মহাভারত
আদিপর্ব
ভাষাংশ>মহাভারত >আদিপর্ব>চতুরশীতিতম- পঞ্চাশীতিতম অধ্যায়
চতুরশীতিতম অধ্যায়
পুরুদেহে যযাতির জরাসঞ্চার
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ!
তৎপরে রাজা যযাতি জরাগ্রস্ত হইয়া নিজ রাজধানী প্রত্যাগমনপূর্ব্বক স্বীয় জ্যেষ্ঠ
পুৎত্র যদুকে কহিলেন, “বৎস! শুক্রের শাপপ্রভাবে এই মহাঘোর জরা আমাকে আক্রমণ
করিয়াছে, কিন্তু অদ্যাপি আমি বিষয়ভোগ করিয়া পরিতৃপ্ত হই নাই; অতএব তুমি মদীয় পাপ ও
জরা গ্রহণ কর। আমি তোমার যৌবন লইয়া ইচ্ছানুরূপ বিষয়-ভোগ করি। সহস্র বৎসর পূর্ণ হইলে
পুনর্ব্বার তোমার যৌবন তোমাকে সমর্পণ করিয়া আমি পাপের সহিত আপন জ্বরা গ্রহণ করিব।”
যদু কহিলেন, “মহারাজ! জরার অনেক দোষ তাহাতে পানভোজনে যথেষ্ট ব্যাঘাত জন্মে,
শ্মশ্রুজাল শুক্ল [বার্ধক্যে দাড়ি পাকিয়া শুভ্রবর্ণ] এবং মাংশ শিথিল ও সঙ্কুচিত
হওয়াতে জীর্ণ ব্যক্তি শ্রীভ্রষ্ট, নিরানন্দ ও সর্ব্বকার্য্যে নিরুৎসাহ হয়।
আত্মীয়ব্যক্তিরা জরাজীর্ণকে পদে পদে পরাভব করে; অতএব আমি সেই জরা-গ্রহণে সম্মত নহি।
আপনার আমা হইতে প্রিয়তর অন্য অনেক পুৎত্র আছে, তাহাদিগকেই প্রদান করুন।” যযাতি
কহিলেন, “তুমি যেহেতু আমার ঔরসপুৎত্র হইয়া স্বকীয় যৌবন-প্রদানে সম্মত হইলে না, অতএব
তোমার বংশ পরম্পরায় কেহই রাজ্যাধিকারী হইবে না।” তৎপরে রাজা যযাতি তুর্ব্বসুর নিকট
উপস্থিত হইয়া কহিলেন, “বৎস! আমার পাপ ও জরা গ্রহণ কর, আমি তোমার যৌবন লইয়া
বিষয়োপভোগ করিব। সহস্র বৎসর অতীত হইলে পুনর্ব্বার তোমার যৌবন তোমাকে সমর্পণ করিয়া
পাপের সহিত আপন জরা গ্রহণ করিব।” তুর্ব্বসু কহিলেন, “মহারাজ! রূপনাশিনী জরা
মনুষ্যকে ইচ্ছানুরূপ ভোগসুখে বঞ্চিত করে। জরার প্রভাবে বুদ্ধিভ্রংশ ও পদে পদে
প্রাণনাশের আশঙ্কা উপস্থিত হয়; অতএব আমি আপনার জরা-গ্রহণে সম্মত নহি।” যযাতি
কহিলেন, “বৎস! তুমি আমার আত্মজ হইয়া আমার প্রার্থনা পূরণে সম্মত হইলে না, অতএব আমি
শাপ দিতেছি, তুমি নির্ব্বংশ হইবে এবং সঙ্কীর্ণাচার [নীচ ব্যবহারযুক্ত]
ধর্ম্মসম্পন্ন, প্রতিলোমজ, রাক্ষস, চণ্ডাল, গুরুদারনিরত, তির্য্যগযোনিজাত,
পশুধর্ম্মা ও পাপিষ্ঠদিগের রাজা হইবে।”
এইরূপে তুর্ব্বসুকে অভিশাপ দিয়া রাজা যযাতি শর্ম্মিষ্ঠাপুৎত্র দ্রুর্য্যকে কহিলেন,
“বৎস! সহস্র বৎসরের নিমিত্ত আমার এই রূপনাশিনী জরা গ্রহণ কর, আমি তোমার যে বন লইয়া
ভোগ বাসনা চরিতার্থ করিব। নির্দ্দিষ্টকাল অতিক্রান্ত হইলেই পুনর্ব্বার পাপের সহিত
জরা গ্রহণ করিয়া তোমার যৌবন তোমাকে প্রদান করিব।” দ্রুহ্যু কহিলেন, “মহারাজ! মনুষ্য
জীর্ণ হইলে হস্তী,অশ্ব ও রথে আরোহণ করিতে বা কামিনীসম্ভোগ করিতে অসমর্থ হয় এবং
