মহাভারত
আদিপর্ব
ভাষাংশ>মহাভারত >আদিপর্ব>সপ্তত্রিংশ-অষ্টত্রিংশ অধ্যায়
সপ্তত্রিংশ অধ্যায়
আত্মরক্ষার্থ নাগগণের মন্ত্রণা
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, ভুজঙ্গোত্তম বাসুকি মাতৃদত্ত শাপ শ্রবণ
করিয়া কিরূপে সেই শাপমোচন হইবে, তদ্বিষয়িণী চিন্তায় একান্ত মগ্ন হইলেন। তদনন্তর
তিনি ধর্ম্মপরায়ণ ঐরাবত প্রভৃতি ভ্রাতৃগণের সহিত পরামর্শ করিলেন যে, "মাতা আমাদিগকে
যে শাপ প্রদান করিয়াছেন, তাহা তোমরা সকলই জান; অতএব আইস, আমরা যাহাতে সেই শাপ হইতে
মুক্ত হইতে পারি, এরূপ চেষ্টা করি। সর্ব্বপ্রকার শাপেরই প্রতিবিধানোপায় আছে, কিন্তু
মাতৃদত্ত শাপমোচনের কোন উপায় দেখি না। জননী অব্যয়, অপ্রমেয়, সনাতন ব্রহ্মার সমক্ষেই
আমাদিগকে শাপ প্রদান করিয়াছেন এবং সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মা তাঁহাকে শাপ-প্রদানে
উদ্যত দেখিয়াও নিবৃত্ত করেন নাই, ইহা শুনিয়া আমার হৃৎকম্প উপস্থিত হইতেছে। বোধ করি,
নিশ্চয়ই আমাদিগকে সমূলে বিনষ্ট হইতে হইবে। তথাপি সম্প্রতি যাহাতে সমস্ত ভুজঙ্গমগণের
মঙ্গল হয়, তদ্বিষয়ে পরামর্শ করা যাউক। আমরা সকলই বুদ্ধিমান্ ও বিচক্ষণ, মন্ত্রণা
দ্বারা অবশ্যই কোন-না-কোন উপায় স্থির করিতে পারিব। দেখ, পূর্ব্বকালে অগ্নি
গুহামধ্যে তিরোহিত হইয়াছিলেন, কিন্তু দেবগণ পরামর্শ দ্বারা তাঁহার পুনরুদ্ভাবন
করেন। অতএব এক্ষণে যাহাতে জনমেজয়ের যজ্ঞ না হয় অথবা নিষ্ফল হয়, তাহার চেষ্টা দেখা
যাউক।"
মন্ত্রণাবিশারদ সর্পগণ ভুজঙ্গরাজ বাসুকির এই কথা শুনিয়া
তৎকার্য্যসম্পাদনে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞা করিলেন। তাঁহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ কহিলেন, "আইস,
আমরা ব্রাহ্মণবেশ ধারণ করিয়া জনমেজয়ের নিকট যাইয়া তিনি যাহাতে সর্পযজ্ঞ না করেন,
এইরূপ ভিক্ষা প্রার্থনা করি।" কোন কোন পাণ্ডিত্যাভিমানী ভুজঙ্গম কহিলেন, "চল, আমরা
সকলে গিয়া তাঁহার মন্ত্রী হই, তাহা হইলে তিনি অবশ্যই আমাদিগের পরামর্শ লইয়া সকল
কার্য্য অনুষ্ঠান করিবেন। তিনি যজ্ঞবিষয়িণী কোন মন্ত্রণা জিজ্ঞাসা করিলে, আমরা
তদনুষ্ঠানে ইহলোকে ও পরলোকে নানাপ্রকার দোষ ঘটিতে পারে, ইহা প্রদর্শন করিয়া এবং
