মহাভারত
আদিপর্ব


ভাষাংশ>মহাভারত >আদিপর্ব>ষড়শীতিতম- অষ্টাশীতিতম অধ্যায়


ষড়শীতিতম অধ্যায়
যযাতির তপস্যা

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! এইরূপে রাজা যযাতি পুরুকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিয়া হৃষ্টচিত্তে বানপ্রস্থাশ্রম [চতুর্থ আশ্রম-অনাসক্তভাবে বনবাস] অবলম্বন করিলেন। অনন্তর তিনি অযত্নসুলভ ফলমুলমাত্র ভোজনপূর্ব্বক ব্রাহ্মণগণের সহিত কিছুকাল বাস করিয়া সুরলোকে গমন করিলেন। তথায় কিয়দ্দিন পরমসুখে অবস্থান করিয়া দেবরাজ ইন্দ্র কর্ত্তৃক পুনর্ব্বার ভূতলে পতিত হইলেন। এইরূপ জনশ্রুতি আছে, স্বর্গভ্রষ্ট যযাতি এককালে ভূমণ্ডলে পতিত না হইয়া কিছুকাল অন্তরীক্ষে অবস্থান করেন। পরে সেই অন্তরীক্ষ হইতে বসুমান্, অষ্টক, প্রতর্দ্দন ও শিবি রাজার সহিত সমবেত হইয়া পুনর্ব্বার দেবলোকে গমন করেন।

জনমেজয় কহিলেন, হে ব্রহ্মণ! কুরুবংশাবতংস মহাতেজাঃ যযাতি মর্ত্ত্যলোকে ও স্বর্গলোকে যে-সকল কার্য্য করিয়াছিলেন, আপনি সভ্যগণ-সন্নিধানে তাহা কীর্ত্তন করুন এবং তিনি কি কারণে পুনর্ব্বার স্বর্গে গমন করেন, তাহা আনুপূর্ব্বিক সমুদয় বলুন, শুনিতে আমার নিতান্ত অভিলাষ হইয়াছে।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! সর্ব্বপাপ-প্রণাশিনী ভূলোক ও দ্যুলোক [স্বর্গলোক]-বিশ্রুতা তদীয় পরমপবিত্র কথা কীর্ত্তন করিতেছি, অবধান [সাবধানে শ্রবণ] করুন। নহুষতনয় যযাতি হৃষ্টচিত্তে কনিষ্ঠ পুৎত্রকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিয়া এবং যদু প্রভৃতি পুৎত্রদিগকে অন্ত্যজ [নীচজাতি]-জাতি মধ্যে সন্নিবেশিত করিয়া বানপ্রস্থাশ্রম অবলম্বনপূর্ব্বক অরণ্যে প্রবেশ করিলেন। জিতেন্দ্রিয় জিতক্রোধ রাজা তথায় শ্রাদ্ধ ও যজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপ দ্বারা পিতৃগণ ও দেবগণকে পরিতৃপ্ত করিলেন। তিনি বানপ্রস্থাশ্রম-সমুচিত বিধানানুসারে জ্বলন্ত হুতাশনে আহুতি প্রদান করিতেন; বন্য ফলমূল ও ঘৃত দ্বারা অতিথি-সৎকার করিতেন এবং উঞ্ছবৃত্তি দ্বারা উদরপূর্ত্তি করিতেন। সহস্র বৎসর অতিবাহিত হইলে তিনি মৌনাবলম্বনপূর্ব্বক ত্রিংশৎ বৎসর কেবল জলাহারী হইলেন। পরে এক বৎসর বায়ুমাত্র ভক্ষণ এবং অপর এক বৎসর পঞ্চাগ্নির [চারদিকে চারিটি অগ্নিকুণ্ড ও উপরে সূর্য্য] মধ্যবর্ত্তী হইয়া অতি কঠোর তপস্যার অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। অনন্তর ছয় মাস বায়ুমাত্র ভক্ষণ ও একপদে ভূমি স্পর্শ করিয়া নিরবচ্ছিন্ন দণ্ডায়মান থাকিতেন। এইরূপে তপোনুষ্ঠানপরায়ণ রাজা প্রভূত পুণ্যসঞ্চার করিয়া স্বর্গে আরোহণ করেন।


