মহাভারত
আদিপর্ব


ভাষাংশ>মহাভারত >আদিপর্ব>একচত্বারিংশ-চতুশ্চত্বারিংশ অধ্যায়


একচত্বারিংশ অধ্যায়
রাজার প্রতি শৃঙ্গীর শাপ

    উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, মহাতেজা শৃঙ্গী স্বীয় জনকের স্কন্ধে মৃতসর্প রহিয়াছে শুনিয়া সাতিশয় সংক্রুদ্ধ হইলেন এবং মৃদুমধুরস্বরে কৃশকে জিজ্ঞাসা করিলেন, "কৃশ! কিরূপে আমার পিতার স্কন্ধে মৃতসর্প সংলগ্ন হইল?" কৃশ কহিলেন, "সখে! অদ্য মৃগয়াবিহারী রাজা পরীক্ষিৎ এই তপোবনে মৃগয়া করিতে আসিয়াছিলেন, তিনিই তোমার পিতার স্কন্ধে মৃতসর্প সমর্পণ করিয়া গিয়াছেন।" তখন শৃঙ্গী ক্রোধে দুই চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া কহিলেন, "আমার পিতা সেই দুরাত্মা নরাধম রাজার কি অপরাধ করিয়াছিলেন, সত্য করিয়া বল, আজি তোমাকে আমার তপোবল দেখাইতেছি।"
    কৃশ কহিলেন, "অভিমন্যুতনয় রাজা পরীক্ষিৎ অদ্য মৃগয়া করিতে আসিয়াছিলেন। তিনি এক মৃগকে বাণবিদ্ধ করেন। বাণাহত মৃগ প্রাণভয়ে দৌড়িতে লাগিল; রাজাও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। পরিশেষে রাজা পরীক্ষিৎ মৃগের অনুসরণক্রমে নিবিড় কাননে প্রবিষ্ট হইলেন; মৃগও ক্রমশঃ তদীয় দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইল। রাজা বহুক্ষণ অরণ্যমধ্যে পর্য্যটন করিয়াও তাহার অনুসন্ধান পাইলেন না; তখন তিনি ক্ষুৎপিপাসায় একান্ত কাতর হইয়া তোমার পিতার সন্নিধানে গমনপূর্ব্বক বারংবার জিজ্ঞাসিতে লাগিলেন, 'মহাশয়! আপনি একটি শরবিদ্ধ মৃগকে এ স্থান দিয়া পলায়ন করিতে দেখিয়াছেন?' তোমার পিতা মৌনব্রতাবলম্বী, সুতরাং ভালমন্দ কিছুই বলিলেন না। তন্নিমিত্ত রাজা ক্রুদ্ধ হইয়া নিজ শরাসনের অগ্রভাগ দ্বারা এক মৃতসর্প উত্তোলনপূর্ব্বক তাঁহার স্কন্ধদেশে সংলগ্ন করিয়া দিলেন। তোমার পিতা তথাপি সেইরূপ মৌনাবলম্বন করিয়াই রহিলেন। পরে রাজা পরীক্ষিৎ স্বীয় রাজধানী হস্তিনানগরে প্রস্থান করিলেন।"
    শৃঙ্গী কৃশের মুখে নিরপরাধ পিতার এইরূপ অপমানবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া কোপোপরক্ত-নয়নে [ক্রোধবশতঃ রক্তচক্ষে] আচমনপূর্ব্বক রাজাকে এই বলিয়া অভিসম্পাত করিলেন, "যে নৃপাধম মৌনব্রতাবলম্বী মদীয় বৃদ্ধ পিতার স্কন্ধে মৃতসর্প সমর্পণ করিয়াছে, আমার বাক্যানুসারে তীক্ষ্ণবিষধর পন্নগেশ্বর তক্ষক সপ্তরাত্রির মধ্যে ব্রাহ্মণের অপমানকারী সেই পাপাত্মাকে