মহাভারত
আদিপর্ব


ভাষাংশ>মহাভারত >আদিপর্ব>ত্রিপঞ্চাশত্তম-ষট্‌ঞ্চাশত্তম অধ্যায়


ত্রিপঞ্চাশত্তম অধ্যায়
যজ্ঞে বৃতিগণের নাম

    শৌনক জিজ্ঞাসা করিলেন, হে সূতাত্মজ! সর্পকুল-সংহর্ত্তা কুরুবংশাবতংস রাজা জনমেজয়ের সেই সর্পসত্রে কোন্ কোন্ ঋষি ঋত্বিক্ হইয়াছিলেন এবং নাগগণের বিষাদজনক সেই দারুণ যজ্ঞে কোন্ কোন্ ঋষিই বা সদস্য হইয়াছিলেন? হে বৎস! তুমি তৎসমুদয় বর্ণন কর। তাহা হইলে আমি সর্পসত্র-বিধানজ্ঞ মহর্ষিগণের নাম জানিতে পারিব।
    উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, রাজা জনমেজয়ের যজ্ঞে যে-সকল মনীর্ষিগণ ঋত্বিক্ ও সদস্য ছিলেন, তাঁহাদিগের নাম কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। অসাধারণ বেদবেত্তা চ্যবনবংশীয় সুবিখ্যাত চণ্ডভার্গব সেই মহাযজ্ঞে হোতাজ্ঞ ছিলেন। বৃদ্ধ সুবিদ্বান্ কৌৎস উদ্‌গাতা এবং জৈমিনি ব্রহ্মা ছিলেন। আর পিঙ্গল, অসিত, দেবল, নারদ, পর্ব্বত, আত্রেয়, কুণ্ডজঠর, কালঘট, বাৎস্য, শ্রুতশ্রবাঃ, কোহল, দেবশর্ম্মা, মৌদ্‌গল্য, সমসৌরভ প্রভৃতি অনেক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ-সকল তাহাতে সদস্য হইয়াছিলেন। ইঁহারা সকলে সেই সুমহান্ সর্পসত্রে আহুতি প্রদান করিতে আরম্ভ করিলে, অতি ভীষণাকার সর্প-সকল প্রজ্বলিত হোমানলে পতিত ও বিনষ্ট হইতে লাগিল। তাহাদিগের বসা ও মেদোদ্বারা শত শত কৃত্রিমসরিৎ প্রবাহিত হইল এবং পূতিগন্ধে চারিদিক ব্যাপ্ত হইয়া উঠিল। অনলে পতিত ও পতনোন্মুখ গগনস্থ নাগগণের তুমুল আর্ত্তনাদে সেই প্রদেশ প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। নাগেন্দ্র তক্ষক রাজা জনমেজয়কে সত্রে দীক্ষিত শুনিয়া তৎক্ষণাৎ ইন্দ্রালয়ে গমন করিল এবং আত্মদোষের পরিচয় দিয়া পুরন্দরের শরণাগত হইল। দেবরাজ প্রসন্ন হইয়া তক্ষককে কহিলেন, "নাগেন্দ্র! তুমি ভীত হইও না, আমি তোমার নিমিত্ত পূর্ব্বেই পিতামহকে প্রসন্ন করিয়াছি; অতএব আর তোমার ভয়ের বিষয় কি? মনোদুঃখ দূর কর।"
    উগ্রশ্রবাঃ শৌনককে কহিলেন, হে ব্রহ্মণ্! নাগেন্দ্র এইরূপে আশ্বাসিত হইয়া ইন্দ্রালয়ে পরমসুখে কালযাপন করিতে লাগিলেন। এদিকে সর্পকুল ক্রমে ক্রমে ভস্মাবশিষ্ট হইতেছে দেখিয়া, স্বজনহিতৈষী বাসুকি বন্ধুবান্ধবগণের বিরহে সাতিশয় কাতর, উদ্‌ভ্রান্তচিত্ত ও ক্ষণে ক্ষণে মূর্চ্ছিত হইতে লাগিলেন। অনন্তর নাগরাজ পরিবারবর্গের অত্যল্পমাত্র অবশিষ্ট আছে দেখিয়া নিজ ভগিনীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, "ভদ্রে! আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ-সকল শোকানলে দগ্ধ হইতেছে, শরীর অবসন্ন ও দশদিক্ শূন্য বোধ হইতেছে, মন ও নয়ন নিতান্ত উদ্‌ভ্রান্ত হইতেছে এবং হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইতেছে। অধিক কি কহিব, বোধ হয়, বুঝি অদ্যই আমাকে সেই প্রদীপ্ত-দহনে দেহ সমর্পণ করিতে হইল। রাজা জনমেজয় আমাদিগকে সবংশে ধ্বংস করিবার নিমিত্তই সর্পসত্র আরম্ভ করিয়াছেন, সুতরাং আমাকেও যমসদনে গমন করিতে হইবে, সন্দেহ নাই। হে ভগিনী! আমি যে অভিপ্রায়ে তোমাকে জরৎকারুহস্তে প্রদান করিয়াছিলাম, এক্ষণে তাহার সময় উপস্থিত, অতএব আমাদিগের প্রাণরক্ষা করিয়া সেই চিরাকাঙ্ক্ষিত মনোরথ পরিপূর্ণ কর। পূর্ব্বে পিতামহের মুখে শ্রবণ করিয়াছি, আস্তীক জনমেজয়ের সর্পসত্র নিবারণ করিবেন। অতএব হে বৎস! অধুনা তুমি আমার ও আমার পরিজনবর্গের জীবনরক্ষার্থ অদ্বিতীয় বেদবেত্তা আপন পুৎত্রকে আদেশ কর।"

