মহাভারত
আদিপর্ব
ভাষাংশ>মহাভারত >আদিপর্ব>ষণ্ণবতিতম ও সপ্তনবতিতম অধ্যায়
ষণ্ণবতিতম অধ্যায়
অভিশপ্ত বসুগণের গঙ্গাগর্ভে জন্ম
বৈশম্পাবন
কহিলেন, ইক্ষ্বাকুবংশজাত রাজা মহাভিষ সত্যবাদী ও সত্যপরাক্রম ছিলেন। তিনি সহস্র
অশ্বমেধ ও শত-সংখ্যক রাজসুয়যজ্ঞ সম্পাদনপূর্ব্বক দেবরাজকে প্রসন্ন করিয়া চরমে পরমফল
স্বর্গফললাভ করিয়াছিলেন। অনন্তর একদিবস দেবগণ কমলযোনির আরাধনা করিতেছেন, বহুসংখ্যক
রাজর্ষি ও মহারাজ মহাভিষ তথায় উপবিষ্ট আছেন, এমন সময়ে সরিদ্বরা গঙ্গা ব্রহ্মার সহিত
সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত তথায় উপস্থিত হইলেন। বায়ুবেগে সহসা তাঁহার অঙ্গবস্ত্র উড্ডীন
হইল, তদ্দর্শনে দেবতারা লজ্জায় অধোমুখ হইয়া রহিলেন; কিন্তু রাজা মহাভিষ অসঙ্কুচিত
চিত্তে তাঁহার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। তদ্দর্শনে ব্রহ্মা সন্দিহান হইয়া
কিয়ৎক্ষণ তাঁহার বিষয় চিন্তা করিয়া কহিলেন, তুমি দেবলোকের উপযুক্ত পাত্র নহ; অতএব
মর্ত্ত্যলোকে গিয়া জন্মগ্রহণ কর; কিন্তু পুনর্ব্বার তোমার স্বর্গ লাভ হইবে।"
রাজা এই প্রকার দণ্ডিত হইয়া, কাহার ঔরসে জন্মগ্রহণ করিবেন, তদ্বিষয় চিন্তা করিতে
লাগিলেন। তিনি অনেক রাজর্ষি এবং মহর্ষিকে চিন্তা করিয়া রাজা প্রতীপের পুৎত্র হইতে
মানস করিলেন। সরিদ্বরা মহাভিষকে অত্যন্ত অধৈর্য্য দেখিয়া তাঁহাকে মনে মনে চিন্তা
করিতে করিতে প্রত্যাবৃত্ত হইলেন। পথিমধ্যে দেখিলেন, বসু-নামক দেবগণ মূর্চ্ছিত ও
বিকলেন্দ্রিয় হইয়া পতিত রহিয়াছেন।
অনন্তর তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমরা কি নিমিত্ত এরূপ দুরবস্থাগ্রস্থ হইয়াছ? তোমাদিগের কি কোন অনিষ্ট-ঘটনা হই্য়াছে?
