৩.২.৪
বর্ণালঙ্কার ও সুরালঙ্কার
 

সঙ্গীতশাস্ত্রে স্বর হলো সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি যা কোনো সপ্তকের সুনির্দিষ্ট সদস্য। সপ্তক নামক সেটের আদ্যস্বর ষড়্‌জ। এই স্বরের বিচারে সপ্তকের অন্যান্য স্বর নির্ধারিত হয়ে থাকে। স্বর মনকে রঞ্চিত করে বলে এর অপর নাম বর্ণ। স্বর বা বর্ণের বিন্যাসে গড়ে উঠে বর্ণবিন্যাস। এই বর্ণবিন্যাসের অপর নাম বর্ণালঙ্কার। এই বর্ণালঙ্কার যখন কোনো সুরকাঠামোতে ব্যবহৃত হয়ে সুরকে অলঙ্কৃত করে, তখন  তাকে বলা হয় সুরালঙ্কার।

সঙ্গীতের বর্ণালঙ্কার এবং সুরালঙ্কার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় সম্পর্কে ধারণা থাকা উচিৎ। যেহেতু ধ্বনিময় সঙ্গীতের মূল উপাদান শব্দ। তাই ধ্বনি থেকেই এই বিষয়টি শুরু হতে পারে। এই গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে 'অনুভব ও সংবেদন' অংশে শব্দের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তাই এই অধ্যায়ে এই বিষয়ে আলোচনা করবো না। এই অধ্যায়ের আলোচিত বিষয় হবে, 'সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি নিয়ে। এর পর ধীরে ধীরে বর্ণালঙ্কার ও সুরালঙ্কার নিয়ে আলোচনা করবো।

সঙ্গীতোপযোগী শব্দ
সঙ্গীত জগতে শ্রবণযোগ্য সকল শব্দকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এর একটি হলো সঙ্গীতোপযোগী শব্দ, অপরটি কোলাহল।

কোনো বস্তু থেকে উৎপন্ন বা আগত শব্দ তরঙ্গ যখন একটি সুনির্দিষ্ট তরঙ্গ-প্রকৃতি অনুসরণ করে পর্যায়ক্রমিক প্রবহমানতায় বা সূত্রে অগ্রসর হয় এবং তা কোনো শ্রোতার শ্রবণেন্দ্রিয়কে উজ্জীবিত করে, তখন তাকে সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি বলা হয়। পক্ষান্তরে উৎপন্ন শব্দ যখন নানাবিধ তরঙ্গ তৈরি করে এবং পর্যায়ক্রমে শ্রোতার শ্রবণেন্দ্রিয়কে আঘাত করতে থাকে, তখন তাকে কোলাহল বলা হ। উল্লেখিত এখানে কোলাহল বলতে বুঝানো হয়েছে সঙ্গীত -অনুপযোগী শব্দ।


মূলত একটি নির্দিষ্ট প্রকৃতির শব্দ তরঙ্গ যখন একইভাবে শ্রোতার  শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছায়, তখন ওই শব্দ তরঙ্গ মস্তিষ্ককে নানা ধরনের শব্দ শ্রবণের বিড়ম্বনা থেকে মুক্ত রাখে। ফলে ওই শব্দ মানুষের কাছে সুখশ্রাব্য হয়ে উঠে। ক্রমাগত এই ধ্বনি শ্রবণের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে শ্রোতার মনে নান্দনিক অনুভূতির সৃষ্টি হয়। ফলে শ্রবণেন্দ্রিয়ের আনন্দপ্রদায়ক ওই ধ্বনি হয়ে উঠে সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি। অন্যদিকে যখন নানা রকমের শব্দতরঙ্গ পর্যায়ক্রমে শ্রবণেন্দ্রিয়কে আঘাত করতে থাকে, তখন ছোটো ছোটো ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির শব্দকে মস্তিষ্ক শনাক্ত করতে থাকে এবং সে সকল তরঙ্গের সমন্বয় করার সময় মস্তিষ্কে এক ধরনের অস্বস্তিকর অনুভূতি তৈরি হয়। মস্তিকের এই অস্বস্তিকর দশা থেকে জন্ম নেয় এক প্রকার সৌন্দর্যহীন অনুভব এবং তখন এই জাতীয় সকল শব্দতরঙ্গকে কোলাহলের পর্যায়ে ফেলা হয়।

 

সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিসমূহের দ্বারা যে সব সময় নান্দনিক অনুভূতি তৈরি হবে এমনটা বলা যাবে না। একটি বাদ্যযন্ত্র থেকে যদি এলোমেলোভাবে স্বর বাজানো যায়, তাহলে সঙ্গীতপযোগী ধ্বনিগুলো যদি মস্তিষ্কে অস্বস্তিকর অনুভূতি সৃষ্টি করে, তাহলে সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিগুলিই কোলাহল সৃষ্টি করবে। স্বরগুলোর প্রকৃতি অনুসারে পর্যাক্রমে বাজিয়ে যখন শ্রোতার মস্তিষ্কে সুখানুভূতির সৃষ্টি করবে, তখনই তা সঙ্গীতোপযোগী বাদনরীতির সৃষ্টি করবে।