সপ্তাশীতিতম অধ্যায়
যযাতির মুখে ইন্দ্রের নীতি শ্রবণ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! এইরূপ শ্রুত আছে, রাজা যযাতি স্বর্গারোহণপূর্ব্বক দেবতা, সিদ্ধ, সাধ্য, মরুৎ ও বসুগণ কর্ত্তৃক সমাদৃত ও সৎকৃত হইয়া সুদীর্ঘকাল তথায় বাস করেন। তিনি কদাচিৎ ব্রহ্মলোকে, কদাচিৎ দেবলোকে গমনাগমন করিতেন। মহারাজ যযাতি একদা ইন্দ্র-সন্নিধানে উপস্থিত হইলে দেবরাজ রাজার কথাবসানে জিজ্ঞাসা করিলেন, “রাজন্! পুরু তোমার জরা গ্রহণ করে; তুমি তাহাকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিয়া কি উপদেশ দিয়াছিলে, সত্য করিয়া বল, আমার শুনিতে নিতান্ত বাসনা হইতেছে।” যযাতি কহিলেন, “হে দেবরাজ! আমি পুরুকে সমস্ত রাজ্যভার অর্পণ করিয়া কহিলাম, ‘বৎস! গঙ্গা ও যমুনা এই উভয় নদীর অন্তর্গত সমস্ত রাজ্য তোমারই অধিকারভুক্ত হইল; তুমি ধরিত্রীর একমাত্র অধীশ্বর হইলে; তোমার ভ্রাতৃগণ তোমারই অধীনে থাকিয়া অন্ত্যজ-জাতিমাত্র শাসন করিবে। অক্রোধন ক্রোধপরায়ণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, ক্ষমাবান্ অক্ষম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ; অতএব বৎস! তোমাকে এই উপদেশ প্রদান করিতেছি, শ্রবণ কর। মানুষ অমানুষ হইতে প্রধান; বিদ্বান্ মূর্খ হইতে প্রধান; যে ব্যক্তি আক্রোশ করিবে, তাহার উপর আক্রোশ না করিয়া ক্রোধ সংবরণ করাই কর্ত্তব্য, যেহেতু, আক্রোষ্টা [আক্রোশকারী- বিদ্বেষবশে মিথ্যা অভিযোক্তা] কোপানলে মনে মনে দগ্ধ হইতে থাকে, কিন্তু অনাক্রোষ্টা [আক্রোশহীন] তাহার পুণ্যভাগী হয়। লোকের মর্ম্মপীড়ক ও নৃশংসবাদী হওয়া নিতান্ত অবিধেয়। যে কথায় অন্যে উদ্বিগ্ন হয়, এমত কথা উচ্চারণ করা অনুচিত। অর্থহীন ব্যক্তির নিকট প্রচুর অর্থ লওয়া অন্যায্য। যে ব্যক্তি লোকের মর্ম্মপীড়ক পুরুষ [কর্কশ] ভাষী ও বাক্যরূপ কন্টক দ্বারা অন্যের হৃদয় বিদ্ধ করে, তাহাকে অলক্ষ্মীক বলে। তাহার মুখে অলক্ষ্মীর চিহ্ন-সকল সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। সচ্চরিত্র ব্যক্তি অগ্রপশ্চাৎ ভাবিয়া সাধুদিগের প্রশংসাযোগ্য কর্ম্ম করেন, সর্ব্বদা অসাধুজনের অতিবাদ [অমূলক দোষ] সহ্য করেন এবং সন্মার্গে চলিয়া থাকেন। অসতেরা আপন মুখ হইতে নির্গত বাক্যরূপ শায়ক দ্বারা অন্যকে আহত করে। আহত ব্যক্তি ঐ সুতীক্ষ্ণ শরাঘাতে জর্জ্জরিত হইয়া অহর্নিশ যন্ত্রণাভোগ করে, অতএব পণ্ডিতেরা তাহা কস্মিন্‌কালেও অন্যের প্রতি নিক্ষেপ করেন না। জীবের প্রতি দয়া,মৈত্রী, দান ও মধুরবাক্য প্রয়োগ, ইহা অপেক্ষা ধর্ম্ম আর লক্ষ্য হয় না। অতএব সর্ব্বদা সান্ত-বাক্য প্রয়োগ করা কর্ত্তব্য, কদাচ কঠোর বাক্য উচ্চারণ করিও না। পূজ্য ব্যক্তির পূজা ও দান করা কর্ত্তব্য, কিন্তু যাচ্‌ঞা অতিশয় নিষিদ্ধ।”

