মহাভারত
আদিপর্ব


ভাষাংশ>মহাভারত >আদিপর্ব>পঞ্চষষ্টিতম থেকে যট্‌ষষ্টিতম অধ্যায়


পঞ্চষষ্টিতম অধ্যায়
সম্ভবপর্ব্ব
ব্রহ্মর্ষিবংশ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, দেবরাজ ইন্দ্র নারায়ণের সহিত এইরূপ মন্ত্রণা করিয়া দেবগণকে অংশক্রমে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হইতে আদেশ দিলেন। হে রাজন্! তদনন্তর দেবগণ অসুরবিনাশ দ্বারা প্রজাগণের হিতসাধন করিবার মানসে স্বর্গ হইতে অবতীর্ণ হইয়া স্বেচ্ছাক্রমে কেহ ব্রহ্মর্ষিবংশে, কেহ বা রাজর্ষিবংশে জন্মগ্রহণ করিলেন। তাঁহারা বাল্যকালেই এরূপ বলিষ্ঠ হইয়া উঠিলেন যে, দানব, গন্ধর্ব্ব, পন্নগ, রাক্ষস ও নরমাংসলোলুপ অন্যান্য জন্তুগণকে অবলীলাক্রমে বধ করিতে লাগিলেন।

জনমেজয় কহিলেন, "হে মুনিসত্তম! আমি দেব, দানব, গন্ধর্ব্ব, অপ্সরা, মানব ও যক্ষ-রাক্ষস প্রভৃতি অন্যান্য জীবগণের জন্মবৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত শুনিতে বাসনা করি. অনুগ্রহ করিয়া সবিস্তর বর্ণন করুন।

দেবাসুর-বংশবর্ণন

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! আমি ভগবান্ স্বয়ম্ভূকে [ব্রহ্মা] নমস্কার করিয়া সুরাসুর প্রভৃতির জন্মমরণ-বৃত্তান্ত সবিশেষরূপে বর্ণন করিতেছি, শ্রবণ করুন। সর্ব্বলোক-পিতামহ ব্রহ্মার মরীচি. অত্রি, অঙ্গিরা, পৌলস্ত্য, পুলহ ও ক্রতু নামে ছয় মানস-পুৎত্র জন্মেন। মরীচির পুৎত্র কশ্যপ; কশ্যপ হইতেই এই সমস্ত প্রজার সৃষ্টি হইয়াছে। হে মনুজশ্রেষ্ঠ! অদিতি, দিতি, দনু, কালা, দনায়ু, সিংহিকা, ক্রোধা, প্রধা, বিশ্বা, বিনতা, কপিলা, মুনি ও কদ্রু এই এয়োদশ দক্ষকন্যা কশ্যপের ভার্য্যা ছিলেন। ইঁহাদের গর্ভে কশ্যপের মহাবলপরাক্রান্ত অসংখ্য সন্তান সমুৎপন্ন হয়। হে রাজন! অদিতির গর্ভে যথাক্রমে