 

বৈদ্যুতিক যন্ত্র চলার সময় বা লাটিমের দ্রুত ঘোরার সময়ে উৎপন্ন বোঁ জাতীয় শব্দ বা ধনুকের গুণ টেনে ছেড়ে দেওয়ার পর উৎপন্ন শব্দকে কেউ বাদ্যযন্ত্রের পর্যায়ে ফেলবেন না। কিন্তু এই জাতীয় শব্দ যদি সমতরঙ্গ তৈরি করে শ্রবণেন্দ্রিয়ে সুখানুভূতির সৃষ্টি করে, তবে তা সঙ্গীতোপযোগী সৃষ্টি করবে।

 

বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা যাই থাক, সঙ্গীতশাস্ত্রে শব্দের মূল্য বিচার করা হয় শ্রোতার সুখদায়ক বা আনন্দদায়ক অনুভূতি সাপেক্ষে। তাই সঙ্গীতোপযোগী শব্দের তরঙ্গভিত্তিক মূলসূত্র ছাড়াও আরও চারটি বিশেষ গুণকে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়। এই গুণ চারটি হলো- শব্দ-উচ্চতা (Loudness), তীব্রতা (Intensity), শব্দ-তীক্ষ্ণতা (Pitch) শব্দ-রঞ্জকতা (timbre) এর ভিতরে প্রথম তিনটি বিষয় সম্পর্কে এই গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে 'অনুভব ও সংবেদন' অংশে আলোচনা করা হয়েছে। সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনির প্রকৃতি বিচারে এই অংশের আলোচনা শুরু করবো শব্দ-রঞ্জকতা (timbre) থেকে।
 

সঙ্গীত শাস্ত্রে স্বর হলো সঙ্গীতোপযোগী এবং তা একটি স্বরসপ্তকের অংশ। স্বরসপ্তকের আদি স্বর ষড়্‌জকে স্থির ধরে অন্যান্য স্বর শনাক্ত করা হয়। নানা বিবর্তনের ধারায় সপ্তকের অন্তর্গত সকল সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনির দ্বাদশ সম-বিভাজন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। যদিও সাত স্বরকে প্রাধান্য দিয়ে 'সপ্তক' নামকরণ করা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে একটি সপ্তকে ১২টি স্বরকেই মান্য করা হয়। এর বাইরে অতিরিক্ত সকল সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিকে শ্রুতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

একাধিক স্বর মিলিত হয়ে সৃষ্টি হয় সুর। একাধিক স্বর মিলে সাধরণভাবে একটি সুরকাঠামো  তৈরি হয়। স্বরের নানারূপ বিন্যাস হতে পারে। এই কাঠামো হতে পারে একক সুরশৈলী, কিম্বা সাদামাটা সুর। 

সুরকাঠামোর ছোটো ছোটো সুরশৈলী, স্বরগুচ্ছ, বা সাধারণ কোন সুরকাঠামো মিলিত হয়ে বড় বড় সুরমালা তৈরি করে। একটি গানের সুর বা একটি উপস্থাপিত রাগ এই সুরমালাকেই উপস্থাপন করে। এর মূলে থাকে একটি সাধারণ রূপ। এই রূপটির সাথে অতিরিক্ত কোনো কিছু যুক্ত না করেই যা উপস্থাপন করা যায়।

এই সাধারণ রূপটি যেহেতু সঙ্গীতোপযোগ ধ্বনির সমন্বয়ে সাধারণ কোনো  সৌন্দর্যকে প্রকাশ করে, তাই সুরের কাঠামোর একটি স্বাভাবিক সৌন্দর্যগুণ থাকে। কিন্তু সুরকার এবং সঙ্গীতশিল্পী এই সুরকে আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত করার জন্য কিছু বাড়তি উপকরণ মূল কাঠামোর সাথে কিছু বাড়তি উপকরণ যুক্ত করেন। এই বাড়তি উপকরণই হলো সুরের অলঙ্কার।

স্বরের বিশেষ বিন্যাসকে বর্ণ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। যে বিন্যাস স্বরের ধ্বনিগুণকে সম্প্রসারিত করে। অন্যভাবে বলা যায় বর্ণের আশ্রয়ে প্রতিটি স্বরের স্বতন্ত্র প্রকাশ ঘটে। নন্দনতত্ত্বের আলোকে বলা যায়, স্বরের সৌন্দর্যময় বিন্যাসই হলো বর্ণ। সঙ্গীতরত্নাকরে একে বলা হয়েছে 'গানক্রিয়া বর্ণ বলিয়া উক্ত'। সঙ্গীতরত্নাকরে এই স্বরবিন্যাসকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ভাগগুলো হলো স্থায়ী বর্ণ, আরোহী বর্ণ, অবরোহী বর্ণ ও সঞ্চারী বর্ণ।

