অষ্টম অধ্যায়
যৌন-সৌন্দর্য

মানুষের যৌনাকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছে প্রজননের জন্য। মানুষ একলিঙ্গিক বলেই পরস্পরের উপযোগী অঙ্গের বিন্যাস ঘটেছে তার দেহকাণ্ডে। একসাথে এর সাথে যুক্ত হয়েছে যৌনানন্দের উপযোগী যৌনবোধমূলক মানসিক গঠন। এই যৌনবোধের তাড়নায় নারীপুরুষ পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এর প্রধান লক্ষ্য থাকে সঙ্গম। আর এর ভিতর দিয়ে প্রকৃতি তার প্রজননের কাজটি করিয়ে নেয়। নারীপুরুষের আকৃষ্ট হ্‌ওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে সঙ্গম পর্যন্ত যে কার্যক্রম, এর সবই যৌনকর্মের অংশ। আর এই কর্মের নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে থাকে, তার যৌনবোধ। মানুষের যৌনকর্মের উদ্দীপনামূলক প্রেরণা রয়েছে তার সহজাত প্রবৃত্তির মধ্যে। এই প্রবৃত্তিই তাকে যৌনকর্মে তাড়িত করে। এই তাড়না থেকে পরস্পরের প্রতি-আকৃষ্ট হয়। এর ভিতর দিয়ে নারীপুরুষের নিজ নিজ যৌনাঙ্গ প্রস্তুত হতে থাকে চূড়ান্ত সঙ্গমের জন্য এবং শেষ পর্যন্তু সঙ্গমের মধ্য দিয়ে যৌনতৃপ্তি লাভ করে। যদি নারীপুরুষের পরস্পরের যৌনকামনা থেকে সঙ্গম পযর্ন্ত প্রতিটি স্তরকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করা যায়, তাহলে দেখা যায়, অসংখ্য আনন্দলাভের স্তর। আনন্দমাত্রেই ক্ষণস্থায়ী, তাই নারীপুরুষ প্রাথমিক আনন্দের স্তর পার হয়ে অন্য আনন্দের সন্ধান করে। পর্যায়ক্রমে এই আনন্দ লাভের ঘটনা ঘটতে থাকে বিচিত্ভাবে। প্রতিটি পর্যায়ে নারীপুরুষ নিজেদের মতো করে আনন্দ লাভ করে এবং সঙ্গমের চূড়ান্ত আনন্দের দিকে ধাবিত হয়। এক্ষেত্রে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নারী-পুরুষ যে সুসমন্বিত আনন্দ লাভ করে, তার সমষ্টিগত আনন্দের মধ্য দিয়ে তৈরি হয় যৌন-সৌন্দর্য।

অন্যান্য সৌন্দর্যের মতই যৌন-সৌন্দর্যেরও রয়েছে একটি পরমমান। এই পরমমানই যৌনানন্দের পরমসত্য। এই পরম সত্যের কাছে পৌছানোর জন্য, এই পরমসত্যকে লাভের জন্য মানুষ বার বার যৌনকর্মে লিপ্ত হয়। একটি সাময়িক তৃপ্তি লাভের মধ্য শেষও হয়, কিন্তু এই তৃপ্তির মধ্যে থাকে একটি অতৃপ্তি। এই অতৃপ্তির থেকে জন্মে নেয় পুনরায় মিলনের আকাঙ্ক্ষা।

একটি পূর্ণাঙ্গ যৌনকর্মের পরম সৌন্দর্য তৈরি হয়, নারীপুরুষের যুগপৎ পরমতৃপ্তি তথা পরম সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে। তাই পরমতৃপ্তির পরম মান বিভাজিত হয়ে যায়। এর এক ভাগে থাকে নারীর পরমানন্দ, অপরভাগে থাকে পুরুষের পরমানন্দ। যদি কোন যুগলের একজন পরমানন্দ থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে যেখানে যৌন-সৌন্দর্যের পরমমান প্রতিষ্ঠিত হয় না।

প্রকৃতি ও যৌনপ্রবৃত্তি
প্রজাতি মাত্রেই প্রকৃতির সন্তান। তাই অপত্য স্নেহে প্রকৃতি চায় তার প্রতিটি সন্তান বেঁচে থাকুক। আবার প্রকৃতির বিধান, জীবের মৃত্যু হবেই। এই দ্বন্দ্বের নিরসনে প্রকৃতির বিধানে যুক্ত হয়েছে প্রজনন-কর্ম।

বিজ্ঞানীদের অভিমত,
হেডিনকালের শেষে অর্থাৎ ৪০০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে সাগরজলে তৈরি হয়েছিল, রাইবোজ, ডিঅক্সিরাইবোজ, নাইট্রোজেন ক্ষার, ফসফরিক এ্যাসিড ও এ্যামিনো‌ এ্যাসিড। এই সূত্রে এই যুগে তৈরি হয়েছিল, নানা ধরনের প্রোটিন, উৎসেচক আরএনএ, ডিএনএ। ক্রমবিবর্তনের ধারায় এসব উপকরণের সমন্বয়ে ৪০০-৩৯০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে উদ্ভব হয়েছিল এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে ৩৯০-৩৮০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের সৃষ্টি হয়েছিল  প্রাক্-প্রাণকেন্দ্রিক কোষ এবং এই জাতীয় কোষ ভিত্তিক জীব। আর প্রাক্-প্রাণকেন্দ্রিক কোষ-ভিত্তিক আদি জীবকণিকা থেকে ব্যাক্টেরিয়ার উদ্ভব হয়েছিল। বর্তমানে ব্যাক্টেরিয়াকে জীবস্বক্ষেত্র (Domain) হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তারপর কোটি কোটি বছরের বিবর্তনের ধারা পেরিয়ে জীবজগত বর্তমান অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।

জীবের আদি দশায়, যখন জীবের ভিতরে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, তখন থেকেই জীবের বিদ্রোহের সূচনা। এই কারণে বলা যায়, জীব মাত্রেই বিদ্রোহী। বেঁচে থাকার সহজাত আকাঙ্ক্ষায় আদিম জীব প্রতিকুল অবস্থাকে জয় করার জন্য বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। এই সূত্রে সে নিজের দেহকাঠামোতে পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট হয়েছিল। এই বিদ্রোহের সূত্রে তৈরি হয়েছিল জীবের ক্রমবির্তনের ধারা। এই ধারায় জীব ক্রমে ক্রমে উন্নতর দশায় বিবর্তি হয়েছে এবং একই সাথে সে প্রকৃতিকেও পাল্টে দিয়েছে। মূলত প্রকৃতির একটি অমোঘ লীলা। প্রাকৃতিক উপাদান এবং জীব উভয়ই প্রকৃতির সন্তান। জীব এবং তার পরিবেশের এই বিবর্তন, এই লীলারই অংশ।

প্রকৃতির প্রতিকুল পরিবেশে জীবের টিকে
সংগ্রামে, এককভাবে কোন জীব অমর নয়। তবু সে অমরত্ব চায়। এই অমরত্বের তাড়নায় সৃষ্টি হয়েছিল প্রজনন। শুরু দিকে জীব নিজের দেহকে বিভাজিত করে প্রজননের কাজটি সম্পন্ন করতো। প্রজননের এই তাড়না তার সহজাত প্রবৃত্তির ভিতরে সংরক্ষিত হয়েছিল আরএনএ-তে। একই সাথে যুক্ত হয়েছিল প্রজননের সুখবোধ। যেমনটা জীবনীশক্তিকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য জীব খাদ্য গ্রহণ করে। কিন্তু এর ভিতরে থাকে খাদ্য গ্রহণের আনন্দ। মানুষের মতো উন্নতর জীব স্বাভাবিকভাবে সুস্বাদু খাদ্যের সন্ধান করে। দেহের জন্য ক্ষতিকারক জেনেও, এই আনন্দ লাভের জন্য অনেকে অখাদ্য-কুখাদ্যও গ্রহণ করে থাকে। প্রজননের বিষয়টিও এমনি। জীবের এই আনন্দের উপজাত ফসল হলো- তার সন্তান।

সুসমন্বিত আনন্দের সমহারে সৌন্দর্যের উদ্ভব হয়, জীবের সকল ধরনের আনন্দই হয়ে ওঠে তার সৌন্দর্যের উপকরণ। প্রজননের আনন্দের সমন্বিত দশাই হলো- প্রজননের সৌন্দর্য। আদিকালের জীবের প্রজনন প্রক্রিয়ায় ছিল একান্তই নিজের আনন্দ। যখন জীব বিবর্তিত হয়ে বিপরীতমুখী এবং পরস্পরের উপযোগী হয়ে বিভাজিত হয়ে গেলো- তখনি লিঙ্গের বিচারে প্রজাতির ভিতরে উপ-প্রজাতির উদ্ভব হলো। একে বলা যায় লিঙ্গ-ভিত্তিক উপপ্রজাতি। যেমন মানুষের প্রজাতিগত পরিচয় -হোমো স্যাপয়েন্স। তিনটি লিঙ্গভিত্তিক উপ-প্রজাতি হলো- হোমো স্যাপয়েন্স (পুরুষ), হোমো স্যাপয়েন্স (নারী), হোমো স্যাপয়েন্স (নপুংশক)। নপুংশক জীব প্রজননের অংশভাগী নয়, তাই এই আলোচনা থেকে এদের সরিয়ে রেখে- নারী-পুরুষের দিকে নজর দেবো

বিবর্তনের ধারায়  যখন প্রজাতির লিঙ্গভিত্তিক বিভাজন হয়ে গেলো, তখন শুধু তাদের দেহ-কাঠামো পাল্টে গেলো, তাই নয় মনোগত দিকও পাল্টে গেল। দেহগত কাঠামোর বিচারে প্রজনন অঙ্গ এমনভাবে তৈরি হলো, যেন উভয়ের যৌনাঙ্গ পরস্পরের উপযুক্ত হয়। মনোগত দিকে যুক্ত হলো- বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ। যদিও প্রকৃতি উদ্দেশ্য ছিল, প্রজননের মধ্য দিয়ে প্রজাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা। বোধ করি প্রজাতি রক্ষার জন্য যৌনকর্মে অংশগ্রহণ করতে হবে, একমাত্র মানুষ ছাড়া এই ভাবনা অন্য কোনো প্রজাতির মধ্যে নেই। অন্যান্য প্রজাতি আনন্দ লাভের জন্য যৌনকর্মে অংশগ্রহণ করে, আর এর উপজাত ফসল হিসেবে জন্ম নেয় সন্তান।


এ্যামিবার মতো যে সকল প্রজাতি নিজেদের দেহকে বিভাজিত করে বংশবৃদ্ধি করে, সম্ভবত তাদের ভিতরেও প্রজননগত নিজস্ব আনন্দ রয়েছে। কেঁচো বা শামুকের মতো উভলিঙ্গিক প্রজাতিসমূহের ভিতরে রয়েছে বিপরীতমুখী যৌন-আনন্দ। এরা একই সাথে পুংসত্ত্বা এবং স্ত্রীসত্ত্বার যৌনানন্দ ভোগ করে। একলিঙ্গিক প্রজাতিসমূহের যৌনানন্দ হয় একমুখী।

মানবেতর প্রজাতির গণ্ডী পেরিয়ে যখন শুধুই হোমো স্যাপিয়েন্সের কথায় এলে দেখা যায়, এদের ভিতরে রয়েছে যৌনানন্দের উচ্চতর পর্যায়। এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, মানুষের উন্নতর মস্তিষ্কের গঠন এবং এবং দেহগত কাঠামো। মানুষ একলিঙ্গিক বলে যৌনানন্দ লাভে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। দৈহিক বা মানসিকভাবে তাকে বিপরীত লিঙ্গের দ্বারস্থ হতেই হয়। নারী-পুরুষ যখন স্ব-মৈথুন লিপ্ত হয়, তখনও তার চেতনায় থাকে বিপরীতলিঙ্গ।

যৌনানন্দে ইন্দ্রিয় ও মন
নারীপুরুষের পারস্পরিক আকর্ষণ এবং সঙ্গম পর্যন্ত যদি একটি অখণ্ড যৌনাচার হিসেবে বিবেচনা করে থাকি, তাহলে দেখা যাবে প্রতিটি স্তরে রয়েছে বিশেষ ধরনের আনন্দ। মানবেতর প্রজাতিসমূহের ভিতর যৌনকর্মের এত বিচিত্র দশা নেই-যতটা মানুষের আছে। ক্রমবিবর্তনের ধারায় এই দশার বিস্তার ঘটেছে ব্যাপকভাবে। এর জন্য দায়ী মানুষের সুগঠিত এবং সংবেদনশীল উন্নত মস্তিষ্ক। এই ঘটনাটি শুধু যৌনকর্মের ক্ষেত্রে ঘটেনি, ঘটেছে মানুষের অন্যান্য কার্মকাণ্ডেও।

মানুষের চলাচল, খাদ্যগ্রহণ, নিদ্রা, যৌনকর্ম ইত্যাদি যাবতীয় কর্মকাণ্ডে পঞ্চেন্দ্রিয়ের একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে। পঞ্চেন্দ্রিয় মানুষের ইচ্ছা পূরণের জন্য যেমন সক্রিয় হয়ে উঠে, আবার পঞ্চেন্দ্রিয়ের বিশেষ সঙ্কেতে মস্তিষ্ক থেকে সৃষ্টি হয় নতুন কর্ম-উদ্দীপনা। যেমন ক্ষুধার উদ্রেক হলে, মানুষ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে খাদ্যের সন্ধান করে। আবার সুস্বাদু খাদ্যের সন্ধান ইন্দ্রিয় মস্তিষ্ককে জানিয়ে দিলেও, খাদ্যগ্রহণের ইচ্ছা জাগ্রত হয়ে ওঠে। সকল ক্ষেত্রেই মস্তিষ্কের কাছ থেকে খাদ্যগ্রহণের ছাড়পত্র নিতে হয়। মস্তিষ্ক খাদ্যগ্রহণকালের আনন্দ এবং খাদ্যগ্রহণের তৃপ্তি লাভ করে। মানুষের সকল কর্মকাণ্ডেই ইন্দ্রিয় মনের আজ্ঞাবাহী সেবক হিসেবে কাজ করে থাকে।

মানুষের যৌনানন্দের সাথে রয়েছে পঞ্চেন্দ্রিয়ের ভূমিকা। একই সাথে রয়েছে মন নাম সত্তার অগ্রণী ভূমিকা। মনের ভিতরে যৌনানন্দের যে অভিলাষের উদ্ভব হয়ে, সেই অভিলাষ থেকেই নরনারী যৌনকর্মে আগ্রহী হয়ে উঠে।