"তাঁহারা কহিলেন,"সরিদ্বরে! অতি সামান্য অপরাধে মহর্ষি বশিষ্ঠ ক্রুদ্ধ হইয়া
আমাদিগকে অভিসম্পাত করিয়াছেন, তন্নিমিত্ত আমরা এইরূপ হইয়াছি। একদিবস সায়ংকালে
ভগবান্ বশিষ্ঠ প্রচ্ছন্নবেশে উপবিষ্ট ছিলেন, আমরা অজ্ঞানতাপ্রযুক্ত মহর্ষির যথাবিধি
সম্মান না করিয়া প্রস্থান করিয়াছিলাম, এই অপরাধে তিনি ক্রোধান্বিত হইয়া আমাদিগকে
মনুষ্যযনি প্রাপ্ত হও' বলিয়া অভিসম্পাত করিয়াছেন। তিনি সামান্য ব্যক্তি নহেন; সেই
ব্রহ্মবাদীর বাক্য কদাপি অন্যথা হইবার নহে; অতএব আপনি নবকলেবর ধারণপূবর্ব্বক
ভুমণ্ডলে অবতীর্ণ হইয়া আমাদিগের সৃষ্টি-বিধান করুন, নতুবা সামান্য মানুষীর গর্ভে
আমরা জন্মগ্রহণ করিতে পারিব না।" গঙ্গা বসুগণের প্রার্থনায় সম্মতা হইয়া তাঁহাদিগকে
জিজ্ঞাসিলেন,''মর্ত্ত্যলোকে কোন্ মহাপুরুষ তোমাদিগের জনক হইতে পারেন? ''তাঁহারা
কহিলেন, ''প্রতীপ রাজার ঔরসে শান্তনু নামে এক সুবিখ্যাত ভূপাল ভূমণ্ডলে জন্মগ্রহণ
করিবেন, তিনিই আমাদিগের জনক হইবেন। ''গঙ্গা কহিলেন,''তোমরা যাহা বলিলে, উহা আমারও
অভিমত বটে; অতএব তোমাদিগের অভিলষিত এবং সেই রাজার প্রিয়কার্য্য আমি অবশ্যই সম্পাদন
করিব।'' বসুগণ বলিলেন, ''হে ত্রিপথগে ! আপনার পুত্র জন্মিবামাত্র সলিলে নিক্ষেপ
করিবেন, অধিককাল যেন আমাদিগকে ভূলোক-যন্ত্রণা সহ্য করিতে না হয়। গঙ্গা কহিলেন "তোমরা যাহা বলিলে আমি তাহাই করিব;
কিন্তু যাহাতে রাজার একটি পুৎত্র জীবিত থাকে, তাহার
কোন উপায় স্থির কর। কারণ, সেই পুত্রার্থী ভূপতির মৎসহবাস নিতান্ত নিষ্ফল হওয়া
কোনক্রমেই বিধেয় নহে।'' তখন বসুগণ কহিলেন,''আমরা স্ব স্ব বীর্যের চতুর্থ ভাগের
অর্দ্ধাংশ প্রদান করিব, তাহাতেই তাঁহার পুত্রলাভ হইবে; কিন্তু সেই পুত্রের
মর্ত্ত্যলোকে সন্তান সন্ততি হইবে না; অতএব হে ত্রিপথগামিনি! আপনার সেই
মহাবলপরাক্রান্ত পুৎত্র অপুৎত্র হইবেন।'' বাসুদেবতারা সরিদ্বরা গঙ্গার নিকট এইরূপ
প্রতিজ্ঞা করিয়া নিজ নিজ অভীষ্ট প্রদেশে গমন করিলেন।
সপ্তনবতিতম অধ্যায়
শান্তনুর জন্মবৃত্তান্ত
বৈশম্পায়ন কহিলেন, অনন্তর
সর্ব্বভূতহিতৈষী প্রতীপ পৃথিবীর অধিরাজ হইলেন। তিনি, যে স্থান হইতে ভাগীরথী
প্রবাহিত হইতেছেন, তথায় গমন করিয়া তপোনুষ্ঠান দ্বারা অনল্পকাল অতিবাহিত করিলেন। একদা
সুরধুনী রাজার রূপ ও গুণে মোহিত হই্য়া স্ত্রীরূপ-ধারণপূর্ব্বক জলমধ্য হইতে গাত্রোত্থান
করিয়া ধ্যানপর রাজর্ষির দক্ষিণ উরুদেশে উপবেশন করিলেন। মহীপাল প্রতীপ সেই
বরবর্ণিনীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ''কল্যাণি ! তুমি কি নিমিত্ত এখানে আগমন করিয়াছ?
