মহাভারত
আদিপর্ব


ভাষাংশ>মহাভারত >আদিপর্ব>পঞ্চচত্বারিংশ- অষ্টচত্বারিংশ অধ্যায়


পঞ্চচত্বারিংশ অধ্যায়
বংশধর সন্তানের প্রশংসা

    উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, এই সময়ে মহাতপা জরৎকারু মুনি বায়ুমাত্র-ভক্ষণে শীর্ণকলেবর হইয়া তপোনুষ্ঠান ও পুণ্যতীর্থে স্নান করিয়া, অবনীমণ্ডল পরিভ্রমণ করিতেন এবং যেস্থানে সায়ংকাল উপস্থিত হইত, সেই স্থানেই অবস্থিতি করিতেন। একদা তিনি পর্য্যটনক্রমে এক স্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, নিরাহারে শীর্ণকলেবর, বায়ুমাত্রভোজী, পরিত্রাণেচ্ছু, অতি দীনভাবাপন্ন, স্বকীয় পিতৃগণ ঊর্দ্ধ্বপাদ ও অধোমস্তকে তন্তুমাত্রাবশিষ্ট উশীরস্তম্ব অবলম্বন করিয়া এক মহাগর্ত্তাভিমুখে লম্বমান রহিয়াছেন। ঐ গর্ত্তে এক প্রকাণ্ড মূষিক বাস করে। সে প্রতিদিন সেই বীরণস্তম্বের মূল সকল ক্রমে ক্রমে ছেদন করিতেছে। মহর্ষি জরৎকারু তাঁহাদিগকে নিতান্ত দীনভাবাপন্ন ও পরিত্রাণেচ্ছু দেখিয়া দয়ার্দ্রাচিত্তে জিজ্ঞাসা করিলেন, "আপনারা কে এবং কি নিমিত্তই বা এই উশীরস্তম্ব অবলম্বন করিয়া ঊর্দ্ধ্বপাদে ও অধোমুখে মহাগর্ত্তাভিমুখে লম্বমান রহিয়াছেন? আপনারা যে উশীরস্তম্ব অবলম্বন করিয়া আছেন, উহার একমাত্র তন্তু অবশিষ্ট আছে; এই গর্ত্তনিবাসী মূর্ষিক তাহাও ক্রমে ক্রমে ছেদন করিতেছে। ইহা ছিন্ন হইলেই আপনারা এই গর্ত্তমধ্যে অধঃশিরে পতিত হইবেন। আপনাদের এই দুর্দ্দশা দর্শনে আমার যৎপরোনাস্তি দুঃখ হইতেছে। আজ্ঞা করুন, আপনাদের কি প্রিয়কার্য্য করিব? আমার তপস্যার চতুর্থভাগ বা তৃতীয়ভাগ অথবা অর্দ্ধভাগ লইয়া যদি আপনারা এই বিপদ হইতে মুক্ত হইতে পারেন, লউন। অধিক আর কি কহিব, যদি সমগ্র তপস্যা দ্বারাও আপনাদের এই দুঃসহ দুঃখ-নিবারণ হয়, তাহাতেও আমি সম্মত আছি।"
    পিতৃগণ তাঁহার সেই বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, "হে বৃদ্ধ ব্রহ্মচারিন্! তুমি তপঃপ্রভাবে আমাদিগকে পরিত্রাণ করিতে চাহিতেছ, কিন্তু তপস্যা দ্বারা আমাদিগকে উদ্ধার করিতে পারিবে না। আমাদিগেরও তপঃসিদ্ধি আছে; কেবল বংশক্ষয়োপক্রম হইয়াছে বলিয়া আমরা এই অপবিত্র নরকে নিপতিত হইতেছি। সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মা