অন্যান্য কারণ দর্শাইয়া যাহাতে সেই যজ্ঞ না হয়, এরূপ পরামর্শ দিব।" কেহ কহিলেন,
রাজার হিতসাধনে তৎপর যে-কোন সর্পযজ্ঞবিধানজ্ঞ ব্যক্তি সেই যজ্ঞের উপাধ্যায় হইবেন,
কোন ভুজঙ্গম যাইয়া তাঁহাকে দংশন করিবে; উপাধ্যায়ের মৃত্যু হইলে সুতরাং
যজ্ঞানুষ্ঠানের বিষম ব্যাঘাত জন্মিবে; তদ্ভিন্ন অন্যান্য যে-সকল সর্পসত্রজ্ঞ
ব্যক্তি সেই যজ্ঞে ঋত্বিক্ হইতে আসিবেন, আমরা সকলে যাইয়া তাঁহাদিগকে দংশন করিব,
তাহা হইলে আর যজ্ঞ হইতে পারিবে না।"
এই কথা শুনিয়া অন্যান্য ধর্ম্মপরায়ণ দয়াবান্ নাগগণ কহিলেন,
"তোমরা যাহা কহিতেছ, এ অতি অসৎ পরামর্শ; ব্রহ্মহত্যা করা কোনক্রমেই বিধেয় নহে,
বিপৎকালে ধর্ম্মপথ অবলম্বনপূর্ব্বক প্রতীকারচেষ্টা করাই কর্ত্তব্য; কারণ,
অধর্ম্মানুষ্ঠান সমস্ত জগতের বিনাশকারী।" কতকগুলি ভুজঙ্গম কহিলেন, "আমরা জলধর কলেবর
ধারণ করিয়া মুষলধারে জলবর্ষণ দ্বারা প্রজ্বলিত যজ্ঞাগ্নি নির্ব্বাণ করিব, কিংবা
রাত্রিকালে ঋত্বিক্গণ অনবহিত হইলে কোন সর্প তথায় উপস্থিত হইয়া স্রুগ্ভাণ্ড
প্রভৃতি যজ্ঞীয় দ্রব্যসমুদয় অপহরণ করিবে, তাহা হইলেই যজ্ঞের বিঘ্ন ঘটিবে। অথবা শত
শত ভুজঙ্গম সেই যজ্ঞস্থলে এককালে উপস্থিত হইয়া তত্রত্য সমস্ত লোকদিগকে দংশন করিতে
উদ্যত হইবে, তাহা হইলে তাহাদিগের অবশ্যই ভয় জন্মিবে কিংবা সর্পগণ সংস্কৃত যজ্ঞীয়
সামগ্রী-সমুদয় স্বীয় মূত্র-পুরীষ দ্বারা দূষিত করিবে, তাহাতেও যজ্ঞবিঘ্নের বিলক্ষণ
সম্ভাবনা।"
অন্যান্য নাগগণ কহিল, "আমরাই ঐ যজ্ঞে ঋত্বিক্ হইয়া প্রথমেই
'দক্ষিণা প্রদান কর' বলিয়া যজ্ঞবিঘ্ন সমুৎপাদন করিব, তাহা হইলেই রাজা আমাদিগের
বশীভূত হইবেন এবং যাহা বলিব, তাহাই করিবেন।" অপর ভুজঙ্গমগণ কহিল, "রাজা যখন
জলক্রীড়া করিবেন, সেই সময়ে তাঁহাকে ধরিয়া আপনাদিগের আলয়ে আনয়নপূর্ব্বক বন্ধ করিয়া
রাখিব।" কোন কোন পাণ্ডিত্যাভিমানী ভুজঙ্গম কহিলেন, "আইস, আমরা অন্যান্য চেষ্টা
পরিত্যাগ করিয়া রাজা জনমেজয়কেই দংশন করি, তিনি মরিলে সকল অনর্থের মূলচ্ছেদ হইবে।"
পরিশেষে সকলে বাসুকিকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, "হে রাজন্! আমরা স্ব স্ব বুদ্ধি
অনুসারে কহিলাম, এক্ষণে আপনার যাহা অভিরুচি হয়, করুন; আর কালক্ষেপ করা কোনক্রমেই
