১.১১
মন ও মনোজগৎ

স্বয়ম্ভূ আত্মার পরিচালক  অংশ হলো আমি। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সব কিছু 'আমি'র কাছে প্রকাশ পায়, 'আমি' সিদ্ধান্ত নেয় সে অনুভূতি অনুসারে কি করবে। 'আমি' ইচ্ছা করলো গান শুনবে বা শুনবে না। অর্থাৎ 'আমি'র মন নামক অংশে এই ইচ্ছা জাগ্রত হবে। এরূপ মনে নানা ধরনের ইচ্ছা জাগ্রত হতে পারে। এই ইচ্ছা কার্যকর করা উচিত কি অনুচিত মন তার ধার ধারে না। এই বিচারে মন স্বেচ্ছাচারী। কিন্তু 'আমি' স্বেচ্ছাচারী নয়। 'আমি'র ইচ্ছায় প্রাথমিকভাবে যে ভাবনাই জাগ্রত হোক না কেন, 'আমি' তা বিচার করতে বসে। এই বিচারে যে জয় যুক্ত হয়, 'আমি' তা-ই করে। ফলে মন দ্বৈত-সত্তার ভূমিকা নেয়। এক্ষেত্রে আমির ভূমিকা হয়ে উঠে আদালতের মতো। মনের স্বেচ্ছাচারী ভাবাবেগ এবং তাকে অভিজ্ঞতার আলোকে বিচার করার ইচ্ছা, উভয়ই একটি অখণ্ড মনের দুটি অংশ হিসেবে প্রকাশ পায়। 'আমি' মনের উভয় অংশ নিয়ে ভালোমন্দের তুলনামূলক বিচারে বসে।  'আমি'র ইচ্ছাতেই এই কার্যক্রম চলতে থাকে। ফলে  'আমি'র আর একটি ইচ্ছা আগের ইচ্ছার কাতারে এসে হাজির হয়। আবার সবশেষে 'আমি' কোনটি গ্রহণ করবে, তার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই সিদ্ধান্ত দ্বারা চালিত হয়। এর ফলে মনের আরও একটি অংশের সৃষ্টি হয়। এই কারণে মন বলে যে সত্তাকে উল্লেখ করা হয়, তা অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইচ্ছার সমন্বিত অখণ্ড অংশ হিসেবে উপস্থাপিত হয়। এই কারণে মন বড়ই জটিল। এক্ষেত্রে  'আমি'কে দক্ষ বিচারকের ভূমিকায় থাকতে হয়। কখনো কখনো মন সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। ফলে ইচ্ছা বা মনের অস্থিরতার ভিতর দিয়ে 'আমি' অসহায় হয়ে পড়ে। একটি 'আমি' অন্য কোনো 'আমি'র সাহায্য নিতে পারে। এটাও মনের অংশ হয়ে যায়। 'আমি' মস্তিষ্কের স্মৃতিভাণ্ডার থেকে অভিজ্ঞতাকে উত্তোলন করে। উল্লেখ্য 'আমি' যে স্মৃতি ভাণ্ডার থেকে অভিজ্ঞতা তুলে আনার ইচ্ছা করে, তাও মনের আর একটি অংশ। এক্ষেত্রে 'স্মৃতি' দুটি দশায় কাজ করে।

মানুষের বোধ, ধারণা, বিচার সিদ্ধান্ত ইত্যাদির সূত্রে তৈরি হয় মনোজগৎ। এই মনোজগতের রাজধানী মস্তিষ্ক। জৈবিক উপদান দিয়ে তৈরি স্থাপত্য উপকরণ। তাতে শক্তি জোগায় জৈবিক শক্তি। আর এই জগতের প্রশাসন বা পরিচালন কর্মকাণ্ড চলে স্বয়ম্ভূ আত্মার পরিচালক 'মন' দিয়ে। পরস্পরের সমন্বয়ে চলে মনোজগৎ।