তোমার কি প্রিয়কার্য সম্পাদন করিতে হইবে?'' তিনি কহিলেন মহারাজ,"আমি অন্য
কোন বস্তুর আকাঙ্ক্ষা করি না, কেবল আমার অভিলাষ পূর্ণ করুন; প্রণয়াকাঙ্ক্ষিণী রমনীকে
প্রত্যাখ্যান করা অতি গর্হিত কর্ম।'' প্রতীপ কহিলেন ''হে বরবর্ণিনি ! আমি ব্রতে
দীক্ষিত হইয়াছি ,অত্এব পরপরিগ্রহে [পরস্ত্রীতে] অথবা অসবর্ণা স্ত্রীতে গমন করিতে পারিব
না; তাহা করিলে আমাকে অধর্মস্পৃষ্ট হইতে হইবে।" দেবী কহিলেন মহারাজ, "অগম্যা অথবা
নিন্দনীয়া নহি, আমা হইতে কোনপ্রকার অনিষ্টশঙ্কা করিবেন না, আমি দিব্যাঙ্গনা, আপনার
প্রণয়পাশে আকৃষ্ট হইয়া অভিগমন করিয়াছি, অতএব আমাকে ভজনা করুন; পরকলত্র [পরনারী] বোধে
প্রত্যাখ্যান করবেন না।" প্রতীপ কহিলেন, "তুমি প্রিয়বোধে যে বিষয়ে আমাকে উৎসাহ দিতেছ, আমি
তাহাতে নিবৃত্ত হইয়াছি। এক্ষণে যদি তোমার প্রবর্ত্তনাপরতন্ত্র হইয়া সেই
অসাধুকার্য্যে
প্রবৃত্ত হই, তাহা হইলে ধর্মবিপ্লব আমাকে উৎসন্ন করিবে সন্দেহ নাই। বিশেষতঃ তুমি কামিনী
ভোগ্য বামোরু পরিত্যাগপূর্ব্বক পুৎত্র ও পুৎত্রবধূসেব্য দক্ষিণ উরুদেশে উপবেশন করিয়া
আমার পুৎত্রবধূস্থানীয় হইয়াছ, অতএব কিরূপে তোমাকে পত্নী বলিয়া স্বীকার করিতে পারি?
তুমি স্নুষাভগ্য [পুত্রবধূ]
দক্ষিণোরু আশ্রয় করিয়াছ, এই নিমিত্ত আমার
পুৎত্রবধু হইলে। আমি অঙ্গীকার করিতেছি, আমার পুৎত্রের সহিত তোমার বিবাহ দিব। এক্ষণে
পরিণায়ার্থ বরণ করিয়া রাখিলাম। স্ত্রী কহিলেন, ''মহারাজ ! আপনি সসাগরা
বসুন্ধরার অধীশ্বর। পৃথিবীস্থ সমস্ত রাজমণ্ডল আপনার অধীন। ত্বদীয় সদ্গুণাবলী
শত শত বৎসর নিরন্তর কীর্ত্তন করিলে তাহার অবধি [সীমা] লাভ হয় না; অতএব আপনার আজ্ঞা
সর্ব্বতোভাবে আলঙ্ঘনীয়। কেবল আপনার প্রতি অবিচলিত ভক্তি ও প্রীতিনিবন্ধন আমি
ভরতকুলের কামিনী হইতে বাসনা করিয়াছি। কিন্তু মহারাজ! আমি যে সকল কার্য্যের
অনুষ্ঠান করিব, তদ্বিষয়ে আপনার পুত্র বাঙ্নিষ্পত্তি [প্রতিবাদ] করিতে পারিবেন না । যদ্যপি তিনি
আমার সহিত এইরূপ ব্যবহার করেন, তাহা হইলে আমি তাঁহার প্রীতিবর্ন্ধনপূর্ব্বক
কালযাপন করিব এবং তিনিও আমার গর্ভে পুৎত্র উৎপাদন করিয়া পরিশেষে স্বর্গপ্রাপ্ত
হইবেন।'' এই কথা বলিয়া স্ত্রীরূপধারিণী গঙ্গা অন্তর্হিতা হইলেন।
মহারাজ প্রতীপ
পুৎত্রজন্ম-প্রতিক্ষায় কালক্ষেপ করিতে লাগিলেন। এই সময়ে ক্ষৎত্রিয়াগণী প্রতীপ