বিধেয় নহে।" এই বলিয়া সমস্ত নাগগণ তাঁহার মুখ নিরীক্ষণ করিতে লাগিল।
বাসুকি তাঁহাদিগের বাক্য-শ্রবণানন্তর ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া
কহিলেন, "হে ভুজঙ্গমগণ! তোমরা সকলে যে যে উপায় নির্দ্দেশ করিলে, তন্মধ্যে একটিও
আমার মনোগত হইতেছে না। যাহাতে সকলের হিতসাধন হয়, তাহাই করা কর্ত্তব্য, অতত্রব এ
বিষয়ে ভগবান্ কশ্যপকে প্রসন্ন করাই আমার শ্রেয়ঃকল্প বোধ হইতেছে। জ্ঞাতিগণের প্রতি
সৌহার্দ্দ্য ও আত্মস্নেহবশতঃ আমি তোমাদিগের বাক্যানুসারে কর্ম্ম করিতে ইচ্ছা করি
না। কারণ, এক্ষণে আমি তোমাদের সর্ব্বজ্যেষ্ঠ, যাহাতে সমস্ত বান্ধবগণের মঙ্গল হয়,
আমার সর্ব্বতোভাবে তাহাই করা কর্ত্তব্য। এ বিষয়ে দোষ-গুণ যে কিছু ঘটিবে, তোমরা কেহই
তাহার অংশভাগী হইবে না, সমস্তই আমার উপর পড়িবে, এই নিমিত্ত আমি সবিশেষ সন্তপ্ত
হইতেছি।"
অষ্টত্রিংশ অধ্যায়
নাগরক্ষার গুপ্তবাণী
উগ্রশ্রবাঃ
কহিলেন, বাসুকির ও অন্যান্য নাগগণের এই সকল বাক্য শ্রবণ করিয়া এলাপত্র নামক সর্প
বাসুকিকে সন্বোধন করিয়া কহিলেন, হে ভুজঙ্গমনাথ! সেই সর্পসত্র অবশ্যই হইবে সন্দেহ
নাই এবং যে জনমেজয় রাজা হইতে আমাদিগের মহৎ ভয় উপস্থিত, তাঁহাকেও বঞ্চিত করিতে পারা
যাইবে না। হে রাজন্! যে ব্যক্তি দৈবপর হয়, তাহার দৈবের উপর নির্ভর করাই
সর্ব্বতোভাবে বিধেয়। কারণ, সে স্থলে দৈব ব্যতিরেকে তাহার রক্ষা পাইবার আর কোন
উপায়ান্তর নাই। হে পন্নগোত্তম! আমাদিগের এ ভয়কে দৈব-ভয় বলিতে হইবে, অতএব দৈব
অবলম্বন করাই উত্তম কল্প বোধ হইতেছে। এ বিষয়ে আমি যাহা কহিতেছি, তোমরা
অবধানপূর্ব্বক শ্রবণ কর। যখন মাতা আমাদিগকে শাপ দেন, আমি সেই সময়ে
ত্রাসাকুলিতচিত্তে তাঁহার ক্রোড়ে বলিয়া দেবগণের এই কথা শুনিয়াছিলাম। দেবগণ সাতিশয়
দুঃখিত হইয়া ব্রহ্মার নিকট গিয়া কহিলেন, "হে পিতামহ! পাষাণহৃদয়া কদ্রু আপনার
সম্মুখেই স্বীয় প্রিয়পুৎত্রগণকে যেরূপ দারুণ অভিসম্পাত করিলেন, মাতা হইয়া পুৎত্রের
প্রতি সেরূপ শাপ প্রদান করিতে কেহই পারে না। আপনিও "এবমস্ত" বলিয়া তাঁহার সেই
বাক্যে অনুমোদন করিলেন; অতএব হে ব্রহ্মন্! আপনি কি নিমিত্ত তাঁহাকে স্ব-সমক্ষে শাপ