যে দেহকে আশ্রয় করে মনোজগৎ গড়ে উঠে, তার সাথে যুক্ত থাকে জীবন ধারণের ভাবনা এবং একই সাথে জীবন-যাপনের ভাবনা। জীবন ধারণের জন্য মানুষকে নজর দিতে দেহের কলকব্জার দিকে। আর জীবন যাপনের হলো সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা। জীবন ধারণের জন্য
জীবনহরণকারী হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার, বৃক্কের অসুস্থতা সবই যেমন মনোজগতকে তাড়িত করে, তেমনি অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের মতো মৌলিক মানবিক চাহিদাগুলোও মনোজগৎকে ব্যস্ত রাখে। তাই মনের রোগ সারিয়ে তোলার জন্য মনিবিজ্ঞানীদের দেহের জীবন-ধারণের উপকরণগুলোর খবর রাখতে হয়। জীবন-ধারণের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত, কিন্তু পৃথক ভাবনা হলো জীবন-যাপন। হৃদযন্ত্রের বিকার নিয়ে চিকিৎসক ভাবেন জীবন-ধারণকে সচল রাখার জন্য, কিন্তু প্রেমিককে দেখে প্রেমিকার মনে যে সপ্রেম হৃদযন্ত্রে কম্পন জাগে, সেখানে শল্য চিকিৎসক নিরুপায়। হৃদ-কম্পনের এই রোগ জীবন-ধারণের অংশ নয়, জীবন-যাপনের অংশ। ব্যর্থ হৃদয়ে কেউ যখন জীবনধারণের আশা ত্যাগ করে আত্মহননের কথা ভাবেন, তখন তার চিকিৎসক হন মনোবিজ্ঞানী। এক্ষেত্রে মনোচিকিৎসককে সুন্দর জীবন-যাপনের ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে জীবন-ধারণের আশাকে উজ্জীবিত করেন। চিকিৎশাস্ত্রে বলা হয়, যে রোগী নিজে বাঁচতে চায় না, তাঁকে চিকিৎসার দ্বারা বাঁচানো যায় না। তাই যে কোনো বিভাগের চিকিৎসক, রোগীকে আশার বাণী শোনান। অনেক সময় মানবিক কারণেও অচিরেই নিশ্চিত মৃত্যু হবে জেনেও, চিকিৎসক সে কথা রোগীর কাছে গোপন রাখেন।

মনের ঘর বন্ধুর ঘর
মানুষ জন্মগত সূত্রে একক, কিন্তু বন্ধুসঙ্গমে বহু। এই বহুত্বই একক দুর্বল মানুষকে সবল করে। মানুষের যা কিছু, তার সবটুকই মহ হয়ে উঠে, যদি সে আপন হতে বাইরে এসে দাঁড়াতে পারে, সবাইকে আপন করে নিতে পারে। যিনি সবাইকে আপন করে নিয়ে সবার ভিতরে এসে দাঁড়াতে পারেন, তিনিই মহৎ বন্ধু হতে পারেন। মানুষ দুটি হাত নিয়ে জন্ম নেয়, কিন্তু যত তার বন্ধু বাড়ে, তার হাতের সংখ্যাও ততটাই বাড়ে। আর যত হাত বাড়ে তার ক্ষমতাও ততটাই বাড়ে।

মানুষের মনোজগৎ হলো একটি মুক্ত প্রান্তরের মতো। সে প্রান্তরে আনন্দ-বেদনার লীলা চলেছে প্রতিনিয়ত। সেখানে জন্ম নেয় অজস্র স্বপ্ন, অজস্র কামনা এবং সেই সাথে জন্ম নেয় অজস্র দ্বন্দ্ব। এতসব হট্টগোলের ভিতরে সেই মনের এক কোণে একটি ক্ষুদ্র ঘর তৈরি হয়। সে ঘর নিতান্তই নিজের ঘর। সে ঘরের অনেক গোপন কথা। সে এমনই গোপন, যে কাউকে বলা যায় না। প্রতিটি মানুষ সে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকে। এই ঘরের সত্ত্বার সাথে অন্য কারো বন্ধুত্ব হয় না। সে ঘরের মানুষ বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসবাসকারী সঙ্গহীন, সঙ্গীহীন।

মানব শিশুর বুদ্ধির উন্মেষলগ্নে এই ঘরটি থাকে না। তাই শিশু অকপট, শিশু সকলের বন্ধু হয়ে ওঠে। যখন একটু একটু করে বাইরের জগতের সাথে তার পরিচয় ঘটতে থাকে, তখন তার ভিতরে স্বতন্ত্র সত্তা জেগে উঠতে থাকে। সে বুঝতে থাকে, সে আলাদা, একটি একক সত্তা। এর কিছুটা সে তার সহজাত বোধ থেকে জানে, কিছুটা বার বার বলে বা দেখিয়ে বড়রা জানিয়ে দেয়। এরই ভিতর দিয়ে জন্ম নেয় মনের কোণের লুকানো সত্তা। প্রাথমিকভাবে একই সাথে জন্ম নেয় আরও দুটি আবরণ। এর একটিতে থাকে এমন কিছু কথা, যা সে তার মা বা নিকটজনদের বলতে পারে, সবাইকে বলতে পারে না। এই দ্বিতীয় ঘরে এসে তার সৃষ্টি হয় গুটি কয়েক বন্ধু। ঘরের অবশিষ্ট যে ঘরটি থাকে, সে ঘরের কথা সবাইকে বলা যায়। সে ঘরের চারদিক খোলা, পৃথক কোনো দরজা জানালা নেই।

মানুষ বয়সে বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে, সে ছোট্ট ঘরকে কেন্দ্র করে বহু আবরণ তৈরি হতে থাকে। নিজের গড়া এসকল আবরণের আড়ালে শিশু ক্রমাগত তার সরলতা হারাতে থাকে। নানা ধরনের প্রতিপত্তিতে সে হয়ে উঠে আত্মকেন্দ্রিক বড় মানুষ। অর্থ, বংশ, জ্ঞান, বয়স ইত্যাদির দ্বারা আবরণটা হয়ে উঠে তার নিত্য সঙ্গী। এসকল সঙ্গীকে ভেঙে মানুষসঙ্গীকে বন্ধু হিসেবে পেতে হলে, নিজেকেই মেলে ধরতে হবে অকৃপণভাবে। রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর গানে বলেন- 'আপনারে দিয়ে রচিলি কি এ আপনারই আবরণ/খুলে দেখ্ দ্বার, অন্তরে তার আনন্দনিকেতন', তখন তিনি অহমিকার আবরণ ভেদ করে, জগতের আনন্দযজ্ঞে মিলিত হওয়ার কথাই বলেন।

বিচ্ছিন্ন দ্বীপের নিঃসঙ্গ মানুষ, যখন অপরের সাথে সেঁতুবন্ধ তৈরি করে, তখন তার অসংখ্য আবরণের একটিকে অপরের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। ওই একটি সেঁতু দিয়ে তাঁর বন্ধন ঘটে অন্যজনের সাথে। এই বন্ধনেই তৈরি হয় বন্ধুত্ব। এক্ষেত্রেও মানুষ অনেকটাই রক্ষণশীল। প্রথমে দেখে তার মনের সাথে অন্যের মনের মনের মিল কোথায়। যদি কোনো ক্ষেত্রে মিল খুঁজে পায়, তাহলে সেই বিশেষ ক্ষেত্রের আবরণ খুলে দেয়। ফলে দুটি মানুষের মধ্যে একটি সঙ্কীর্ণ সেঁতু তৈরি হয়। এক্ষেত্রে বন্ধুত্বও হয় স্বল্প পরিসরে। যার সাথে একাধিক বিষয়ে মনের মিল ঘটে, তার সাথে বন্ধুত্বের সেঁতু তৈরি হয় একটু বড় পরিসরে। সকল বিষয়ে মিল রয়েছে এমন দুজন মানুষের সন্ধান পাওয়াটা বিরল, তাই প্রকৃষ্ট বন্ধুত্বের নিদর্শনও বিরল।

হাত বাড়ালেই প্রকৃষ্ট বন্ধু নাই বা জোটে, চেষ্টা করলে ভালো বন্ধুর অভাব হয় না। এক্ষেত্রে নিজেকে আগে ভালো হতে হয়। এই ভালো হওয়াটার জন্য ঈশ্বরের মতো নির্মল হওয়ার প্রয়োজন নেই। এই ভালোটা হলো কল্যাণকর। কল্যাণকর ইচ্ছা বা বাসনা রয়েছে যার ভিতর, তাই ভালোবাসা। মনের সাথে মিল হলে যে সেঁতুবন্ধ তৈরি হয়, তার সাথে ভালোবাসা না থাকলে বন্ধুত্ব হয় না। এক্ষেত্রে ভালো বলতে বুঝানো হয়েছে শুভ, আর বাসা হলো বাসনা বা কামনা। যখন কারো প্রতি শুভ ইচ্ছা জেগে উঠে, তখনই সৃষ্টি হয় ভালোবাসা। এর ভিতরে প্রতিদানের বিষয় নেই। সম্ভবত মানুষের শ্রেষ্ঠ ভালোবাসার পাত্র হলো তার সন্তান। কল্যাণ কামনায় পিতাকে ভালোবাসা যায়, কিন্তু পরমপিতার জন্য একেবারেই নয়। কারণ, পরমপিতার কল্যাণ কামনা ঔদ্ধত্যের পর্যায়ে পড়ে।

ভালোবাসার অধিকারে যদি বন্ধুকে কিছু দিতেই হয়, তাহলে প্রতিদানের আশা না করেই দেবো। দেওয়া-নেওয়ার মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠে, বন্ধুত্ব হয় না। যদি বন্ধুর কাছে নিই, তাতে গ্লানি নেই। বন্ধুর কাছে যা পাবো তা বন্ধুত্ব, অন্যের কাছে যা নেবো, তা হবে কাঙালিপনা। যদি বন্ধুই হই, তা হলে না চাইতে তাকে দেবো। যদি বন্ধুর কাছ থেকে কিছু নিতেই হয়, তা বন্ধুত্বের জোরেই নেবো। বিনিময়ের মধ্য দিয়ে যে সহযোগিতা দেওয়া হয়, তা হলো পরিসেবা। প্রতিদানহীন যে সহযোগিতা তাই হলো সেবা। রোগীকে হাসপাতালে অর্থের বিনিময়ে সেবিকা যা দেন, সেটা তার পরিসেবা। ঘরের প্রিয়মানুষ যা দেন, সেটাই সেবা। পরিসেবা প্রচারে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেবা প্রতিষ্ঠিত হয় নিভৃতে। বন্ধুর জন্য সেবার হাত, অন্যের জন্য পরিসেবার হাত। সেবার লক্ষ্য আমাদের দক্ষিণ হাত হোক দাক্ষিণ্যে পূর্ণ। আমাদের সকল দক্ষিণ হাত মিলিত হোক সকলের দক্ষিণ হাতের সাথে।

যখন বন্ধুর জন্য হাত বাড়াবো, তখন মনের আবরণ ভেঙেই হাত বাড়াবো। গাড়ির উভয় পাশের চাকা সমান না হলে যেমন গাড়ি চালানো যায় না, উভয় মনের চাকা সমান না হলে, বন্ধুত্ব চলে না। বড়র পীড়িতি বালির বাঁধ, সেটা অর্থের হোক কিম্বা প্রতিপত্তির হোক। বড়র কাছে নিজেকে উচ্চতর করা যায় না, তাই বন্ধু্ত্ব হয় না। সে ক্ষেত্রে বড় যদি ছোটো হয়ে আসে, তা হলে বন্ধুত্বটা হতে পারে। কিন্তু বড় যদি পদে পদে মনে করিয়ে দেয়, আমি ছোটো হয়েছি করুণা করে; যদি মনে করে বন্ধু হও কিন্তু একটু মান্য করো। তাহলে, সত্যিকার বন্ধু হ্‌ওয়া হয়ে উঠে না।

বন্ধনের মধ্য দিয়ে নিজেকে উন্মুক্ত করবো বলেই হাত বাড়িয়েছি। যদি সম্মত হও, তা হলেই বন্ধু। বন্ধু যদি হও, থাকবো সকল কর্মযজ্ঞে পাশাপাশি; থাকবো সঙ্কটে, সম্পদে, সৌভাগ্যে, সাধনায়, ব্রতে। বন্ধু যদি হও, তাহলে জগতের কল্যাণে একীভূত হবো, প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো একসাথে। বন্ধু যদি হও সকল ত্রুটিকে স্বীকার করবো নিজের ত্রুটি মনে করে, বন্ধুর কৃতিত্বকে মনে করবো নিজের।

আমাদের নানা ধরনের সঙ্কট আছে। তার ভিতরে অন্যতম সঙ্কট হলো বন্ধুত্বের। কখনো কখনো কোনো কোনো বিষয়ে সমমনা মানুষ একত্রিত হয় বটে, প্রগাঢ় বন্ধুত্বের অভাবে ভাঙতে বেশি সময় লাগে না। তাই আমাদের অনেক মহৎ কর্মযজ্ঞের মধুর সমাপন ঘটে না। গঠনমূলক সমালোচনা যেমন কর্মযজ্ঞের ফললাভকে ত্বরান্বিত করে, স্বার্থন্বেষী কর্মকাণ্ড তেমনি কর্মযজ্ঞকে অসুরের মতো ধ্বংসও করে। বৃহৎকর্মকাণ্ড সম্পাদনে যেমন বন্ধুসভার দরকার, তেমনি সে কর্মকাণ্ড সচল রাখার জন্য বন্ধুসভা টিকিয়ে রাখারও দরকার।

