের আশাকে উজ্জীবিত করেন। চিকিৎশাস্ত্রে বলা হয়, যে রোগী নিজে বাঁচতে চায়
না, তাঁকে চিকিৎসার দ্বারা বাঁচানো যায় না। তাই যে কোনো বিভাগের চিকিৎসক, রোগীকে
আশার বাণী শোনান। অনেক সময় মানবিক কারণেও অচিরেই নিশ্চিত মৃত্যু হবে জেনেও, চিকিৎসক
সে কথা রোগীর কাছে গোপন রাখেন।
মনের ঘর বন্ধুর ঘর
মানুষ জন্মগত সূত্রে একক, কিন্তু বন্ধুসঙ্গমে বহু। এই বহুত্বই একক দুর্বল মানুষকে
সবল করে। মানুষের যা কিছু, তার সবটুকই মহৎ হয়ে উঠে, যদি সে
আপন হতে বাইরে এসে দাঁড়াতে পারে, সবাইকে আপন করে নিতে পারে। যিনি সবাইকে আপন করে
নিয়ে সবার ভিতরে এসে দাঁড়াতে পারেন, তিনিই মহৎ বন্ধু হতে পারেন। মানুষ দুটি হাত
নিয়ে জন্ম নেয়, কিন্তু যত তার বন্ধু বাড়ে, তার হাতের সংখ্যাও ততটাই বাড়ে। আর যত হাত
বাড়ে তার ক্ষমতাও ততটাই বাড়ে।
মানুষের মনোজগৎ হলো একটি মুক্ত প্রান্তরের মতো। সে
প্রান্তরে আনন্দ-বেদনার লীলা চলেছে প্রতিনিয়ত। সেখানে জন্ম নেয় অজস্র স্বপ্ন, অজস্র
কামনা এবং সেই সাথে জন্ম নেয় অজস্র দ্বন্দ্ব। এতসব হট্টগোলের ভিতরে সেই মনের এক
কোণে একটি ক্ষুদ্র ঘর তৈরি হয়। সে ঘর নিতান্তই নিজের ঘর। সে ঘরের অনেক গোপন কথা। সে
এমনই গোপন, যে কাউকে বলা যায় না। প্রতিটি মানুষ সে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকে। এই ঘরের
সত্ত্বার সাথে অন্য কারো বন্ধুত্ব হয় না। সে ঘরের মানুষ বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসবাসকারী
সঙ্গহীন, সঙ্গীহীন।
মানব শিশুর বুদ্ধির উন্মেষলগ্নে এই ঘরটি থাকে না। তাই শিশু অকপট, শিশু সকলের বন্ধু
হয়ে ওঠে। যখন একটু একটু করে বাইরের জগতের সাথে তার পরিচয় ঘটতে থাকে, তখন তার ভিতরে
স্বতন্ত্র সত্তা জেগে উঠতে থাকে। সে বুঝতে থাকে, সে আলাদা, একটি একক সত্তা। এর
কিছুটা সে তার সহজাত বোধ থেকে জানে, কিছুটা বার বার বলে বা দেখিয়ে বড়রা জানিয়ে দেয়।
এরই ভিতর দিয়ে জন্ম নেয় মনের কোণের লুকানো সত্তা। প্রাথমিকভাবে একই সাথে জন্ম নেয়
আরও দুটি আবরণ। এর একটিতে থাকে এমন কিছু কথা, যা সে তার মা বা নিকটজনদের বলতে পারে,
সবাইকে বলতে পারে না। এই দ্বিতীয় ঘরে এসে তার সৃষ্টি হয় গুটি কয়েক বন্ধু। ঘরের
অবশিষ্ট যে ঘরটি থাকে, সে ঘরের কথা সবাইকে বলা যায়। সে ঘরের চারদিক খোলা, পৃথক কোনো
দরজা জানালা নেই।
মানুষ বয়সে বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে, সে ছোট্ট ঘরকে কেন্দ্র করে বহু আবরণ তৈরি হতে
থাকে। নিজের গড়া এসকল আবরণের আড়ালে শিশু ক্রমাগত তার সরলতা হারাতে থাকে। নানা ধরনের
প্রতিপত্তিতে সে হয়ে উঠে আত্মকেন্দ্রিক বড় মানুষ। অর্থ, বংশ, জ্ঞান, বয়স ইত্যাদির
দ্বারা আবরণটা হয়ে উঠে তার নিত্য সঙ্গী। এসকল সঙ্গীকে ভেঙে মানুষসঙ্গীকে বন্ধু
হিসেবে পেতে হলে, নিজেকেই মেলে ধরতে হবে অকৃপণভাবে। রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর গানে
বলেন- 'আপনারে দিয়ে রচিলি কি এ আপনারই আবরণ/খুলে দেখ্ দ্বার, অন্তরে তার
আনন্দনিকেতন', তখন তিনি অহমিকার আবরণ ভেদ করে, জগতের আনন্দযজ্ঞে মিলিত হওয়ার কথাই
বলেন।
বিচ্ছিন্ন দ্বীপের নিঃসঙ্গ মানুষ, যখন অপরের সাথে সেঁতুবন্ধ তৈরি করে, তখন তার অসংখ্য আবরণের একটিকে অপরের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। ওই একটি সেঁতু দিয়ে তাঁর বন্ধন ঘটে অন্যজনের সাথে। এই বন্ধনেই তৈরি হয় বন্ধুত্ব। এক্ষেত্রেও মানুষ অনেকটাই রক্ষণশীল। প্রথমে দেখে তার মনের সাথে অন্যের মনের মনের মিল কোথায়। যদি কোনো ক্ষেত্রে মিল খুঁজে পায়, তাহলে সেই বিশেষ ক্ষেত্রের আবরণ খুলে দেয়। ফলে দুটি মানুষের মধ্যে একটি সঙ্কীর্ণ সেঁতু তৈরি হয়। এক্ষেত্রে বন্ধুত্বও হয় স্বল্প পরিসরে। যার সাথে একাধিক বিষয়ে মনের মিল ঘটে, তার সাথে বন্ধুত্বের সেঁতু তৈরি হয় একটু বড় পরিসরে। সকল বিষয়ে মিল রয়েছে এমন দুজন মানুষের সন্ধান পাওয়াটা বিরল, তাই প্রকৃষ্ট বন্ধুত্বের নিদর্শনও বিরল।
হাত বাড়ালেই প্রকৃষ্ট বন্ধু নাই বা জোটে, চেষ্টা করলে ভালো
বন্ধুর অভাব হয় না। এক্ষেত্রে নিজেকে আগে ভালো হতে হয়। এই ভালো হওয়াটার জন্য
ঈশ্বরের মতো নির্মল হওয়ার প্রয়োজন নেই। এই ভালোটা হলো কল্যাণকর। কল্যাণকর ইচ্ছা বা
বাসনা রয়েছে যার ভিতর, তাই ভালোবাসা। মনের সাথে মিল হলে যে সেঁতুবন্ধ তৈরি হয়, তার
সাথে ভালোবাসা না থাকলে বন্ধুত্ব হয় না। এক্ষেত্রে ভালো বলতে বুঝানো হয়েছে শুভ, আর
বাসা হলো বাসনা বা কামনা। যখন কারো প্রতি শুভ ইচ্ছা জেগে উঠে, তখনই সৃষ্টি হয়
ভালোবাসা। এর ভিতরে প্রতিদানের বিষয় নেই। সম্ভবত মানুষের শ্রেষ্ঠ ভালোবাসার পাত্র
হলো তার সন্তান। কল্যাণ কামনায় পিতাকে ভালোবাসা যায়, কিন্তু
পরমপিতার জন্য একেবারেই নয়। কারণ, পরমপিতার কল্যাণ কামনা ঔদ্ধত্যের পর্যায়ে পড়ে।
ভালোবাসার অধিকারে যদি বন্ধুকে কিছু দিতেই হয়, তাহলে প্রতিদানের আশা না করেই দেবো।
দেওয়া-নেওয়ার মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠে, বন্ধুত্ব হয় না। যদি বন্ধুর
কাছে নিই, তাতে গ্লানি নেই। বন্ধুর কাছে যা পাবো তা বন্ধুত্ব, অন্যের কাছে যা নেবো,
তা হবে কাঙালিপনা। যদি বন্ধুই হই, তা হলে না চাইতে তাকে দেবো। যদি বন্ধুর কাছ থেকে
কিছু নিতেই হয়, তা বন্ধুত্বের জোরেই নেবো। বিনিময়ের মধ্য দিয়ে যে সহযোগিতা দেওয়া
হয়, তা হলো পরিসেবা। প্রতিদানহীন যে সহযোগিতা তাই হলো সেবা। রোগীকে হাসপাতালে
অর্থের বিনিময়ে সেবিকা যা দেন, সেটা তার পরিসেবা। ঘরের প্রিয়মানুষ যা দেন, সেটাই
সেবা। পরিসেবা প্রচারে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেবা প্রতিষ্ঠিত হয় নিভৃতে। বন্ধুর জন্য
সেবার হাত, অন্যের জন্য পরিসেবার হাত। সেবার লক্ষ্য আমাদের দক্ষিণ হাত হোক
দাক্ষিণ্যে পূর্ণ। আমাদের সকল দক্ষিণ হাত মিলিত হোক সকলের দক্ষিণ হাতের সাথে।
যখন বন্ধুর জন্য হাত বাড়াবো, তখন মনের আবরণ ভেঙেই হাত বাড়াবো। গাড়ির উভয় পাশের চাকা সমান না হলে যেমন গাড়ি চালানো যায় না, উভয় মনের চাকা সমান না হলে, বন্ধুত্ব চলে না। বড়র পীড়িতি বালির বাঁধ, সেটা অর্থের হোক কিম্বা প্রতিপত্তির হোক। বড়র কাছে নিজেকে উচ্চতর করা যায় না, তাই বন্ধু্ত্ব হয় না। সে ক্ষেত্রে বড় যদি ছোটো হয়ে আসে, তা হলে বন্ধুত্বটা হতে পারে। কিন্তু বড় যদি পদে পদে মনে করিয়ে দেয়, আমি ছোটো হয়েছি করুণা করে; যদি মনে করে− বন্ধু হও কিন্তু একটু মান্য করো। তাহলে, সত্যিকার বন্ধু হ্ওয়া হয়ে উঠে না।
বন্ধনের মধ্য দিয়ে নিজেকে উন্মুক্ত করবো বলেই হাত বাড়িয়েছি। যদি সম্মত হও, তা হলেই বন্ধু। বন্ধু যদি হও, থাকবো সকল কর্মযজ্ঞে পাশাপাশি; থাকবো সঙ্কটে, সম্পদে, সৌভাগ্যে, সাধনায়, ব্রতে। বন্ধু যদি হও, তাহলে জগতের কল্যাণে একীভূত হবো, প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো একসাথে। বন্ধু যদি হও সকল ত্রুটিকে স্বীকার করবো নিজের ত্রুটি মনে করে, বন্ধুর কৃতিত্বকে মনে করবো নিজের।
আমাদের নানা ধরনের সঙ্কট আছে। তার ভিতরে অন্যতম সঙ্কট হলো বন্ধুত্বের। কখনো কখনো কোনো কোনো বিষয়ে সমমনা মানুষ একত্রিত হয় বটে, প্রগাঢ় বন্ধুত্বের অভাবে ভাঙতে বেশি সময় লাগে না। তাই আমাদের অনেক মহৎ কর্মযজ্ঞের মধুর সমাপন ঘটে না। গঠনমূলক সমালোচনা যেমন কর্মযজ্ঞের ফললাভকে ত্বরান্বিত করে, স্বার্থন্বেষী কর্মকাণ্ড তেমনি কর্মযজ্ঞকে অসুরের মতো ধ্বংসও করে। বৃহৎকর্মকাণ্ড সম্পাদনে যেমন বন্ধুসভার দরকার, তেমনি সে কর্মকাণ্ড সচল রাখার জন্য বন্ধুসভা টিকিয়ে রাখারও দরকার।
রবীন্দ্রনাথ প্রতীক্ষায় ছিলেন− তাঁর ঘরের চাবি ভেঙে, কে নিয়ে যাবে বাইরের আনন্দনিকেতনে। সে চাবি নামক বন্ধন-পদ্ধতিতে আমরা সবাই আপন ঘরে আবদ্ধ। কিন্তু আমাদের প্রতীজ্ঞা হওয়া উচিৎ, সহৃদয় বন্ধুর দেখা মেলে নি বলে, ঘরের কোণে বসে রইবো না। নিজের ঘরের চাবি নিজেই ভাঙবো, সবার রঙে রঙ মিশিয়ে মনের বিশাল আঙিনাকে রঙিন করে তুলবো। সে ক্ষমতা আমাদের আছে। শুধু দরকার নিজের ইচ্ছা এবং উদ্যোগ। হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে বন্ধু। আর বন্ধুসঙ্গমে সফল হয়ে উঠবে আমাদের সকল কর্মকাণ্ড।
মনের ঘরের খেলা
মানুষের মনোজগতের নানা দশা এবং নানা রূপের
সূত্রে যে খেলা চলে, তার একদিকে রয়েছে বুদ্ধি অন্যদিকে ভাব। এই দুয়ের পৃথক