জীর্ণ ব্যক্তির বাক্য স্খলিত হয়, অতএব আমি জরা-গ্রহণে সম্মত নহি।” তাহা শুনিয়া রাজা
রোষাবিষ্ট-চিত্তে কহিলেন, “দ্রুহ্যুো! তুমি আমার আত্মজ হইয়া যৌবন-প্রদানে পরাঙ্মুখ
হইলে; অতএব অতঃপর তোমার কোন বাসনা ফলবতী হইবে না; আর যে-স্থানে গজ, বাজী, রথ ও
শিবিকাদি যানের সমাগম নাই; কেবল উড়ুপ [ভেলা] বা সন্তরণ দ্বারা গমনাগমন করিতে হয়,
তোমাকে সেই স্থানে যাইয়া বাস করিতে হইবে। তোমার বংশে কেহই রাজা হইবে না।” রাজা
দ্রুহ্যুকে এইরূপ অভিশাপ দিয়া অনুকে কহিলেন, “বৎস! তুমি আমার পাপ ও জরা গ্রহণ কর;
আমি তোমার যৌবন লইয়া এক সহস্র বৎসর বিষয়-ভোগ করিব।” অনু কহিলেন, “মহারাজ! জীর্ণ
ব্যক্তি অশুচি ও বালকের ন্যায় অনিয়ত-কালে [অসময়ে-অনুপযুক্তকালে] ভোজন করিতে
প্রবৃত্ত হয় এবং যথাকালে অগ্নিহোত্রাদি ক্রিয়া সম্পাদন করিতে পারে না; অতএব আমি
জরা-গ্রহণ করিব না।” তখন রাজা কহিলেন, “তুমি আমার ঔরসপুৎত্র হইয়া জরার
দোষোল্লেখপূর্ব্বক যৌবন-প্রদানে পরাঙ্মুখ হইলে; অতএব আমি তোমাকে অভিশাপ দিতেছি,
তুমি অচিরাৎ সেই জরাদোষে লিপ্ত হইবে এবং তোমার সন্তান-সন্ততি যৌবন প্রাপ্তিমাত্রেই
কালগ্রাসে পতিত হইবে।” সর্ব্বশেষে পুরুর নিকট উপস্থিত হইয়া কহিলেন, “বৎস পুরো! আমি
শুক্রের শাপে জরাগ্রস্ত হইয়াছি; আমার কেশ পলিত [পক্ব―পাকিয়া
যাওয়া] ও মাংস লোলিত [গলিত্ব―
আঁট-সাট না থাকা] হইয়াছে। কিন্তু আমি যৌবনসুখ-সম্ভোগ করিয়া পরিতৃপ্ত হই নাই; অতএব
তুমি আমার পাপের সহিত জরা গ্রহণ কর; আমি তোমার যৌবন লইয়া কিছুকাল ইচ্ছানুরূপ বিষয়
ভোগ করি। আমি অঙ্গীকার করিতেছি, সহস্র বৎসর অতিক্রান্ত হইলে তোমার যৌবন তোমাকে
পুনর্ব্বার প্রদান করিয়া পাপের সহিত আপন জরা গ্রহণ করিব। হে পুরো! তুমি আমার
প্রিয়তম পুৎত্র, এইরূপ করিলে সর্ব্বপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হইতে পারিবে।” পুরু এইরূপ অভিহিত
হইয়া কহিলেন, “যে আজ্ঞা মহারাজ! আপনি যেরূপ অনুমতি করিতেছেন, আমি তাহা পালন করিব;
আমি পাপের সহিত আপনার জরা গ্রহণ করিব, আপনি আমার যৌবন লইয়া বাসনরূপ বিষয়-সম্ভোগ
করুন।” তখন যযাতি কহিলেন, “বৎস! তোমার এইরূপ অচলা ভক্তি ও প্রগাঢ় অনুরাগ সন্দর্শনে
আমি যৎপরোনাস্তি প্রীত ও প্রসন্ন হইলাম; এক্ষণে আশীর্ব্বাদ করি, তোমার রাজ্যে
প্রজারা সর্ব্বসমৃদ্ধিসম্পন্ন হইয়া সর্ব্বকাল পরমসুখে বাস করিবে।” এই বলিয়া রাজা
শুক্রকে স্মরণপূর্ব্বক স্বীয় পুৎত্র পুরুর শরীরে স্বকীয় জরা সঞ্চারিত করিলেন।
পঞ্চাশীতিতম অধ্যায়
পুরুর রাজ্যাভিষেক
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ!
