মহাভারত
আদিপর্ব


ভাষাংশ>মহাভারত >আদিপর্ব>অষ্টাধিকশততম,  নবাধিকশততমদশাধিকশততম অধ্যায়

অষ্টাধিকশততম অধ্যায়
মাণ্ডব্যশাপে যমের বিদুররূপে জন্ম

    বৈশম্পায়ন কহিলেন, তদন্তর মুনিবর সমাগত তপোধনদিগকে কহিলেন, ''আমি কাহার উপর দোষারোপ করিব? কেহই আমার নিকট অপরাধ করা নাই।'' ইহা শুনিয়া মুনিগণ প্রস্থান করিলেন। মহামুনি মাণ্ডব্য তদবস্থায় কালযাপন করিতে লাগিলেন। এইরূপ বহুকাল অতীত হইলে একদিবস নগরপালেরা মহর্ষিকে তদবস্থায় নিরীক্ষণ করিয়া রাজসমীপে সমস্ত বৃত্তান্ত নিবেদন করিল। রাজা নগরপালের মুখে সমুদয় শ্রবণ করিয়া মন্ত্রিগণের সহিত পরামর্শ স্থির করিয়া শূলস্থ ঋষিকে প্রসন্ন করিবার নিমিত্ত অশেষ প্রকার যত্ন করিতে লাগিলেন। তিনি অতি বিনীতভাবে কহিলেন, ''হে ব্রাহ্মণ্! আমি মোহান্ধতাপ্রযুক্ত যে গুরুতর দুষ্কর্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়াছি, তন্নিমিত্ত এক্ষণে ক্ষমা প্রার্থনা করি; আপনি আমার প্রতি ক্রুদ্ধ হইবেন না, প্রসন্ন হউন।'' ভূপতির বিনয়ে মুনীন্দ্র প্রসন্ন হইলেন। পরে রাজা তাঁহাকে শূল হইতে অবতরণ করাইয়া শূল বহির্গত করিবার নিমিত্ত অনেক যত্ন করিলেন, কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না। পরিশেষে শূলের মূলচ্ছেদ করিয়া দিলেন। ঋষি সেই অন্তর্গত শূল বহন করিয়া সর্ব্বত্র পর্য্যটন করিতে লাগিলেন এবং কঠোর তপস্যা দ্বারা অসুলভ লোক-সকল জয় করিলেন। তদবধি তিনি ভুমণ্ডলে অণীমাণ্ডব্য বলিয়া প্রথিত হইলেন। একদা তিনি যম সদনে গমনপূর্ব্বক সিংহাসনোপবিষ্ট ধর্ম্মরাজকে তিরস্কার করিয়া কহিলেন, ''হে ধর্ম্! আমি যে পাতকের ফলভোগ করিতেছি, ইহা কোন্ দুস্কর্ম্মের পরিণাম, শীঘ্র বল, আমি এই মুহুর্ত্তেই আমার তপোবল প্রকাশ করিতেছি।''
    ধর্ম্ম কহিলেন, ''তপোধন! আপনি পতঙ্গের পুচ্ছদেশে তৃণ প্রবিষ্ট করিয়াছিলেন, সেই দুষ্কর্ম্মের প্রতিফল প্রাপ্ত হইয়াছেন।'' অণীমাণ্ডব্য কহিলেন, ''ধর্ম্ম! তুমি আমার লঘু-পাপে গুরুদণ্ড বিধান করিয়াছ, এই নিমিত্ত তোমাকে মনুষ্য হইয়া শূদ্রযোনি প্রাপ্ত হইতে হইবে। আর আমি অদ্যবধি পাপপুণ্যের সীমা নির্দ্দিষ্ট করিয়া দিতেছি। চতুর্দশ বর্ষের অনধিক বয়ক্রমে কেহ পাপপুণ্যের ফলভাগী হইবে না, পঞ্চদশ বর্ষ অবধি কর্ম্মানুসারে ফললাভ হইবে।' ধর্ম্মরাজ স্বীয় অপরাধে মহাত্মা অণীমাণ্ডব্য কর্ত্তৃক অভিশপ্ত হইয়া বিদুররূপে শূদ্রযোনিতে জন্মগ্রহণ করিলেন। তিনি ধর্ম্মার্থচিন্তায় কুশল, লোভশূন্য, জিতক্রোধ, বহুদর্শী, শমপর ও কৌরবগণের পরম হিতৈষী ছিলেন।