অষ্টাশীতিতম অধ্যায়
আত্মপ্রশংসায় যযাতির স্বর্গচ্যুতি

ইন্দ্র কহিলেন, "হে নহুষনন্দন! তুমি সর্ব্বকর্ম্মসম্পাদনপূর্ব্বক গৃহ পরিত্যাগ করিয়া বনপ্রবেশ করিয়াছিলে, অতএব জিজ্ঞাসা করি, তুমি কাহার তুল্য তপোনুষ্ঠান করিয়াছ?" যযাতি কহিলেন, "হে দেবরাজ! দেবতা, মনুষ্য, গন্ধর্ব্ব ও মহর্ষি ইঁহাগিগের মধ্যে কেহই অদ্যাবধি আমার তুল্য তপোনুষ্ঠান করিতে সক্ষম হয় নাই।" তখন ইন্দ্র কহিলেন, "মহারাজ! যেহেতু, অন্যের তপঃপ্রভাব না জানিয়া শুনিয়া উৎকৃষ্ট, নিকৃষ্ট ও সমকক্ষ লোকের অবমাননা করিলে, তন্নিমিত্ত তুমি অদ্যই ক্ষীণপুণ্য হইয়া দেবলোক হইতে পরিভ্রষ্ট হইবে।" যযাতি কহিলেন, "হে দেবরাজ! দেবর্ষি, গন্ধর্ব্ব ও নরলোকের অবমাননা করিয়া যদি দেবলোকভ্রষ্ট হইতে হইল, তবে যাহাতে সাধু-সন্নিধানে পতিত হই, এইরূপ অনুকম্পা করুন।" ইন্দ্র কহিলেন, "মহারাজ! তুমি সাধুসন্নিধানেই পতিত হইয়া যথেষ্ট খ্যাতি প্রতিপত্তি লাভ করিবে; কিন্তু সাবধান, যেন এইরূপে আর কাহারও অবমাননা করিও না।"

রাজা যযাতি দেবরাজ কর্ত্তৃক এইরূপে আদিষ্ট ও স্বর্গভ্রষ্ট হইয়া ভূমণ্ডলে পতিত হইতেছেন, ইত্যবসরে ধর্ম্মপরায়ণ রাজর্ষি অষ্টক তাঁহাকে অন্তরীক্ষে নিরীক্ষণ করিয়া কহিলেন, "হে যুবক! তুমি কে? তোমার রূপ ইন্দ্রের ন্যায় ও তেজ অগ্নির ন্যায় দেখিতেছি; তোমাকে প্রচণ্ড মার্ত্তণ্ডের ন্যায় অকস্মাৎ গগনমণ্ডল হইতে পরিভ্রষ্ট দেখিয়া আমরা বিস্ময়াবিষ্টচিত্তে নানাপ্রকার বিতর্ক করিতেছিলাম। এক্ষণে তোমাকে সন্নিকৃষ্ট [নিকটবর্তী] দেখিয়া পতনকারণ জিজ্ঞাসার্থ প্রত্যুদ্‌গমন করিলাম। অগ্রে তোমার পরিচয় লইতে আমাদিগের সাহস হইতেছে না এবং তুমিও আমাদিগকে কিছুই জিজ্ঞাসা করিতেছ না, অতএব জিজ্ঞাসা করি, তুমি কে এবং কি নিমিত্তই বা দেবলোকে আগমন করিয়াছিলে? হে মহানুভব! তোমার ভয় নাই, শ্রীঘ্রই বিষাদ ও মোহ পরিত্যাগ কর। এই সাধু-সমাজে বল-নামক অসুরের হন্তা ইন্দ্রও তোমাকে পরাভব করিতে সমর্থ নহেন। হে দেবরাজকল্প! সাধুলোকেরা সন্তপ্ত সাধুলোকদিগের আশ্রয়, সম্প্রতি তুমি সাধুসন্নিধানে আসিয়াছ, আর ভয় কি? যেমন তাপদানে অগ্নির, বীজাধানে পৃথিবীর, আলোকদানে সূর্য্যের প্রভুত্ব আছে, সাধুদিগের নিকট অভ্যাগত ব্যক্তিরও তাদৃশ প্রভুত্ব।"