চতুঃপঞ্চাশত্তম অধ্যায়
আস্তীকের প্রতি মাতার আদেশ

    উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, তদনন্তর নাগরাজভগিনী জরৎকারু স্বীয় সন্তান আস্তীককে আহবান করিয়া বাসুকির বাক্যানুসারে কহিলেন, "পুৎত্র! আমার ভ্রাতা যে অভিপ্রায়ে আমাকে তোমার পিতৃহস্তে প্রদান করিয়াছিলেন, এক্ষণে তাহার সময় উপস্থিত হইয়াছে, অতএব যাহা কর্ত্তব্য হয়, কর।" আস্তীক কহিলেন, "মাতঃ! মাতুল কি নিমিত্ত আপনাকে মদীয় পিতার হস্তে প্রতিপাদন [সৎকারপূর্ব্বক প্রদান] করিয়াছিলেন, আজ্ঞা করুন, জানিয়া প্রতিবিধান করিতেছি।" তখন বান্ধবহিতৈষিণী নাগভগিনী কহিলেন, "বৎস! শ্রবণ কর। সর্প-কুলজননী কদ্রু সপত্নী বিনতাকে পণে পরাস্ত করিয়া দাসীত্ব শৃঙ্খলে বদ্ধ করিবেন, এই অভিসন্ধিতে আপন পুৎত্রদিগকে আদেশ করেন, "তোমরা সত্বর যাইয়া উচ্চৈঃশ্রবা অশ্বের অঙ্গবেষ্টন করিয়া থাক, তাহা হইলে অশ্বাধিপের শুভ্রবর্ণ তিরোহিত হইয়া কৃষ্ণবর্ণ হইবে।" কিন্তু তন্মধ্যে কেহ কেহ মাতৃ-আজ্ঞায় অসম্মতি প্রকাশ করাতে কদ্রু ক্রোধভরে তাহাদিগকে এই বলিয়া অভিসম্পাত করিলেন, "তোমরা আমার আজ্ঞা-লঙ্ঘন করিলে, অতএব এই অপরাধে রাজা জনমেজয়ের সর্পসত্রে দগ্ধ ও পঞ্চত্ব-প্রাপ্ত হইবে।" সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মাও 'তথাস্তু' বলিয়া সেই শাপবাক্য অনুমোদন করিলেন। নাগরাজ বাসুকি প্রজাপতির সেই অনুমোদন বাক্য শ্রবণ করিয়াছিলেন। অনন্তর তিনি সমুদ্রমন্থনকালে ক্ষমা প্রার্থনা-বাসনায় দেবগণের শরণাগত হইলেন। দেবগণ দুর্লভ অমৃতলাভে হৃষ্টচিত্ত হইয়া আমার ভ্রাতাকে সঙ্গে লইয়া ব্রহ্মার নিকট উপস্থিত হইলেন এবং নানা প্রকার স্তুতিবাক্যে কমলযোনিকে প্রসন্ন করিয়া কহিলেন, "ভগবন্! ইনি নাগরাজ বাসুকি, ইনি জ্ঞাতিবর্গের নিমিত্ত অত্যন্ত কাতর হইয়াছেন; এক্ষণে কিরূপে মাতৃশাপ হইতে মুক্ত হইতে পারেন, আজ্ঞা করুন।"