ধাতা, মিত্র, অর্য্যমা, শক্র, বরুণ, অংশ, ভগ, বিবস্বান্, পূষা, সবিতা, ত্বষ্টা ও বিষ্ণু নামে দ্বাদশ আদিত্য জন্মেন। আদিত্যগণের সর্ব্বকনিষ্ট বিষ্ণু সর্ব্বাপেক্ষা গুণজ্যেষ্ঠ। দিতির গর্ভে একমাত্র পুৎত্র জন্মে। তাহার নাম হিরণ্যকশিপু। হিরণ্যকশিপুর পঞ্চ পুৎত্র;প্রহ্লাদ, সংহ্লাদ, অনুহ্লাদ, শিবি ও বাষ্কল; ইঁহারা সকলেই সুবিখ্যাত ছিলেন। প্রহ্লাদের তিন পুৎত্র;বিরোচন, কুম্ভ ও নিকুম্ভ। বিরোচনের পুৎত্র বলি, ইনি ভুবনবিশ্রুত ছিলেন। বলির পুৎত্র মহাবলপরাক্রান্ত বাণ। ইনি বহুকালাবধি ভূতনাথ ভবানীপতির আরাধনা করিয়া মহাকাল নামে বিখ্যাত হন। প্রথম, রাজা, বিপ্রচিত্তি; মহাযশা:, শম্বর, নমুচি, পুলোমা, বিশ্রুত, অসিলোমা, কেশী, দুর্জ্জয়, দানবন, অয়ঃশিরাঃ, অশ্বশিরাঃ, অশ্বশঙ্কু, বীর্য্যবান্, গগনমূর্দ্ধা, বেগবান্, কেতুমান, স্বর্ভানু, অশ্ব, অশ্বপতি, বৃষপর্ব্বা, জ্জক, অশ্বগ্রীব, সূক্ষ্ণ, তুহুণ্ড, মহাবল, একপাদ, একচক্র, বিরূপাক্ষ, মহোদর, নিচন্দ্র, নিকুম্ভ, কুপট, কপট, শরভ, শলভ, সূর্য্য, চন্দ্রমাঃ, এই চত্বারিংশৎ পুৎত্র দনুর গর্ভে জন্মে। একাক্ষ, অমৃতপ, প্রলম্ব, নরক, বাতাপি, শত্রুতাপন, শঠ, গরিষ্ঠ, চ্যবনায়ু, দীর্ঘজিহ্ব এই দশ দানবের পুৎত্র পৌৎত্রাদি অসংখ্য। চন্দ্রার্কবিদ্বেষী রাহু, সুচন্দ্র, চন্দ্রহন্তা ও চন্দ্রমর্দ্দন, এই কয়েকটি পুৎত্র সিংহিকার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। সিংহিকা ক্রুরস্বভাবা ছিলেন, এই নিমিত্ত তাঁহার পুৎত্র-পৌৎত্রগণ ক্রোধপরবশ, ক্রুরকর্ম্মা ও অরিমর্দ্দন বলিয়া লোকে বিখ্যাত। দনায়ুর চারি পুৎত্র;বিক্ষর, বল, বীর, ও বৃত্র। বিনাশন, ক্রোধ, ক্রোধহন্তা, শত্রু প্রভৃতি শমনসদৃশ প্রহর্ত্তা দানবেরা কালার পুৎত্র। ইঁহারা সকলেই মহাবলপরাক্রান্ত ও অরিমর্দ্দন ছিলেন। ঋষিপুৎত্র শুক্র অসুরগণের উপাধ্যায় ছিলেন।