যমসদনে প্রেরণ করিবে।" শৃঙ্গী রাজাকে এইরূপে শাপগ্রস্ত করিয়া গোচারণস্থ স্বকীয় পিতা শমীকের সন্নিধানে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, সত্যই তাঁহার স্কন্ধে মৃতসর্প রহিয়াছে। তিনি তদ্দর্শনে পুনর্ব্বার সাতিশয় সংক্রুদ্ধ হইয়া মনোদুঃখে রোদন করিতে লাগিলেন। পরে স্বীয় পিতাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, "পিতাঃ! দুরাত্মা পরীক্ষিৎ বিনাপরাধে আপনার এই অপমান করিয়াছে শুনিয়া আমি তাহাকে এই উগ্রশাপ প্রদান করিয়াছি যে, পন্নগরাজ তক্ষক সেই কুরুকুলাধমকে দংশন করিয়া অদ্য হইতে সপ্তম দিবসে যমালয়ে প্রেরণ করিবে।"
    শমীক কুপিত পুৎত্রের এই অহিতানুষ্ঠান শ্রবণ করিয়া কহিলেন, "হে পুৎত্র! তুমি রাজা পরীক্ষিৎকে শাপ দিয়া অতি কুকর্ম্ম করিয়াছ। আমি ইহাতে প্রীত হইলাম না। তপস্বিগণের এরূপ ধর্ম্ম নহে। আমরা সেই রাজার অধিকারে বাস করি। তিনিও ন্যায়পূর্ব্বক আমাদিগকে রক্ষা করিয়া থাকেন; কখন কোন অত্যাচার করেন না। ন্যায়পরায়ণ রাজা যদিও কদাচিৎ কোন অপরাধ করেন, তাহা আমাদিগের অবশ্যই সহ্য করা উচিত। আরও দেখ, যদি রাজা আমাদিগকে রক্ষা না করেন, তাহা হইলে আমাদিগের যৎপরোনাস্তি কষ্ট হইবার সম্ভাবনা। ধর্ম্মপরায়ণ ভূপতিগণ আমাদিগকে রক্ষা করেন বলিয়াই আমরা বিপুল ধর্ম্ম উপার্জ্জন করিতেছি। অস্মদুপার্জ্জিত ধর্ম্মে রাজাদিগেরও ধর্ম্মতঃ অধিকার আছে। অতএব হে পুৎত্র! রাজা যদিও কোন অপরাধ করেন, তাহা আমাদের ক্ষমা করা উচিত। বিশেষতঃ রাজা পরীক্ষিৎ আপন প্রপিতামহ পাণ্ডুর ন্যায় আমাদিগকে রক্ষা করিতেছেন। প্রজাগণের রক্ষণাবেক্ষণই রাজার প্রধান ধর্ম্ম ও অবশ্য কর্ত্তব্য কর্ম্ম। সেই মহানুভব রাজা পরীক্ষিৎ ক্ষুধিত ও পরিশ্রান্ত হইয়া আমার আশ্রমে আগমন করিয়াছিলেন। ইহা স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, তিনি আমার মৌনব্রতাবলম্বনের বিষয় না জানিয়া এই কুকর্ম্ম করিয়াছেন। আর দেশ অরাজক হইলে তাহাতে সর্ব্বদাই নানাবিধ দোষ ঘটে এবং লোকসকল উচ্ছৃঙ্খল ও উদ্বিগ্ন হইয়া কোন ধর্ম্মকার্য্যের অনুষ্ঠান করিতে পারে না। রাজা উচ্ছৃঙ্খল লোকদিগের প্রতি দণ্ডবিধান করেন। রাজদণ্ড-ভয়ে পুনর্ব্বার ধর্ম্ম ও শান্তির সংস্থাপন হয় এবং ধর্ম্ম হইতে স্বর্গ সংস্থাপিত হয়। রাজার প্রভাবেই সমুদয় যজ্ঞক্রিয়া সুচারুরূপে অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে, যজ্ঞানুষ্ঠান