কহিয়াছেন, 'সন্তানই পরম ধর্ম্ম।' আমরা এই গর্ত্তে লম্বমান হইয়া হতজ্ঞান হইয়াছি, তন্নিমিত্ত তোমার পৌরুষ সর্ব্বলোক-বিশ্রুত হইলেও তোমাকে চিনিতে পারিতেছি না। তুমি আমাদিগের দুঃখদর্শনে সাতিশয় কাতর হইয়াছ, অতএব তোমাকে পরিচয় প্রদান করিতেছি, শ্রবণ কর। আমরা যাযাবর নামে ব্রতশীল ঋষি, সন্তানক্ষয়ের উপক্রম হওয়াতে এই পবিত্র লোক হইতে ভ্রষ্ট হইতেছি। আমাদের কঠোর তপস্যার ফল অদ্যাপিও বিনষ্ট হয় নাই। আমাদের জরৎকারু নামে এক সন্তান আছেন। তিনি বেদবেদাঙ্গ-শাস্ত্রে পারদর্শী, নিয়তাত্মা, ব্রতনিরত ও তপঃপ্রভাবসম্পন্ন; কিন্তু তাঁহার থাকা না থাকা উভয়ই সমান হইয়াছে। তাঁহার স্ত্রী-পুৎত্র বন্ধুবান্ধব কেহই নাই; কেবল কঠোর তপস্যা করিয়াই কালযাপন করেন। তিনি তপস্যা লোভে নিতান্ত আক্রান্ত হওয়াতেই আমাদিগের এই দুর্দ্দশা ঘটিয়াছে। এই যে উশীরস্তম্ব দেখিতেছ, ইহা আমাদের বংশবর্দ্ধক কুলস্তম্ব। আর ইহার যে সকল মূল দেখিতেছ, ইহা আমাদিগের কালকবলিত সন্তানসমূহ। অর্দ্ধভক্ষিত যে মূলটি আমরা অবলম্বন করিয়া আছি, উহা সেই তপোনিষ্ঠ জরৎকারু। আর এই যে মূষিক দেখিতেছ, ইনি মহাবলপরাক্রান্ত কাল। ইনি সেই তপোলুব্ধ মূঢ়মতি জরৎকারুকে ক্ষয় করিতেছেন। জরৎকারুর কঠোর তপস্যা আমাদিগকে রক্ষা করিতে পারিবে না। আমরা অতি মন্দভাগ্য, আমাদিগের মূল ছিন্নপ্রায় হইয়াছে। এই দেখ, আমরা কালোপহতচিত্ত [দৈববিড়ম্বিত] হইয়া দুরাত্মাদিগের ন্যায় অধঃপতিত হইতেছি। আমরা সবান্ধবে এই গর্ত্তে পতিত হইলে তাঁহাকেও কালনিয়ন্ত্রিত হইয়া নিরয় [নরক] গামী হইতে হইবে। হে ব্রহ্মন্! কি তপস্যা, কি যজ্ঞ, কি অন্যান্য পুণ্যকর্ম্ম, সন্তানের সদৃশ কিছুই দেখিতে পাই না। হে বৎস! এক্ষণে তুমি আমাদিগের নাথস্বরূপ। তোমার সহিত সেই মূঢ়মতি জরৎকারুর সাক্ষাৎকার হইলে তাহার নিকট আমাদিগের এই দুর্দ্দশা-বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত পরিচয় দিবে এবং কহিবে, তুমি ত্বরায় দারপরিরগ্রহ করিয়া সন্তানোৎপাদন দ্বারা তাহাদিগের পরিত্রাণ কর। সে যাহা হউক, তুমি যে আমাদের দুর্দ্দশা দেখিয়া পরম-বন্ধুর ন্যায় অনুতাপ করিতেছ, তন্নিমিত্ত আমরা শুনিতে ইচ্ছা করি, তুমি কে?”
    উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, জরৎকারু তাঁহাদের এই বাক্যশ্রবণে সাতিশয় শোকার্ত্ত হইয়া সবাষ্প-গদগদস্বরে কহিতে লাগিলেন, "হে মহর্ষিগণ! আপনারা আমারই পর্ব্বপুরুষ; আমিই আপনাদিগের সেই পাপাত্মা, নরাধম ও কৃতঘ্ন পুৎত্র; আমার নাম জরৎকারু। সম্প্রতি আপনাদিগের কি প্রিয়কার্য্য করিতে হইবে, আজ্ঞা করুন এবং আমার এই অপরাধের যথোচিত দণ্ডবিধান করুন।"

ষট্‌চত্বারিংশ অধ্যায়
জরৎকারুর বংশরক্ষায় প্রতিজ্ঞা

    পিতৃগণ কহিলেন, "বৎস! আমাদিগের সৌভাগ্যবলে তুমি যদৃচ্ছাক্রমে এই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছ, এক্ষণে জিজ্ঞাসা করি, তুমি কি নিমিত্ত দারপরিগ্রহ কর নাই?" জরৎকারু কহিলেন, "হে পিতৃগণ! আমার মনে সর্ব্বদাই এই ভাব উদিত হয় যে, আমি ঊর্দ্ধ্বরেতা হইয়া ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বনপূর্ব্বক দেহত্যাগ করিব, কদাচ দারপরিগ্রহ করিব না। এক্ষণে আপনাদিগকে এই মহাগর্ত্তমধ্যে পক্ষীর ন্যায় লম্বমান দেখিয়া আমার ব্রহ্মচর্য্যের বাসনা অপনীত হইল। আমি আপনাদের হিতসাধনার্থে অচিরাৎ বিবাহ করিব, কিন্তু তদ্বিষয়ে এই এক প্রতিজ্ঞা রহিল যে, যদি আমি আমার সনাম্নী কন্যা ভিক্ষাস্বরূপ প্রাপ্ত হই এবং তাহাকে ভরণপোষণ করিতে না হয়, তাহা হইলেই তাহার পাণিগ্রহণ করিব, প্রকারান্তর হইলে তদ্বিষয়ে প্রবৃত্ত হইব না। আমার সেই পত্নীর গর্ভে যে পুৎত্র জন্মিবে, সেই আপনাদিগকে উদ্ধার করিবে। হে পিতামহগণ! তখন আপনারা অক্ষয় স্বর্গলাভ করিয়া পরম সুখে কালযাপন করিতে পারিবেন।"
    উগ্রশ্রবাঃ শৌনককে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, হে ভৃগুবংশাবতংস! মহর্ষি জরৎকারু এইরূপে পিতৃগণকে আশ্বাসিত করিয়া সমস্ত মহীমণ্ডল ভ্রমণ করিতে লাগিলেন; কিন্তু তিনি বৃদ্ধ বলিয়া কেহই তাঁহাকে কন্যাপ্রদানে উদ্যত হইল না। যখন তিনি পিতৃগণের আদেশানুসারে বিবাহ করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়াও তৎসম্পাদনে কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না, তখন দুঃখার্ত্তমনে অরণ্যানী প্রবেশ পূর্ব্বক উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন। পরিশেষে পিতৃলোক-হিতৈষী-মহাপ্রাজ্ঞ জরৎকারু এই বলিয়া ক্রমে ক্রমে তিনবার কন্যা ভিক্ষা করিলেন, "এ স্থানে যে কোন স্থাবর বা অস্থাবর বস্তু বর্ত্তমান আছ অথবা যাহারা অন্তর্হিত [অদৃষ্ট-অগোচর] আছ, সকলে আমার বাক্য শ্রবণ কর। আমি যাযাবরবংশে সমুদ্ভত। আমার নাম জরৎকারু। জন্মাবধি