প্রদানে উদ্যত দেখিয়াও নিবারণ করিলেন না, তাহা শুনিতে বাসনা করি।'
ব্রহ্মা কহিলেন, 'সর্পগণ অতিশয় তীক্ষ্ণবিষ, খল ও প্রজাগণের
অহিতকারী, অতএব আমি প্রজাগণের হিতকামনায় শাপ প্রদানোদ্যতা কদ্রু নিবারণ করি নাই;
কিন্তু সর্পসত্রে কেবল তীক্ষ্ণবিষ, নীচাশয় ও পাপাচার বিষধরদিগেরই বিনাশ হইবে;
ধার্ম্মিক নাগগণের কোন অপচয় হইবে না। তৎকালে তাঁহারা যে প্রকারে ঐ শাপ হইতে মুক্ত
হইবেন, তাহা শ্রবণ কর। যাযাবরবংশ অসাধারণ-ধীশক্তিসম্পন্ন, তপোনিরত, জিতেন্দ্রিয়,
জরৎকারু নামে এক মহর্ষি জন্মগ্রহণ করিবেন। তাঁহার ঔরসে আস্তীক নামে এক পুৎত্র
জন্মিবেন। তিনি মহারাজ জনমেজয়কে সর্পযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিতে নিষেধ করিবেন। তাহা হইলে
ধর্ম্মশীল সর্পগণের পরিত্রাণ হইবে।'
ব্রহ্মার এই বাক্য শ্রবণ করিয়া দেবগণ জিজ্ঞাসা করিলেন, "হে
ব্রহ্মন্! মহাতপা, মহাবীর্য্য, মুনিবর জরৎকারু কাহার গর্ভে সেই মহানুভব পুৎত্র
আস্তীককে উৎপাদন করিবেন?' ব্রহ্মা কহিলেন, 'বীর্য্যবান্ জরৎকারু সনাম্নী কন্যাতে
সেই মহাবীর্য্যসম্পন্ন পুৎত্র উৎপাদন করিবেন। সর্পরাজ বাসুকির জরৎকারুনাম্নী এক
ভগিনী আছেন। তাঁহার গর্ভে সেই পুৎত্র জন্মিবেন এবং তৎকর্ত্তৃক সর্পকুলের পরিত্রাণ
হইবে।' দেবগণ ব্রহ্মার এই বাক্য শ্রবণ করিয়া 'তথাস্তু' বলিলেন। সর্ব্বলোকপিতামহ
ব্রহ্মাও তাঁহাদিগকে এই কথা বলিয়া ত্রিদশালয়ে প্রস্থান করিলেন।
অতএব হে নাগাধিরাজ বাসুকে! নাগগণের ভয়শান্তির নিমিত্ত সেই
সুব্রত ভিক্ষমাণ [ভাবী যাচ্ঞাকারী–
যিনি ভিক্ষা করিবেন] মহর্ষিকে তোমার জরৎকারুনাম্নী ভগিনী ভিক্ষাস্বরূপ সম্প্রদান
কর, তাহা হইলেই নাগকুল পরিত্রাণ পাইবে। আমি নাগগণের এই মোক্ষোপায় শ্রবণ করিয়াছি।"
ঊনচত্বারিংশ অধ্যায়
নাগগণের আশ্বস্তি
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, নাগগণ এলাপত্রের এই বাক্যশ্রবণে সাতিশয় আহ্বাদিত হইয়া
তাঁহাকে সাধুবাদ করিতে লাগিলেন। নাগরাজ বাসুকিও সেই কথা শ্রবণ করিয়া পরম পরিতোষ
প্রাপ্ত হইলেন এবং তদবধি জরৎকারুনাম্নী নিজ ভগিনীকে অতি প্রযত্নে রক্ষণাবেক্ষণ
করিতে লাগিলেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে দেবাসুরগণ একত্র হইয়া