নবাধিকশততম অধ্যায়
ধৃতরাষ্ট্রাদির জন্মে বিবিধ শুভলক্ষণ

    বৈশম্পয়ান কহিলেন, ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুর এই তিন কুমার জন্মগ্রহণ করিলে কুরুজাঙ্গল, কুরব এবং কুরুক্ষেত্র এই তিনটি জনপদ অতীব সমৃদ্ধসম্পন্ন হইয়া উঠিল। পৃথিবী সরস ও সুস্বাদ শস্যে পরিপুর্ণা হইল; পর্জ্জন্য [মেঘ] যথাকালে জলবর্ষণ করিতে লাগিল; পাদপসকল সুরস ফল-কুসুমে সুশোভিত হইল। গবাশ্বাদি বাহন সকল প্রহৃষ্ট, মৃগযুথ ও পক্ষিগণ সানন্দ, কুসুমমালা সুগন্ধি এবং ফলরাশি রসপূর্ণ হইল; নগর ব্যবসায়ী ও শিল্পিগণে পরিব্যাপ্ত হইল এবং জনপদস্থ সমস্ত লোক মহাবলপরাক্রান্ত, কৃতবিদ্য, সচ্চরিত্র ও পরম সুখী হইল। তৎকালে দস্যু-তস্করের কিছুমাত্র প্রাদুর্ভাব রহিল না; অধর্ম্মাচার লোকের অন্তর হইতে এককালে আন্তর্হিত হইল। প্রজাগণের রীতি, নীতি, সদাচার ও সদ্ব্যবহার সন্দর্শনে সেই সময়কে সত্যযুগ বলিয়া প্রতীয়মান হইত। প্রজামণ্ডলী ধর্ম্মনিরত, যজ্ঞশীল, সত্যপরায়ণ, ব্রতনিষ্ঠ ও পরস্পর প্রণয়পর হইয়া স্বচ্ছন্দে কালাতিপাত করিত। সকল লোকই অভিমানশূন্য, জিতক্রোধ ও লোভবিহীন হইল। দিন দিন তাহাদিগের ধর্ম্মপ্রবৃত্তির শ্রীবৃদ্ধি হইয়া উঠিল। জলপূরিত জলনিধির ন্যায় সেই জনাকীর্ণ নগর মেঘাকার তোরণকলাপ [নানা বর্ণচিত্রিত প্রধান প্রধান দ্বার সমূহ] দ্বারা অনির্ব্বচনীয় শোভমান হইল; শত শত সুরম্য হর্ম্ম্য দ্বারা মহেন্দ্রনগরী অমরাবতীর ন্যায় প্রতীয়মান হইতে লাগিল। বিলাসী নগরবাসী সকল তত্রত্য নদ, নদী, সরোবর প্রভৃতি জলাশয়ে এবং পরমরমণীয় বন, উপবন ও ক্রীড়াশৈলে মনের সুখে বিহার করিয়া বিপুল আনন্দ অনুভব করিতে আরম্ভ করিল। দাক্ষিণাত্য[দক্ষিণদিক্‌স্থিত] কুরুগণ উদীচ্য [উত্তরদিক্‌স্থিত] কুরুদিগের সর্ব্বদাই স্পর্দ্ধা করিতেন। সেই সুরম্য জনপদে কেহই কৃপণস্বভাব ছিলেন না; পতিবিহীনা কামিনী নেত্রগোচর হইত না; লোকহিতার্থে স্থানে স্থানে কূপ, বাপী [দীর্ঘিকা-দীঘি] আরাম [ রমনীয় উদ্যান-ফলফুলের সুন্দর বাগান] ও সভাসকল প্রতিষ্ঠিত ছিল; সুসমৃদ্ধ বিপ্রভবন-সকল অবিরত উৎসবময় পরিলক্ষিত হইত; ধর্ম্মাত্মা ভীষ্মের পরিরক্ষিত সেই জনপদের ঐশ্বর্য্য ও রমণীয়তার আর পরিসীমা রহিল না। চৈত ও যূপকাষ্ঠ তত্রস্থ জনগণের যাগশীলতার প্রমাণস্বরূপ লক্ষিত হইত। সেই সকল দেশ অন্যান্য রাজ্যের সাহায্য ব্যতিরেকেও পরিবর্দ্ধিত হইত; ধর্ম্মাত্মা ভীষ্ম তথায় ধর্ম্মচক্র প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন; রাজকুমারেরা নিরন্তর সৎকর্মের অনুষ্ঠান করিতেন। পৌর ও জনপদ-সকল তাঁহাদিগের আচরিত প্রণালী অবলম্বন করিবার নিমিত্ত সাতিশয় উৎসুক হইয়াছিলেন। তত্রত্য কুরুপ্রধানদিগের ও নগরবাসিগণের ভবনে 'দীয়তাং ভুজ্যতাং' [দান করদাও] এই বাক্যই সর্ব্বদা শ্রুতিগোচর হইত; মহাত্মা ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং মহামতি বিদুর ইহাদিগকে জন্মাবধি পুৎত্রনির্ব্বিশেষে প্রতিপালন করিতেন। তিনি তাঁহাদিগের জাতক্রিয়া প্রভৃতি সমস্ত সংস্কারে সংস্কৃত করিয়াছিলেন; উপযুক্ত শিক্ষকের সন্নিধানে নিযুক্ত করিয়া অধ্যয়ন করাইয়াছিলেন এবং পরিশ্রমে ও ব্যায়াম সুনিপুণ করিয়ছিলেন। রাজতনয়েরা তরুণাবস্থা প্রাপ্ত হইয়া ধনুর্ব্বেদ, গদাযুদ্ধ, অসিচর্ম্ম-প্রয়োগ, গজশিক্ষা, নীতিশাস্ত্র, ইতিহাস, পুরাণ, বেদাঙ্গ প্রভৃতি সমস্ত অধ্যেতব্য বিষয়ে পারদর্শী হইয়া উঠিলেন। তন্মধ্যে পাণ্ডু অদ্বিতীয় ধানুষ্ক [ধনুর্ব্বিদ্যায় নিপুণ] ও ধৃতরাষ্ট্র অসাধারণ বলবান্ ছিলেন। বিধুরের ন্যায় ধার্ম্মিক ত্রিভুবনমধ্যে দৃষ্টিগোচর হইত না। প্রনষ্টপ্রায় শান্তনুবংশ পুনরুদ্ধৃত হইলে সর্ব্বত্র সত্যের সমাদর ও গৌরব-বৃদ্ধি হইল। মহারাজ! তৎকালে সমস্ত বীরপ্রসবিনী রমণীগণের মধ্যে কাশীশ্বরনন্দিনী, দেশের মধ্যে কুরুজাঙ্গল, ধার্ম্মিকের মধ্যে বিদুর এবং নগরের মধ্যে হস্তিনাপুর শ্রেষ্ঠ হইয়া উঠিল। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ ছিলেন, বিদুর পারসব [ব্রাহ্মণ হইতে শূদ্রাগর্ভজাত] সুতরাং পাণ্ডুই সিংহাসনে অধিরূঢ় হইলেন।