এতাবৎকাল পর্য্যন্ত কেবল ব্রহ্মচর্য্যানুষ্ঠান দ্বারা কালযাপন করিয়াছি। সম্প্রতি আমার পিতৃগণ বংশলোপভয়ে আমাকে পাণিগ্রহণ করিতে আদেশ দিয়াছেন। আমি অত্যন্ত দরিদ্র হইয়াও পিতৃগণের আজ্ঞাক্রমে দারপরিগ্রহাভিলাষে [বিবাহিত পত্নী পাইবার আশায়] নিখিল ধরণীমণ্ডল পরিভ্রমণ করিলাম, কিন্তু কুত্রাপি কন্যালাভ হইল না। অতএব এক্ষণে আমি যাঁহাদের নিকট কন্যা প্রার্থনা করিতেছি, তাঁহাদের মধ্যে যদি কোন ব্যক্তির মৎসনাম্নী [আমারতুল্যা নামের] দুহিতা থাকে, আর যদি আমাকে সেই কন্যা ভিক্ষাস্বরূপ সম্প্রদান করেন এবং তাহাকে যদি ভরণপোষণ করিতে না হয়, তবে আনয়ন করুন, আমি তাহার পাণিগ্রহণ করিব।"
    অনন্তর যে সকল সর্প জরৎকারুর দারপরিগ্রহাভিলাষের অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিল, তাহারা সত্বর যাইয়া বাসুকিকে সংবাদ দিল। নাগরাজ বাসুকি তাহাদের মুখে এই বাক্য শ্রবণ করিবামাত্র সাতিশয় সন্তোষপ্রকাশপূর্ব্বক স্বীয় ভগিনীকে বিচিত্র বসন ভূষণে বিভূষিত করিয়া জরৎকারু সন্নিধানে লইয়া গেলেন এবং তাঁহাকে ভিক্ষা-স্বরূপ সেই কন্যা প্রদান করিলেন; কিন্তু মুনিবর কন্যার নাম ও ভরণ-পোষণ-বিষয়ে সন্দিহান হইয়া নাগরাজ বাসুকিকে তাঁহার নাম জিজ্ঞাসা করিলেন এবং কহিলেন, "আমি ইঁহার ভরণপোষণ করিতে পারিব না।" এইরূপে মহর্ষি জরৎকারু মুমুক্ষু হইয়াও দারপরিগ্রহার্থ দ্বিমনা [সংশয়িত চিত্ত- ইতস্ততঃ ভাব] হইয়াছিলেন।


সপ্তচত্বারিংশ অধ্যায়
জরৎকারুর পত্নীপরিত্যাগ

    উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, নাগরাজ বাসুকি জরৎকারুকে কহিলেন, "হে তপোধন! আমার এই ভগিনী আপনার সনাম্নী এবং ইনি তপঃপরায়ণা! আপনি ইঁহার পাণিগ্রহণ করুন। আমি ইঁহাকে আপনার সহধর্ম্মীণী করিয়া দিন বলিয়াই এতাবৎকাল পর্য্যন্ত অভিলাষ করিয়া আছি। আর অঙ্গীকার করিতেছি, আমি সাধ্যানুসারে ইঁহার ভরণপোষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করিব।" ঋষি কহিলেন, "তবে এই নিশ্চয় হইল যে, আমি কদাচ ইঁহার ভরণপোষণ করিব না এবং ইনিও আমার কোন অপ্রিয় আচরণ করিবেন না, যদি করেন, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ পরিত্যাগ করিব।"