সমুদ্রমন্থন আরম্ভ করিলেন। সর্ব্বনাগশ্রেষ্ঠ বাসুকি তাহাতে মন্থনরজ্জু হইয়াছিলেন।
সমুদ্রমন্থন সমাপ্ত হইলে দেবগণ বাসুকিকে সমভিব্যাহারে লইয়া ব্রহ্মার নিকটে
গমনপূর্ব্বক নিবেদন করিলেন, "ভগবান্! এই নাগকুলাগ্রণী
বাসুকি মাতৃশাপে ভীত হইয়া অত্যন্ত সন্তপ্ত হইয়াছেন। আপনি অনুগ্রহ করিয়া
জ্ঞাতিকুলহিতৈষী নাগরাজের মাতৃশাপরূপ হৃদয়শল্য উৎপাটন করুন। ইনি আমাদিগের অত্যন্ত
প্রিয়কারী ও হিতসাধনে তৎপর, অতএব অনুকূল হইয়া আপনাকে ইঁহার মনোব্যথা নিবারণ করিতে
হইবে।"
দেবগণের এই প্রার্থনা শ্রবণ করিয়া
ব্রহ্মা কহিলেন, "পূর্ব্বে এলাপত্র সর্প ইঁহাকে যাহা
কহিয়াছেন, সে আমারই বাক্য। ইনি সেই বাক্যানুসারে কার্য্য করুন, তাহার সময়ও উপস্থিত
হইয়াছে। যাহারা দুরাচার ও পাপিষ্ঠ, তাহারাই সর্পসত্রে বিনষ্ট হইবে। ধর্ম্মপরায়ণ
নাগগণের কিছুই ভয় নাই। সেই জরৎকারু জন্মগ্রহণ করিয়াছেন এবং কঠোর তপস্যার অনুষ্ঠান
করিতেছেন। নাগরাজ বাসুকি তাঁহাকে যথাকালে ভগিনী প্রদান করুন। হে দেবগণ! এলাপত্র
যাহা কহিয়াছেন, উহা নাগকুলের পরম হিতকর, উহাতে সন্দেহ নাই।"
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, নাগাধিপ বাসুকি
সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মার এই বাক্য শ্রবণ করিয়া অবধি জরৎকারুকে ভগিনী প্রদান করিতে
সঙ্কল্প করিলেন এবং ঐ সঙ্কল্পে বহুসংখ্যক সর্পদিগকে তদীয় সন্নিধানে সতত অবস্থান
করিতে প্রেরণ করিলেন। ভুজঙ্গমরাজ তাহাদিগকে এই কহিয়া দিলেন, "ভগবান্
জরৎকারু যে মুহূর্ত্তে দারপরিগ্রহ করিতে অভিলাষ প্রকাশ করিবেন, তোমরা তৎক্ষণাৎ
আসিয়া আমাকে সংবাদ দিবে।"
চত্বারিংশ অধ্যায়
পরীক্ষিতের ব্রহ্মশাপ
শৌনক কহিলেন, হে সূতনন্দন! তুমি জরৎকারুনামা যে মহর্ষির বিবরণ কহিলে, তিনি
কি নিমিত্ত জগতে জরৎকারু নামে বিখ্যাত হইয়াছিলেন এবং জরৎকারু শব্দের যথাশ্রুত অর্থই
বা কি, তাহা আমি শুনিতে ইচ্ছা করি, বর্ণন কর।
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, জরাশব্দের অর্থ
ক্ষয়, কারু শব্দের অর্থ দারুণ। সেই মহর্ষির শরীর সাতিশয় দারুণ ছিল, তিনি কঠোর
তপস্যা দ্বারা ক্রমে ক্রমে সেই দারুণ শরীরকে ক্ষীণ করিয়াছিলেন, তন্নিমিত্ত তাঁহার