উপস্থিতিতে বা সংমিশ্রণে মনোজগতের বৈচিত্র্য প্রকাশ পায় বা বৈচিত্র্য ধৃত হয়।
এই দুটি ধারার সূত্রে মনোজগৎকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো।
'আমি'র ঐচ্ছিক স্তর হলো মন। ইন্দ্রিয় বা দেহাভ্যন্তরীণ স্নায়ুবাহিত অনুভূতিগুলো 'আমি'র কাছে সমান মূল্য পায় না। নানাবিধ তথ্যের ভিতর থেকে কোনটিকে কি মর্যাদা দেব, তা নির্ধারণ করে 'আমি'। রাস্তায় দাঁড়িয়ে যখন বন্ধুর সাথে কেউ কথা বলবে, তখন রাস্তার সকল কোলাহলকে উপেক্ষা করে বন্ধুর কথার মর্যাদা দেবে। কাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে, আর কাকে নয়, সেটাই 'আমি' নির্ধারণ করে। এই নির্ধারণে মনের ইচ্ছা কখনো কখনো পূরণ হয়, কখনো অবদমিত হয়। আদি মানুষের মন জটিল ছিল না। ক্রমবিবর্তনের ধারায় মনের রূপ জটিল থেকে জটিলতর হয়ে গেছে। আধুনিক মানুষের বিচারে আদি মানুষের ভিতর নীতিবোধ ছিল অত্যন্ত দুর্বল। তখন ছিল শুধুই টিকে থাকার সংগ্রাম। এরা খাদ্যের জন্য, নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য, যৌনাচারের জন্য নিজেদের মধ্যে লড়াই করতো। দৈহিকভাবে সবলরাই এই লড়াইয়ে জয়ী হতো। হয়তো দুর্বলদের জন্য সবলদের করুণাও ছিল না। মনোবিজ্ঞানীর মানুষের ভাবের এই জগতকে নানা দিক থেকে বিভিন্ন স্তরে ভাগ করেছেন। যেমন- মনের তথ্য নির্বাচন স্তর, মনের দ্বান্দ্বিক স্তর, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য স্তর, সৃজনশীল স্তর।
আমি'র তথ্য নির্বাচন স্তর
ইন্দ্রিয় বা দেহাভ্যন্তরীণ স্নায়ুবাহিত অনুভূতিগুলো 'আমি'র কাছে সমান মূল্য পায়
না। নানাবিধ তথ্যের ভিতর থেকে কোনটিকে কি মর্যাদা পাবে, তা নির্ধারণ করে 'আমি'।
'আমি'র তথ্য নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়।
সহজাত স্তর: সুস্থ দেহ ও মনের যে কেউ, সহজাত ক্ষমতায়
শুনবে, দেখবে, ঘ্রাণ নেবে, স্পর্শ নেবে, স্বাদ গ্রহণ করবে। এটাকে স্বাভাবিকভাবে
অগ্রাহ্য করা যায় না।
মানুষ যতটা তাকায়, তার চেয়ে দেখে কম। মনের সাথে যার কোনো
যোগ নেই, তা দেখা নয় তাকানো। এই দেখাটা হলো 'আমি'র তথ্য গ্রহণস্তর। ধরা যাক,
একজন মানুষ রাস্তা দিয়ে চলছে, সে তাকাতে তাকাতে চলছে সহজাত প্রবৃত্তিতে। চলার
পথে এই তাকানোর ভিতর দিয়ে সে পথের অনেক কিছু মনে রাখতে পারবে না। কারণ তার মনে
রাখার প্রয়োজন নেই। তারপরেও সহজাত ক্ষমতায় কিছু মনে থাকবে। যতটুকু মনে থাকবে,
ততটুকু 'আমি'র অজান্তেই মনের সাথে সংযোগ ঘটেছে বলেই তা সম্ভব হবে। অনেক সময়,
মানুষ চোখ খুলে বসে থাকে, কিন্তু চিন্তা করে অন্যকিছু। সে সময়ে তার কিছুই দেখা
হয় না। মানুষের তাকানোর ভিতর দিয়ে যেটুকু মনে রাখে, তাতে মনের অংশগ্রহণ
সামান্য। এই সামান্য অংশটুকু মানুষের সহজাত ক্ষমতায় মস্তিষ্কের স্মৃতিভাণ্ডারে
জমা হয়। সেই সামান্য মনে রাখা তথ্যানুসারে, মানুষের কাছে অনেক তাকানো বিষয় আবছা
স্মৃতির সৃষ্টি করে। মানুষ যতটা তাকানোর ক্ষেত্রে মনোযোগী হয়, দেখাটাও তার
ততটাই হয়। নিজের অজান্তে যা দেখা হয়ে যায়, তা হয়ে যায় তা নিজের অজান্তেই অবচেতন
মনের অংশ হয়ে যায়। গ্রহণস্তরে এই ঘটনা শুধু দর্শনেন্দ্রিয়ে
ঘটে না, ইন্দ্রিগ্রাহ্য সকল স্তরেই ঘটে।
বীক্ষণস্তর: বীক্ষণ হলো আরও
গভীরভাবে দেখার কাজ। ধরা যাক, রাস্তার পাশে একটি গাছে ফুল ফুটেছে। চলার পথে তা
কারো চোখে পড়লো। যদি মনের সামান্য যোগ থাকে, তা হলে তার একটু দেখা হবে।
ভালোভাবে ফুলটিকে দেখতে হলে, তাকে মনোযোগ দিয়ে ফুলটির দিকে তাকাতে হবে। সে তখন
ফুলের আকার, রঙ, পাপড়ির গড়ন সম্পর্কে ধারণা গ্রহণ করবে। এর
ভিতর দিয়ে 'আমি' বীক্ষণ স্তরে পৌঁছুবে।
প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রাপ্ত তথ্যের মর্যাদা অনুসারে আমরা নিচের ছকে
সাজাতে পারি।
মূলত প্রতিটি বীক্ষণ শেষে 'দার্শনিকের আমি' আরও গভীরভাবে বীক্ষণজাত তথ্যকে সমন্বিতভাবে অনুভব করার চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে 'আমি' অজস্র আত্ম-জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হয়। দার্শনিকের ভিতরে অন্য 'আমি' তার উত্তর খুঁজতে বসেন। ধরা যাক একজন একটি ফুল দেখছে। এই দেখার ভিতর দিয়ে সে এক ধরনের আনন্দ লাভ করেছে। এবার 'দার্শনিকের আমি'র কাছে একটি আত্মজিজ্ঞাসা নানারকম ভাবে জেগে উঠতে পারে। যেমন−