    বাসুকি ভগিনীর ভরণপোষণের ভারগ্রহণ করিলে মহাতপা জরৎকারু তাঁহার বাসভবনে গমন করিয়া যথাবিধানে তদীয় ভগিনীর পাণিপীড়ন [পাণিগ্রহণ-বিবাহ] করিলেন। বিবাহকালে মহর্ষিগণ তাঁহাকে স্তব করিতে লাগিলেন। অনন্তর জরৎকারু ভার্য্যা সমভিব্যাহারে ভুজঙ্গরাজের রমণীয় অন্তঃপুরে প্রবেশপূর্ব্বক সুচারু আস্তরণ-পটে আচ্ছাদিত [প্রচ্ছদ-বাস-ওয়াড় দ্বারা আবৃত] বিচিত্র শয্যায় শয়ন করিলেন। পরে ভার্য্যার সহিত এইরূপ নিয়ম করিলেন যে, "তুমি কদাচ আমার অপ্রিয় আচরণ করিবে না, অপ্রিয় কার্য্যের অনুষ্ঠান করিলে আমি তদ্দণ্ডেই তোমাকে পরিত্যাগ করিব ও ত্বদীয় বাসগৃহে আর ক্ষণমাত্রও অবস্থিতি করিব না। দেখিও, যাহা কহিলাম, যেন কদাপি ইহার অন্যথা না হয়।" পিতৃকুলহিতৈষিণী নাগরাজভগিনী অতিমাত্র দুঃখিত ও উদ্বিগ্নচিত্তে অগত্যা 'তথাস্তু' বলিয়া স্বামিবাক্যে অঙ্গীকার করিলেন এবং অতি সতর্কমনে ভর্ত্তৃশুশ্রূষা করিতে লাগিলেন।
    কিয়ৎকাল পরে ভুজঙ্গরাজভগিনী ঋতুস্নাতা হইয়া যথাবিধি স্বামিসেবায় নিযুক্ত হইলেন। মহর্ষির সহযোগে তাঁহার গর্ভসঞ্চার হইল। ঐ গর্ভ শুক্লপক্ষীয় শশিকলার ন্যায় দিন দিন পরিবর্দ্ধিত হইতে লাগিল। একদা মহাযশা জরৎকারু একান্ত ক্লান্ত হইয়া প্রিয়তমার অঙ্কশয্যায় শিরোনিবেশ [ক্রোড়ে-কপলে মাথা রাখিয়া] পূর্ব্বক শায়িত ও নিদ্রিত হইলেন। দ্বিজেন্দ্র নিদ্রাক্রান্ত হইলে দিনমণি অস্তাচলে গমন করিলেন। মনর্স্বিনী নাগভগিনী সায়ংকাল উপস্থিত দেখিয়া স্বামীর তৎকালোচিত সন্ধ্যা-বন্দনাদি ক্রিয়ালোপের আশঙ্কায় চিন্তা করিলেন, "সম্প্রতি আমার কি কর্ত্তব্য, ভর্ত্তার নিদ্রাভঙ্গ করি কি না? ইনি অতি কোপনস্বভাব, নিদ্রাভঙ্গ করিলে নিশ্চয়ই কোপ করিবেন; কিন্তু জাগরিত না করিলেও নিত্যক্রিয়ার ব্যতিক্রম ঘটে; অতএব এক্ষণে কি করা উচিত? ফলতঃ কোপ ও ধর্ম্মশীল ব্যক্তির ধর্ম্মলোপ এই দুইয়ের মধ্যে ধর্ম্মলোপই নিতান্ত দূষণাবহ; অতএব যাহাতে ব্রাহ্মণের ধর্ম্মরক্ষা হয়, তাহাই করা কর্ত্তব্য।"এইরূপ নিশ্চয় করিয়া মধুরভাষিণী বাসুকি-ভগিনী জ্বলন্ত-হুতাশনসন্নিভ তেজঃপুঞ্জাকৃতি সুখপ্রসুপ্ত মহাতপা জরৎকারুকে সম্বোধন করিয়া অতি বিনীত-বচনে কহিলেন, "মহাভাগ! সূর্য্যদেব অস্তাচল শিখরদেশে আরোহণ করিয়াছেন। সন্ধ্যাতিমির [সন্ধ্যার অন্ধকার] পশ্চিমদি্‌ক‌ অল্প অল্প আচ্ছন্ন করিতেছে। গাত্রোত্থান করিয়া সন্ধ্যোপাসনা করুন, অগ্নিহোত্রের সময় উপস্থিত।" ভগবান্ জরৎকারু জাগরিত হইয়া ওষ্ঠাধর পরিস্ফুরণপূর্ব্বক রোষভরে কহিলেন, "হে ভুজঙ্গমে! তুমি আমার অবমাননা করিলে, অতএব আমি আর তোমার নিকট অবস্থিতি করিব না, যথাস্থানে গমন করিব। হে বামোরু! আমার এরূপ দৃঢ়-নিশ্চয় আছে, আমি নিদ্রিতাবস্থায় থাকিলে সূর্য্যের সাধ্য কি যে, তিনি যথাকালে অস্তগত হন? অপমানিত হইলে সামান্য লোকেও তথায় বাস করে না, আমার বা মাদৃশ ধর্ম্মশীল ব্যক্তির কথা কি বলিব?"
    তদীয় এতাদৃশ নির্দ্দয়-বাক্য শ্রবণে বাসুকি-ভগিনী কহিলেন, "ভগবান্! ধর্ম্মলোপের আশঙ্কায় আমি আপনার নিদ্রাভঙ্গ করিয়াছি, অপমানের উদ্দেশ্যে করি নাই।" তখন জরৎকারু ক্রোধাবিষ্ট হইয়া ভার্য্যা-পরিত্যাগ-বাসনায় বলিলেন, "হে ভুজঙ্গমে! আমার কথা মিথ্যা হইবার নহে, আমি অদ্যই এ স্থান হইতে প্রস্থান কবির। আমি ত' পূর্ব্বেই তোমার সহিত এইরূপ নিয়ম করিয়া-ছিলাম ; অতএব হে ভদ্রে! এতদিন তোমার নিকট পরমসুখে ছিলাম, এক্ষণে চলিলাম। আমি গমন করিলে তোমার ভ্রাতাকে বলিও, সেই মুনি গমন করিয়াছেন এবং তুমিও মদীয় অদর্শনে শোকাভিভূত হইও না।"
    তাঁহার এই দারুণ কথা শুনিয়া নাগ-স্বসা [সর্পভগিনী] জরৎকারুর মুখ শুষ্ক হইল ও হৃদয় কম্পিত হইতে লাগিল। পরিশেষে তিনি ধৈর্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক বাষ্পাকুললোচনে ও গদগদ বচনে কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিলেন, "হে ধর্ম্মজ্ঞ! বিনা অপরাধে আমাকে পরিত্যাগ করিও না, আমি কখন অধর্ম্মাচরণ করি নাই এবং প্রাণপণে আপনার প্রিয়কার্য্য ও হিতানুষ্ঠান করিয়া থাকি। ভ্রাতা যে অভিসন্ধি করিয়া আপনার হস্তে আমাকে সম্প্রদান করিয়াছেন, দুরদৃষ্টক্রমে আমি অদ্যাপিও তাহা প্রাপ্ত হইলাম না। তিনিই বা আমাকে কি বলিবেন? আমার জ্ঞাতিবর্গ মাতৃশাপে অভিভূত আছেন; আপনার ঔরসে আমার গর্ভে একটি পুৎত্র জন্মিবে এবং ঐ পুৎত্র হইতে তাঁহাদিগের শাপমোচন হইবে, এই তাঁহাদিগের অভিপ্রেত। কৈ, তাহারও ত’ কোন বিশেষ চিহ্ন দেখিতে পাইতেছি না; অতএব এক্ষণে যাহাতে তাঁহাদিগের ঐ মনোরথ নিষ্ফল না হয়, তাহা সম্পাদন করুন। হে ভগবান্! আমি জ্ঞাতিবর্গের হিতসাধনে প্রবৃত্ত হইয়াছি, আমার প্রতি প্রসন্ন হউন, এই অপরিস্ফুট গর্ভাধান [যে গর্ভ প্রকাশ পাব নাই এইরূপ] পূর্ব্বক বিনা-অপরাধে আমাকে পরিত্যাগ করিয়া কোথায় গমন করিবেন?" মহর্ষি জরৎকারু সহধর্ম্মিণীর এইরূপ বাক্য শুনিয়া তৎকালোপযুক্ত অনুরূপ বচনে কহিলেন, "হে সুভগে! তোমার গর্ভে পরম-ধার্ম্মিক, বেদ-বেদাঙ্গপারগ, অগ্নিকল্প এক ঋষি জন্মিবেন।" এই বলিয়া অতি কঠোর তপশ্চরণে কৃতনিশ্চয় হইয়া সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।

অষ্টচত্বারিংশ অধ্যায়
আস্তীক নামনিরুক্তি

    উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, হে তপোধন! অনন্তর নাগদুহিতা ভ্রাতৃসন্নিধানে আগমন করিয়া স্বভর্ত্তার গমনবৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত নিবেদন করিলেন।তখন ভুজঙ্গরাজ বাসুকি অতিশয় অপ্রিয় সংবাদ শ্রবণ করিয়া যৎপরোনাস্তি পরিতাপ পাইলেন এবং কহিলেন, "ভদ্রে! আমি যে অভিপ্রায়ে তোমাকে জরৎকারু-হস্তে সম্প্রদান করিয়াছিলাম, বোধ করি, তুমি তাহা সম্যক্‌রূপে অবগত আছ। যদি তাঁহার ঔরসে তোমার সন্তান উৎপন্ন হয়, তাহা হইলে সর্পদিগের সবিশেষ উপকার দর্শিবে অর্থাৎ ঐ পুৎত্র রাজা জনমেজয়ের সর্পসত্র হইতে আমাদিগকে পরিত্রাণ করিবে। সর্ব্বলোকপিতামহ ভগবান্ ব্রহ্মা পূর্ব্বে দেবগণের নিকট এই কথা কহিয়াছিলেন, অতএব জিজ্ঞাসা করি, সেই মুনি হইতে তোমার গর্ভসঞ্চার হইয়াছে কি না? আমার জিজ্ঞাসার উদ্দেশ্য এই যে, জরৎকারুকে ভগিনী সম্প্রদান করা কতদূর সফল হইল, জানিতে ইচ্ছা করি। নতুবা তোমাকে আমার এরূপ প্রশ্ন করা কোনক্রমেই ন্যায্য নহে, কিন্তু কি করি, নিতান্ত গুরুতর কার্য্য বলিয়াই অগত্যা এরূপ অনুচিত প্রশ্ন করিতে হইল। তোমার ভর্ত্তা তপস্যায় একান্ত অনুরক্ত ও নিতান্ত রোষপরবশ, বোধ করি, আমি অনুনয় করিলেও তিনি প্রতিনিবৃত্ত হইবেন না। বরং আমাকে অভিসম্পাত করিলেও করিতে পারেন। এই নিমিত্ত আমি তাঁহার অনুগমন করিতে চাহিনা। অতএব হে ভদ্রে! তোমার ভর্ত্তৃবৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত পরিচয় দিয়া আমার চিরপ্রোত হৃদয়শল্য [দীর্ঘকালের বিন্যস্ত বাসনারূপ মনের উদ্বেগ] উন্মুলিত কর।"
    জরৎকারু নাগরাজ বাসুকিকে আশ্বাস প্রদানপূর্ব্বক কহিলেন, "ভ্রাতঃ! সেই মহাত্মা যৎকালে গমন করেন, তখন আমি পুৎত্রের নিমিত্ত প্রার্থনা করিয়াছিলাম। তৎপরে 'অস্তি' অর্থাৎ আমার ঔরসে তোমার গর্ভসঞ্চার হইয়াছে এই উত্তর দিয়া তিনি প্রস্থান করিলেন। আমি তাঁহাকে ভ্রমক্রমেও মিথ্যা কহিতে শুনি নাই, সুতরাং এরূপ বিষয়ে কখনই মিথ্যাকথা কহিবেন না। তিনি গমনকালে আমাকে কহিলেন, 'হে ভূজঙ্গমে! আমি নিষ্ক্রান্ত হইলে তুমি আমার নিমিত্ত সন্তাপ করিও না। অগ্নিসমপ্রদীপ্ত ও সূর্য্যের ন্যায় তেজস্বী তোমার এক পুৎত্র উৎপন্ন হইবে।" অতএব হে ভ্রাতঃ! এক্ষণে তোমার সেই মনোদুঃখ দূর হউক।" বাসুকি "তথাস্তু" বলিয়া ভগিনীবাক্য স্বীকার করিলেন এবং আহ্লাদ সাগরে মগ্ন হইয়া মধুসম্ভাষণ, সম্মান ও প্রার্থনাধিক অর্থদানে তাঁহাকে সন্তুষ্ট করিলেন।
    অনন্তর সেই মহাপ্রভাবশালী গর্ভ শুক্লপক্ষীয় শশধরের ন্যায় দিন দিন পরিবর্দ্ধিত হইতে লাগিল। পরে নাগ-ভগিনী জরৎকারু যথাকালে পিতৃকুল-মাতৃকুল এই উভয় কুলের ভয়াপহারক দেব কুমারসদৃশ এক পুৎত্র প্রসব করিলেন। ঐ কুমার নাগরাজ-গৃহে অবস্থিত থাকিয়া প্রতিপালিত হইতে লাগিলেন এবং স্বীয় অসাধারণ বুদ্ধিবলে বাল্যকালে ভৃগুনন্দন চ্যবনের নিকট নিখিল বেদ ও বেদাঙ্গ অধ্যয়ন করিলেন। তাঁহার গর্ভাবস্থানকালে তদীয় পিতা "অস্তি" বলিয়া প্রস্থান করিয়াছিলেন, এই নিমিত্ত তিনি আস্তীক নামে বিখ্যাত হইলেন। বাসুকি অলৌকিক ধীশক্তিসম্পন্ন সেই বালককে পরম-যত্নে প্রতিপালন করিতে লাগিলেন। তিনিও দিন দিন পরিবর্দ্ধিত হইয়া নাগকুলের আনন্দবর্দ্ধন করিতে লাগিলেন।