জনমেজয়ের যজ্ঞে আস্তীকের আগমন

    ব্রহ্মা কহিলেন, 'জরৎকারু মুনি জরৎকারুনাম্নী যে স্ত্রীর পাণিগ্রহণ করিবেন, তাঁহার গর্ভে এক সন্তান উৎপন্ন হইবেন, তিনিই সর্পগণকে মাতৃশাপ হইতে মোচন করিবেন।' নাগরাজ বাসুকি এই কথা শ্রবণ করিয়া সর্পসত্র আরম্ভের কিয়ৎকাল পূর্ব্বে আমাকে তোমার পিতার হস্তে সম্প্রদান করেন। হে বৎস! তাহাতেই তুমি আমার গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছ। অধুনা সেই অভীষ্টসিদ্ধির সময় উপস্থিত হইয়াছে, অতএব আসন্ন বিপদ্ হইতে মাতুলকুলের পরিত্রাণ করিয়া নাগরাজের আশালতা ফলবতী কর।'
    আস্তীক 'যে আজ্ঞা' বলিয়া জননীর আদেশ গ্রহণ করিলেন এবং নানা প্রকার প্রবোধবাক্যে বাসুকিকে আশ্বাসিত করিয়া কহিলেন, 'হে ভুজঙ্গেশ্বর! আমি নিশ্চয় বলিতেছি, তোমার শাপমোচন করিব এবং যাহাতে তোমার মঙ্গল হয়, তদ্বিষয়ে সর্ব্বতোভাবে যত্ন করিব। আর ভীত বা দুঃখিত হইবার প্রয়োজন নাই। আমি ভ্রমক্রমেও কদাপি মিথ্যা প্রয়োগ করি না। হে মাতুল! আমি অদ্যই সেই দীক্ষিত রাজা জনমেজয়ের নিকট গমন করিয়া আশীর্ব্বাদাদি দ্বারা তাঁহাকে পরিতুষ্ট করিব এবং যাহাতে যজ্ঞানুষ্ঠান রহিত হয়, তাহা করিব। আপনি আমার বাক্যে কিছুমাত্র সংশয় করিবেন না, নিশ্চিন্ত থাকুন।'
    বাসুকি কহিলেন, 'বৎস আস্তীক! আমি ব্রহ্মার এই গুরুতর দণ্ডের ভয়ে হতজ্ঞান হইয়াছি, দশদিক্ শূন্য দেখিতেছি এবং আমার চিত্ত উদ্বেগচঞ্চল হইতেছে।' তখন আস্তীক কহিলেন, "আপনি সন্তাপ পরিত্যাগ করুন, আমি নিশ্চয় বলিতেছি, অচিরাৎ সেই প্রচণ্ড ব্রহ্মদণ্ডের নিরাকরণ করিব।" আস্তীক এইরূপ আশ্বাস বচনে বাসুকির মনোদুঃখ দূর করিয়া স্বয়ং সমস্ত ভারগ্রহণপূর্ব্বক সর্পগণের পরিত্রাণার্থ রাজা জনমেজয়ের সেই সর্ব্বাবয়বসম্পন্ন যজ্ঞে উপনীত হইলেন। তিনি তথায় যাইয়া দেখিলেন, তপোধন তদ্দর্শনে প্রীত হইয়া সেই স্থানে প্রবেশ করিতে বাসনা করিলেন। দ্বারপালগণ প্রবেশ করিতে না দেওয়াতে তিনি সেই যজ্ঞের নানা প্রকার গুণকীর্ত্তন করিতে লাগিলেন। অনন্তর যজ্ঞভূমিতে উপনীত হইয়া তাহার চতুষ্পার্শ্ববর্ত্তী সূর্য্যসদৃশ ঋত্বিক্ ও সদস্যগণের এবং রাজার ও হোমাগ্নির স্তব করিতে লাগিলেন।