এই জাতীয় প্রশ্নের ভিতর দিয়ে 'দার্শনিকের আমি' একটি সত্যে
উপনীত হতে চায়। আর তার এই প্রশ্নোত্তরের ভিতর দিয়ে জন্ম নেয় নতুন নতুন দর্শন।
মূলত
যে কোনো ইন্দ্রিয়বাহিত বা দেহাভ্যন্তরীণ স্নায়ুবাহিত একক অনু্ভূতি বা
অনুভূতিসমূহকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের সূত্রে পরম সত্যের সন্ধানই হলো দর্শন। এই
দর্শনের অর্থ চোখের দেখা নয়, অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে পরম সত্যকে উপলব্ধি করার প্রচেষ্টার
পারিভাষিক নাম মাত্র। মানুষের 'আমি'র পরম লক্ষ্য সেটাই হওয়া উচিৎ। এই লক্ষ্য পূরণের
মধ্য দিয়ে 'আমি' তার জীবনের সার্থকতা খুঁজে পায়। আনন্দ-বেদনার ছন্দে বাধা জীবনে
'আমি' হয়ে ওঠে নিজের এবং জগতের।
দেখা না দেখায় মেশা
কোনো এক বর্ষণ মুখর ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ রাত্রি। অন্ধকার আকাশের
ক্যানভাসে আলোর রেখায় ক্ষণে ক্ষণে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে বিদ্যুৎলতা। তীব্র ঝড়ের
মর্মস্থল কাঁপিয়ে চিত্রকর প্রকৃতি সৃষ্টি করে চলেছে 'দেখা না দেখায় মেশা'র
চিত্রকল্প। এই কি সাবলাইম বা ভয়ঙ্কর সুন্দর। রবীন্দ্রনাথের এ গান শুধু সুরবাণীর
বন্ধন নয়, তার চেয়ে বেশি ব্যঞ্জনার অপরূপ দর্শন। এ গান সুর ও বাণীর ব্যঞ্জনা
রচিত এমন চিত্রকল্প, যা অরূপের অতল আহ্বানকে প্রকটীত করে। যা দেখার ভিতর দিয়ে
না-দেখাকে দেখায়।
শিল্পীই পারেন দেখার ভিতর দিয়ে না দেখার নান্দনিক অনুভবকে ধারণ করতে। শিল্পী
বলেই পারেন দেখার ভিতর দিয়ে না দেখাকে রচনা করতে। শিল্পীই
পারেন তাঁর সৃজনশীল ক্ষমতার ভিতর দিয়ে নানাভাবে নিজেকে সৌন্দর্যরসে সিক্ত করতে।
কারণ শিল্পীর মন বহুচারী। একনিষ্ঠতার সাথে সৌন্দর্যকে অনুভব করার ভিতর দিয়ে
সৃষ্টি হয় কূপমণ্ডূকতা। বহুচারিতার মধ্য দিয়ে পাওয়া যায় মুক্তির স্বাধীনতা,
পাওয়া যায় সুন্দরের প্রবাহে সৌন্দর্য-অবগাহনের স্বাদ। সৌন্দর্যের অতল আহ্বানে
সাড়া দিতে হলে, বহুগামী হতেই হয়। একনিষ্ঠ কোনো সঙ্গীত সাধকের নিজের ঘর হতে পারে
ধ্রুপদ। তাই বলে পাশের বাউলের ঘরে তার অধিকার থাকতে পারে না, এমন জোর জবরদস্তি
শিল্পাঙ্গনে চলে না। এ অঙ্গনে পরকীয়াই নিষিদ্ধ শব্দ। শিল্পজগতে সত্য-সুন্দরের
সঙ্গমে ব্যভিচার বলে কিছু নেই। এজগতে বহুগামিতাই দিতে পারে সত্য-সুন্দরের
সন্ধান। সৌন্দর্যের তুলনামূলক দর্শনের ভিতর দিয়ে শিল্পীর সত্তার বিকাশ ঘটে। পরম
সত্য-সুন্দরের ভিতর দিয়ে চলে উত্তোরণের খেলা, এর ভিতর দিয়ে রচিত হয় পরমেশ্বরের
পথে অভিযাত্রা।
বহুগামিতার বহুদর্শনে সৌন্দর্য-অনুভবে ঘটে রূপান্তর। আর না রূপের ভিতরে দিয়ে
সুন্দরের সত্যরূপ উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। তাই সত্য-সুন্দরকে উপলব্ধির জন্য বহুদিক
থেকে দেখাটা জরুরি। আমাদের আটপৌরে জীবনের সাদা চোখে দেখাটাই ভালো করে হয়ে উঠে
না। তাই সৌন্দর্য-সন্দর্শনের তৃতীয় নয়ন উন্মীলিত হয় না। তাই দেখার আড়ালে ঢাকা
পড়ে যায় না-দেখাটা।
আমাদের চারপাশের সাদা চোখে দেখা জগতের সবদিকে ছড়িয়ে রয়েছে কত না প্রাকৃতিক
দৃশ্য। রয়েছে চলমান জীবনের ঘটনাপ্রবাহ, কত না শিল্পকর্ম। সাদাচোখে সে সবের দিকে
আমরা শুধুই তাকাই, দেখাটা ঠিক হয়ে ওঠে না। বা দেখতে চাই না। বহুদিনের এই
না-দেখার অভ্যাসটা এতটা গভীরভাবে আমাদের চোখ ঢেকে দিয়েছে যে, অনেক সময় দেখিয়ে
দিলেও সহজে দেখা হয়ে উঠে না। বেশ কিছুদিন আগে একটি সহাস্য মুখ দেখেছিলাম ছবিতে।
প্রথম দেখায়, মনে এক ধরনের স্নিগ্ধ অনুভব জেগে উঠেছিল। এই রূপের আড়ালে যে আরও
একটি রূপ রয়েছে, তা দেখিয়ে না দেওয়ার আগে বুঝতে পারি নি। প্রথম ছবিকে ১৮০
ডিগ্রি ঘুরিয়ে দেখার পর দেখা গেল সেই অন্য রূপ।
|
|
প্রথম ছবি |
১৮০ ডিগ্রি ঘুরানো ছবি |
