মহাভারত
আদিপর্ব


ভাষাংশ>মহাভারত >আদিপর্ব>একোনঅশীতিতম- অশীতিতম অধ্যায়


একোনঅশীতিতম অধ্যায়
বৃষপর্ব্বার প্রতি শুক্রের ক্রোধ

শুক্র কহিলেন, "হে দেবযানী! যে ব্যক্তি ক্ষমাগুণে পরের তিরস্কারবাক্যে উপেক্ষা প্রদর্শন করেন, এই সচরাচর বিশ্ব তাঁহারই আয়ত্ত। সাধুলোকেরা অশ্বরশ্মি [বল্গাধারী] গ্রাহীকে সারথি না বলিয়া যিনি উত্তেজিত ক্রোধকে অশ্বের ন্যায় নিগ্রহ করিতে পারেন, তাঁহাকে যথার্থ সারথি বলিয়া থাকেন। যিনি উদ্রিক্ত ক্রোধানলে ক্ষমাবারি সেচন করিতে পারেন, এই স্থাবরজঙ্গমাত্মক জগৎ তাঁহারই জয় করা হয়। যেমন সর্প নির্ম্মোক [খোলস] পরিত্যাগ করে, তদ্রুপ যিনি ক্রোধ পরিত্যাগ করিতে পারেন, পণ্ডিতেরা তাঁহাকেই সৎপুরুষ কহেন। যিনি ক্রোধবেগ সংবরণ পূর্ব্বক তিরস্কারে উপেক্ষা প্রদর্শন করেন এবং সন্তপ্ত হইয়াও অন্যকে তাপিত করেন না, তাঁহারই সর্ব্বার্থসিদ্ধ হইয়া থাকে। যে-ব্যক্তি শত বৎসর ব্যাপিয়া প্রতিমা-সেবা বা যজ্ঞানুষ্ঠান করেন, আর যিনি কাহারও উপর কখনও ক্রুদ্ধ হয়েন না, এই উভয়ের মধ্যে অক্রোধন ব্যক্তিই অপেক্ষাকৃত উৎকৃষ্ট। বালক-বালিকারা বিবেকাভাবপ্রযুক্ত ক্রোধান্ধ হইয়া পরস্পর বিরোধ করিয়া থাকে; কিন্তু প্রাজ্ঞব্যক্তি সেরূপ করেন না।" দেবযানী কহিলেন, "তাত! আমি অল্পবয়স্কা বালিকা বটে, কিন্তু ধর্ম্মের মর্ম্ম বিবেচনা করিতে নিতান্ত অসমর্থ নহি এবং ক্রোধ ও ক্ষমা এই উভয়ের বলাবল-পরিজ্ঞানেও অক্ষম নহি। কিন্তু যে-ব্যক্তি শিষ্য হইয়া অশিষ্যের ন্যায় আচরণ করে, মঙ্গলার্থী ব্যক্তি তাহাকে কিছুতেই ক্ষমাপ্রদর্শন করিবে না। অতএব এই ভ্রষ্টাচার দেশে বাস করিতে আমার অভিলাষ নাই। যে-সকল পরনিন্দা করে, মঙ্গলার্থী ব্যক্তি সেই সকল পাপিষ্ঠ লোকের সংসর্গ করিবেন না; আর যেস্থানে বাস করিলে আচার ব্যবহার ও কৌলীন্যাদির গৌরব থাকে, সেই স্থানে বাস করাই শ্রেয়ঃকল্প। হে তাত! বৃষপর্ব্বতনয়া শর্ম্মিষ্ঠার সেই সকল দুর্ব্বাক্য আমার হৃদয় দগ্ধ করিতেছে। অধিক কি বলিব, যে হতভাগ্য ব্যক্তি যৎকিঞ্চিৎ লাভপ্রত্যাশায় ধনিগণের উপাসনা করে, বোধ হয়, তদপেক্ষা তাহার মৃত্যু হওয়া উত্তম।"