দ্বারা দেবগণ পরম প্রীত হয়েন, দেবগণ হইতে বৃষ্টি হয়, বৃষ্টি দ্বারা শস্য জন্মে এবং শস্য দ্বারা মনুষ্যগণের পরমোপকার দশে। ভগবান্ মনু কহিলেন, রাজা মনুষ্যদিগের বিধাতাস্বরূপ ও দশ শ্রোত্রিয়ের সমান। সেই রাজা ক্ষুধিত ও পরিশ্রান্ত হইয়া আমার মৌনব্রতের বিষয় না জানিতে পারিয়াই এবম্ভূত গর্হিত ব্যাপারে প্রবৃত্ত হইয়া থাকিবেন, সন্দেহ নাই। অতএব তুমি কি নিমিত্ত বালকতাপ্রযুক্ত হঠাৎ সেই রাজর্ষির প্রতি এই কুকর্ম্মের অনুষ্ঠান করিলে? সেই ভূপতি কোনমতেই আমাদের শাপ-প্রদানের পাত্র নহেন।"

দ্বিচত্বারিংশ অধ্যায়
পরীক্ষিৎকে শাপবৃত্তান্তজ্ঞাপন

    শৃঙ্গী পিতার তিরস্কার-বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, "হে পিতা! এই শাপ প্রদান করাতে আমার সাহস প্রকাশ করাই হউক বা দুষ্কর্ম্ম করাই হউক এবং ইহাতে আপনি সন্তুষ্টই হউন বা অসন্তুষ্টই হউন, যাহা করিয়াছি, তাহা মিথ্যা হইবার নহে। মহাশয়! আমি আপনাকে যথার্থ কহিতেছি, ইহা কখন অন্যথা হইবে না। আমি পরিহাসচ্ছলেও কখন মিথ্যা কহি না, অতএব মৎপ্রদত্ত শাপ কিরূপে মিথ্যা হইবে?" শমীক কহিলেন, "পুৎত্র! আমি উত্তমরূপে জানি, তুমি সাতিশয় উগ্র-প্রভাবশালী ও সত্যবাদী এবং পূর্ব্বে কখন মিথ্যা কহ নাই; সুতরাং তোমার সেই শাপ কখনই মিথ্যা হইবে না। কিন্তু হে পুৎত্র! পিতা বয়ঃস্থ সন্তানকেও শাসন করিতে পারেন, যেহেতু তদ্দ্বারা ক্রমে ক্রমে পুৎত্রের গুণ ও যশোবৃদ্ধির সম্ভাবনা; তুমি বালক, অতএব তুমি অবশ্যই আমার শাসনার্হ। আমি জানি তুমি সর্ব্বদা তপোনুষ্ঠান করিয়া থাক, তপঃপ্রভাবশালী মহাত্মারা অতিশয় কোপন-স্বভাব হইয়া থাকেন। কিন্তু হে বৎস! তুমি একে ত’ আমার পুৎত্র, বিশেষতঃ বালক, তাহাতে আবার অত্যন্ত সাহসের কার্য্য করিয়াছ, এই সকল ভাবিয়া-চিন্তিয়া আমি তোমাকে ভর্ৎসনা করিলাম। এক্ষণে তোমাকে কিছু উপদেশ দিতেছি, শ্রবণ কর। তুমি শান্তিগুণ অবলম্বন করিয়া বন্য ফল-মূলাদি আহার দ্বারা ক্রমে ক্রমে ক্রোধের উপশম কর, তাহা হইলে শাপদান জন্য তোমার আর ধর্ম্মক্ষয় হইবে না। দেখ, ক্রোধ সংযমী তপস্বিগণের বহুযত্নে সঞ্চিত ধর্ম্মরাশি লোপ করে। ধর্ম্মবিহীন লোকদিগের সদ্‌গতি লাভ হয় না। শমগুণই ক্ষমাশীল তপস্বিগণের সর্ব্বত্র সিদ্ধিদায়ক। কি ইহলোক, কি পরলোক ক্ষমাবানের সর্ব্বত্রই মঙ্গল। অতএব হে পুৎত্র! তুমি সর্ব্বদাই ক্ষমাশীল ও জিতেন্দ্রিয় হইয়া কালযাপন কর। ক্ষমাগুণ অবলম্বন করিলে চরমে পরমপদ প্রাপ্ত হইবে। আমি শমপরায়ণ, অতএব এক্ষণে আমার যতদূর সাধ্য, সেই নরপতির উপকার করা কর্ত্তব্য। সম্প্রতি নৃপ-সন্নিধানে এই সংবাদ পাঠাই যে, আমার পুৎত্র বালক ও অতিশয় অপরিণতবুদ্ধি, সে ত্বৎকৃত মদীয় অবমাননা দর্শনে ক্রোধ-পরতন্ত্র হইয়া তোমাকে শাপ প্রদান করিয়াছে।"