সস্ত্রীক হইয়া অনুরূপ পুৎত্রালাভার্থ তপস্যা করিতে আরম্ভ করিলেন। উল্লিখিত মহাভিষ
সেই বৃদ্ধ দম্পতির পুৎত্র হইলেন। শান্তিপর রাজার সন্তান হইল বলিয়া তাঁহার নাম
শান্তনু হইল। শান্তনু জন্মান্তরীণ অক্ষয় স্বর্গ স্মরণ করিয়া নিরন্তর কেবল সৎকর্মের
অনুষ্ঠানেই তৎপর হইলেন। তিনি তরুণাবস্থা প্রাপ্ত হইলে প্রতীপ তাঁহাকে আদেশ
করিলেন,''বৎস পূর্ব্বে এক দিব্যাঙ্গনা উৎপাদনার্থ মৎসকাশে আগমন করিয়াছিলেন; যদি
সেই রূপলাবণ্যবতী বরবণিনী পুৎত্রার্থিনী হইয়া তোমার নিকট আগমন করেন, তাহা হইলে তুমি
বিচার না করিয়া তাঁহার পাণিগ্রহণ করিও, আমি অনুমতি করিতেছি। আর তোমাকে তাঁহার
চিন্তানুবর্ত্তন করিতে হইবে। তিনি যখন যে কার্য্য করিবেন, তাহা বাস্তবিক গর্হিত হইলেও
তুমি কিঞ্চিন্মাত্র রোষ বা অসন্তোষ প্রকাশ করিও না।''
প্রতীপ
স্বীয় পুত্র শান্তনুকে এইরূপ উপদেশ প্রদানানন্তর তাঁহাকে
রাজ্যে অভিষিক্ত করিয়া অরণ্যে গমন করিলেন। অসাধারণ-ধীশক্তিসম্পন্ন রাজা শান্তনু
অত্যন্ত মৃগয়াশীল হইয়া উঠিলেন এবং মৃগয়াসক্ত হইয়া নানা বন ও উপবন পর্যটন করিতে
লাগিলেন। তিনি প্রতিদিন অরণ্যানী প্রবেশপূর্ব্বক মৃগ, মহিষ প্রভৃতি নানাজাতীয় বন্য
পশুর প্রাণসংহার করিয়া পরিশেষ একাকী সিদ্ধচারণগণ পরিসেবিত ভাগীরথীতীরে উপনীত হইলেন।
একদিবস মৃগয়া হইতে প্রত্যবৃত্ত হইয়া সাক্ষাৎ লক্ষীর ন্যায় উজ্জ্বলতনু পরমসুন্দরী এক
রমণীকে তরঙ্গীণী-তীরে নীরীক্ষণ করিলেন। সেই কামিনীর সুললিত নবযৌবন, রমণীয় দশনচ্ছদ
[অধর ওষ্ঠ] মনোহর বেশভূষা, সূক্ষ্ণ পরিধেয়-বস্ত্র ও পদ্মোদরসদৃশ রুচির [মনোজ্ঞ] বর্ণ নয়নগোচর করিয়া রাজা
বিস্মিত ও চমৎকৃত হইলেন; কণ্টকিত-কলেবর হইয়া সতৃষ্ণদৃষ্টিতে বারংবার তাহাকে নিরীক্ষণ
করিতে লাগিলেন; কিন্তু তাহার নয়ন-যুগল পরিতৃপ্ত হইল না। তিনি ইতস্ততঃ বিচরণ করিতে
আরম্ভ করিলেন। সেই বিলাসিনীও তদীয় প্রণয়াসক্ত হইয়া অবিতৃপ্তনয়নে রাজার প্রতি পুনঃ
পুনঃ দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন।
অনন্তর রাজা তাঁহাকে মধুরবাক্যে প্রিয়সম্ভাষণপূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, ''হে কৃশাঙ্গি! দেব, দানব, গন্ধর্ব্ব, অপ্সরা, যক্ষ, পন্নগ ও মনুষ্য ইহার মধ্যে তুমি কোন জাতিকে অলঙ্কৃত করিয়াছ? আমার বাসনা হয়, তোমার পাণিগ্রহণপূর্ব্বক তোমার সহবাসে যৌবনকাল চরিতার্থ করি।''