অশীতিতম অধ্যায়
শুক্রের বৃষপর্ব্বার সম্বন্ধত্যাগ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, অনন্তর শুক্র ক্রোধভরে সিংহাসনোপবিষ্ট রাজা বৃষপর্ব্বার নিকট উপস্থিত হইয়া অসঙ্কুচিত-চিত্তে কহিলেন, "হে দানবরাজ! অধর্ম্ম আচরণ করিলে সদ্যই তাহার ফল দর্শে না বটে, কিন্তু পরিণামে সেই পাপপরায়ণ ব্যক্তিকে সমূলে উচ্ছেদ করিয়া থাকে। যদিও অনুষ্ঠানকর্ত্তার তাহার ফলভোগ হয় না, তত্রাপি তাহার পুৎত্র বা পৌৎত্রদিগকেও তাহার ফলভোগ করিতে হয়। বৃহস্পতি-তনয় কচ বিদ্যালাভ করিবার নিমিত্ত আমার নিকট আসিয়াছিল। সে ধর্ম্মপরায়ণ, সুশীল ও শুশ্রূষাপরশ [শাস্ত্রীয় তত্ত্ব শ্রবণে ইচ্ছুক]। তুমি অন্য দ্বারা নিরপরাধে বারংবার তাহার প্রাণহিংসা করিয়াছিলে। আজি আবার তোমার কন্যা শর্ম্মিষ্ঠা আমার দেবযানীর প্রাণ নষ্ট করিবার আশয়ে তাহাকে এক গভীর কূপে নিক্ষেপ করিয়াছিল। এই সকল অত্যাচারে আমি অদ্যই তোমাদিগকে পরিত্যাগ করিলাম। আমি আর তোমার অধিকারে বাস করিব না। তোমরা আমার কথা প্রলাপ বলিয়া বিবেচনা কর, নতুবা আপন দোষ সংশোধনে প্রতীক্ষা [উপেক্ষা-বিলম্ব] করিতে না।" বৃষপর্ব্বা কহিলেন, "হে ভার্গব! আমি আপনাকে অধার্ম্মিক বা মিথ্যাবাদী বলিয়া বোধ করি না, প্রত্যুত পরমধার্ম্মিক ও সত্যপরায়ণ বলিয়া জ্ঞান করিয়া থাকি। আপনার প্রতি আমি কখনই ঘৃণা বা অশ্রদ্ধা করি না, অতএব ক্রোধ সংবরণ করুন এবং আমার প্রতি প্রসন্ন হউন। যদি আপনি আমাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া অন্যত্র গমন করেন, তাহা হইলে আমরা সমুদ্রগর্ভে প্রবেশ করিব, সংশয় নাই।" শুক্র কহিলেন, "তোমরা সাগরেই প্রবেশ কর বা দেশান্তরেই যাও, তোমার কন্যা আমার দেবযানীকে যেরূপ অপমান করিয়াছে, তাহা আমি কখনই সহ্য করিব না। আমি দেবযানীকে অতিশয় স্নেহ করিয়া থাকি; যেমন বৃহস্পতি ইন্দ্রের যোগক্ষেমকর [সুমন্ত্রাদানে সংসারযাত্রা নির্ব্বাহের সাহায্যকারী], আমিও সেইরূপ তোমার যোগক্ষেম সম্পাদন করিয়া থাকি। অতএব যদি আমাকে রাজ্যে রাখিতে বাসনা থাকে, তবে দেবযানীকে প্রসন্ন কর। দেবযানী আমার জীবনস্বরূপ।" বৃষপর্ব্বা কহিলেন, ভগবন্! অসুরেরা যে কিছু ধনসম্পত্তি বা গো হস্তী, অশ্ব প্রভৃতি অধিকার করে, আপনি তৎসমুদয়ের ও আমার অধীশ্বর, অতএব আপনি প্রসন্ন হউন।" শুক্র কহিলেন, "যদি আমি দানবদিগের সমুদয় সম্পত্তির ও ঈশ্বর হই, তাহা হইলেও তুমি দেবযানীকে প্রসন্না কর।" দানবরাজ বৃষপর্ব্বা তৎক্ষণাৎ তাঁহার বাক্যে সম্মতি প্রদান করিলেন।
    পরে ভৃগুনন্দন শুক্র দেবযানীর নিকট গমন করিয়া এই কথা আদ্যোপান্ত অবগত করাইলেন। তখন দেবযানী কহিলেন, "হে পিতাঃ! তুমি যে অসুরদিগের সকল সম্পত্তির ঈশ্বর, তাহা বৃষপর্ব্বা স্বয়ং আমার নিকট অঙ্গীকার করুক, নতুবা আমার বিশ্বাস হয় না।" তাহা শুনিয়া দানবরাজ বৃষপর্ব্বা কহিলেন, "হে চারুহাসিনী দেবযানী! তোমার যাহা অভিলাষ হয় বল, অতিশয় দুর্লভ বস্তু হইলেও আমি তোমাকে প্রদান করিব।" তখন দেবযানী কহিলেন, "শর্ম্মিষ্ঠা সহস্র অসুর কন্যার সহিত আমার দাসীভাব অবলম্বন করুক, এই আমার অভিলাষ এবং আমি বিবাহিতা হইয়া যৎকালে ভর্ত্তৃগৃহে গমন করিব, তখনও তাহাকে আমার অনুসরণ করিতে হইবে।" তাহা শুনিয়া বৃষপর্ব্বা সমীপবর্ত্তিনী এক পরিচারিকাকে আদেশ করিলেন, "তুমি যাও এবং শীঘ্র শর্ম্মিষ্ঠাকে আমার নিকট আনয়ন কর। দেবযানীর যেরূপ অভিলাষ, শর্ম্মিষ্ঠা আসিয়া তাহা অবিলম্বে সম্পাদন করুক।" পরিচারিকা রাজার আদেশক্রমে শর্ম্মিষ্ঠার নিকট উপনীত হইয়া নিবেদন করিল, "রাজনন্দিনী! মহারাজ তোমাকে আহ্বান করিতেছেন, এক্ষণে চল এবং জ্ঞাতি কুলের শুভসম্পাদন কর। শুক্রাচার্য্য দেবযানী কর্ত্তৃক উত্তেজিত হইয়া অসুরকুল পরিত্যাগের উপক্রম করিয়াছেন, এক্ষণে দেবযানীকে প্রসন্ন করিবার নিমিত্ত তোমাকে তাঁহার নির্দ্দেশানুসারে সমস্ত কর্ম্ম সম্পাদন করিতে হইবে।"

শর্ম্মিষ্ঠার দেবযানী-দাসীত্ব

পিতার আদেশ শুনিয়া শর্ম্মিষ্ঠা কহিলেন, "তিনি যখন যাহা আদেশ করিবেন, আমি বিচার না করিয়া তৎক্ষণাৎ তাহা সম্পাদন করিব, আর দেবযানীকে সান্ত্বনা করিবার নিমিত্ত মহর্ষি শুক্রও যাহা আদেশ করিবেন, তাহাতেও আমার অসম্মতি নাই। আমার দোষে শুক্রও দেবযানী নগর পরিত্যাগ করিবেন, তাহা কখনই হইবে না।" এই বলিয়া শর্ম্মিষ্ঠা শিবিকায় আরোহণ পূর্ব্বক সহস্র দাসীপরিবৃতা হইয়া সত্বর অন্তঃপুর হইতে নির্গত হইলেন এবং দেবযানী সন্নিধানে উপনীত হইয়া কহিলেন, “হে গুরুকন্যে! আমি সহস্র অসুর কন্যার সহিত তোমার দাস্যকর্ম্ম করিব এবং তুমি পরিণীতা হইয়া যখন পতিগৃহে গমন করিবে, তৎকালেও আমি দাসীভাবে তোমার সমভিব্যাহারে যাইব।" দেবযানী কহিলেন, "দেখিও, তুমি রাজনন্দিনী হইয়া কিরূপে চাটুকার ও ভিক্ষুকের ন্যায় দাসীভাব অবলম্বন করিবে।" শর্ম্মিষ্ঠা কহিলেন, "জ্ঞাতিকুলের বিপদ ঘটিলে যে-কোন উপায় দ্বারা হউক, তাহার প্রতীকার-চেষ্টা করা কর্ত্তব্য, এজন্য আমি তোমার দাসীবৃত্তি স্বীকার করিলাম।" এইরূপে শর্ম্মিষ্ঠা দাসীভাব অঙ্গীকার করিলে দেবযানী নিজ পিতা শুক্রকে কহিলেন, "হে তাত! আমি ক্রোধ সংবরণ করিয়াছি, চল, এক্ষণে নগরে প্রবেশ করি। জানিলাম, তোমার বিজ্ঞান ও বিদ্যাবল অমোঘ।" মহাযশাঃ শুক্র কন্যা কর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত এবং দানবরাজ কর্ত্তৃক সমাদৃত ও সৎকৃত হইয়া হৃষ্টচিত্তে পুনর্ব্বার দেবযানীর সহিত পুরে প্রবেশ করিলেন।