এইরূপে নহুষতনয় রাজা যযাতি যৌবন-সম্পন্ন হইয়া প্রসন্নমনে অভিলাষানুরূপ বিষয়ভোগে
প্রবৃত্ত হইলেন। তিনি ধর্ম্মের অব্যাঘাতে বাসনা ও উৎসাহের অনুরূপ বিষয়-ভোগ করিতে
আরম্ভ করিলেন। মহারাজ যযাতি যজ্ঞ দ্বারা দেবগণকে, শ্রাদ্ধ দ্বারা পিতৃলোককে,
অনুগ্রহ দ্বারা দীন ব্যক্তিদিগকে, অভিলাষসম্পাদন দ্বারা দ্বিজগণকে, অন্ন-পান দ্বারা
অতিথিগণকে, ধর্ম্মতঃ পরিপালন দ্বারা প্রজাগণকে অনুরঞ্জন করিয়া এবং নিগ্রহ দ্বারা
দস্যুদিগকে শাসন করিয়া সাক্ষাৎ সুরেন্দ্রের ন্যায় রাজ্যশাসন করিতে লাগিলেন। সেই
সিংহবিক্রান্ত ভূপতি ধর্ম্মের অবিরোধে বিষয়-বাসনা চরিতার্থ করিলেন। তিনি
স্বর্গবিদ্যাধারী বিশ্বাচীর সহিত কখন নন্দনবনে, কখন অলকায়, কখন বা উত্তর-মেরুশৃঙ্গে
বিহার করিয়া পরিতৃপ্ত ও নিস্পৃহ হইলেন। পরে প্রতিজ্ঞাত সহস্র বৎসর স্মরণ করিলেন।
যখন দেখিলেন, যৌবনসুখে সহস্র বৎসর অতিবাহিত হইয়াছে, তখন আপন পুৎত্র পুরুকে কহিলেন,
“বৎস পুরো! আমি তোমার যৌবন লইয়া ইচ্ছানুরূপ ও উৎসাহানুরূপ বিষয়-ভোগ করিয়া দেখিলাম,
কাম্যবস্তুর উপভোগে কামের উপশম না করিয়া প্রত্যুত ঘৃতদানে বহ্নির ন্যায় ক্রমশঃ
পরিবর্দ্ধিত হইতে থাকে। এই পৃথিবীতে যে কিছু ধন, ধান্য, হিরণ্য, পশু ও রমণী প্রভৃতি
উপভোগের দ্রব্য আছে, এক ব্যক্তি তৎসমুদয় পাইলেও তাহার পরিতৃপ্তি হয় না; অতএব
ভোগতৃষ্ণা পরিত্যাগ করাই কর্তব্য। দুর্ম্মতি ব্যক্তিরা যে আশাপাশ হইতে মুক্ত হইতে
পারে না এবং শরীর জীর্ণ হইলেও যে আশা জীর্ণ হয় না, সেই প্রাণান্তিক রোগস্বরূপ আশাকে
পরিত্যাগ করাই সর্ব্বতোভাবে বিধেয়। আমি ইচ্ছানুরূপ বিষয়সম্ভোগ করিয়া সহস্র বৎসর
অতিবাহিত করিলাম, তথাপি আমার ভোগতৃষ্ণা উত্তরোত্তর উত্তেজিত হইতেছে। এক্ষণে আমি
আশাপিশাচীকে পরিত্যাগ করিয়া তপোবনে প্রবেশপূর্ব্বক পরব্রহ্মে মনোনিবেশ করিব। বৎস!