    দয়াবান্ মহাতপা শমীক ঋষি রাজা পরীক্ষিতের নিকট এই সংবাদ প্রদান করিবার নিমিত্ত শ্রুতশীলবিশিষ্ট [বেদাদি-শাস্ত্রজ্ঞান ও সৎস্বভাবসম্পন্ন] গৌরমুখ নামে শিষ্যকে প্রেরণ করিলেন। তিনি তাঁহাকে কহিয়া দিলেন যে, "তুমি অগ্রে রাজার ও রাজকার্য্যের কুশল জিজ্ঞাসিবে, তৎপরে এই অশুভ সংবাদ দিবে।" গোরমুখ গুরুর আজ্ঞানুসারে অবিলম্বে হস্তিনানগরে উপস্থিত হইয়া অগ্রে দ্বারপাল দ্বারা সংবাদ দিলেন, পরে রাজভবনে প্রবেশ করিলেন। রাজা তাঁহাকে দেখিয়া পরম সমাদরপূর্ব্বক পাদ্য-অর্ঘ্যাদি দ্বারা পূজা করিলেন। গৌরমুখ রাজকৃত সৎকার গ্রহণ ও কিয়ৎক্ষণ শ্রান্তি দূর করিয়া শমীকোপদিষ্ট বাক্য-সকল অবিকল করিতে লাগিলেন। তিনি কহিলেন, "মহারাজ! শান্ত, দান্ত, পরমধার্ম্মিক শমীক নামে এক মহাতপা মহর্ষি আপনার অধিকারে বাস করেন। আপনি শরাসনের অগ্রভাগ দ্বারা সেই মৌনব্রতাবলম্বী মহর্ষির স্কন্ধে এক মৃতসর্প অর্পণ করিয়া আসিয়াছিলেন। শমগুনাবলম্বী মহামুনি শমীক আপনার সেই অপরাধ ক্ষমা করিয়াছিলেন; কিন্তু তদীয় পুৎত্র শৃঙ্গী সাতিশয় উগ্রস্বভাব। তিনি আপনার গর্হিত অনুষ্ঠান দর্শনে ক্রোধে অধীর হইয়া আপনাকে এই অভিসম্পাত করিয়াছেন যে, সপ্তম দিবসে তক্ষক দংশনে আপনার প্রাণবিয়োগ হইবে। শমীক মুনি শাপনিবারণার্থ পুৎত্রকে যথেষ্ট অনুরোধ করিয়াছিলেন, কিন্তু কাহার সাধ্য যে, সে শাপ অন্যথা করে? মহর্ষি কোপান্বিত পুৎত্রকে কোনক্রমে শান্ত করিতে না পারিয়া আপনার হিতার্থে আমাকে এই শাপসংবাদ দিতে পাঠাইলেন।"
    রাজা পরীক্ষিৎ গৌরমুখের মুখে এই দারুণ সংবাদ শুনিয়া এবং আপন দুষ্কর্ম্ম স্মরণ করিয়া অত্যন্ত বিষণ্ণ হইলেন। মুনিবর শমীক মৌনব্রতাবলম্বী ছিলেন, এই নিমিত্তই তাঁহাকে প্রত্যুত্তর প্রদান করেন নাই, ইহা শুনিয়া রাজার শোকাগ্নি দ্বিগুণ প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। তখন তিনি ভাবিতে লাগিলেন, "শমীক মুনি এমত শান্তস্বভাব যে, তিনি মৎকৃত তাদৃশ অপমান সহ্য করিয়াও দয়া প্রদর্শন করিয়াছেন! হায়! আমি কি কুকর্ম্ম করিয়াছি, সেই পরম-কারুণিক মুনিবরের উপর তদ্রূপ অত্যাচার করা আমার নিতান্ত অন্যায় হইয়াছে।" এই ভাবিয়া রাজার আর পরিতাপের পরিসীমা রহিল না। রাজা বিনাপরাধে সেই মুনিবরের তাদৃশী অবমাননা করিয়াছেন বলিয়া যেরূপ শোকার্ত্ত হইলেন, আপনার মৃত্যুবার্ত্তা শ্রবণে সেরূপ হইলেন না। অনন্তর রাজা গৌরমুখকে এই বলিয়া বিদায় করিলেন যে, মহাশয়! আপনি অনুগ্রহ করিয়া সেই মুনিবরকে এই কথা বলিবেন, যেন তিনি আমার প্রতি সুপ্রসন্ন থাকেন।
    রাজা এইরূপে গৌরমুখকে বিদায় করিয়া নিতান্ত উদ্বিগ্নমনে আপন মন্ত্রিগণ সমভিব্যাহারে মন্ত্রণা করিতে লাগিলেন। মন্ত্রণানন্তর এক একস্তম্ভ-সুরক্ষিত [একটি মাত্র স্তম্ভের উপর সুব্যবস্থায় স্থাপিত] প্রাসাদ নির্ম্মাণ করাইয়া তথায় নানাবিধ ঔষধ, বহুসংখ্যক চিকিৎসক ও মন্ত্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণগণ নিযুক্ত করিলেন এবং সেই প্রাসাদে সুরক্ষিতরূপে অবস্থান করিয়া মন্ত্রিগণ সমভিব্যাহারে রাজকার্য্য সম্পাদন করিতে লাগিলেন। তাঁহার সমীপে কেহই গমন করিতে পারিতেন না। অধিক কি কহিব, সর্ব্বত্রগামী বায়ুরও সে স্থানে সঞ্চার রহিল না।
    বিষবিদ্যা-বিশারদ দ্বিজোত্তম কাশ্যপ মুনি শ্রবণ করিয়াছিলেন যে, রাজা পরীক্ষিৎ ভুজঙ্গশ্রেষ্ঠ তক্ষকের দংশনে প্রাণপরিত্যাগ করিবেন। তন্নিমিত্ত তিনি মনে মনে বিবেচনা করিয়াছিলেন যে, তক্ষক রাজাকে দংশন করিলে আমি মন্ত্রৌষধিবলে তাঁহাকে সঞ্জীবিত করিব, তাহা হইলে আমার ধর্ম্ম ও অর্থ উভয়ই লাভ হইবে। পরে নির্দ্ধারিত সপ্তম দিন উপস্থিত হইলে তিনি রাজাকে রক্ষা করিবার বাসনায় একাগ্রচিত্ত হইয়া রাজভবনে গমন করিতেছেন, এমন সময়ে বৃদ্ধ-ব্রাহ্মণবেশধারী নাগরাজ তক্ষক পথিমধ্যে তাঁহাকে দেখিতে পাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, "হে মুনিবর! তুমি অনন্যমনা হইয়া এত সত্বরগমনে কি অভিপ্রায়ে কোথায় চলিয়াছ?" কাশ্যপ কহিলেন, "অদ্য কুরুকুলোৎপন্ন রাজা পরীক্ষিৎ উরগ-রাজ তক্ষকের বিষানলে দগ্ধ হইবেন শুনিয়া তাঁহাকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত গমন করিতেছি।" তক্ষক কহিলেন, "হে ব্রাহ্মণ! আমিই সেই তক্ষক, আমি অদ্য সেই মহীপালের প্রাণসংহার করিব, তুমি ক্ষান্ত হও, আমি দংশন করিলে তোমার সাধ্য কি যে, তুমি তাঁহাকে রক্ষা কর।" কাশ্যপ কহিলেন, "তুমি দংশন করিলে আমি স্বীয় বিদ্যা-প্রভাবে অবশ্যই তাঁহাকে নির্বিবষ করিব, সন্দেহ নাই।"


