অলঙ্কার ও অলঙ্করণ

সাধারণ ভাবে বৈদিক শব্দ অলম্ -এর অর্থ হলো ভূষণ বা শোভিতকরণ। আর অলঙ্করণ হলো, যার দ্বারা শোভিত করা হয়। অর্থাৎ যা সজ্জার উপকরণ, তাই অলঙ্কার। কিন্তু শিল্পজগতে অলঙ্করণ শব্দটি ব্যবহৃত হয়, অলঙ্কার দ্বারা সজ্জিত করার প্রক্রিয়া।

প্রতিটি সত্তার নিজস্ব রূপ আছে। উল্লেখ্য, সত্তার রূপ সম্পর্কে 'বোধ ও রূপ' অংশে আলোচনা করা হয়েছে। তাই এখানে এ বিষয়ে নতুন করে আলোচনা করা হলো না। রূপ থেকে যখন  'আমি' আনন্দ লাভ করতে চায়। তখন তার ভিতরে আরও আনন্দ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। 'আমি' অনুভব করে, যা আছে, তাকে আরও আনন্দময় কিভাবে করা যায়। একজন শিল্পী তাঁর নিজের অনুভূতির ভিতর দিয়ে তার ভাবনাকে সম্প্রসারিত করতে গিয়ে লক্ষ্য করেন, যা আছে তার সাথে আরও কিছু যুক্ত করলে, আরও ভালো হয়। আর এই বোধ থেকেই তিনি কিছু বাড়তি উপকরণ যুক্ত করেন। শিল্পের জন্য এই বাড়তি উপকরণই হলো অলঙ্কার। আর অলঙ্কৃত করার এই প্রক্রিয়াটিই হলো অলঙ্করণ।

অলঙ্করণের উপকরণ
কিন্তু মানুষ শুধু শিল্পের জন্য সাজে না। জীবনের চলার পথে নানা কারণে, নানাভাবে মানুষ সৌন্দর্যের সেবার জন্য অলঙ্কারের আশ্রয় নেয়। মানুষের প্রথম প্রচেষ্টা হলো নিজেকে টিকিয়ে রাখা। বাঁচার প্রচেষ্টার প্রাথমিক স্তর পেরিয়ে, মানুষ যখন কিছুটা নিরাপদ বোধ করে, তখন সে জীবনকে সাজাতে চায়। এক্ষেত্রে শিল্পের মূল কাঠামোর সাথে বাড়তি কিছু যোগ করে সৌন্দর্য বৃদ্ধির চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এই বাড়তি যোগ করা সব কিছুই অলঙ্কার হয়ে হয়ে ওঠে না। একটি কিশোরী বিশেষ কৌশলে চুল বেঁধেছে, এটি অলঙ্করণের অংশ। কিন্তু চুল দেহের বাড়তি অংশ নয়, তাই চুল অলঙ্কার নয়। কিন্তু পরচুলা ব্যবহার করে খোঁপা করলে, পরচুলা অলঙ্কার হিসেবে বিবেচিত হবে।

অলঙ্কার মাত্রেই কোনো সত্তার মূল রূপকে অধিকতর সৌন্দর্যমণ্ডিত করার জন্য, বাড়তি কোনো উপকরণ। মূল সত্তা হতে পারে দেহ, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকর্ম ইত্যাদি। মাধ্যমভেদে অলঙ্কারের প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়। কোনো কোনো অলঙ্কার একাধিক মাধ্যমে ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন কোনো সুরশৈলী কোনো সুনির্দিষ্ট গানের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে, আবার ওই সুরশৈলী কোনো নাটকের আবহসঙ্গীতে ব্যবহৃত হতে পারে। কোনোটি আবার সুনির্দিষ্ট মাধ্যমের জন্যই ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন বাস্তব কানের ঝুমকো দেহের অলঙ্কারের জন্যই ব্যবহৃত হয়। সঙ্গীত, সাহিত্যে, ঝুমকো শব্দ হিসেবে একটি প্রতীকী রূপ হিসেবে থাকতে পারে। চিত্রকর্মে ঝুমকোর আদলটা গ্রহণ করা হয়। অবশ্য মূর্তির কানে সত্যিকার ঝুমকোও অনেক সময় ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে দেবীর রূপটা নারীর রূপেই থাকতে হয়। অলঙ্কার সার্থক হয়ে উঠে কোনো না কোনো রূপকে অবলম্বন করে।