অসুরগুরু শুক্রের বংশ

শুক্রের চারি পুৎত্র; ত্বষ্টাধর, অত্রি এবং অপর দুইজন। ইঁহারা চারি জনেই সূর্য্যসম তেজস্বী ও ব্রহ্মলোকপরায়ণ ছিলেন। ইঁহারাই অসুরগণের যাজনক্রিয়া সমাধা করিতেন। হে রাজন! পুরাণে যেরূপ শ্রুত আছে, তদনুসারে দেবাসুরগণের বংশ কীর্ত্তন করিলাম। কিন্তু যে যে দেবতা বা দানবের নামোল্লেখ করিলাম, তাঁহাদের পুৎত্র-পৌৎত্রাদি অসংখ্য। অশেষরূপে তাঁহাদিগের নাম নির্দ্দেশ করা অতিশয় দুঃসাধ্য।

তির্য্যক্‌প্রাণী প্রভৃতির জন্মক্রম

তার্ক্ষ্য, রিষ্টনেমি, গরুড়, অরুণ, আরুণি ও বারুণি, ইঁহারা বিনতার পুৎত্র। শেষ, অনন্ত, বাসুকি, তক্ষক, কূর্ম্ম ও কুলিক, ইঁহারা কদ্রুর পুৎত্র। ভীমসেন, সুপর্ণ, বরুণ, গোপতি, ধৃতরাষ্ট্র, সূর্য্যবর্চ্চাঃ, সত্যবাক্, অর্ক, পর্ণ, প্রযুত, ভীম, চিত্ররথ, শালিশিরাঃ, পর্জ্জন্য, কলি, নারদ এই ষোড়শ পুৎত্র মুনির গর্ভে জন্মেন। ইঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ দেবতা, কেহ কেহ গন্ধর্ব্ব। প্রধার গর্ভে অনবদ্যা, মনু, বংশা, অসুরা, মার্গণপ্রিয়া, অনূপা, সুভগা ও ভাসী এই কয়েকটি কন্যা এবং সিদ্ধ, পূর্ণ, বহী, পূর্ণায়ু, ব্রহ্মচারী, রতিগুণ, সুপর্ণ, বিশ্বাবসু, ভানু ও প্রচন্দ্র এই দশপুৎত্র জন্মগ্রহণ করেন। পুরাণে কথিত আছে, মহাভাগা প্রধাদেবী দেবর্ষির ঔরসে পরম-পবিত্র সুবিখ্যাত অপ্সরোবংশে সমুৎপন্ন হয়েন। অলম্বুষা, মিশ্রকেশী, বিদ্যুৎপর্ণা, তিলোত্তমা, অরুণা, রক্ষিতা, রম্ভা, মনোরমা, কেশিনী, সুবাহু, সুরতা, সুরজা ও সুপ্রিয়া এই কয়েকটি কন্যা এবং অতিবাহু, হাহা, হূহূ, তুম্বুরু প্রভৃতি গন্ধর্ব্বগণ ও ব্রাহ্মণ, অমৃত, গো গন্ধর্ব্ব প্রভৃতি নানাবিধ অপত্য কপিলা হইতে সমুৎপন্ন হয়। হে রাজন্‍! আমি তোমার নিকট গন্ধর্ব্ব অপ্সরা, ভুজঙ্গ, সুপর্ণ, রুদ্র, মরুৎ এবং গোব্রাহ্মণ প্রভৃতি সমস্ত জীবগণের জন্মবৃত্তান্ত বর্ণন করিলাম। যে ব্যক্তি অসূয়াশূন্য হৃদয়ে এই শ্রবণানন্দদায়ক সর্ব্বপ্রাণীগণের জন্মবৃত্তান্ত শ্রবণ করে ও অন্যকে শুনায়, তাহার আয়ুঃ, পুণ্য ও যশঃ বৃদ্ধি হয়। আর যে ব্যক্তি ব্রাহ্মণগণ-সন্নিধানে নিয়মপূর্ব্বক ইহা পাঠ করে, তাহার ইহকালে ধন ও যশঃ এবং পরকালে সদ্‌গতি লাভ হয়।