তোমার সুশীলতা দর্শনে আমি সাতিশয় প্রীত ও প্রসন্ন হইয়াছি, আশীর্ব্বাদ করি, তোমার
মঙ্গল হউক। এক্ষণে আপন যৌবন ও মদায় রাজ্যভার গ্রহণ কর। বৎস! তুমিই আমার প্রিয়কারী
পুৎত্র। আমি তোমা হইতে যথেষ্ট সুখভোগ করিলাম।”
অনন্তর নহুষতনয় যযাতি পুনর্ব্বার আপন জরা গ্রহণ করিলেন এবং তৎপুৎত্র পুরু
যৌবনসম্পন্ন হইলেন। মহারাজ যযাতি কনিষ্ঠ পুৎত্র পুরুকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিবেন, এই
কথা প্রচার করিয়া দিলেন। ব্রাহ্মণ প্রভৃতি চারিবর্ণ তথায় উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে
নিবেদন করিলেন, “মহারাজ! দেবযানী-গর্ভসম্ভূত শুক্রের দৌহিত্র যদু বিদ্যমান থাকিতে
পুরু কি প্রকারে রাজ্য পাইতে পারেন? যদু আপনার জ্যেষ্ঠ পুৎত্র, তৎপর তুর্ব্বসু
জন্মেন। শর্ম্মিষ্ঠার দ্রুহ্যু, অনু ও পুরু নামে তিন পুৎত্র যথাক্রমে উৎপন্ন হয়েন।
অতএব হে মহারাজ! আমরা জিজ্ঞাসা করি, জ্যেষ্ঠকে অতিক্রম করিয়া কনীয়ান [কনিষ্ঠ―ছোট]
কিরূপে রাজ্যভোগী হইতে পারেন? এক্ষণে যাহা উচিত হয়, আপনি করুন।” রাজা কহিলেন, “হে
বর্ণচতুষ্টয় [ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ও শুদ্রজাতীয় জনগণ]! আমি যে-কারণে জ্যেষ্ঠকে রাজ্যে
অভিষিক্ত করিব না, তাহা সবিশেষে কহিতেছি, শ্রবণ কর। জ্যেষ্ঠ পুৎত্র যদু আমার
নির্দ্দেশ পালন করে নাই, সুতরাং যে পুৎত্র পিতার প্রতিকূল, সে সাধুসমাজে পুৎত্র
বলিয়া পরিগণিত হইতে পারে না। যে পুৎত্র পিতামাতার আজ্ঞাবহ এবং কায়মনোবাক্যে
তাঁহাদিগের হিতসাধন করে, তাহাকেই যথার্থ পুৎত্র বলা যায়। যদু, তুর্ব্বসু, দ্রুহ্যু
ও অনু ইহারা আমার আজ্ঞাপালন না করিয়া অতিশয় অপ্রিয়কার্য্য করিয়াছে; কিন্তু পুরু
আমার বাক্যরক্ষা ও সম্মানরক্ষা করিয়াছে। পুরু আমার জরা-গ্রহণ করিয়া স্বকীয় যৌবন
আমাকে সম্প্রদান করিয়াছিল এবং পুরু আমার মিত্ররূপ সমুদয় অভিলাষ সম্পাদন করিয়াছিল,
এই কারণে সে কনিষ্ঠ হইয়াও রাজ্যের অধিকারী হইয়াছে। আর শুক্র আমাকে এই বর প্রদান
করেন, ‘যে পুৎত্র তোমার আজ্ঞাবহ হইবে, সে রাজ্যভাগী হইবে’; অতএব তোমাদিগকে অনুনয়
করিতেছি, তোমরা পুরুকে রাজ্যে অভিষিক্ত কর।” রাজার এই কথা শুনিয়া প্রজারা কহিল,
“মহারাজ! যে পুৎত্র সর্ব্বগুণসম্পন্ন এবং পিতামাতার হিতকারী, সে সর্ব্বকনিষ্ঠ হইলেও
সমস্ত কল্যাণের পাত্র হইতে পারে। পুরু আপনার প্রিয়কার্য্য সম্পাদন করিয়াছেন,
বিশেষতঃ শুক্রের ঐরূপ বর আছে, অতএব এ বিষয়ে আমাদিগের কোন বক্তব্য নাই, সুতরাং পুরুই
রাজা হইবেন।” পুরবাসী ও জনপদবাসী লোকেরা সন্তুষ্ট-মনে এই কথা কহিলে রাজা কনিষ্ঠ
পুৎত্রকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিলেন। তিনি পুরুকে রাজ্যভার অর্পণ করিয়া বিষয়বাসনায়
জলাঞ্জলি প্রদানপূর্ব্বক বনবাসের মানসে তপস্বী ব্রাহ্মণগণের সহিত রাজধানী হইতে
নির্গত হইলেন। তৎপরে যদু হইতে যাদব, তুর্ব্বসু হইতে যবন, দ্রুহ্যু হইতে বৈভোজ
[হীনবংশ], অনু হইতে ম্লেচ্ছজাতি এবং পুরু হইতে পৌরব বংশ উৎপন্ন হইল। হে মহারাজ!
আপনি সেই বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন।