মহাভারত
আদিপর্ব
ষোড়শ-সপ্তদশ অধ্যায়


ভাষাংশ>মহাভারত >আদিপর্ব>ষোড়শ-সপ্তদশ অধ্যায়


ষোড়শ অধ্যায়
অরুণ ও গরুড়ের জন্ম

    শৌনক কহিলেন, হে সূতনন্দন! তুমি যাহা কীর্ত্তন করিলে, পুনর্ব্বার তাহাই সবিস্তরে বর্ণন কর; আস্তীকবৃত্তান্ত বিশেষরূপে শ্রবণ করিতে আমাদিগের নিতান্ত ঔৎসুক্য হইয়াছে। আস্তীকোপাখ্যানটি অতি সুললিত ও সুমধুর বোধ হইল। ইহা শুনিয়া আমার পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হইয়াছি। ফলতঃ তুমি পুরাণকীর্ত্তনবিষয়ে স্বীয় পিতার ন্যায় পাণ্ডিত্য প্রকাশ করিয়াছ। তোমার পিতা যেমন অনন্য বিষয়ানুরক্ত হইয়া প্রত্যহ আমাদিগকে পুরাণ শ্রবণ করাইতেন, এক্ষণে তুমিও সেইরূপ অনন্যমনা ও অনন্যকর্ম্মা হইয়া আমাদিগকে পুরাণ শ্রবণ করাও।
    উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, হে মহাত্মন্! আমি পিতার নিকট আস্তীকোপখ্যান যেরূপ শুনিয়াছি, অবিকল সেইরূপ কহিতেছি, শ্রবণ করুন। সত্যযুগে দক্ষপ্রজাপতির কদ্রু ও বিনতা নামে দুই পরমাসুন্দরী কন্যা ছিলেন। মহর্ষি কশ্যপ ঐ দুই কন্যার পাণিগ্রহণ করেন। একদা তিনি সেই ধর্ম্মপত্নীদ্বয়ের প্রতি অতিমাত্র প্রসন্ন হইয়া তাঁহাদিগকে বরপ্রদান করিতে চাহিলেন। "পরস্পর সমান-পরাক্রান্ত, এইরূপ সহস্রনাগ আমার পুৎত্র হউক" বলিয়া কদ্রু বর প্রার্থনা করিলেন; কিন্তু বিনতা এই বর চাহিলেন, "আমার দুইটি মাত্র পুৎত্র হউক, কিন্তু তাহারা যেন বল, বিক্রম ও শরীরে কদ্রু-পুৎত্র অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হয়।" মহর্ষি কশ্যপ "তথাস্তু" বলিয়া তাঁহাদিগকে সেই অভিলষিত বর প্রদান করিলেন। বিনতা স্বামিসন্নিধানে স্বাভিলষিত বর সংপ্রাপ্ত হইয়া সাতিশয় সন্তুষ্টা ও কৃতার্থম্মন্যা হইলেন। কদ্রু তুল্যতেজস্বী পুৎত্র-সহস্র-লাভে আপনাকে কৃতকৃত্য জ্ঞান করিলেন। মহাতপা কশ্যপ পত্নীদিগকে "তোমরা স্বীয় প্রযত্নে গর্ভধারণ করিও" এই আদেশ দিয়া অরণ্যানী প্রবেশ করিলেন।
    বহুকালের পর কদ্রু অণ্ড-সহস্র ও বিনতা অণ্ডদ্বয় প্রসব করিলেন। পরিচারিকাগণ সেই সমুদয় অণ্ড উপস্বেদযুক্ত [তাপসংযুক্ত– ডিমে তা দেওয়া হয় এইরূপ।] ভাণ্ডমধ্যে পঞ্চশত বৎসর রাখিলেন। তৎপরে কদ্রু-প্রসূত অণ্ডসহস্র হইতে এক একটি পুৎত্র বহির্গত হইল। কিন্তু বিনতার অণ্ডদ্বয় তদবস্থই রহিল। পুৎত্রার্থিনী বিনতা তদ্দর্শনে সাতিশয় লজ্জিতা হইয়া স্ব-প্রসূত অণ্ডদ্বয়ের অন্যতর ভেদ করিয়া দেখিলেন যে, পুৎত্রের পূর্ব্বার্দ্ধকায়মাত্র সুসঙ্ঘটিত হইয়াছে, অন্যার্দ্ধ অতিশয় অপক্কাবস্থায় রহিয়াছে। তখন সেই সদ্যঃ-প্রসূত পুৎত্র সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া স্বীয় জননীকে অভিসম্পাত করিলেন, "লোভ-পরতন্ত্র হইয়া অপক্কাবস্থায় অণ্ড-ভেদনপূর্ব্বক আমাকে তন্মধ্য হইতে বাহির করা তোমার নিতান্ত অসদৃশ কর্ম্ম হইয়াছে; অতত্রব তুমি যে সপত্নীর সহিত স্পর্দ্ধাপ্রযুক্ত এই অন্যায্য কার্য্যের অনুষ্ঠান করিলে, পঞ্চাশৎ বৎসর তোমাকে সেই সপত্নীর দাসী হইয়া থাকিতে হইবে।" আরও বলিলেন, "এই অপর অণ্ডমধ্যে তোমার যে পুৎত্র আছে, যদি অকালে অণ্ডভেদ না কর এবং তাহাকেও আমার ন্যায় হীনাঙ্গ বা বিকলাঙ্গ না কর, তবে সেই তোমাকে দাসীত্ব হইতে মোচন করিবে। যদি তুমি আপন পুৎত্রকে বিশিষ্টরূপে বল বিক্রমশালী করিতে চাও, তবে ধৈর্য্যধারণপূর্ব্বক ইহার জন্মকাল প্রতীক্ষা কর। ইহার জন্মের আরও পঞ্চশত বৎসরকাল বিলম্ব আছে।"
    অরুণ এইরূপে জননীকে শাপ প্রদান করিয়া আকাশপথে আরোহণপূর্ব্বক সূর্য্যদেবের সারথ্যকার্য্যে নিযুক্ত হইলেন। সর্পভোজী গরুড়ও যথাকালে জন্মিলেন। তিনি জন্মিবামাত্র ক্ষুধাতুর হইয়া স্বীয় জননী বিনতাকে পরিত্যাগপূর্ব্বক বিধাতৃবিহিত স্বকীয় আহার-সংগ্রহার্থে আকাশমণ্ডলে উড্ডীয়মান হইলেন।


সপ্তদশ অধ্যায়
সমুদ্রমন্থনের প্রশ্ন

    উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, হে তপোধন! ঐ সময়ে উচ্চৈঃশ্রবা কদ্রু ও বিনতার সমীপ দিয়া গমন করিতেছিল। দেবগণ অমৃতমন্থনকালে উৎপন্ন সেই সর্ব্বোৎকৃষ্ট ও সর্ব্ব-সুলক্ষণ-সম্পন্ন হয়-রত্নকে গমন করিতে দেখিয়া প্রশংসা করিতে লাগিলেন।
    শৌনক কহিলেন, হে সূতপুৎত্র! তুমি কহিলে, সেই মহাবীর্য্য অশ্বরাজ সুধা-মন্থনসময়ে উৎপন্ন হয়; অতএব জিজ্ঞাসা করিতেছি, বল, দেবগণ কি কারণে ও কোন্ স্থানে অমৃত-মন্থন করিয়াছিলেন?
    উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, সুমেরু নামে এক পরম রমণীয় মহীধর আছে। যাহার সুবর্ণময় শৃঙ্গ-পরম্পরার প্রভাজাল প্রদীপ্ত সূর্য্যের প্রভামণ্ডলকে তিরস্কৃত করে, যে অপ্রমেয় ভূধর দেবগণ ও গন্ধর্ব্বগণের আবাস-স্থান, যাহাতে দুর্দ্দান্ত হিংস্র-জন্তুগণ সর্ব্বদা বিচরণ করে, যে পর্ব্বত প্রতিদিন রজনীযোগে নানা প্রকার ওষধি দ্বারা আলোকময় হয় এবং যে পর্ব্বত উন্নতি দ্বারা অমরলোক আচ্ছন্ন করিয়া রহিয়াছে, নানাবিধ নদ নদী ও তরুলতাগণ যাহাকে সুরভিত করিয়াছে, মনোহর বিহঙ্গমগণ যাহার বৃক্ষশাখায় বসিয়া সর্ব্বদা সুমধুরস্বরে কলরব করিতেছে, যে সুবর্ণময় মহীধর প্রাকৃত-জনসমূহের মনেরও অগোচর, একদা, তপোনিয়মানুরক্ত, প্রবলপরাক্রান্ত দেবগণ সেই পর্ব্বতের নানারত্ন সুশোভিত শিখরদেশে উপবেশনপূর্ব্বক অমৃতপ্রাপ্তিবিষয়ক মন্ত্রণা করিতেছিলেন। ভগবান্ ভূতভাবন নারায়ণ দেবতাদিগকে এইরূপে মন্ত্রণা করিতে ব্যাসক্ত দেখিয়া ব্রহ্মাকে কহিলেন, "দেবগণ ও অসুরগণ একত্র হইয়া জলধিমন্থন করিতে আরম্ভ করুন। মন্থন করিলে সমুদ্র হইতে অমৃত উত্থিত হইবে।" তদনন্তর দেবগণকে কহিলেন, "হে সুরগণ! তোমরা সমুদ্র-মন্থন কর, কিন্তু বহুবিধ ওষধি এবং রত্নসমূহ পাইয়াও মন্থনে ক্ষান্ত হইও না। ধৈর্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক অনবরতই মন্থন করিতে থাকিবে, তাহা হইলেই তোমাদের অমৃতলাভ হইবে, সন্দেহ নাই।"