যট্‌ষষ্টিতম অধ্যায়
রুদ্রাদি সৃষ্টিবিস্তার

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! পূর্ব্বে আপনাকে কহিয়াছি যে, মরীচি প্রভৃতি অতিবীর্য্যবান্ ছয়জন ব্রহ্মর্ষি ব্রহ্মার মানস-পুৎত্র। মৃগব্যাধ, সর্প, নির্ঋতি, অজৈকপাদ্, অহি, বুধ্ন্য, পিনাকী, দহন, কপালী, স্থাণু ও ভর্গ স্থাণুর এই একাদশ পুৎত্র; ইঁহাদিগকেই একাদশ রুদ্র কহে। অঙ্গিরার তিন পুৎত্র; বৃহস্পতি, উতথ্য ও সংবর্ত্ত; ইঁহারা সর্ব্বলোকবিখ্যাত। হে নরনাথ! শ্রুত আছে, অত্রির অনেক পুৎত্র; তাঁহারা সকলেই বেদজ্ঞ, সিদ্ধ ও শমগুণাবলম্বী মহর্ষি। হে নরশ্রেষ্ঠ! রাক্ষস, বানর, কিন্নর ও যক্ষগণ ধীমান্ পুলস্ত্যের পুৎত্র। শলভ, সিংহ, কিংপুরুষ, ব্যাঘ্র ও ঈহামৃগগণ পুলহ হইতে সমুৎপন্ন হয়। ক্রতুর পুৎত্রগণ স্বীয় পিতার সদৃশ প্রতাপশালী, সূর্য্যসহচারী, ত্রিভুবনবিশ্রুত ও সত্যনিষ্ঠ ছিলেন। হে ধরানাথ! শান্তিগুণাবলম্বী, তপঃপরায়ণ, ভগবান্ দক্ষ-ঋষি ব্রহ্মার দক্ষিণ অঙ্গুষ্ঠ হইতে ও তাঁহার পত্নী প্রজাপতির বামাঙ্গুষ্ঠ হইতে উৎপন্ন হয়েন। মহর্ষি দক্ষ ঐ ভার্য্যার গর্ভে পঞ্চাশৎ কন্যা উৎপাদন করেন। মহর্ষির পুৎত্র জন্মে নাই, এই নিমিত্ত তিনি ঐ সকল সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী কন্যাগণকে পুৎত্রিকা করিয়াছিলেন। হে রাজন! মহর্ষি দক্ষ ঐ পঞ্চাশটি কন্যার মধ্যে ধর্ম্মকে দশটি, কশ্যপকে ত্রয়োদশটি ও চন্দ্রকে সাতাইশটি বেদ-বিধানানুসারে সম্প্রদান করেন। ধর্ম্ম, চন্দ্র ও কশ্যপের ধর্ম্মপত্নীদিগের নাম কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। কীর্ত্তি, লক্ষ্মী, ধৃতি, মেধা, পুষ্টি, শ্রদ্ধা, ক্রিয়া, বুদ্ধি, লজ্জা ও মতি এই দশটি ধর্ম্মের পত্নী। লোকবিশ্রুতা সময়বোধিকা নক্ষত্ররূপিণী অশ্বিনী, ভরণী প্রভৃতি সাতাইশটি চন্দ্রের ভার্য্যা। সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মার পুৎত্র মনু। মনুর পুৎত্র প্রজাপতি। ধর, ধ্রুব, সোম, অহঃ, অনিল, অনল, প্রত্যুষ ও প্রভাস এই অষ্টবসু প্রজাপতি হইতে সমুৎপন্ন হয়েন। ইঁহাদিগের মধ্যে ধর ও ব্রহ্মবিৎ ধ্রুব ধূম্রার গর্ভে জন্মেন; সোম মনস্বিনীর গর্ভে, অহঃ রতার গর্ভে অনিল শ্বাসার গর্ভে অনল শাণ্ডিল্যার গর্ভে এবং প্রত্যূষ ও প্রভাস প্রভাতার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। ধরের দুই পুৎত্র;দ্রবিণ ও হুতহব্যবহ। সংহারকর্ত্তা ভগবান্ কাল ধ্রুবের পুৎত্র। সোমের পুৎত্র বর্চ্চাঃ, যদ্দ্বারা লোক বর্চ্চস্বী হয়। শিশির, প্রাণ ও রমণ ইঁহারা মনোহরার পুৎত্র। জ্যোতিঃ, শম, শান্ত ও মুনি ইঁহারা অহের ঔরসে জন্মেন। শরবনবাসী শ্রীমান্ কুমার অগ্নির পুৎত্র। শাখ, বিশাখ ও নৈগমেয় এই তিনজন কার্ত্তিকেয়ের অনুজ। কুমার কৃত্তিকা কর্ত্তৃক পালিত হইয়াছিলেন বলিয়া কার্ত্তিকেয় নামে বিখ্যাত হইয়াছেন। অনিলের ভার্য্যা শিবা, তাঁহার গর্ভে মনোজব ও অবিজ্ঞাতগতি নামে অনিলের দুই পুৎত্র জন্মে। দেবল ঋষি প্রত্যুষের পুৎত্র। দেবলের দুই পুৎত্র, তাঁহারা সাতিশয় ক্ষমাবান্ ও বিদ্বান ছিলেন। বৃহস্পতির ভগিনী ব্রহ্মবাদিনী যোগাসক্তা বরস্ত্রী সমস্ত পৃথিবী পরিভ্রমণ করেন। ইঁহার গর্ভে অষ্টম বসু প্রভাসের ঔরসে শিল্পপ্রজাপতি দেবসূত্রধর বিশ্বকর্ম্মা জন্মগ্রহণ করেন। ইনি সর্ব্বশিল্পকরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। দেবতাদিগের সমুদয় অলঙ্কার ও বিমানাদি বিশ্বকর্ম্মা নির্ম্মাণ করেন। ইঁহার শিল্পকার্য্য উপজীব্য করিয়া মনুষ্যেরা জীবিকা নির্ব্বাহ করে এবং শিল্পোপজীবী লোকেরা সেই অক্ষয় বিশ্বকর্ম্মাকে পূজা করিয়া থাকে।

সর্ব্বলোক-সুখাবহ ভগবান্ ও ধর্ম্ম নরকলেবর ধারণপুরঃসর ব্রহ্মার দক্ষিণস্তন ভেদ করিয়া বিনির্গত হয়েন। ধর্ম্মের তিন পুৎত্র;শম, কাম ও হর্ষ। শমের পত্নী প্রাপ্তি, কামের স্ত্রী রতি ও হর্ষের ভার্য্যা নন্দা; ইঁহাদিগকে অবলম্বন করিয়া লোকযাত্রা নির্ব্বাহ হইতেছে। ঘোটকী-রূপধারিণী ত্বাষ্ট্রী সবিতার স্ত্রী। ইনি অন্তরীক্ষে অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে প্রসব করেন। হে রাজন্! মরীচির পুৎত্র কশ্যপ হইতে সুরাসুরগণ জন্মেন। অতএব ভগবান্ কশ্যপ হইতেই সমস্ত লোকের উৎপত্তি হইয়াছে বলিতে হইবে।

অদিতির গর্ভে ইন্দ্রাদি দ্বাদশ পুৎত্র জন্মেন; সর্ব্বজগৎ পালনকর্ত্তা ভগবান্ বিষ্ণু তাঁহাদিগের সর্ব্বকনিষ্ঠ। রুদ্র, সাধ্য, মরুৎ, বসু, ভার্গব ও বিশ্বদেব এই নবতি দেবতার নাম কার্ত্তীত হইল। এক্ষণে ইঁহাদের বংশাবলী পক্ষ ও গণ কীর্ত্তন করিতেছি। বিনতানন্দন গরুড় ও বলবান্ অরুণ এবং বৃহস্পতি ইঁহারা আদিত্যমধ্যে পরিগণিত। অশ্বিনীকুমারদ্বয়, গুহ্যকগণ, যাবতীয় ওষধি ও সমস্ত পশুগণ দেবতামধ্যে পরিগণিত। লোকে আনুপূর্ব্বিক ইঁহাদের নাম কীর্ত্তন করিলে সর্ব্বপাপ হইতে বিমুক্ত হয়। ভগবান্ ভৃগু ব্রহ্মার হৃদয়দেশ ভেদ করিয়া বিনির্গত হয়েন। ভৃগুর পুৎত্র শুক্র, ইনি পরম প্রাজ্ঞ ও কবিশ্রেষ্ঠ। যিনি ত্রৈলোক্যের প্রাণযাত্রার্থে বর্ষাবর্ষ [বর্ষলক্ষণ
অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি] ও ভয়াভয় বিষয়ে ভগবান্ স্বয়ম্ভূ কর্ত্তৃক নিযুক্ত হইয়া ত্রিভুবন ভ্রমণ করিতেছেন, সেই অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন যোগাচার্য্য শুক্রাচার্য্য দৈত্যগণের গুরু। তিনি যোগক্ষেম [সাংসারিক মঙ্গল সংসারযাত্রানির্ব্বাহ] সম্পাদনার্থে বিধাতা কর্ত্তৃক নিযুক্ত হইলে ভগবান্ ভৃগু চ্যবন্ নামে আর এক পুৎত্র উৎপাদন করেন। তিনি স্বীয় জননীর দুঃখ মোচনের নিমিত্ত ক্রোধভরে গর্ভ হইতে বহির্গত হয়েন। মনুর কন্যা আরুষী বিচক্ষণ চ্যবনের ভার্য্যা। আরুষীর উরুদেশ ভেদ করিয়া ঔর্ব্ব নামে এক পুৎত্র নির্গত হয়েন। ইনি বাল্যকালেই সাতিশয় তেজঃশালী, মহাবলপরাক্রান্ত ও নানা গুণযুক্ত হইয়াছিলেন। ঔর্ব্বেরপুৎত্র ঋচীকের পুৎত্র জমদগ্নি। মহাত্মা জমদগ্নির চারি পুল। রাম [পরশুরাম] তাঁহাদের সর্ব্বকনিষ্ঠ; কিন্তু সর্ব্বাপেক্ষা গুণজ্যেষ্ঠ সর্ব্বশাস্ত্রবিশারদ ও ক্ষৎত্রিয়কুলান্তক। ঔর্ব্বপুৎত্র ঋচীকের জমদগ্নি প্রভৃতি একশত পুৎত্র। সেই শত পুৎত্রের সহস্র সহস্র পুৎত্রগণ পৃথিবীতে ব্যাপ্ত হইয়াছেন এবং তাঁহার ধাতা ও বিধাতা নামে অপর দুই পুৎত্র আছেন; পদ্মালয়া লক্ষ্মী তাঁহাদের ভগিনী। আকাশগামী তুরঙ্গমগণ লক্ষ্মীর মানস-পুৎত্র। বরুণের জ্যেষ্ঠা ভার্য্যা শুক্রাদেবী, তাঁহার গর্ভে বল নামে পুৎত্র ও সুরানাম্নী কন্যা জন্মে। অন্নার্থী প্রজাগণের পরস্পর ভক্ষণ হইতে সর্ব্বভূত নাশনকারী অধর্ম্মের জন্ম হয়। অধর্ম্মের ভার্য্যা নির্ঋতি; নির্ঋতির গর্ভে রাক্ষসগণের জন্ম হয়, এই নিমিত্ত উহারা নৈর্ঋত নামে বিখ্যাত। অধর্ম্মের নিরন্তর পাপকারী তিন পুৎত্র;ভয়,মহাভয় ও ভূতান্তক মৃত্যু। মৃত্যুর পুৎত্র-কলত্র কিছুই নাই। তাম্রা দেবী সর্ব্বলোকবিশ্রুতা কাকী, শ্যেনী, ভাসী, ধৃতরাষ্ট্রী ও শুকী এই পাঁচটি কন্যা প্রসব করেন। তন্মধ্যে কাকীর গর্ভে কাক, শ্যেনীর গর্ভে শ্যেন, ভাসীর গর্ভে ভাস ও গৃধ্র, লোকবিখ্যাত ধৃতরাষ্ট্রীর গর্ভে হংস, কলহংস ও চক্রবাক্ এবং যশস্বিনী শুকীর গর্ভে শুক জন্মে। কল্যাণগুণযুক্তা সর্ব্বলক্ষণসম্পন্না মৃগী, মৃগমন্দা, হরী, ভদ্রমনা, মাতঙ্গী, শার্দ্দূলী, শ্বেতা, সুরভি ও সর্ব্বলক্ষণোপেতা সুরমা এই নয় কন্যা ক্রোধ হইতে জন্মে। হে নরোত্তম! মৃগসমুদয় মৃগীর পুৎত্র। ভল্লুক ও ক্ষুদ্রজাতীয় হরিণ মৃগমন্দার পুৎত্র। ভদ্রমনা হইতে মহাগজ দেবনাগ ঐরাবত সমুৎপন্ন হয়েন। বলশালী বানরগণ হরীর গর্ভে জন্মে। গোলাঙ্গুল নামে যে বানরবিশেষ, তাহারাও হরী হইতে সমুৎপন্ন। মহাতত্ত্ব সিংহ, ব্যাঘ্র ও দ্বীপিগণ শার্দ্দূলীগর্ভসম্ভূত। মাতঙ্গগণ মাতঙ্গীর গর্ভে ও শ্বেতাখ্য দ্রুতগতি দিগ্‌গজ শ্বেতা হইতে জন্মে! হে মহারাজ! সুশীলা, রোহিণী ও যশস্বিনী গন্ধর্ব্বী সুরভীর কন্যা। বিমলা, অমলা এবং গো-সমুদয় রোহিণী হইতে জন্মে। অশ্বগণ গন্ধর্ব্বীর পুৎত্র। অমহা হইতে পিণ্ডফল, সপ্তরক্ষ ও শুকীনাম্নী কন্যা সমুৎপন্ন হয়। সুরসা হইতে কঙ্ক পক্ষীর উৎপত্তি। অরুণের ভার্য্যা শ্যেনীর গর্ভে সম্পাতি ও জটায়ু নামে দুই মহাবলপরাক্রান্ত পুৎত্র জন্মে। হে ধীমন্! সমস্ত মহৎপ্রাণিগণের জন্মবৃত্তান্ত বিশেষরূপে কীর্ত্তন করিলাম। ইহা শ্রবণ করিলে লোক পাপপুঞ্জ হইতে নির্ম্মুক্ত হয়, সর্ব্বজ্ঞত্ব লাভ করে ও চরমে পরমপদ প্রাপ্ত হয়।