পঞ্চপঞ্চাশত্তম অধ্যায়
আস্তীক কর্ত্তৃক জনমেজয়ের গুণকীর্ত্তন

    আস্তীক কহিলেন, "হে ভারতবংশাবতংস! চন্দ্র, বরুণ ও প্রজাপতি প্রয়াগে যে প্রকার যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়াছিলেন, আপনার এই মহাযজ্ঞও তদ্রূপ সর্ব্বাঙ্গসুন্দর হইয়াছে; কিন্তু হে পরীক্ষিতাত্মজ! আমি প্রার্থনা করি, আমার বন্ধুবর্গের মঙ্গল হউক। দেবরাজ ইন্দ্র একশত অশ্বমেধ যজ্ঞ করিয়াছেন, আপনার এই সর্পসত্র তত্তুল্য এক অযুত অশ্বমেধের সদৃশ; কিন্তু হে পরীক্ষিতাত্মজ! আমি প্রার্থনা করি, আমার বন্ধুবর্গের মঙ্গল হউক। যম, হরিমেধাঃ ও রন্তিদেব রাজার যজ্ঞ যেরূপ হইয়াছিল, আপনার এই যজ্ঞও তদ্রূপ হইয়াছে; কিন্তু হে পরীক্ষিতাত্মজ! আমি প্রার্থনা করি, আমার বন্ধুবর্গের মঙ্গল হউক। গয় রাজা, শশবিন্দু রাজা, বৈশ্রবণ [কুবের], নৃগ রাজা, আজমীঢ় রাজা এবং রাম রাজা যেরূপ যজ্ঞ করিয়াছিলেন, আপনার এই যজ্ঞও তৎসদৃশ হইয়াছে, কিন্তু হে পরীক্ষিতাত্মজ! আমি প্রার্থনা করি,  আমার বন্ধুবর্গের মঙ্গল হউক। ধর্ম্মপুৎত্র যুধিষ্ঠির ও আজমীঢ় রাজার যজ্ঞ অতি সুপ্রসিদ্ধ, আপনার এই যজ্ঞ তদপেক্ষা ন্যূন নহে; কিন্তু হে পরীক্ষিতাত্মজ! আমি প্রার্থনা করি, আমার বন্ধুবর্গের মঙ্গল হউক। সত্যবতীর পুৎত্র ব্যাসদেব এক মহাসত্র করিয়াছিলেন, সেই সত্রে তিনি স্বয়ং ঋত্বিকের কর্ম্ম করেন, আপনার এই সর্পসত্রও তদনুরূপ হইয়াছে; কিন্তু হে পরীক্ষিতাত্মজ! আমি প্রার্থনা করি, আমার বন্ধুবর্গের মঙ্গল হউক।
    আপনার যজ্ঞানুষ্ঠাতা এইসকল সূর্য্যসমতেজা মহর্ষিগণ ইন্দ্রের যজ্ঞানুষ্ঠানকর্ত্তাদিগের সদৃশ; ইঁহাদিগের জ্ঞানের ইয়ত্তা করা অতি দুষ্কর, ইঁহাদিগকে দান করিলে অক্ষয় হয়। আপনার এই ঋত্বিকের কথা অধিক কি বলিব, ব্যাসদেব কহিয়াছেন, ইঁহার সমান লোক ত্রিলোকে লক্ষ্য হয় না, ইঁহারই শিষ্যোপশিষ্যগণ স্বধর্ম্মে নিরত হইয়া এই ভূমণ্ডল ব্যাপিয়া আছেন। আপনার এই প্রজ্বলিত হোমাগ্নি দক্ষিণাবর্ত্ত শিখা দ্বারা দেবোদ্দেশে প্রদত্ত হব্য গ্রহণ করিতেছেন। মহারাজ! আপনার সমান প্রজ্ঞাপালনকর্ত্তা ভূপাল অতি বিরল। আপনি সাক্ষাৎ ধর্ম্মরাজ, বরুণ ও ভাগবান্ বজ্রপাণির [ইন্দ্রেয়] ন্যায় এই ভূমণ্ডল রক্ষা করিতেছেন। আর আপনার বিষয়-নিস্পৃহতা দেখিয়া আমি যৎপরোনাস্তি সন্তুষ্ট হইয়াছি। আপনি খট্বাঙ্গ, নাভাগ, দিলীপ,,যযাতি, মান্ধাতা ও ভীষ্ম প্রভৃতি রাজেন্দ্রগণের সদৃশ; মহর্ষি বাল্মীকির ন্যায় নিগূঢ়-মহত্ত্ব, বশিষ্ঠের ন্যায় জিতক্রোধ, ইন্দ্রের ন্যায় প্রভুত্বশালী, নারায়ণের ন্যায় কান্তি সম্পন্ন, ঔর্ব্ব ত্রিত দুই ঋষির ন্যায় তেজস্বী, যমের ন্যায় ধর্ম্মনিয়ন্তা এবং কৃষ্ণের ন্যায় সর্ব্বগুণালঙ্কৃত। আপনি যেমন অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিপতি, তদ্রূপ যাগাদি সৎক্রিয়ার পথপ্রদর্শক। মহারাজ! অধিক কি বলিব, ধৈর্য্য, বীর্য্য, গাম্ভীর্য্য প্রভৃতি যে-সকল সদ্‌গুণ প্রভাবে লোকে খ্যাতি ও প্রতিপত্তি লাভ করিতে পারে এবং রামাদির ন্যায় চিরস্মরণীয় হইতে পারে, আপনি সেই সমস্ত গুণরাশিতে বিভূষিত হইয়াছেন।" আস্তীক এইরূপ স্তুতিবাক্য দ্বারা নৃপতি, সদস্য, ঋত্বিক ও হব্যবাহ [অগ্নি] প্রভৃতি সকলকেই প্রসন্ন করিলেন। অনন্তর রাজা জনমেজয় আকার ও ইঙ্গিত দ্বারা তাঁহাদিগের সকলের অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া কহিতে লাগিলেন।
 

ষট্‌পঞ্চাশত্তম অধ্যায়
নাগকুলরক্ষার্থ বরপ্রার্থনা

    জনমেজয় কহিলেন, "ইনি বালক, কিন্তু ইঁহার যেরূপ অভিজ্ঞতা দেখিতেছি, তাহাতে বালক বলিয়া কোনক্রমে প্রতীতি হয় না। যাহা হউক, আমি ইঁহার অভিলষিত বর প্রদান করিতে ইচ্ছা করি, হে দ্বিজগণ! আপনাদিগের কি অনুমতি হয়?' সদস্যগণ কহিলেন, 'মহারাজ! ব্রাহ্মণ বালক হইলেও রাজাদিগের পূজনীয়, সন্দেহ নাই। বিশেষতঃ ইনি সর্ব্বশাস্ত্রে মহামহোপাঁধ্যায়, অতএব তক্ষক ব্যতিরেকে আর যাহা প্রার্থনা করিবেন, তাহাই পাইতে পারেন।" অনন্তর রাজা ব্রাহ্মণকে বর-প্রদান করিতে উদ্যত হইলে হোতা কিঞ্চিৎ অসন্তোষ প্রকাশপূর্ব্বক তাঁহাকে কহিলেন, "মহারাজ! তক্ষক অদ্যাপিও এই যজ্ঞাঙ্গনে উপস্থিত হইল না।" তখন জনমেজয় কহিলেন, "যাহাতে আমার ক্রিয়া সুসম্পন্ন হয় এবং সেই বিষম শত্রু তক্ষক শীঘ্র সমুপস্থিত হয়, তদ্বিষয়ে আপনারা যথাসাধ্য যত্নবান হউন।" ঋত্বিক্‌গণ উত্তর কহিলেন, "আমরা শাস্ত্রপ্রভাবে ও অগ্নির মাহাত্ম্যে জানিতে পারিয়াছি, তক্ষক ইন্দ্রের শরণাগত হইয়া তথায় অবস্থিতি করিতেছে।" পৌরাণিক মহাত্মা লোহিতাক্ষ সূতও এই কথা কহিয়াছিলেন। রাজা তৎশ্রবণে সূতকে জিজ্ঞাসা করিলেন। তিনি কহিলেন, "রাজন্! ঋত্বিকেরা যাহা কহিতেছেন, তদ্বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। আমি পুরাণে অবগত হইয়াছি যে, তক্ষক প্রাণভয়ে ভীত হইয়া দেবরাজের শরণাগত হইয়াছে। সুররাজ এই বলিয়া তাহাকে অভয় প্রদান করিয়াছেন, "তুমি অতি গোপনে আমার ভবনে বাস কর, অগ্নি তোমাকে দগ্ধ করিতে পারিবেন না"। রাজা সূতবাক্য-শ্রবণে অত্যন্ত বিষণ্ণ হইয়া হোতাকে নিবেদন করিলেন, "মহাশয়! আপনি ইন্দ্রের আরাধনা করুন।" হোতা তদনুসারে দেবরাজের আরাধনা আরম্ভ করিলে, অমরেন্দ্র বিমানে আরোহণ করিয়া তৎক্ষণাৎ অমরনগরী হইতে যাত্রা করিলেন। চতুর্দ্দিকে দেবতারা স্তুতিপাঠ করিতে লাগিলেন। মেঘমালা, বিদ্যাধরগণ ও অপ্সরাগণ তাঁহার অনুগমন করিল। তক্ষক প্রাণভয়ে ভীত ও সঙ্কুচিত হইয়া দেবরাজের উত্তরীয়বস্ত্রে লুক্কায়িত হইল। এদিকে রাজা ক্রুদ্ধ হইয়া আজ্ঞা করিলেন, "যদি সেই দুরাত্মা তক্ষক ইন্দ্রের নিকট পলায়ন করিয়া লুক্কায়িত থাকে, তবে ইন্দ্রের সহিত তাহাকে অগ্নিসাৎ কর।" হোতা রাজাজ্ঞা পাইয়া তক্ষককে উল্লেখ করিয়া অগ্নিতে আহুতি প্রদান করিবামাত্র নাগেন্দ্র কম্পিত-কলেবর হইয়া ইন্দ্র সমভিব্যাহারে আকাশ-পথে উপস্থিত হইলেন। ইন্দ্র সেই যজ্ঞের আড়ম্বর দর্শনে ভীত হইয়া তক্ষককে পরিত্যাগপূর্ব্বক স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন। তখন ভয়বিহ্বল তক্ষক ঋত্বিকগণের মন্ত্রপ্রভাবে অবশেন্দ্রিয় হইয়া ক্রমে ক্রমে প্রজ্বলিত পাবক-শিখার সমীপবর্ত্তী হইল।