বর্ণালঙ্কার: কোনো সুরকাঠামো যখন বর্ণের দ্বারা অলঙ্কৃত হয়, তখন ওই বর্ণগুলোকে বর্ণালঙ্কার বলা হয়। তাই সাধারণভাবে সগর একটি বর্ণ মাত্র। সুরের অলঙ্করণের জন্য এই 'সগর'-ই হয়ে যায় বর্ণালঙ্কার।  একটি ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে যখন বর্ণালঙ্কারের প্রকাশ ঘটে, তখন এতে স্বরগুচ্ছ থাকে। তখন প্রতিটি স্বরগুচ্ছকে বলা হয় কলা। যেমন নিষ্কর্ষ বর্ণালঙ্কারে ধারাবাহিক স্বরবিন্যাস ঘটে 'সস রর গগ মম পপ ধধ নন' হিসেবে। এক্ষেত্রে প্রতি জোড়া স্বর হবে কলা।

ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রমতে ৬৩ প্রকার বর্ণালঙ্কার স্বীকার করা হয়। বর্ণের প্রকৃতি এবং বিন্যাসের বিচারে বর্ণালঙ্কারকে ৪টি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগগুলো হলো- স্থায়ী, আরোহী, অবরোহী ও সঞ্চারী।

বর্ণালঙ্কার ধারাবাহিক বর্ণবিন্যাসের সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। কোনো বিশেষে গানের সুরের কাঠামোতে সাধারণত এর প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় না। একটি সাধারণ গানের বা রাগের যে সাধারণ কাঠামো থাকে, তা গানের বা রাগের বিশেষ রূপ ফুটে উঠে। এই রূপকে অলঙ্কৃত করার জন্য কিছু স্বরের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এই জাতীয় অলঙ্কারের কোনো ধারাবাহিকতা থাকে না। কিন্তু মাঝে মাঝে ব্যবহৃত হয়ে সুরের মূল কাঠামোকে শোভিত করে। এই পর্যায়ের অলঙ্কারগুলোর ভিতরে পড়ে, আশ, খটকা, গমক, জমজমা, মীড় ইত্যাদি। যন্ত্রসঙ্গীতে নানা ধরনের হস্তক্রিয়াও এর ভিতরে পড়ে।  সুরালঙ্কারের এই প্রকরণগুলো নিয়ে আলোচনার আগে, স্বর ও সুর সম্পর্কে আলোকপাত করবো।

সুরালঙ্কার ও তার প্রকরণ
উপরের আলোচনা সাপেক্ষে এখানে সুর বলতে একটি সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি কাঠামোকে বিবেচনা করবো। এই সুরের মৌলিক রূপ যখন কোনো স্বর বা স্বরবিন্যাস দ্বারা অলঙ্কৃত করা হবে, তখনই তা সুরালঙ্কার হিসেবে বিবেচিত হবে। নিচে এর প্রকরণগুলো বর্ণানুক্রমে আলোচনা করা হলো।

লক্ষণীয় বিষয় সুর-সঙ্গীতে একটি অংশ প্রধান হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রধান অংশ থাকতে পারে কণ্ঠস্বর, কোনো বিশেষ বাদ্যযন্ত্র। এর সাথে তালরক্ষার সহায়ক যন্ত্র থাকতে পারে তবলা, পাখোয়াজ, খোল ইত্যাদি। সুরের পরিবেশ তৈরির জন্য থাকতে পারে তানপুরা, কিন্তু সুরে অনুসরণের জন্য, হারমোনিয়াম এস্রাজ। সাধারণভাবে মূল পরিবেশনার জন্য এগুলোকে সহায়ক যন্ত্র হিসেবেই বিবেচিত হয়। কিন্তু কোনো কোনো সময় প্রধান সুরকে অলঙ্কৃত করার জন্য, সহায়ক যন্ত্রের ধ্বনিই অলঙ্কার হয়ে যেতে পারে বা হয়েও থাকে। প্রথাগতভাবে এই সময়ে যেসকল গানকে আধুনিক গান বলছি, সেসব গানের শুরুতে বা মাঝের ফাঁকা জায়গায় কিছু বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। মূলত এগুলোও এই জাতীয় গানের অলঙ্কারের কাজ করে। কিন্তু গান ভেদে সৌন্দর্যের সমন্বয়বোধ না থাকলে, যন্ত্রের শব্দ অলঙ্কার না হয়ে যন্ত্রণায় পরিণত হয়। একালের বহু গান আছে, যেগুলোর এই বাড়তি বাদ্য পৃথকভাবে সুন্দর কিন্তু মূল গানের সাথে মেশে না বলে, ওই বাদ্যযন্ত্র অলঙ্কার হয়ে উঠে না। এমনকি যে গানের সাথে যে যন্ত্র যায়, তার সাথে অন্য যন্ত্র ব্যবহার করলেও অলঙ্করণে ত্রুটির সৃষ্টি হয়। একালের মাইক্রফোনের জগতে শব্দোচ্চতার মান হেরফের করা যায়। কোন যন্ত্রের শব্দ কতটুকু ছোটো বড় করা হবে, তার উপরও সঙ্গীতের অলঙ্করণ নির্ভর করে।