রবীন্দ্রনাথ প্রতীক্ষায় ছিলেন তাঁর ঘরের চাবি ভেঙে, কে নিয়ে যাবে বাইরের আনন্দনিকেতনে। সে চাবি নামক বন্ধন-পদ্ধতিতে আমরা সবাই আপন ঘরে আবদ্ধ। কিন্তু আমাদের প্রতীজ্ঞা হওয়া উচিৎ, সহৃদয় বন্ধুর দেখা মেলে নি বলে, ঘরের কোণে বসে রইবো না। নিজের ঘরের চাবি নিজেই ভাঙবো, সবার রঙে রঙ মিশিয়ে মনের বিশাল আঙিনাকে রঙিন করে তুলবো। সে ক্ষমতা আমাদের আছে। শুধু দরকার নিজের ইচ্ছা এবং উদ্যোগ। হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে বন্ধু। আর বন্ধুসঙ্গমে সফল হয়ে উঠবে আমাদের সকল কর্মকাণ্ড।

মনের ঘরের খেলা
মানুষের মনোজগতের নানা দশা এবং নানা রূপের সূত্রে যে খেলা চলে, তার একদিকে রয়েছে বুদ্ধি অন্যদিকে ভাব। এই দুয়ের পৃথক উপস্থিতিতে বা সংমিশ্রণে মনোজগতের  বৈচিত্র্য প্রকাশ পায় বা বৈচিত্র্য ধৃত হয়। এই দুটি ধারার সূত্রে মনোজগৎকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো।

'আমি'র ঐচ্ছিক স্তর হলো মন। ইন্দ্রিয় বা দেহাভ্যন্তরীণ স্নায়ুবাহিত অনুভূতিগুলো 'আমি'র কাছে সমান মূল্য পায় না। নানাবিধ তথ্যের ভিতর থেকে কোনটিকে কি মর্যাদা দেব, তা নির্ধারণ করে 'আমি'। রাস্তায় দাঁড়িয়ে যখন বন্ধুর সাথে কেউ কথা বলবে, তখন রাস্তার সকল কোলাহলকে উপেক্ষা করে বন্ধুর কথার মর্যাদা দেবে। কাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে, আর কাকে নয়, সেটাই 'আমি' নির্ধারণ করে। এই নির্ধারণে মনের ইচ্ছা কখনো কখনো পূরণ হয়, কখনো অবদমিত হয়। আদি মানুষের মন জটিল ছিল না। ক্রমবিবর্তনের ধারায় মনের রূপ জটিল থেকে জটিলতর হয়ে গেছে। আধুনিক মানুষের বিচারে আদি মানুষের ভিতর নীতিবোধ ছিল অত্যন্ত দুর্বল। তখন ছিল শুধুই টিকে থাকার সংগ্রাম। এরা খাদ্যের জন্য, নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য, যৌনাচারের জন্য নিজেদের মধ্যে লড়াই করতো। দৈহিকভাবে সবলরাই এই লড়াইয়ে জয়ী হতো। হয়তো দুর্বলদের জন্য সবলদের করুণাও ছিল না। মনোবিজ্ঞানীর মানুষের ভাবের এই জগতকে নানা দিক থেকে বিভিন্ন স্তরে ভাগ করেছেন। যেমন- মনের তথ্য নির্বাচন স্তর, মনের দ্বান্দ্বিক স্তর, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য স্তর, সৃজনশীল স্তর।

যে কোনো কারণে মনে যে বিশেষ অনুভবের জন্ম হয়, সেটাই হলো ভাব। বাস্তব জগতের থেকে যে মনোদশার জন্ম হয়, সেগুলো প্রত্যক্ষভাবের জন্ম দেয়। আর শিল্পজগতের যে ভাবের জন্ম হয়, তাই রস জগৎ। মানুষের মনের বাস্তব স্তর, রসস্তর এবং রসোত্তীর্ণ স্তর নিয়ে 'ভাব ও রস' অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।