সৌন্দর্য সৃষ্টিতে অলঙ্কার অনেকটা ব্লক হিসেবে কাজ করে। একটি কানের ঝুমকোর উপাদান হতে পারে স্বর্ণ, রৌপ্য, মাটি, প্লাস্টিক ইত্যাদি। উপাদান যাই হোক, একটি একক ব্লক হিসেবে ঝুমকো পৃথক সত্তা হিসেবে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়। সাজার সময় মুখমণ্ডলের বিভিন্ন অংশে নানা মাত্রায় নানা ধরনের রঙ মাখা হয়। এই রঙগুলো এটি অলঙ্করণে উপদান, কিন্তু অলঙ্কার নয়। কারণ, এক্ষেত্রে রঙ অলঙ্করণের উপাদান মাত্র। রঙের নিজস্ব কোনো রূপ আছে। সেরূপ আলাদাভাবে রঙই বটে। স্বর্ণ যেমন বিশেষ কৌশলে অলঙ্কার হয়ে উঠে। রঙ তেমনভাবে হয় না। রঙকে নির্ভর করতে হয়ে দৃশ্যমান কোনো মাধ্যমের উপরে। একই ভাবে ভাষা শিল্পের উপাদান। এর ক্ষুদ্র অন্তর্গত শব্দও শিল্পের উপদান। কিন্তু অলঙ্কার নয়। কিন্তু উপমা বা অনুপ্রাস অলঙ্কার। কোনো সত্তা অলঙ্কারের পরিণত হতে পারে দুটি প্রক্রিয়া।

অলঙ্কার দ্বারা শোভাবৃদ্ধির কাজ হলো অলঙ্করণ। কিম্বা বলা যায় অলঙ্করণের জন্য ব্যবহৃত উপকরণ হলো অলঙ্কার। অলঙ্করণের মূল বিষয় হলো সৌন্দর্যবৃদ্ধিকরণ। তাই অলঙ্করণের প্রভু হলো সৌন্দর্য, আর অলঙ্কার হলো তার অনুগত দাস। সৌন্দর্যের দাবিতে অলঙ্কার রূপ পাল্টায়, অবস্থান পাল্টায়, বিশেষক্ষেত্রে বাতিলও হয়ে যায়। বিষয়টা নির্ভর করে শিল্পীর 'আমি'র ইচ্ছার উপর। ফরমায়েসী শিল্পকর্মে অবশ্য শিল্পীর দাবী অনেক সময় মর্যাদা পায় না। অবশ্য সেক্ষেত্রে ফরমায়েসকারী নিজেই শিল্পী হয়ে উঠেন। তাই অলঙ্কার নির্বাচন, ব্যবহারের ক্ষেত্র, ব্যবহারে পরিমিতি বোধ, এসবই একটি আপেক্ষিক দশায় থাকে। ফলে নানাজনের নান্দনিক বোধের বিচারে অলঙ্করণের হেরফের হয়ে যায়। একই অলঙ্করণ দিয়ে সবাইকে সন্তুষ্ট করা যায় না। অনেক সময় একই অলঙ্করণ অনেকের নান্দনিক রুচির সাথে মিলে যায়, কিন্তু সবার সাথে মিলবেই এমনটা জোর দিয়ে বলা যায় না।