নাম জরৎকারু হইল এবং উক্ত কারণবশতঃ বাসুকির ভগিনী জরৎকারু নামে বিখ্যাত হইলেন।
মহর্ষি শৌনক তৎশ্রবণে কিঞ্চিৎ হাস্য
করিয়া কহিলেন, হাঁ, তুমি যাহা বলিলে. ইহা যুক্তিসিদ্ধ বটে। তুমি ইতিপূর্ব্বে যাহা
যাহা কীর্ত্তন করিলে, তৎসমস্তই আমি শ্রবণ করিলাম। এক্ষণে আস্তীকের জন্মবৃত্তান্ত
শ্রবণ করিতে বাসনা করি, বর্ণনা কর।
উগ্রশ্রবাঃ শৌনকের এই বাক্য শ্রবণ
করিয়া শাস্ত্রানুসারে কহিতে লাগিলেন। মহামতি বাসুকি ভুজঙ্গমগণের প্রতি উক্তরূপ আদেশ
দিয়া মহর্ষি জরৎকারুকে ভগিনী প্রদান করিতে উদ্যত হইয়া রহিলেন। বহুকাল অতীত হইল,
তথাপি ঊর্দ্ধ্বরেতা স্বাধ্যায়নিরত সেই মহাত্মা দারপরিগ্রহে অভিলাষী হইলেন না। তিনি
কেবল তপস্যাদি ধর্ম্মকর্মে নিতান্ত অনুরক্ত হইয়া নির্ভয়হৃদয়ে সমস্ত মেদিনীমণ্ডল
পরিভ্রমণ করিতেন।
কিয়ৎকাল পরে কৌরববংশীয় পরীক্ষিৎ
পৃথিবীর অধিরাজ হইলেন। তিনি স্বীয় প্রাপিতামহ পাণ্ডু রাজার ন্যায় অদ্বিতীয়
ধনুর্দ্ধর, যুদ্ধবিশারদ ও মৃগয়াপ্রিয় ছিলেন। মহারাজ পরীক্ষিৎ সর্ব্বদাই মৃগ, বরাহ,
তরক্ষু [ব্যাঘ্র], মহিষ ও অন্যান্য বিবিধ প্রকার বন্যজন্তু শিকার করিয়া মহীমণ্ডল
পরিভ্রমণ করিতেন। একদা তিনি স্বকীয় আনতপর্ব্ব শর দ্বারা এক মৃগকে বিদ্ধ করিয়া
পৃষ্ঠে শরাসন ধারণপূর্ব্বক যজ্ঞরূপী মৃগের অনুযায়ী ভগবান্ ভূতনাথের ন্যায় সেই মৃগের
অনুসরণক্রমে নিবিড় অরণ্যানী-মধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। পরীক্ষিতের বাণে বিদ্ধ হইলে কোন
মৃগই জীবিতাবস্থায় পলায়ন করিতে পারে না; কিন্তু এই মৃগ যে বাণবিদ্ধ হইয়াও পলায়ন
করিল, উহা কেবল তাঁহার অচিরাৎ স্বর্গলাভের প্রতি হেতু হইয়া উঠিল।
রাজা পরীক্ষিৎ মৃগের অনুসরণ-প্রসঙ্গে ক্রমে ক্রমে অতি দূরদেশে
উপনীত হইলেন। পরে সাতিশয় পরিশ্রান্ত ও পিপাসার্ত্ত হইয়া এক গোপ্রচারে [গোষ্ঠে–গোচারণ-স্থানে]
উপস্থিত হইলেন এবং অবলোকন করিলেন, এক তপস্বী স্তন্যপায়ী বৎসগণের মুখনিঃসৃত ফেনপুঞ্জ
পান করিয়া জীবন-ধারণ করিতেছেন। অত্যান্ত ক্ষুৎপিপাসান্বিত রাজা সেই মুনির সন্নিধানে
সমুপস্থিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, "হে মুনিসত্তম! আমি অভিমন্যুর পুৎত্র রাজা
