মহাভারত
আদিপর্ব
অষ্টম-দশম অধ্যায়
ভাষাংশ>মহাভারত >আদিপর্ব>অষ্টম-দশম অধ্যায়
অষ্টম অধ্যায়
রুরু-চরিত
সূত কহিলেন, হে ব্রহ্মন্! ভৃগুনন্দন চ্যবন সুকন্যার গর্ভে পরমতেজস্বী প্রমতি নামে
এক পুৎত্র উৎপাদন করেন। ঘৃতাচীর গর্ভে প্রমতির রুরু-নামক এক সন্তান হয়। রুরুর ঔরসে
প্রমদ্বরার গর্ভে শুনক নামে তনয় জন্মে। সেই মহাতেজা রুরুর সমস্ত বৃত্তান্ত সবিস্তর বর্ণনা করিতেছি,
শ্রবণ করুন।
পূর্ব্বকালে সর্ব্বভূতহিতৈষী, সর্ব্ববিদ্যাবিশারদ, তপোনিরত স্থূলকেশ নামে এক মহর্ষি
ছিলেন। ঐ সময়ে গন্ধর্ব্বরাজ বিশ্বাবসুর সংযোগে অপ্সরা মেনকা গর্ভবতী হইয়াছিল।
অকরুণা মেনকা প্রসবকাল উপস্থিত দেখিয়া মহর্ষি স্থূলকেশের আশ্রমে গমন এবং তথায়
গর্ভবিমোচন করিয়া নদীতীরে পলায়ন করিল। সেই গর্ভে এক পরমা সুন্দরী কুমারী
জন্মিয়াছিল। তপোধনাগ্রণী স্থূলকেশ কিয়ৎক্ষণ পরে আশ্রমে উপস্থিত হইয়া সেই
সুরকন্যাতুল্য সদ্যঃপ্রসূত কন্যাকে অসহায়া নির্জ্জনে পতিতা দেখিয়া কারুণ্যরসে
আর্দ্রচিত্ত হইলেন এবং তৎক্ষণাৎ তাহাকে গ্রহণ করিয়া ঔরসকন্যা-নির্ব্বিশেষে লালন
পালন করিতে লাগিলেন। তিনি স্বয়ং তাহার জাতকর্ম্মাদি সমস্ত কর্ম্ম বিধিপূর্ব্বক
নির্ব্বাহ করিলেন। কন্যা সেই আশ্রমে শশিকলার ন্যায় দিনে দিনে পরিবর্দ্ধিত হইতে
লাগিল। মহর্ষি স্থূলকেশ সেই কন্যাকে কি রূপে, কি গুণে, কি শীলে সর্ব্বপ্রকারেই
সমস্ত প্রমদাগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দেখিয়া তাহার নাম প্রমদ্বরা রাখিলেন।
একদা
প্রমতিনন্দন রুরু স্থূলকেশের আশ্রমে সেই প্রমদ্বরাকে নিরীক্ষণ করিয়া অত্যন্ত
কামাতুর হইলেন। পরে আপন বয়স্যগণ দ্বারা পিতার নিকট স্বীয় অভিলাষ জানাইলেন। প্রমতি
তদনুসারে মহর্ষি স্থূলকেশের নিকট গিয়া আপন পুৎত্রের নিমিত্ত সেই কন্যা প্রার্থনা
করিলেন। মহর্ষি স্থূলকেশ ফল্গুনী নক্ষত্রযুক্ত দিবসে বিবাহের দিন নির্দ্ধারিত
করিয়া রুরুকে প্রমদ্বরা সম্প্রদান করিলেন।
একদা
বরবর্ণিনী প্রমদ্বরা আপন সহচরীগণ সমভিব্যাহারে ক্রীড়াকৌতুক করিতে করিতে দৈবগত্যা
প্রসুপ্ত ও কেলিভূমিতে পতিত এক কৃষ্ণসর্পকে পাদাহত করিল। সর্প ক্রুদ্ধ হইয়া বিষাক্ত
দশন-পংক্তি দ্বারা তৎক্ষণাৎ তাহাকে দংশন করাতে সে বিবর্ণা, বিচেতনা ও ভ্রষ্টাভরণা
হইয়া ছিন্নমূল কদলীর ন্যায় ভূতলে পড়িল। তদীয় সখীগণ তাহাকে মুক্তকেশা, ভ্রষ্টবেশা ও
ভূপৃষ্ঠে পতিতা দেখিয়া বিষাদ-সাগরে নিমগ্ন হইয়া হাহাকার করিতে লাগিল। কিন্তু
প্রমদ্বরা ভূজঙ্গবিষে অভিভূতা ও বিবর্ণা হইয়াও পুনর্ব্বার পূর্ব্বাপেক্ষা অধিকতর
রমণীয় হইয়া উঠিল। ফলতঃ তখন তাহাকে বোধ হইতে লাগিল, যেন অকাতরে নিদ্রা যাইতেছে।
তদীয় পিতা
মহর্ষি স্থূলকেশ ও অন্যান্য মহর্ষিগণ প্রমদ্বরাকে বিগতাসু ও ভূতলে পতিত দেখিলেন।
তদনন্তর স্বস্ত্যাত্রেয়, মহাজানু, কুশিক, শঙ্খমেখল, উদ্দালক, কঠ, শ্বেত, ভারদ্বাজ,
কৌণকূৎস, আর্ষ্টিষেন, গৌতম, প্রমতি, রুরু ও অন্যান্য তপোবনবাসী তপোধনগণ
কারুণ্য-রস-পরবশ হইয়া তথায় উপস্থিত হইলেন। পরে সেই পরমাসুন্দরী কন্যাকে আশীবিষ
বিষার্দ্দিত মৃত ও ভূতলে পতিত দেখিয়া সকলেই রোদন করিতে লাগিলেন। রুরু প্রিয়তমাকে
তদবস্থ দেখিয়া নিতান্ত উদ্ভ্রান্ত ও একান্ত কাতর হইয়া তথা হইতে বহির্গমন করিলেন।
নবম অধ্যায়
ডুণ্ডুভ-উপাখ্যান
সৌতি কহিলেন,
সেই সকল মহাত্মা দ্বিজগণ তথায় উপবিষ্ট হইলে, রুরু সাতিশয় দুঃখিত হইয়া অরণ্যানী
প্রবেশপূর্ব্বক উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন এবং শোকে একান্ত ব্যাকুল হইয়া স্বীয়
প্রিয়তমা প্রমদ্বরাকে স্মরণ করিয়া করুণস্বরে এইরূপে বিলাপ করিতে লাগিলেন
–
"আমার ইহা
অপেক্ষা আর দুঃখের বিষয় কি হইতে পারে যে, আমার ও বন্ধুবর্গের শোকবর্দ্ধিনী সেই
সর্ব্বাঙ্গ সুন্দরী রমণী ধরাতলে পড়িয়া আছে? আমি যদি দান, তপশ্চরণ ও গুরুজনের
শুশ্রূষা করিয়া থাকি, তবে আমার প্রিয়া পুনঃসঞ্জীবিত হউক। আমি জন্মাবধি আত্মসংযম ও
ব্রতানুষ্ঠান করিয়া যে-সকল পুণ্যসঞ্চয় করিয়াছি, এক্ষণে আমার প্রাণপ্রিয়া প্রমদ্বরা
সেই পুণ্যবলে ভূমিশয্যা হইতে গাত্রোত্থান করুক।"
রুরু
স্বীয় প্রিয়তমা প্রমদ্বরাকে উদ্দেশ করিয়া এইরূপে বিলাপ করিতেছেন, ইত্যবসরে দেবদূত
তৎসন্নিধানে আসিয়া কহিলেন, "রুরু! তুমি দুঃখার্ত্ত হইয়া যেরূপ প্রার্থনা করিতেছ,
উহা নিতান্ত অসম্ভব; যেহেতু, মনুষ্য একবার কালগ্রাসে পতিত হইলে আর কদাচ
পুনর্জ্জীবিত হয় না। এই প্রমদ্বরা গন্ধর্ব্বের ঔরসে অপ্সরাগর্ভে জন্মগ্রহণ করে,
এক্ষণে আয়ুঃশেষ হইয়াছে বলিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছে। অতএব হে বৎস! তুমি আর
শোকসাগরে নিমগ্ন হইও না। পূর্ব্বে দেবগণ এই বিষয়ে একটি উপায় নির্দ্দেশ করিয়াছেন,
যদি তাহা করিতে পার, তবে পুনর্ব্বার প্রমদ্বরাকে লাভ করিতে পারিবে।" রুরু কহিলেন,
"হে দেবদূত! দেবগণ এই বিষয়ে কি উপায় স্থির করিয়াছেন, যথার্থ করিয়া বল, আমি এই
দণ্ডেই তদনুযায়ী কর্ম্ম করিব।" দেবদূত কহিলেন, "হে ভৃগুনন্দন! তুমি স্বীয়
ভার্য্যাকে আপনার পরমায়ুর অর্দ্ধেক প্রদান কর, তাহা হইলেই সে পুনর্জ্জীবিতা হইবে।" রুরু কহিলেন,
"আচ্ছা আমি প্রমদ্বরাকে আপন পরমায়ুর অর্দ্ধভাগ প্রদান করিলাম, সে
মৃত্যুশয্যা হইতে গাত্রোত্থান করুক।" তখন গন্ধর্ব্বরাজ ও দেবদূত উভয়ে-যম-সমীপে গমন
করিয়া নিবেদন করিলেন, "হে ধর্ম্মরাজ! যদি আপনি অনুমতি করেন, তবে রুরুর মৃতভার্য্যা
প্রমদ্বরা স্বীয় ভর্ত্তার অর্দ্ধায়ু লইয়া পুনর্জ্জীবিত হয়।" ধর্ম্মরাজ কহিলেন, "হে
দেবদূত! যদি তোমার ইচ্ছা হইয়া থাকে, তবে রুরুপত্নী রুরুর অর্দ্ধ পরমায়ু পাইয়া
পুনর্জ্জীবিত হউক।" ধর্ম্মরাজ এই কথা কহিবামাত্র প্রমদ্বরা রুরুর অর্দ্ধ পরমায়ু
প্রাপ্ত হইল এবং তৎক্ষণাৎ সুপ্তোত্থিতার ন্যায় ধরাতল হইতে গাত্রোত্থান করিল। এইরূপে
প্রমদ্বরা পুনর্জ্জীবিত হইলে, রুরুর পিতা এবং প্রমদ্বরার পিতা উভয়ে আনন্দ-সাগরে
মগ্ন হইয়া শুভলগ্নে পুৎত্র-কন্যার বিবাহবিধি নির্ব্বাহ করিলেন। তাঁহারাও পরস্পরের
হিতসাধনে তৎপর হইয়া পরমানন্দে কালাতিপাত করিতে লাগিলেন। রুরু এইরূপে কমলসমপ্রভা
সুদুর্লভা প্রিয়তমাকে পুনর্লাভ করিয়া সর্পবংশ ধ্বংস করিতে প্রতিজ্ঞারূঢ় হইলেন। সর্প
অবলোকন করিবামাত্র তিনি ক্রোধে কম্পান্বিত-কলেবর হইয়া শস্ত্রাঘাতে তাহাকে বিনাশ
করিতেন।
একদা তিনি
এক নিবিড় অরণ্যানী প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, এক অতি জীর্ণ-কলেবর ডুণ্ডুভ সর্প শয়ন
করিয়া রহিয়াছে। রুরু তাহাকে দেখিবামাত্র ক্রোধান্ধ হইয়া যমদণ্ডের ন্যায় নিজ দণ্ড
উদ্ধৃত করিয়া তাহার নিধন-সাধনে উদ্যত হইলেন। ডুণ্ডুভ তাঁহাকে জিঘাংসু দেখিয়া কহিল,
"হে তপোধন! আমি ত' তোমার কোন অপরাধ করি নাই, তবে কেন অকারণে রোষপরবশ হইয়া আমার
প্রাণবধে উদ্যত হইতেছ?"
দশম অধ্যায়
রুরুর সর্পমাত্র
হিংসার কারণ
রুরু কহিলেন,
"হে ভুজঙ্গম! এক দুষ্ট সর্প আমার প্রাণতুল্যা প্রেয়সীকে দংশন করিয়াছিল, সেই অবধি
আমি এই অনুল্লঙ্ঘনীয় দৃঢ়-প্রতিজ্ঞা করিয়াছি যে, সর্প দেখিতে পাইলেই তাহার
প্রাণসংহার করিব; অতএব আমি তোমাকে হত্যা করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি। অদ্য আমার হস্তে
তোমার প্রাণসংহার হইবে।" ডুণ্ডুভ কহিল, "হে ব্রহ্মন্! যে-সকল সর্পেরা মনুষ্যদিগকে
দংশন করে, তাহারা স্বতন্ত্র জাতি; ডুণ্ডুভেরা সেরূপ নহে। ইহারা কখন কাহারও হিংসা
করে না; অতএব হে মহর্ষে! কেবল সর্পনামের গন্ধমাত্র পাইয়া নিরপরাধ ডুণ্ডুভগণকে বধ
করা তোমার সমুচিত কর্ম্ম হয় না। ডুণ্ডুভদিগের সুখভোগাভিলাষ অন্যান্য ভুজঙ্গমের সদৃশ
নহে; কিন্তু ইহারা অনর্থ-ঘটনার সময় তাহাদের সমভাগী, অতএব তুমি ধার্ম্মিক হইয়া
এবম্ভূত হতভাগ্য নিরপরাধ ডুণ্ডুভদিগকে বধ করিও না।"
রুরু
ভয়ার্ত্ত ডুণ্ডুভের এই কাতরোক্তি-শ্রবণে অত্যন্ত দয়ার্দ্র হইয়া তাহার প্রাণসংহারে
পরাঙ্মুখ হইলেন এবং শান্তবাক্যে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, "হে ভুজঙ্গম! তুমি কে, কি
কারণেই বা সর্পযোনি প্রাপ্ত হইয়াছ, আমাকে বল।" সর্প কহিল, "আমি পূর্ব্বে
সহস্রপাদনামা মুনি ছিলাম। ব্রহ্মশাপগ্রস্ত হইয়া ভুজঙ্গ-কলেবর ধারণ করিয়াছি।" ইহা
শুনিয়া রুরু কহিলেন, "হে ভুজঙ্গোত্তম! ব্রাহ্মণ কি নিমিত্ত ক্রুদ্ধ হইয়া তোমাকে শাপ
প্রদান করিয়াছিলেন, আর কত কালই বা তোমাকে এই শরীরে থাকিতে হইবে সবিস্তর শুনিতে
ইচ্ছা করি।"