সৃজনশীল কর্মের নান্দনিক প্রকাশের সূত্রে অলঙ্করণের সৃষ্টি হয়েছে। সৌন্দর্যহীন সৃজনশীল কর্ম শিল্প নয়। শিল্পী মাত্রেই তাঁর সৃজনশীল কাজকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করার চেষ্টা করেন। এর জন্য একটি প্রাথমিক রূপ তৈরি করতে হয়ে। এই প্রাথমিকরূপটি নানন্দিক হলেও তা অলঙ্কার নয়। যেমন একটি রাগের সাধারণভাবে রূপ ফুটিয়ে তোলার জন্য যে কাঠামো পাওয়া যায়, তাকে অলঙ্কার বলা যায় না। মূল কাঠামোর সাথে একটি গমক ব্যবহার করা হলো, সাধারণকাঠামোকে অলঙ্কৃত বা শোভিত করার জন্য। এক্ষেত্রে গমক হয়ে যাবে অলঙ্কার।

অলঙ্করণের ক্রমধারা ও মাধ্যম
'আমি'র নিজের ঘর তার দেহ। দেহকে সাজানোর ভিতরে রয়েছে আত্মতৃপ্তি, আর অন্যকে দেখানোর আগ্রহ। অন্যকে দেখানোর জন্য, নিজ দেহের যে সাজসজ্জা রয়েছে, তার বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে বিপরীত লিঙ্গের কাউকে আকৃষ্ট করা। এর বাইরে রয়েছে নিজের রুচি, আর্থ-সামাজিক অবস্থান, শুধুই সাজার আনন্দ ইত্যাদি বিষয়। দেহের এই সাজসজ্জা হলো মানুষের প্রথম অলঙ্করণ-স্থান।

দেহের বাইরের নিকটতম জগৎ হলে বাড়ি। গ্রামীণ জীবনে বাড়ি বলতে বসবাসের জন্য সুনির্দিষ্ট ভূমি এবং এর প্রধান উপকরণ ঘর। ঘর ছেড়ে একটু মুক্তির স্বাদ পাওয়ার জন্য দরকার নিজস্ব খোলা পরিসর। এরই সূত্রে মানুষ ঘরের বাইরে একটু আঙিনা চায়। সামর্থ থাকলে, বাড়ির সাথে থাকে বাগান, পুকুর ইত্যাদি। মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলে গেলে, সে জায়গাটাকে সাজাতে চায়। আদিতে গ্রামীণ জীবনে বাড়ি সাজানোর উপকরণ ছিল প্রাকৃতিক উপাদান। ঘরের বাইরে ভিতরে নেপে মশৃণ করা, তাতে আল্পনা আঁকা। ঘর থেকে বের হলেই যে আঙিনাটুকু রয়েছে, সেখানে পালাপার্বণে আল্পনা আঁকা, ফুলের গাছ লাগানো কিম্বা ফুলের জন্য বাগান তৈরি করা।

ধ্বনিময় জগৎকে সাজানোর জন্য, সৃষ্টি করেছিল পাতার বাঁশি, নলখাগড়ার রিড, চামড়ায় ঢাকা তালযন্ত্র ইত্যাদি। আর জন্মসূত্রে পাওয়া কণ্ঠস্বরকে সাজিয়েছিল সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি দিয়ে। কালক্রমে ধ্বনিময় জগৎ রূপ করেছিল ধ্বনি-সঙ্গীত। দেহভঙ্গিমার নান্দনিক উপস্থাপনার ধারবাহিক উন্নয়নে সৃষ্টি হয়েছে নানাবিধ নৃত্য। সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে সঙ্গীতজগৎ। সঙ্গীত হলো জীবনকে সাজানোর একটি সাংস্কৃতিক অলঙ্কার। কিন্তু শাস্ত্র হিসেবে সঙ্গীতের প্রতিটি ধারায় আবার রয়েছে নিজস্ব অলঙ্কার। এই সূত্রে তৈরি হয়েছে নাচের অলঙ্কার, গানের অলঙ্কার, যন্ত্রসঙ্গীতের অলঙ্কার।

মানবসভ্যতার ক্রমোন্নয়নের ধারায় এক সময়, ঘরের অলঙ্করণ হয়ে উঠেছে চিত্র শিল্প, শব্দের অলঙ্করণ হয়েছে সুর-তালে গান, দেহের ভঙ্গিমা রূপলাভ করেছে নৃত্য। এই প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে ভাব বিনিময়ের সঙ্কেত কণ্ঠস্বরে ভর করে সৃষ্টি হয়েছিল ভাষা। আর সেই ভাষা থেকেই জন্ম নিয়েছে কাব্য ও কাব্য-সঙ্গীত। মানুষের টিকে থাকার বাইরে জীবন আনন্দের সজ্জায় সাজানোর জন্য যা কিছু যুক্ত করেছে, তার সবই অলঙ্কার। তাই সঙ্গীত, সাহিত্য, নৃত্য, কাব্য ইত্যাদি আর যা কিছু আছে, তার প্রত্যেকটিই বিষয় নিজেই অলঙ্কার। বাস্তবতার বিচারে এসব জীবনের অলঙ্কার। সৌন্দর্যতত্ত্বে আমরা শিল্পের যে অলঙ্কারের সন্ধান করি, তা অলঙ্কারের অলঙ্কার।

মানুষ নানাভবে জীবনক সাজাতে চায়, শোভিত করতে চায়।

এটি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তি আবার সক্রিয় হয়ে উঠে পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে। তাই দর্শন, শ্রবণ, ঘ্রাণ, স্পর্শন, আস্বাদন হলো অলঙ্করণের মূল মাধ্যম। ব্যবহারিক সৌন্দর্যজগতের প্রধান দুই মাধ্যম হলো দর্শন ও শ্রবণ। কারণ এই দুটি মাধ্যমের দ্বারাই বহুজনকে একই বিষয় দেখানো বা শুনানো যায়। ঘ্রাণ অনেক সময় এসবের সাথে বাড়তি উপকরণ হিসেবে থাকতে পারে নাও পারে। স্পর্শ এবং আস্বাদন অনেকটাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। প্রিয়ার স্পর্শ যতই নান্দনিক হোক, জনে জনে বিতরণের জন্য নয়। মায়ের হাতের রান্না ভালো বলে, জনে জনে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানোর ভিতর মায়ের কষ্ট বাড়ানো ছাড়া মহৎ কিছু নেই। বৈচিত্রের বিচারে দর্শনের ক্ষেত্রটি সবচেয়ে বড়। শ্রবণের জগৎ ছোটো হলেও অনেক সময়ই শ্রবণ দর্শন পরস্পরের সহায়ক বা পরিপূরক হয়ে উঠে।

শিল্পের বিচারে দর্শন ও শ্রবণ মাধ্যমের অলঙ্করণ



বহুবিধ এবং বিচিত্র শিল্পের জগতে অলঙ্কার অসীম। কখন কোথায় কোনটি যে অলঙ্কার হয়ে যাবে, তার সন্ধান কে দিতে পারে। সংশয় জাগতে পারে, 'সোনার হাতে সোনার কাঁকন কে কার অলঙ্কার?' ভাষা, চিত্র, সুর, তাল, দেহভঙ্গিমায় ইত্যাদির নানন্দনিক উপস্থাপনায় অলঙ্কার একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে অলঙ্কারশাস্ত্র নামে। নানাবিধ অলঙ্কারের ভিতরে কিছু অলঙ্কার নানা দেশে নানাভাবে সাংস্কৃতি ঐতিহ্যকে প্রকাশ করে। কিছু কাব্যালাঙ্কারে মতো কিছু অলঙ্কার পৃথক শাস্ত্রীয় রূপ লাভ করলেও, অধিকাংশ অলঙ্কার সাধারণ ব্যবহার্য্য উপকরণ হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকে। এমনকি অলঙ্কার বলতে প্রথমেই যে দেহসজ্জার উপকরণের কথা মনে উঠে সেটাই ঠিক শাস্ত্র হিসেবে আলোচনা হয় না। এই অধ্যায়ে কিছু প্রতিষ্ঠিত এবং প্রচলিত অলঙ্কার নিয়ে আলোচনা করবো। এই তালিকায় রয়েছে