পরীক্ষিৎ, তোমাকে জিজ্ঞাসিতেছি, আমি এক মৃগকে বাণ দ্বারা বিদ্ধ করিয়াছিলাম, সে
পলায়ন করিয়াছে, কোন্ দিকে পলায়ন করিল, তুমি কি দেখিয়াছ?" মুনিবর মৌনব্রতাবলম্বী
ছিলেন, কোন কথাই কহিলেন না। তখন রাজা ক্রোধান্ধ হইয়া আপন ধনুর অগ্রভাগ দ্বারা এক
মৃতসর্প উত্তোলন করিয়া মহর্ষির স্কন্ধদেশে অর্পণ করিলেন। ঋষি তাহাতে ক্রোধ করিলেন
না এবং ভালমন্দ কিছুই বলিলেন না। রাজা তাঁহাকে তদবস্থ দেখিয়া ক্রোধ
পরিত্যাগপূর্ব্বক ব্যথিতমনে আপন রাজধানীতে গমন করিলেন, কিন্তু সেই ঋষি তদবস্থই
রহিলেন। ঐ ক্ষমাশীল মহামুনি রাজা পরীক্ষিৎকে স্বধর্ম্মনিরত বলিয়া জানিতেন; এই
নিমিত্ত তৎকর্ত্তৃক অবমানিত হইয়াও তাঁহাকে অভিসম্পাত করিলেন না। কুরুবংশাবতংস
[কুরুবংশের ভূষণস্বরূপ] মহারাজ পরীক্ষিৎও তাঁহাকে তাদৃশ ধর্ম্মপরায়ণ বলিয়া না
জানিতে পারিয়াই তাঁহার তাদৃশী অবমাননা করিলেন।
ঐ মহর্ষির শৃঙ্গী নামে এক তরুণবয়স্ক পুৎত্র ছিলেন। শৃঙ্গী
সাতিশয় রোষপরবশ। তিনি একবার ক্রুদ্ধ হইলে আর তাঁহাকে প্রসন্ন করা দুঃসাধ্য হইয়া
উঠিত। তিনি সময়ে সময়ে সুসংযত হইয়া সর্ব্বভূতহিতৈষী ভগবান্ প্রজাপতির উপাসনা করিতে
যাইতেন। একদা শৃঙ্গী সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মার উপাসনানন্তর তদীয় আদেশ লইয়া আপন
আশ্রমে প্রত্যাগমন করিতেছেন, এমত সময়ে তাঁহার সখা কৃশ নামে এক ঋষিপুৎত্র হাসিতে
হাসিতে তৎসন্নিধানে তদীয় পিতার অপমান-বৃত্তান্ত বর্ণন করিলেন। রুক্ষস্বভাব শৃঙ্গী
কৃশ-মুখে পিতার অপমানবার্ত্তা শ্রবণ করিয়া ক্রোধে প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিলেন। কৃশ
হাসিতে হাসিতে কহিলেন, "তুমি অত্যন্ত তপোবলসম্পন্ন ও তেজস্বী, কিন্তু তোমার পিতা
স্বীয় স্কন্ধদেশে মৃতসর্প বহন করিতেছেন, অতএব হে শৃঙ্গিন! যাও যাও, আর তুমি বৃথা
গর্ব্ব করিও না এবং মাদৃশ সিদ্ধ ব্রহ্মবিৎ তপস্বী ঋষিপুৎত্রগণ কোন কথা কহিলে তাহাতে
প্রত্যুত্তর প্রদান করিও না। হে শৃঙ্গিন্! কৈ, এক্ষণে তোমার সেই পুরুষত্বাভিমান এবং
তাদৃশ সগর্ব্ব বাক্যই বা কোথায় রহিল? তোমার পিতা সেইরূপ অবমানিত হইয়াও ঔদাসীন্য
অবলম্বনপূর্ব্বক রহিয়াছেন; তদ্বিষয়ে যাহা কর্ত্তব্য, কিছুই করেন নাই। আহা! ইহা
দেখিয়া আমি অত্যন্ত দুঃখিত হইয়াছি?"