মহাভারত
আদিপর্ব


ভাষাংশ>মহাভারত >আদিপর্ব>একোনপঞ্চাশত্তম-দ্বিপঞ্চাশত্তম অধ্যায়


একোনপঞ্চাশত্তম অধ্যায়
পরীক্ষিতের নিধনবৃত্তান্ত

    শৌনক কহিলেন, রাজা জনমেজয় পিতার স্বর্গারোহণবৃত্তান্ত মন্ত্রিগণকে যেরূপে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, হে সূতনন্দন! তুমি এক্ষণে তাহা সবিস্তারে কীর্ত্তন কর। উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, হে দ্বিজেন! রাজা জনমেজয় যে প্রকারে মন্ত্রীদিগের পিতার নিধন বার্ত্তা জিজ্ঞাসা করেন এবং তাঁহার যেরূপে সেই বৃত্তান্ত বর্ণন করেন, তাহা কহিতেছি, শ্রবণ করুন। একদা রাজা জনমেজয় স্বীয় মন্ত্রীদিগকে কহিলেন, "হে অমাত্যগণ! তোমরা আমার পিতার নিধনবৃত্তান্ত সমুদয় জান, এক্ষণে আমি তোমাদিগের নিকট তাহা আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিয়া যথোচিত প্রতিবিধান-চেষ্টা করিব।" ধার্ম্মিক ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন অমাত্যগণ মহারাজ জনমেজয় কর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া কহিলেন, "রাজন্! আপনার পিতা মহাত্মা পরীক্ষিতের যেরূপ চরিত্র ও তিনি যে প্রকারে লোকান্তরে গমন করিয়াছেন, তাহা কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। ধর্ম্মাত্মা প্রবলপরাক্রান্ত রাজা পরীক্ষিৎ মূর্ত্তিমান ধর্ম্মের ন্যায় প্রজাপালনপূর্ব্বক ভগবতী ভূতধাত্রীকে রক্ষা করিতেন। তদীয় অধিকার কালে ব্রাহ্মণ, ক্ষৎত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই চারিবর্ণ স্ব স্ব ধর্ম্মে অনুরক্ত ছিলেন। তিনি কাহারও দ্বেষ্টা ছিলেন না এবং তাঁহার প্রতিও কেহ বিদ্বেষ করিত না। তিনি প্রজাপতির ন্যায় সর্ব্বভূতে সমদর্শী ছিলেন এবং বিধবা, বিকলাঙ্গ, অনাথ, দীন, দরিদ্রদিগকে ভরণপোষণ করিতেন। তদীয় কলেবর দ্বিতীয় শশধরের ন্যায় লোকের প্রিয়দর্শন ছিল। মহারাজ পরীক্ষিৎ শারদ্বত হইতে ধনুর্ব্বেদ শিক্ষা করেন ও ভূতভাবনা ভগবান্ বাসুদেবের অতি প্রিয়পাত্র ছিলেন। প্রজাগণ সকলেই তাঁহার প্রতি সবিশেষ অনুরক্ত ছিল। কুরুকুল পরিক্ষীণ হইলে আপনার পিতা অভিমন্যুর ঔরসে উত্তরার গর্ভে উৎপন্ন হয়েন; এই নিমিত্ত তাঁহার নাম পরীক্ষিৎ হইয়াছিল। তিনি রাজধর্ম্মে সুনিপুণ, নীতিশাস্ত্রে পারদর্শী, জিতেন্দ্রিয়, মেধাবী এবং ষড়বর্গ-বিজেতা [কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ. মদ ও মাৎসর্য্য-এই ষড়্‌রিপুজয়ী] ছিলেন। রাজাধিরাজ পরীক্ষিৎ ষষ্টিবর্ষ বয়ঃক্রম পর্য্যন্ত প্রজাপালন করিয়া সংসারলীলা সংবরণ করেন। তদীয় নিধনকালে সকলেই শোকাভিভূত হইয়াছিলেন। তৎপরে আপনি কুলক্রমাগত এই রাজ্যতন্ত্র ধর্ম্মতঃ লাভ করিয়াছেন এবং অতি শৈশবাবস্থাতেই রাজ্যে অভিষিক্ত হইয়া সহস্র বৎসর প্রজাবর্গ শাসন করিয়াছেন।"
    জনমেজয় কহিলেন, "মদীয় পূর্ব্বপুরুষদিগের বিচিত্র চরিত্র পর্য্যালোচনা করিয়া দেখিলে বোধ হয়, এই বংশে এমন কোন রাজা ছিলেন না যে, তিনি প্রজাবর্গের প্রিয়কার্য্য-সম্পাদন না করিতেন। অতএব আমার পিতা তথাবিধ রাজা হইয়াও কি প্রকারে বিনাশপ্রাপ্ত হইলেন, তাহা যথাযথরূপে বর্ণনা কর, আমি শ্রবণ করিতে বাসনা করি।" রাজার প্রিয়হিতাভিলাষী মন্ত্রিগণ তদীয় আদেশক্রমে পরীক্ষিতের নিধনবৃত্তান্ত যথাবৎ বর্ণন করিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহারা কহিলেন, "মহারাজ! আপনার পিতা পাণ্ডু রাজার ন্যায় অসাধারণ ধনুর্দ্ধর ও মৃগয়াতৎপর ছিলেন। একদা তিনি আমাদিগের প্রতি সমস্ত সাম্রজ্যের ভারার্পণ করিয়া মৃগয়ার্থ অরণ্যানী প্রবেশপূর্ব্বক শাণিত বাণ দ্বারা একটি মৃগকে বিদ্ধ করিয়াছিলেন; বিদ্ধ করিয়া অস্ত্র-শস্ত্র সহিত অতি সত্বরপদে তাহার অনুসরণে প্রবৃত্ত হইলেন; কিন্তু পলায়িত বাণবিদ্ধ মৃগের কিছুই অনুসন্ধান করিতে পারিলেন না। তৎকালে তিনি ষষ্টিবর্ষ বয়স্ক ও অতি দুর্ব্বল হইয়াছিলেন, এই নিমিত্ত অতি অল্পকালের মধ্যে একান্ত ক্লান্ত ও ক্ষুৎপিপাসায় নিতান্ত আক্রান্ত হইলেন। পরে ইতস্ততঃ পর্য্যটন করিতে করিতে অরণ্যমধ্যে এক মুনিকে দেখিতে পাইলেন। ঐ মুনি মৌনব্রতাবলম্বনপূর্ব্বক একতানমনে ধ্যান করিতেছিলেন। রাজা তাঁহার নিকট প্রত্যুত্তর করিলেন না। রাজা ক্ষুধার্ত্ত ও পিপাসার্ত্ত ছিলেন, সুতরাং তিনি মুনিকে উত্তরদানে পরাঙ্মুখ দেখিয়া তৎক্ষণাৎ ক্রোধাবিষ্ট হইলেন এবং তাঁহাকে প্রতিবোধিত না করিয়া রোষাবেশ প্রকাশপূর্ব্বক ধরাতল হইতে ধনুষ্কোটি [ধনুকের অগ্রভাগ] দ্বারা এক মৃতসর্প উদ্ধৃত করিয়া সেই শুদ্ধচিত্ত মুনিবরের স্কন্ধদেশে নিক্ষেপ করিলেন। তথাপি তিনি কিছুই না বলিয়া অক্ষুব্ধচিত্তে স্কন্ধে মৃতসর্পধারণ পূর্ব্বক পূর্ব্ববৎ অবস্থিত রহিলেন।"


 পঞ্চাশত্তম অধ্যায়
পরীক্ষিতের শাপরহস্য

    অমাত্যগণ কহিলেন, "মহারাজ! ক্ষুৎপিপাসার্ত্ত রাজা পরীক্ষিৎ এইরূপে সেই মুনির স্কন্ধে মৃতসর্প নিক্ষেপ করিয়া স্বনগরে প্রত্যাগমন করিলেন। উক্ত ঋষির মহাবীর্য্যসম্পন্ন অতি কোপনস্বভাব শৃঙ্গী নামে এক গোগর্ভসমুদ্ভুত পুৎত্র ছিলেন। ঋষিকুমার প্রজাপতির আরাধনানন্তর তদীয় অনুমতি লইয়া ব্রহ্মলোক হইতে ভূলোকে প্রত্যাগমনপূর্ব্বক সখার সন্নিধানে নিজ পিতার অপমান-বৃত্তান্ত শ্রবণ করিলেন। তাঁহার সখা কহিলেন, 'বয়স্য! তোমার পিতা একতানমনে ধ্যান করিতেছিলেন, এই অবসরে রাজা পরীক্ষিৎ আসিয়া অকারণে তাঁহার স্কন্ধদেশে এক মৃতসর্প নিক্ষেপপূর্ব্বক প্রস্থান করিয়াছেন।' মহারাজ! শৃঙ্গী অল্পবয়স্ক হইয়াও প্রাচীনপ্রায় ছিলেন। তিনি সখার মুখে নিজ পিতার এইরূপ অপমান-বৃত্তান্ত শ্রবণ করিবামাত্র ক্রোধে অধীর হইয়া আচমনপূর্ব্বক আপনার পিতাকে এই অভিসম্পাত করিলেন, 'যে ব্যক্তি নিরপরাধে আমার পিতার স্কন্ধে মৃতসর্প নিক্ষেপ করিয়াছে, দুর্বিবষহবীর্য্যসম্পন্ন [অসহনীয় শক্তিযুক্ত] নাগরাজ তক্ষক আমার বাক্যানুসারে সপ্তাহের মধ্যে সেই পাপাত্মকে ভস্মসাৎ করিবে।' ঋষিকুমার এই অভিশাপ দিয়া সখাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, 'বয়স্য! অদ্য আমার তপঃপ্রভাব দেখ।' পরে শৃঙ্গী পিতার নিকট আগমনপূর্ব্বক স্বদত্ত শাপ-বৃত্তান্ত সমুদয় নিবেদন করিলেন। তখন সেই সদাশয় মুনিবর নিরুপায় ভাবিয়া সুশীল, গুণসম্পন্ন গৌরমুখ-নামক শিষ্যকে এই কথা বলিয়া আপনার পিতার নিকট প্রেরণ করিলেন, 'আমার পুৎত্র আপনাকে অভিশাপ দিয়াছে, নাগরাজ তক্ষক আসিয়া সপ্তাহের মধ্যে স্বকীয় তেজোদ্বারা আপনাকে দগ্ধ করিবে; অতএব হে মহারাজ! আপনি অদ্যাবধি সাবধান হউক।' গৌরমুখ রাজগোচরে উপনীত হইয়া বিশ্রামান্তে ঋষিবাক্য আদ্যোপান্ত নিবেদন করিলেন। হে মহারাজ! আপনার পিতা এই ভয়ঙ্কর বাক্য শ্রবণ করিয়া তক্ষকের ভয়ে সতত সাবধানে রহিলেন।
    অনন্তর সেই সপ্তম দিবস উপস্থিত হইলে মহর্ষি কাশ্যপ রাজার নিকটে আগমন করিতেছিলেন। ব্রাহ্মণবেশধারী নাগরাজ তক্ষক পথিমধ্যে তাঁহার সন্দর্শন পাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, 'আপনি এত সত্বরে কোথায় যাইতেছেন এবং কি মনে করিয়াই বা যাইতেছেন?' মহর্ষি কাশ্যপ কহিলেন, 'হে দ্বিজ! শুনিলাম, অদ্য নাগরাজ তক্ষক কুরুরাজ পরীক্ষিৎকে দংশন করিবেন, আমি তাঁহাকে আরোগ্য করিব বলিয়া অতি সত্বর তথায় গমন করিতেছি। আমি সম্মুখে থাকিলে তক্ষক তাঁহাকে দগ্ধ করিতে পারিবেন না।' দ্বিজরূপী তক্ষক কহিলেন, 'মহর্ষি! আমিই সেই তক্ষক। আমি তাঁহাকে দংশন করিলে তুমি কিছুতেই প্রতীকার করিতে পারিবে না। বৃথা কেন কর্ম্মভোগ করিবে? তুমি আমার অদ্ভুত বীর্য্য দেখ।' এই বলিয়া নাগরাজ পুরোবর্ত্তী এক বটবৃক্ষে দংশন করিলেন। বনস্পতি দংশনমাত্রেই ভস্মবশেষ হইল; মহর্ষিও বিদ্যাবলে তৎক্ষণাৎ তাহাকে পুনর্জ্জীবিত করিলেন। তখন তক্ষক বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া কহিলেন, 'ঋষে! তুমি কি অভিলাষে তথায় গমন করিতেছ?' এই বলিয়া তাঁহাকে নানা প্রকার প্রলোভন দেখাইতে লাগিলেন। কাশ্যপ প্রত্যুত্তর করিলেন, 'আমি ধনলাভের প্রত্যাশায় তথায় গমন করিতেছি।' তক্ষক কহিলেন, 'রাজার নিকট যত ধনের আকাঙ্ক্ষায় যাইতেছ, আমি তদপেক্ষা অধিক দিতেছি, তুমি নিবৃত্ত হও।' তদীয় এতাদৃশ প্রমোদকর-বাক্য শ্রবণ করিয়া কাশ্যপ আপনার অভিলাষানুরূপ অর্থ গ্রহণপূর্ব্বক প্রতিনিবৃত্ত হইলেন। ব্রাহ্মণ নিবৃত্ত হইলে তক্ষক ছদ্মবেশে প্রবেশ করিয়া স্বীয় দুঃসহ বিষবহ্নি দ্বারা প্রাসাদোপবিষ্ট ধার্ম্মিকবর ত্বদীয় পিতাকে ভস্মাবশেষ করিলেন। তৎপরে আপনি পিতৃরাজ্যে অভিষিক্ত হইয়াছেন। মহারাজ! এই নিদারুণ বৃত্তান্ত আমরা যেরূপ দর্শন ও শ্রবণ করিতেছি, তাহা আদ্যোপান্ত সমুদয় নিবেদন করিলাম; এক্ষণে আপনার পিতার ও মহর্ষি উতঙ্কের পরাভব বিবেচনা করিয়া যাহা সমুচিত হয়, অবিলম্বে সম্পাদন করুন।"
    রাজা জনমেজয় পিতার লোকান্তরগমনবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, 'হে অমাত্যগণ! তক্ষক যে বটবৃক্ষকে ভস্মসাৎ করিয়াছিল, কশ্যপ তাহাকে পুনর্জ্জীবিত করেন, এই অদ্ভুত কথা তোমরা কাহার নিকট শুনিয়াছিলে? বোধ হয়, পন্নগাধম তক্ষক মনে মনে এই বিবেচনা করিয়াছিল যে, আমি রাজাকে দংশন করিলে কাশ্যপ মন্ত্রবলে তাঁহার প্রাণরক্ষা করিতে পারিবেন সংশয় নাই; সুতরাং আমাকে সর্ব্বলোকের উপহাসাম্পদ হইতে হইবে, অতএব এই ব্রাহ্মণকে পরিতুষ্ট করিয়া প্রতিনিবৃত্ত করাই শ্রেয়ঃকল্প। সে যাহা হউক, এক্ষণে আমি এক উপায় অবধারণ করিয়াছি, তদ্দ্বারা তাহাকে সমুচিত প্রতিফল প্রদান করিব। কিন্তু বল দেখি, কাশ্যপ ও তক্ষকে এই অদ্ভুত বৃত্তান্ত নির্জ্জন অরণ্যমধ্যে ঘটিয়াছিল, ইহা কে প্রত্যক্ষ করিয়াছে এবং কি প্রকারেই বা তোমাদিগের কর্ণগোচর হইল? আমি এই সমস্ত বিষয় উত্তমরূপে জানিয়া সর্পকুল সংহার করিব।"
    মন্ত্রিগণ কহিলেন, "মহারাজ! আমরা তক্ষক ও কাশ্যপের এই অদ্ভুত বৃত্তান্ত যাঁহার নিকট শুনিয়াছিলাম, শ্রবণ করুন। এক ব্রাহ্মণ শুষ্ক কাষ্ঠ আহরণ করিবার নিমিত্ত সেই বটবৃক্ষে আরোহণ করিয়াছিলেন। তক্ষক ও কাশ্যপ উভয়েই তাহা জানিতে পারেন নাই। তক্ষকের বিষানলে বৃক্ষের সহিত ঐ ব্রাহ্মণের কলেবরও ভস্মাবশেষ হয়; কিন্তু কাশ্যপের অলৌকিক মন্ত্রবলে উভয়েই পুনরুজ্জীবিত হইয়াছিল। পরে সেই ব্রাহ্মণ আসিয়া আমাদিগকে এই সংবাদ প্রদান করেন। মহারাজ! যে দেখিয়াছে ও আমরা যেরূপ শুনিয়াছি, তাহা নিবেদন করিলাম, এক্ষণে যাহা কর্ত্তব্য হয়, করুন।"
    তাহা শ্রবণ করিয়া রাজা জনমেজয় অতিশয় সন্তপ্ত হইলেন এবং রোষভরে করে করে পরিপেষণ [এক হস্তে অপর হস্তের ঘর্ষণ] করিতে লাগিলেন। অনন্তর দীর্ঘ ও উষ্ণ নিশ্বাস ত্যাগ এবং অশ্রুমোচনপূর্ব্বক কিয়ৎক্ষণ মৌনাবলম্বনে থাকিয়া মন্ত্রীদিগকে কহিলেন, "হে অমাত্যগণ! পিতার পরাভববৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া যাহা অবধারণ করিলাম, বলিতেছি, শ্রবণ কর। দুরাত্মা তক্ষক শৃঙ্গীকে উপলক্ষ্যমাত্র করিয়া পিতার প্রাণহিংসা করিয়াছে। এক্ষণে তাহার সমুচিত প্রতিফল দিতে হইবে। যদি কাশ্যপ আসিতেন, তাহা হইলে পিতা অবশ্যই জীবিত থাকিতেন, কিন্তু তক্ষক এরূপ দুরাত্মা যে, তাঁহাকে অর্থ দিয়া প্রতিনিবৃত্ত করিয়াছে। যদি পিতা কাশ্যপের প্রসাদে ও মন্ত্রীদিগের মন্ত্রণাবলে জীবনলাভ করিতেন, তাহাতে তক্ষকের কি ক্ষতি হইত? তাহার এ অত্যাচার আর কিছুতেই সহ্য হয় না। অতএব এক্ষণে আমি আমার আপনার, তোমাদিগের ও উতঙ্কের সন্তোষের নিমিত্ত পিতার বৈরনির্য্যাতনে দৃঢ়নিশ্চয় করিলাম।"


একপঞ্চাশত্তম অধ্যায়
সর্পনাশে রাজার প্রতিজ্ঞা

    উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, রাজা জনমেজয় এই কথা বলিয়া মন্ত্রিগণের অনুমোদনক্রমে সর্পবংশ ধ্বংস করিতে প্রতিজ্ঞারূঢ় হইলেন। পরে স্বীয় পুরোহিত দ্বারা ঋত্বিক্‌গণকে আহ্বান করিয়া আপন কার্য্যের অনুকুল এই বাক্য বলিলেন, "দুরাত্মা রক্ষক আমার পিতার প্রাণহিংসা করিয়াছে, এক্ষণে আমি তাহার প্রতীকার করিতে অভিলাষ করি, আপনারা অনুমতি করুন। হে মহাশয়গণ! আপনাদের এমন কোন কর্ম্ম বিদিত আছে, যদ্দ্বারা আমি সেই দুরাত্মাকে ও তাহার বন্ধুবান্ধবদিগকে প্রজ্জলিত হুতাশনে নিক্ষেপ করিয়া সবংশে ধ্বংস করিতে পারি? সে যেমন আমার পিতাকে তীব্র বিষাগ্নিতে দগ্ধ করিয়াছে, তদ্রুপ আমিও সেই পাপাত্মাকে ভস্মসাৎ করিব।" ঋত্বিকগণ কহিলেন, "মহারাজ! পুরাণে বর্ণিত আছে, দেবতারা তোমার নিমিত্ত সর্পসত্র নামে এক অতি মহৎ সত্র সৃষ্টি করিয়াছেন। পৌরাণিকেরা কহিয়া থাকেন, আপনি ব্যতীত সেই যজ্ঞের অনুষ্ঠানকর্ত্তা আর কেহই নাই। সেই যজ্ঞের অনুষ্ঠান-প্রণালীও আমাদিগের বিদিত আছে, অতএব আপনি সর্পসত্র আরম্ভ করুন; তাহাতেই দুরাত্মা তক্ষকের বিনাশ হইবে, সন্দেহ নাই।" রাজর্ষি এই বাক্য শ্রবণ করিবামাত্র বোধ করিলেন, যেন তক্ষক প্রজ্বলিত হুতাশনে দগ্ধ হইয়াছে। পরে মন্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণদিগকে কহিলেন, "আমি সেই যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিব, আপনারা আদেশ করুন, কিরূপ যজ্ঞীয় দ্রব্যসামগ্রী আহরণ করিতে হইবে?" তখন বেদজ্ঞ ও বিচক্ষণ ঋত্বিকগণ শাস্ত্রানুসারে যজ্ঞভূমির পরিমাণ করিয়া মহামূল্য রত্নসমূহে ও প্রভুত ধনধান্যে সেই যজ্ঞায়তন পরিপূরিত করিলেন। ঋত্বিকগণ এইরূপে যজ্ঞভূমি প্রস্তুত করাইয়া সেই সত্রে আপনারা ব্রতী হইলেন এবং রাজাকে যথাবিধি দীক্ষিত করিলেন; কিন্তু যজ্ঞারম্ভের পূর্ব্বে যজ্ঞ-বিঘ্নকর এক মহৎ ব্যাপার উপস্থিত হইয়াছিল। যজ্ঞায়তন নির্ম্মাণকালে একজন বাস্তুবিদ্যা বিশারদ [গৃহাদির স্থান ও কাল বিচারে নিপুণ] পুরাণবেত্তা সূত্রধর তথায় উপস্থিত হইয়া কহিলেন, 'যে প্রদেশে ও যে সময়ে যজ্ঞায়তনের পরিমাণ করা হইয়াছে, তদ্দ্বারা বোধ হইতেছে যে, একজন ব্রাহ্মণ হইতে এই যজ্ঞের ব্যাঘাত জন্মিবে।' রাজা এই কথা শ্রবণ করিয়া দীক্ষিত হইবার পূর্ব্বেই দ্বারপালকে আজ্ঞা করিয়াছিলেন, "যেন আমার অজ্ঞাতসারে কোন ব্যক্তি এখানে প্রবিষ্ট হইতে না পারে।"

দ্বিপঞ্চাশত্তম অধ্যায়
সর্পযজ্ঞারম্ভ

    তদনন্তর বিধানানুসারে সর্পসত্র আরব্ধ হইল। পুরোহিতগণ স্ব স্ব কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়া কৃষ্ণবর্ণ বসন-যুগল পরিধান ও মন্ত্রোচ্চারণ পূর্ব্বক বহ্নিতে আহুতি প্রদান করিতে লাগিলেন। অনবরত ধূম সম্পর্কে তাঁহাদিগের চক্ষু রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল। সর্পগণের নামোল্লেখপূর্ব্বক আহুতি দিতে আরম্ভ করিলে, তাহাদিগের হৃৎকম্প উপস্থিত হইল। পরে নাগগণ নিতান্ত ব্যাকুল ও একান্ত অস্থির হইয়া ঘন ঘন নিশ্বাস পরিত্যাগ এবং পরস্পর মস্তক ও লাঙ্গুল দ্বারা বেষ্টন করিয়া করুণস্বরে পরস্পরকে আহ্বান করিতে করিতে সেই প্রদীপ্ত হুতাশনে অনবরত পতিত হইতে লাগিল। শ্বেতবর্ণ, নীলবর্ণ, কৃষ্ণবর্ণ, বালক, বৃদ্ধ, যুবা, ক্রোশপ্রমাণ, যোজন [চারি ক্রোশ] প্রমাণ, অশ্বাকার, করিশুণ্ডাকার, মহাকায়, মহাবলপরাক্রান্ত শত শত, সহস্র সহস্র, প্রযুত প্রযুত, অর্ব্বুদ বহুবিধ মহাবিষ বিষধরগণ মাতৃশাপদোষে অবশ হইয়া সেই প্রজ্বলিত হুতবহ [অগ্নি] মুখে পতিত হইতে লাগিল।