আমরা অনেক সময় প্রতারিত হয়ে আক্ষেপ করি। ভাবি, এই ভাবে যদি সব কিছু ঠিকঠাক ঘুরিয়ে দেখতে পেতাম তাহলে হয়তো আক্ষেপটা কম হতো। উদাহরণ হিসেবে, এই ছবি দুটির মতো যে কোনো বিষয়ের সত্য ও সুন্দরকে যদি উপলব্ধির করতে পারতাম, তা কতই ভালো হতো। কিন্তু দেখতে চাইলেও কি সব সময় ঠিক ঠিক দেখাটা ঠিকভাবে হয়। এর জন্য প্রয়োজন গভীর পর্যবেক্ষণ। পর্যবেক্ষণের অভাবে আমাদের চোখে অনেক সময় বিভ্রমের সৃষ্টি হয়। এই বিভ্রম থেকে বেড়িয়ে না এলে, কখনোই সত্যকে উপলব্ধি করা যাবে না। আর একবার বিভ্রম থেকে বেড়িয়ে এলে, নিজের বিভ্রম উপলব্ধি করে চমৎকৃত হতে পারি কিম্বা নিজেকে গাধা শ্রেণির ভাবতে পারি। তাতে কিছুই আসে যায় না। এর দ্বারা নিজের দেখার প্রসারতা বড়বে বই কমবে না। ছবি দিয়ে আর একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
এই ছবি দেখে প্রথমেই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, রাস্তায় বেরুলে, অন্য গাড়ির ধাক্কায় বোতলের মুখটা ভেঙে যাবে না তো। না, একদম তা হবে না। কারণ, এটা গাড়ি গায়ে লাগানো পোস্টার মাত্র। এমন অনেক দৃশ্য হতে পারে, যা অনবরত বিভ্রম জাগাতে পারে। যতবার ছবিটির দিকে তাকাবেন, ততবারই আপনি বিভ্রান্ত হবেন। এই জাতীয় বিভ্রম মানুষ উপভোগ করে এবং আনন্দ পায় এবং অন্যকে দেখিয়ে আনন্দটা ভাগ করে নেয়। উদাহরণ স্বরূপ চৌকো ঘর দিয়ে আঁকা একটি ছবি দেখা যাক।
একটি চেষ্টা করলেই দেখবেন, ছবিতে বেশ
কয়েকটি সম্পূর্ণ বৃত্ত আছে। ধাঁধাঁর ছবি হিসেব বৃ্ত্তের সংখ্যা উল্লেখ করলাম
না। নিজেরাই উদ্ধার করুন- এবং উদ্ধারের আনন্দ উপভোগ করুন। দৃষ্টি বিভ্রমের মতো
দর্শন বিভ্রম ঘটে যখন একটি শব্দ শুনে অন্য শব্দ মনে হয়। একই ভাবে অন্য আস্বাদ,
স্পর্শ, ঘ্রাণেরও বিভ্রম ঘটে থাকে। অনেক সময় সবগুলো মিলেমিশেও মিশ্র বিভ্রম
ঘটে।
সত্যালোক ও অন্ধত্বের তমসা
সত্য যদি আলো হয়, অসত্য হবে অন্ধকার। এ অন্ধত্ব শুধু চোখের নয়, হতে পারে মনের
অন্ধত্ব, বুদ্ধির অন্ধত্ব, বোধের অন্ধত্ব। সত্য যখন অন্ধত্বের গভীর তলে ডুবে
থাকে, আনন্দ তখন রাহুগ্রস্তের মতো নিষ্প্রভ হয়ে যায়। সব মিলিয়ে সৌন্দর্য
স্বমহিমায় প্রকাশিত হতে পারে না। তাই সবার আগে দরকার ভালোভাবে উপলব্ধি করা। সহজ
কথায় বলতে পারি ভালোভাবে দেখা।
মানুষের জ্ঞানার্জনের প্রধান অন্তরায়
হলো- পূর্বজ্ঞান। অনেক সময়ই পূর্বজ্ঞান, নতুন জ্ঞানের পথে অগ্রসর হতে দেয় না।
ফলে মানুষ নিজেই পূর্বজ্ঞানের একটি বলয়ের ভিতরে আটকে যায়। মূলত পূর্বজ্ঞান হলো
জ্ঞানের একটি সসীম স্তর, কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানের রাজ্য অসীম। পূর্বজ্ঞান শেখায়
আমি জানি। আর অসীম জ্ঞান শেখায় 'আমি জানি না- আমি কী জানি'।
পূর্বজ্ঞানের একটি অংশ মানুষের ভিতরে সক্রিয় থাকে মনের উপরিতলে। এই অংশ দিয়ে
মানুষ নতুন জ্ঞানকে নিয়ে ভাবে। পূর্বজ্ঞানের অপর অংশ থাকে অবচেতন মনে। এই অংশ
মানুষের ভাবনাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। কখনো ভয় দেখায়, কখনো আশ্বস্ত করে, কখনো
এড়িয়ে যেতে বলে।
প্রাপ্ত মনস্ক মানুষের কিছু না কিছু বিষয় জানা থাকে। এটা তার পূর্বজ্ঞান। এই
পূর্বজ্ঞানের আলোকে যে যখন নতুন কিছু জানতে চায়, তখনই সে অন্ধলোকে পা রাখে।
একে বলা যায় জ্ঞানচর্চার প্রথম স্তর।
প্রথম স্তরের চিন্তা: মানুষের
নবতর জ্ঞানচর্চার প্রথম স্তরের ভাবনা হলো 'আমি জানি না- আমি কী জানি'। এই
ভাবনার উদয় হওয়া মাত্র মানুষ অন্ধলোকে প্রবেশ করবে। ধরা যাক, একজন সঙ্গীত
শিল্পীকে হঠাৎ কোনো আসরে গান গাইতে বলা হলো। সে গান জানে এটা তার
পূর্বজ্ঞান। নতুন আসরে কি গাইবে সেটা বুঝে উঠতে পারে নি বলেই সেটা তার
অন্ধলোক। এরূপ নতুন পরিস্থিতিতে মানুষ প্রতিনিয়ত অন্ধলোকের অভিজ্ঞতা লাভ
করে। এর ভিতর দিয়ে এক ধরনের নেতিবাচক জ্ঞানের উদ্ভব হয়। এই পর্যায়ে সে
না-জানার জগতে প্রবেশ করতে পারে বা জেনে কাজ নেই মনে করে, নিজেকে
প্রত্যখ্যান করতে পারে। যদি সে না-জানার জগতে প্রবেশ করতে চায়, তাহলেই সে
জ্ঞানার্জনের দ্বিতীয় ধাপে পা রাখার যোগ্যতা লাভ করবে।
দ্বিতীয় স্তরের চিন্তা: দ্বিতীয় স্তরে এসে মানুষ নিজের কাছে প্রশ্ন করে জেনে নেবে, সে কি জানে বা জানে না। উদাহরণ হিসেবে আগের সঙ্গীতশিল্পীকে ধরে আনা যাক। প্রথম স্তরে সে ছিল, 'কি গান করবে, সে তা জানে না' স্তরে। তারপরেও শিল্পী গান গাইতে রাজি হয়ে গেল। এবার সে ভাববে কোন গানগুলো সে জানে। এর ভিতর দিয়ে শিল্পী জানতে পারবে, ''আমি জানি, আমি কী জানি না'। এরপর সে তার জানা গানের তালিকা থেকে একটি গান বাছাই করে গাইবে। একটি গান গাওয়ার পর, শ্রোতার কোনো বিশেষ গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করবে। শিল্পী এবার তার ''আমি জানি, আমি কী জানি না' -সূত্রে বলবে এ গানটা আমি জানি না। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে জ্ঞানের পথ দুটি ধারায় চলতে পারে।
জানি না, জানার দরকার নেই।
জানি না, জানতে হবে।
'জানি না, জানতে হবে' এটা হলো অন্ধকার থেকে আলোর পথের যাত্রা। মানুষ যখন পূর্বজ্ঞানের আলোকে, নতুন জ্ঞানের দ্বারে এসে বলে 'আমি জানি না- আমি কী জানি', তখন সে থাকে অন্ধ। এরপর সে যখন বুঝতে পারে ''আমি জানি, আমি কী জানি না'। তখন সে আলোর পথ দেখে। কিন্তু যখন সে নিজের জানাকে বড় করে দেখার চেষ্টা করে, তখনই সে নতুন অন্ধকার জগত সৃষ্টি করে। জ্ঞানীর অন্ধত্ব ঘটতে পারে কয়েকটি কারণে।
১. আত্মাহঙ্কার: উদাহরণ
হিসেবে আগের সঙ্গীতশিল্পীকে আবার ধরে আনা যাক। এই শিল্পী বেশ কিছু টপ্পা
গান জানেন। এই অহঙ্কারে তিনি যদি আবদ্ধ হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি একটি সসীম
জ্ঞানের অধীনে চলে যাবেন। তিনি যদি ভাবেন টপ্পা তো জানিই, আর জানার কি আছে!
এই মনোভাব হবে তাঁর আত্মাহঙ্কারের দ্বারা পরিচালিত অন্ধত্বের দশা। কোনো
বিষয়ে যাঁরা কিছুটা খ্যাতি লাভ করেছেন, তাঁরা এই অন্ধত্বের শিকার হন। যে
শিল্পী ভাবেন আমি তো ভালো গাই, শ্রোতারাই তাঁকে নিতে পারছেন না। এই
পর্যায়ের অন্ধরা নিজের ভালো ছাড়া অন্যের ভালো বা অধিকতর ভালো দেখতে পান না।
জ্ঞানের অহঙ্কারে এই পর্যায়ে মানুষ নিজেই বুঝতে পারে না, সে অন্ধ। আর বলাই
বাহুল্য জ্ঞানই যেখানে অন্ধ, সেখানে নবতর আলোর প্রবেশ ঘটে না।
২. প্রভাবিত অন্ধত্ব: মানুষ নানাভাবে প্রভাবিত হয়। এর ভিতরে একটি
বিশেষ প্রভাব হলো- নিজের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া। মূলত পূর্বজ্ঞান এতে বিশেষ
ভূমিকা রাখে। পূর্বজ্ঞানের প্রভাবে মানুষের মনের ভিতরে এক ধরনের সরল ও সহজ
প্রক্রিয়া সচল থাকে। নতুন পরিস্থিতে সে এই সরল উপায়টা প্রয়োগ করে থাকে।
এক্ষেত্রে পূর্বজ্ঞানের সুফলতার কিছু অভিজ্ঞতা যদি থাকে, তাহলে সে নতুন
পরিস্থিতিতে তা প্রয়োগ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠে। নতুনভাবে না ভাবার কারণে
বা অন্যভাবে না ভাবার কারণে, সে প্রতারিত হয়। এর বড়ো উদাহরণ হলো- ধাঁধাঁ।
ধাঁধার খেলায় মানুষ যখন উত্তর খোঁজে, তখন সে তার পূর্বজ্ঞানকে অবলম্বন করে
সরল পথে চলতে চায়। ফলে অন্যভাবে ভাবার পথ রুদ্ধ হয়ে থাকে। যখনই সে
ভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করে, তখনই রহস্যের দরজা খুলে যায়।
প্রভাবিত অন্ধত্বের মূলে যে বিভ্রমের সৃষ্টি হয়, তার পিছনে বাড়তি উপকরণ
অনেক সময় দায়ী থাকে। এই উপকরণগুলো সাংকেতিক হতে পারে, অথবা বুঝে উঠতে না
পারার কারণে সহজ বিষয়টি সাংকেতিক মনে হয়। মূল উপকরণ এবং বাড়তি উপকরণ কিভাবে
বিভ্রান্ত করে, তার একটা নমুনা দেখা যাক। প্রথমে নিচের ছবিটি দেখুন।
এই ছবির প্রতিটি অনুভূমিক রেখা সমান। কিন্তু কোনোটি বড় কোনোটি ছোটো মনে হচ্ছে। এটি হচ্ছে বিখ্যাত মুলার-লায়ার বিভ্রম (Müller-Lyer illusion)। প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক জাঁ-পল সাত্রে এই বিভ্রমের কারণ হিসেব চক্ষুসঞ্চালনকে দায়ি করেছেন। তাঁর মতে, আমরা যখন কোনো রেখা দেখি, তখন তার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত দৃষ্টিকে সঞ্চালিত করি। প্রথম রেখাটি '< >' দ্বারা আবদ্ধ। এ ক্ষেত্রে রেখার উভয় প্রান্তের পরে আর দৃষ্টি সঞ্চালিত হয় না। ফলে একটি দেখার সীমা তৈরি হয়। কিন্তু পরের রেখার সাথে রয়েছে '> <' রেখাদ্বয়। এক্ষেত্রে আমরা মূল রেখার বাইরে গিয়ে > থেকে দেখা শুরু করি এবং শেষ করি মূল রেখা ছাড়িয়ে < পর্যন্ত। ফলে দৃষ্টি সঞ্চালন বিস্তৃত হয়। এই বিস্তৃত দৃষ্টি মূল রেখার সাথে যুক্ত হয়ে যায় এবং মূল রেখাকে বড় মনে হয়। তৃতীয় রেখাটির ডান দিকে আছে <। এর দ্বারা দৃষ্টি প্রথমেই ডান দিকে সঞ্চালিত হয়। ফলে এই রেখার শুরুটা মনে হয় দ্বিতীয় রেখার সমান। কারণ উভয় রেখার শুরু < দিয়ে। কিন্তু তৃতীয় রেখার বাম পাশে রয়েছে < । তাই রেখার এই প্রান্ত প্রথম রেখা বরাবর মনে হয়ে। মূলত তিনটি রেখার দৈর্ঘ্য যে একই, তা নিচের দুটি প্রান্ত পরিমাপক দিয়ে দেখানো হয়েছে।
দৃষ্টি বিভ্রমই হোক বা শ্রবণ-বিভ্রমই হোক, মূল কথা আমাদের মনে যত অনুভূতিই সঞ্চারিত হোক না কেন, তার সবই সত্যাশ্রয়ী হয়ে ধরা পড়ে না। আমাদের দেখার মধ্যে আছে 'যা আছে, তাই' এবং 'যা নাই, তাও'। আরও আছে, 'আছে ও নাই'-এর সংমিশ্রণ। সবই যেন 'দেখা না দেখায় মেশা'।
জ্ঞানের সীমা
জানার জগৎ অসীম কিন্তু জ্ঞানের জগৎ সসীম। জানার চেয়ে অজানা বেশি বলেই জানার
জগৎ অসীম। আর এর বেশির ভাগ অংশ জানা হয়ে উঠে নাই বলেই জ্ঞানের জগৎ সসীম। তাহলেও
প্রশ্ন জেগে উঠে জ্ঞানের সীমাটা কোথায়। বিষয়টা নির্ভর করে ব্যক্তিবিশেষের জানার
ক্ষেত্রের উপর। তাই প্রতিটি মানুষ নিজেকে প্রশ্নোত্তরের মধ্য দিয়ে তার জ্ঞানের
সীমা নির্ধারণ করে নিতে পারে। যেমন-
প্রশ্ন: পানির
রাসায়নিক উপাদান কি?
উত্তর: 'হাইড্রোজেন' ও 'অক্সিজেন'
প্রশ্ন:
হাইড্রোজোনের উপাদান কি?
উত্তর: প্রোটন ও ইলেক্ট্রন?
প্রশ্ন: প্রোটনের
উপাদান কি?
উত্তর: তিনটি
কোয়ার্ক কণা।
প্রশ্ন: কোয়ার্কের উপাদান কি?
উত্তর: জানি না।
এই জানি না হলো কণা বিষয়ে ওই ছাত্রের জানার শেষ সীমা। আবার ওই ছাত্রটিকে যদি সঙ্গীত, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে পরীক্ষা নেওয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে, ক্ষেত্র বিশেষে জানার সীমার হেরফের ঘটছে। জ্ঞানকে কোনি বৃ্ত্তের কেন্দ্রবিন্দু ধরে যদি জানার বিন্দুগুলো আঁকা যায়, তাহলে সেই বৃত্তের পরিধি নিখুত বক্র হবে না। এর প্রকৃতি হবে- অনেকটা নিজের চিত্রের মতো।
মনোজগত যদি সাগর হিসেবে বিবেচনা করা যায়, তাহলে জ্ঞানের রূপ হবে এ্যামিবার মতো। কার্যকারণে এর রূপের পরিবর্তন ঘটে চলেছে। আমাদের চলমান জগতে প্রতিনিয়ত যা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জানাটা হয়ে যাচ্ছে, সেটাই এই বুদ্ধির এ্যামিবার বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে, অবয়বগত পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। গানে শুনেছি, 'মনের হদিস কেউ জানে না, সেও জানে না যে ধারণ করে'। এ কথা জ্ঞানের ক্ষেত্রেও সত্য।
রূপসী বাংলার কবি
জীবনানন্দ দাশ
যখন বলেন- 'বাংলার
মুখ আমি দেখিয়াছি,
তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর...'।
তখন তার ভিতরে সৌন্দর্যপিপাসু আত্মমগ্ন কবির মুগ্ধতা। বাংলার রূপদর্শনে
নিমগ্ন কবির এই আত্মমগ্নতাকে প্রণাম করে যখন বিশ্বরূপের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত
করি, তখন পরম বিস্ময়ে বিস্মৃত হয়ে যাই স্বদেশ-বিদেশ-সন্দর্শনে। এসবের কিছু আছে
একেবারেই না দেখা, কিছু আছে দেখার ভিতরে না দেখা। আমি শ্রাবণের অঝোর ধারায়
খালের জলে সোনা ব্যাঙের উল্লাস দেখেছি, কিন্তু পানামার সোনালি ব্যাঙের উচ্ছ্বাস
দেখা হয় নি। আমি শরতের নীলাভ আকাশের ছায়া আর কাশফুলের শ্বেত-নির্মাল্য দেখেছি
পদ্মার জলে। দেখা হয় নি, কুয়াশার চাদর সরিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা, কিম্বা রৌদ্রদগ্ধ
মরুভূমির বালিয়াড়ির ঝিকিমিকি। এমনি কত কী, এমন কী ' একটি ধানের
শীষের উপর/একটি শিশির বিন্দু'। এমনি করে কেটে যায় আমাদের দেখা-না-দেখায় মেশা
জীবন। প্রত্যক্ষ দর্শনের অপরাঙ্মতা অনেক সময় আমাদের কাছে আক্ষেপের হয়ে ওঠে,
কিন্তু দেখার ভিতর দিয়ে না-দেখার আক্ষেপও কখনো কখনো আরও তীব্রতর হয়ে উঠে। এ
আক্ষেপ কি শুধুই রবীন্দ্রনাথের? আমাদের নয় কেন? এ প্রশ্নও জাগে, একি শুধুই
আক্ষেপের, আত্মপ্রবঞ্চনার নয়। আবার অনেক সময় দেখার
এই অতৃপ্ততা থেকে, কিম্বা দেখার বিবমিশা থেকে অনেক সময় মনে হয়- দেখার চেয়ে
না-দেখাটাই ভালো ছিল।
দ্বান্দ্বিক ও প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য স্তর
আদি
মানুষের ভিতরে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে মনের আদিম স্তর সৃষ্টি হয়েছিল। মনোবিজ্ঞানীরা একে বলেন ইউ। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার্থেই এক সময় মানুষ অনুভব করেছিল,
নিজের দলের সদস্যকে হত্যা করা উচিত নয়। এর ফলে মানুষের মনের ভিতর অপরের প্রতি
হিংসার ভাব কমে এসেছিল। দলবদ্ধ জীবনযাপনে এক সময় এরা খাদ্য, বাসস্থান ভাগাভাগি
করার অভ্যাস গড়ে তুলেছিল। শিশুর প্রতি মমতাবোধ ছিল সহজাত। কিন্তু শিশু বড় হয়ে উঠলে,
তাদের বৃদ্ধ বয়সে বেঁচে থাকার অবলম্বন হবে, এ কারণটিও ছিল। মানুষের প্রতি মানুষের
মমত্ববোধ থেকে জন্ম নিয়েছিল বিবেক। মনোবিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন সুপার-ইগো। এই
দশার ভিতর দিয়ে মানুষ অতিক্রম করার মধ্য দিয়ে মানুষ উপলব্ধি করা শুরু করেছিল
উচিত-অনুচিতের আর একটি স্তর। আদিম মানুষের খাদ্য সঙ্কটের সময়, দলনেতা ভাবলো ইউ-এর
কারণে, সকল খাবার সেই খাবে। সুপার-ইগো বললো অন্যদের অভুক্ত রেখে নিজে সব খেয়ো না,
বরং নিজেই উপোষ থাকো। শুরু হলো উভয় বোধের ভিতরে দ্বন্দ্ব। এই সঙ্কট নিরসনের জন্য
উৎপত্তি হলো তৃতীয় সত্তা। এর নাম মনোবিজ্ঞানীরা দিয়েছেন ইগো। ইগো বললো− সকলের খাবার
একাই খেয়ো না, এবং নিজেও উপোষ থেকো না। বরং সবাই মিলে ভাগাভাগি করে খাও। মনের এই
কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রক 'আমি'। ইউ এবং সুপার-ইগো হলো মন আর ইগো হলো বিচারকর্তা
'আমি'।
এক সময় ইউ-ইগো-সুপারইগোর
দ্বন্দ্বের ভিতর সৃষ্টি হয়েছিল কিছু বিধি। এই বিধিতে অনেকেই হয়তো সন্তুষ্ট ছিল না।
কিন্তু যখন দেখলো এই বিধি তার নিজের জন্য কখনো কখনো উপকার বয়ে আনছে, তখন মানুষ বিধি
মানতে অভ্যস্ত হয়ে গেলো। এরই সূত্রে কালক্রমে তৈরি হলো পারিবারিক, সামাজিক এবং
রাষ্ট্রীয় আইন। এর ভিতর দিয়ে মানুষের সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করার মানসিক কাঠামো তৈরি
হয়ে গিয়েছিল।
ইউ-ইগো-সুপারইগোর দ্বন্দ্বের ভিতর সৃষ্টি হয়েছে মনের আরই একটি স্তর, তা হলো অবচেতন মন
(Sub-conscious mind)।
ইগো যখন ইউ এবং সুপারইগোর ইচ্ছাকে দমন করে মধ্যস্থতা করা শুরু করে, তখন উভয় সত্তার
ইচ্ছা অবদমিত হয়। এই ইচ্ছা সুপ্ত থাকে। মানুষের মনের তাৎক্ষণিক বিজয়ী ভাব প্রকাশিত
হয় তার কার্যকলাপের ভিতরে। কিন্তু পরাজিত ভাব সুপ্ত দশায় গিয়ে অপ্রকাশিত দশায়
থাকে। এর ফলে মনের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য স্তর তৈরি করে। অপ্রকাশ্যভাবের কথা
অনেক সময় প্রাত্যহিক নানারকম কাজের ভিতরে ভুলেও যায়। এই সুপ্ত ইচ্ছা কখনো কখনো আকস্মিকভাবে জেগে
উঠে। কখনো আকস্মিকভাবে জেগে উঠা সেই অনুভবে তাড়িত হয়ে এমন কিছু করে বা বলে, যা পরে
নিজের কাছেই অস্বস্তিকর বলে মনে হয়। মনো-চিকিৎসকদের কাছে 'অবচেতন মন'-এর
গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ অবচেতন মনকে পাঠ করতে পারলে, অনেক জটিল মানসিক রোগকে সারিয়ে
তোলা সম্ভব হয়।
সৃজনশীল জগতের স্তর: মানুষ প্রত্যহিক প্রত্যক্ষ কাজের যে ভিতর দিয়ে যা কিছু অনুভব করে, তা হয়ে উঠে মনোজগতের বাস্তব স্তরে। আর যখন সে কোনো শিল্পকর্ম সৃষ্টির জন্য উদ্যোগী হয়। তখন সে, মন কল্প-বাস্তব জগতের স্তরে অবস্থান করে। একে বলা যায় রসস্তর। আর মানুষ যখন শিল্পকর্মের ভিতরে গভীরভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করে এবং এর দ্বারা প্রভাবিত বা আবেশিত হয়ে ভাবের প্রকাশ ঘটায় তখন তা, ভাব রসোত্তীর্ণ স্তরে পৌঁছায়। এটি মনের তৃতীয় স্তর। এই বিষয়ে এই গ্রন্থের 'রস' অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে।
যে কোনো কারণে মনে যে বিশেষ অনুভবের জন্ম হয়, সেটাই হলো ভাব। বাস্তব জগতের থেকে যে মনোদশার জন্ম হয়, সেগুলো প্রত্যক্ষভাবের জন্ম দেয়। আর শিল্পজগতের যে ভাবের জন্ম হয়, তাই রস জগৎ। মানুষের মনের বাস্তব স্তর, রসস্তর এবং রসোত্তীর্ণ স্তর নিয়ে 'ভাব ও রস' অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।