দশাধিকশততম অধ্যায়
ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুর বিবাহ মন্ত্রণা

    একদা ভীষ্ম বিদুরকে সন্বোধন করিয়া কহিলেন, ''বৎস! ভূমণ্ডলস্থ সমস্ত নরেন্দ্রকুল অপেক্ষা অস্মাৎকুল সমধিক গুণভূয়িষ্ঠ [গুণবহুলবহুগুণযুক্ত] ও প্রসিদ্ধ। ইহা পূর্ব্বতন সুধার্ম্মিক নরেন্দ্রগণ কর্ত্তৃক পরিরক্ষিত হইয়া আসিতেছে। অধুনা ইহার উচ্ছেদ নিতান্ত দুর্ব্বিষহ বিবেচনা করিয়া ভগবতী সত্যবতী, মহাত্মা দ্বৈপায়ন এবং আমি, এই তিন জনে মিলিত হইয়া যুক্তিযুক্ত ও শাস্ত্রসিদ্ধ উপায়োদ্ভাবনপূর্ব্বক তোমাদিগকে উৎপাদন করাইয়া পুনর্ব্বার ইহাকে প্রতিষ্ঠিত করিলাম, অতএব এক্ষণে যাহাতে আমাদিগের বংশের ক্রমশঃ উন্নতি হয়, তাহার উপায়-বিধান করা আমাদিগের সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য, সন্দেহ নাই। শুনিয়াছি, মদ্রেশ্বর ও সুবলের পরমসুন্দরী এক এক কুমারী আছে, তাহারা আমাদিগের কুলের অনরূপা; অতএব সেই কুলীনা কামিনীদ্বয়ের সহিত ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর সম্বন্ধ স্থির করাই উচিত। এই কুলের স্থায়িতার নিমিত্ত আমি তাহাদিগকে বরণ করিতে অভিলাষ করি, তোমার অভিপ্রায় কি? বিদুর কহিলেন, ''মহাশয়! আপনি আমাদিগের পিতৃতুল্য ও পরমগুরু; অতএব যাহা উচিত হয়, স্বয়ং বিচারপূর্ব্বক অনুষ্ঠান করুন।''

গান্ধারীসহ ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহ

‌    অনন্তর কুরুপিতামহ ভীষ্ম বিপ্রগণ-প্রমুখাৎ শ্রবণ করিলেন, সুবলাত্মজা গান্ধারী ভগবান্ ভবানীপতিকে আরাধনা করিয়া বরলাভ করিয়াছেন যে, তিনি একশো পুৎত্রের জননী হইবেন। সেই কন্যার প্রার্থনায় গান্ধাররাজের নিকট দূত প্রেরণ করিলেন; গান্ধাররাজ সুবল প্রথমতঃ ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ বলিয়া কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিলেন, পরিশেষে সবিশেষ পর্য্যালোচনা করিয়া সুবিখ্যাত কুল, মহতী খ্যাতি ও সদ্‌বৃত্ত জামাতার অভিলাষে তাঁহাকেই কন্যাদান করিতে কৃতনিশ্চয় হইলেন। যখন গান্ধারী শ্রবণ করিলেন যে, পিতামাতা তাঁহাকে নয়নহীন পাত্রে সম্প্রদান করিতে অভিলাষী হইয়াছেন, তখনই সেই পতিপরায়ণা সান্দ্র [ঘন,গাঢ়একাধিক পরদাবিশিষ্ট] বস্ত্র দ্বারা স্বীয় নেত্রযুগল বন্ধন করিলেন এবং মনে মনে সঙ্কল্প করিলেন যে, পতি অন্ধ বলিয়া তাঁহাকে কদাপি অশ্রদ্ধা বা অসুয়া করিব না। গান্ধাররাজতনয় পিতৃ-আজ্ঞায় অভিনব-যৌবনবতী ও লক্ষীযুক্তা ভগিনী লইয়া কৌরবসমীপে উপনীত হইলেন। তদন্তর ভীষ্মের অনুমতিক্রমে তাঁহাকে ধৃতরাষ্ট্র-হস্তে সম্প্রদান করিলেন এবং তিনি ভীষ্ম কর্তৃক যথোচিত পূজিত হইয়া স্বনগরে প্রত্যাগমন করিলেন। বরারোহা [উত্তমা-সুশীলা] গান্ধারী সদাচর, সদ্ব্যবহার ও সুশীলতা প্রদর্শন দ্বারা সমস্ত কৌরবগণের পরম সন্তোষ জন্মাইতে লাগিলেন। তিনি গুরুশুশ্রূষা ও সকলকে প্রিয়-সম্ভাষন করিতেন এবং কদাপি কাহারও অকীর্ত্তি বা নিন্দা করিতেন না।