ত্রিচত্বারিংশ অধ্যায়
পরীক্ষিতের তক্ষকদংশন

    তক্ষক কহিলেন, "হে কাশ্যপ! যদি আমি কোন বস্তু দংশন করিলে তুমি চিকিৎসা দ্বারা তাহাকে রক্ষা করিতে পার, তবে সম্মুখস্থ এই বটবৃক্ষে দংশন করিতেছি, তুমি ইহাকে রক্ষা করিয়া আপনার মন্ত্রপ্রভাব দেখাও।" কাশ্যপ কহিলেন, “হে ভুজগেন্দ্র! তুমি দংশন কর, আমি এই মুহূর্ত্তে ইহাকে পুনর্জ্জীবিত করিতেছি।" ভুজঙ্গেশ্বর রক্ষক মহাত্মা কাশ্যপের এই বাক্য শ্রবণ করিয়া সম্মুখস্থ সেই বটবৃক্ষে দংশন করিলেন। বটবৃক্ষ তক্ষকের তীব্র বিষানলে মূল অবধি পল্লবাগ্র পর্য্যন্ত প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল এবং ক্ষণকালমধ্যে ভস্মসাৎ হইয়া গেল। তখন তক্ষক কাশ্যপ মুনিকে কহিলেন, "হে দ্বিজোত্তম! এই বৃক্ষকে পুনর্জ্জীবিত করিতে যত্নবান্ হও।" মহর্ষি কাশ্যপ তক্ষকের বাক্য শ্রবণ করিয়া সেই ভস্মীভূত বৃক্ষের ভস্মরাশি গ্রহণপূর্ব্বক তক্ষককে কহিলেন, "হে ভুজগেন্দ্র! আমার বিদ্যাবল দেখ, আমি তোমার সমক্ষেই এই ভস্মীভূত বনস্পতিকে পুনর্জ্জীবিত করিতেছি।" অনন্তর দ্বিজসত্তম কাশ্যপ স্বীয় বিদ্যাপ্রভাবে সেই ভস্মীকৃত ন্যগ্রোধ পাদপকে পুনর্জ্জীবিত করিলেন। প্রথমে অঙ্কুর, তৎপরে পত্রদ্বয়, তদনন্তর পত্রসমূহ, পরিশেষে শাখা-প্রশাখা প্রভৃতি সমুদয় অংশ সুচারুরূপে প্রস্তুত হইল।
    এইরূপে মহর্ষি কাশ্যপের মন্ত্রবলে ঐ বটবৃক্ষ পুনর্জ্জীবিত হইল দেখিয়া তক্ষক তাঁহাকে কহিলেন, "হে ব্রহ্মন্! তুমি যে বিদ্যাবলে আমার বা আমার মত অন্য সর্পের বিষক্ষয় করিবে, ইহা বড় আশ্চর্য্যের বিষয় নহে, যেহেতু, ভবাদৃশ মন্ত্রবিশারদ তেজস্বী লোকের কিছুই দুঃসাধ্য নহে। এক্ষণে জিজ্ঞাসা করি, তুমি কি নিমিত্ত তথায় গমন করিতেছ? তুমি যে বস্তুর লাভাকাঙ্ক্ষায় সেই নৃপের নিকট যাইতেছ, তাহা অতি দুষ্প্রাপ্য হইলেও আমি তোমাকে দিব। ব্রহ্মশাপে রাজার আয়ুঃশেষ হইয়াছে, অতএব তুমি তাঁহার রক্ষণ-বিষয়ে কৃতকার্য্য হইতে পার কি না সন্দেহ। যদি তুমি তাঁহাকে রক্ষা করিতে না পার, তাহা হইলে তোমার ত্রিলোকী-বিশ্রুত যশোরাশি নিস্তেজ দিবাকরের ন্যায় একেবারে অন্তর্হিত হইবে।"
    কাশ্যপ তক্ষক-বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, "হে ভুজঙ্গম! আমি ধনার্থী হইয়া তথায় গমন করিতেছি, তুমি আমাকে প্রচুর ধন দাও, তাহা হইলেই আমি নিবৃত্ত হইতেছি।" তক্ষক কহিলেন, "হে দ্বিজোত্তম! তুমি যত ধন আকাঙ্ক্ষা করিয়া রাজার নিকট গমন করিতেছ, আমি তদপেক্ষা অধিক দিতেছি, তুমি নিবৃত্ত হও।" দ্বিজোত্তম কাশ্যপ তক্ষকের বাক্য-শ্রবণানন্তর দিব্যজ্ঞান-প্রভাবে ধ্যান করিয়া দেখিলেন যে, সত্যই রাজা পরীক্ষিতের আয়ুঃশেষ হইয়াছে। তখন তিনি তক্ষকের নিকট হইতে স্বাভিলষিত অর্থ লইয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন।
    এইরূপে মহাত্মা কাশ্যপ প্রতিনিবৃত্ত হইলে তক্ষক অবিলম্বে হস্তিনানগরে উপস্থিত হইলেন। গমনসময়ে শুনিলেন, রাজা বিষহর মন্ত্র ও ঔষধ সংগ্রহ করিয়া অতি সাবধানে রহিয়াছেন। তখন তিনি মনে মনে চিন্তা করিলেন যে, রাজাকে মায়াপ্রভাবে বঞ্চিত করিতে হইবে, অতএব এক্ষণে কি উপায় অবলম্বন করা কর্ত্তব্য? তদনন্তর নাগরাজ তক্ষক অন্যান্য সর্পগণকে আদেশ করিলেন, "তোমরা ব্রাহ্মণরূপ ধারণপূর্ব্বক বিশেষ প্রয়োজন আছে’ এই ছল করিয়া অব্যগ্রচিত্তে রাজসমীপে গিয়া ফল, পুষ্প, কুশ ও জল প্রদান দ্বারা তাঁহাকে আর্শীর্ব্বাদ করিবে।" নাগগণ তক্ষক কর্ত্তৃক এইরূপ আদিষ্ট হইয়া ব্রাহ্মণ-বেশ পরিগ্রহণপূর্ব্বক রাজ-সন্নিধানে গমন করিয়া কুশ, জল ও ফল দিয়া রাজাকে আশীর্ব্বাদ করিলে রাজা সেই সমস্ত গ্রহণ করিলেন; পরে কার্য্য সমাধানানন্তর তাঁহাদিগকে বিদায় করিলেন। ছদ্মতাপসরূপী [কৃত্রিম মুনিবেশধারী] ভুজঙ্গমেরা গমন করিলে রাজা অমাত্যগণ ও সুহৃদ্‌গণকে কহিলেন, "আইস, আমরা সকলে একত্র হইয়া এই সকল তাপসদত্ত সুস্বাদু ফল ভক্ষণ করি। দুর্দ্দৈববশতঃ ভূপতির ফলভোজনে প্রবৃত্তি হইল। যে ফলের মধ্যে তক্ষক গুপ্তভাবে ছিলেন, দৈবনির্ব্বন্ধক্রমে তিনি সেই ফলটিই স্বয়ং ভক্ষণ করিতে লইলেন। ভক্ষণ করিবার সময় ঐ ফল হইতে এক অণু পরিমাণ কৃষ্ণনয়ন তাম্রবর্ণ কীট বহির্গত হইল। রাজা সেই কীট গ্রহণ করিয়া সচিবদিগকে কহিতে লাগিলেন, "সূর্য্যদেব অস্তাচলে গমন করিতেছেন, আজি আর আমার বিষের ভয় নাই। এক্ষণে এই কীট তক্ষক হইয়া আমাকে দংশন করুক। তাহা হইলে শাপেরও মোচন হয় এবং ব্রাহ্মণের বাক্যেও সত্য হয়।" মন্ত্রীরাও কালপ্রযোজিত হইয়া তাঁহার সেই বাক্যে অনুমোদন করিলেন। মরণো রাজার দুর্ব্বুদ্ধি ঘটিল। তিনি সেই কীট স্বীয় গ্রীবায় রাখিয়া হাসিতে লাগিলেন। কীটরূপী তক্ষক নিজ দেহ দ্বারা তৎক্ষণাৎ রাজার গ্রীবাদেশ বেষ্টন করিল। তখন রাজার চৈতন্য হইল, তক্ষক অতিবেগে রাজার গ্রীবাদেশ বেষ্টনপূর্ব্বক ভীষণ গর্জ্জন করিয়া তাঁহাকে দংশন করিল।


চতুশ্চত্বারিংশ অধ্যায়