    ঋত্বিকেরা তক্ষককে সমাগত দেখিয়া কহিলেন, "মহারাজ! আর চিন্তা নাই, তক্ষক আপনার বশংবদ হইয়াছে। বোধ হয়, ইন্দ্র উহাকে পরিত্যাগ করিয়াছেন। ঐ দেখুন, সেই পন্নগেন্দ্র আমাদিগের মন্ত্রপ্রভাবে বিকলেন্দ্রিয় ও বিচেতনপ্রায় হইয়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক উচ্চৈঃস্বরে আর্ত্তনাদ করিতে করিতে ঘুর্ণিতকলেবরে স্বর্গ হইতে আকাশপথে আগমন করিতেছে। অতএব আপনার অভীষ্টসিদ্ধির আর বিলম্ব নাই। এক্ষণে দ্বিজবরে বর প্রদান করুন।" রাজা প্রসন্ন হইয়া কহিলেন, "হে ব্রাহ্মণকুমার! অভিলষিত বর প্রার্থনা কর। প্রার্থিত বিষয় অদেয় হইলেও আমি তাহাতে পরাঙ্মুখ হইব না।"
    উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, হে ব্রহ্মন্! তক্ষকের অনলে পতিত হইবার অব্যবহিতপূর্ব্বেই আস্তীক কহিলেন, "হে নরেন্দ্র! যদ্যপি আমাকে বর প্রদান করেন, তবে এই বর দিন যে, আপনার এই যজ্ঞ নিবৃত্ত হউক এবং ইহাতে যেন আর সর্পেরা দগ্ধ না হয়।" ইহা শ্রবণ করিয়া রাজা জনমেজয় অনতিহৃষ্টমনে প্রত্যুত্তর করিলেন, "আপনি সুবর্ণ, রজত, গো প্রভৃতি যে-কোন বস্ত্র প্রার্থনা করিলেন, আমি অবিলম্বে প্রদান করিতেছি, কিন্তু যজ্ঞানুষ্ঠানে নিবৃত্ত হইতে পারিব না।" আস্তীক কহিলেন, "মহারাজ! আমি সুবর্ণ, রজত, গো-অশ্বাদির নিমিত্ত আপনার নিকট আসি নাই! মাতুলকুলের হিতার্থে আপনার নিকট অর্থিভাবে [যাচক] আসিয়াছি। অতএব যদি সেই অভিলষিত অর্থসাধনে কৃতকার্য্য হইতে না পারিলাম, তবে রজতসুবর্ণাদি লইয়া কি করিব?" আস্তীকের এইরূপ অতর্কিতচর [অচিন্তিতপূর্ব্ব
অভাবনীয়] বর-প্রার্থনায় রাজা বিষাদসাগরে নিমগ্ন হইলেন এবং বরান্তর দিবার নিমিত্ত পুনঃ পুনঃ অনুরোধ করিতে লাগিলেন; কিন্তু তাঁহাকে ব্যবসায় [সঙ্কল্প] হইতে বিচলিত করিতে পারিলেন না। তদনন্তর বেদজ্ঞ সদস্যেরা একবাক্যে কহিলেন, "মহারাজ! পূর্ব্বে অঙ্গীকার করিয়াছেন, অতএব বর প্রদান করা আপনার সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য।"