পরীক্ষিতের প্রাণবিয়োগ

    উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, মন্ত্রিগণ রাজাকে তক্ষকের শরীর দ্বারা বেষ্টিত দেখিয়া বিষণ্ণ বদনে ও দুঃখিতমনে রোদন করিতে লাগিলেন; তদনন্তর তক্ষকের সেই ভীষণ গর্জ্জন শ্রবণে ভীত হইয়া সে স্থান হইতে পলায়ন করিলেন। তাঁহারা পলায়নকালে গগনমণ্ডলে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলেন, ভুজঙ্গরাজ তক্ষক দীপ্তাগ্নি শিখা-সদৃশ স্বীয় শরীর দ্বারা নভোমণ্ডল দ্বিখণ্ডিত করিয়া অতিবেগে গমন করিতেছেন। পরিশেষে সেই একস্তম্ভ গৃহ তক্ষকের বিষাগ্নি দ্বারা প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। মন্ত্রিবর্গ তদ্দর্শনে শঙ্কাকুলিতচিত্তে ইতস্ততঃ পলায়ন করিতে লাগিলেন এবং রাজাও বজ্রাহতের ন্যায় ভূপৃষ্ঠে পতিত ও মূর্চ্ছিত হইলেন। রাজা পরীক্ষিৎ এইরূপে তক্ষকদংশনে প্রাণত্যাগ করিলে তদীয় মন্ত্রিগণ ও রাজপুরোহিতগণ সমবেত হইয়া তাঁহার পারত্রিক ক্রিয়াকলাপ সম্পাদন করিলেন। পরে পুরবাসী সমস্ত প্রজাগণকে একত্র করিয়া তাঁহার শিশুপুৎত্রকে পিতৃরাজ্যে অভিষিক্ত করিলেন। ঐ অমিত্রঘাতী কুরুপ্রবীর নৃপাত্মজের নাম জনমেজয়। কুরুবংশাবতংস মহামতি জনমেজয় শিশু হইয়াও মন্ত্রিগণ ও পুরোহিতগণের সহিত মন্ত্রণা করিয়া আপন প্রপিতামহ ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠিরের ন্যায় সুচারুরূপে রাজ্যশাসন করিতে লাগিলেন। অনন্তর মন্ত্রিগণ ঐ নবীন রাজার রাজকার্য্য-সম্পাদনে বিলক্ষণ নিপুণতা জন্মিয়াছে দেখিয়া তাঁহার পরিণয়ার্থে কাশীপতি সুবর্ণবর্ম্মার নিকটে গিয়া তদীয় কন্যা বপুষ্টমাকে প্রার্থনা করিলেন। কাশীশ্বর সেই কুরুপ্রবীরকে বেদবিধানানুসারে বপুষ্টমা প্রদান করিলেন। রাজা জনমেজয় ঐ লোকললামভূত[অসামান্য রূপবতী] নিতম্বিনীকে [সুলক্ষণাস নারী] পাইয়া পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হইলেন। তিনি কদাচ অন্য রমণীর প্রতি কটাক্ষপাতও করিতেন না। পূর্ব্বকালে পার্থিবাগ্রণী [নৃপশ্রেষ্ঠ] পুরুরবা যেমন ঊর্ব্বশীকে পাইয়া তাঁহার সহিত বিহার করিয়াছিলেন, তদ্রূপ ইনিও সেই মনোহারিণী বরবর্ণিনী[উত্তমা নারী]কে পাইয়া কদাচিৎ সুরম্য সরোবরে, কদাচিৎ বিচিত্র উপবনে, তাঁহার সহিত বিহার করিয়া পরমসুখে কালযাপন করিতে লাগিলেন। রূপলাবণ্যবতী পতিব্রতা বপুষ্টমাও বিহারকাল সাতিশয় প্রেম প্রদর্শন দ্বারা প্রিয় পতিকে যৎপরোনাস্তি সন্তুষ্ট করিলেন।