ভাষাংশ
বেদব্যাস বিরচিত
কালীপ্রসন্ন সিংহ অনূদিত
মহাভারত
অনুসরণ : তুলি-কলম। জ্যৈষ্ঠ, ১৩৯৪। জুন, ১৯৮৭।
দ্রোণপর্ব্ব
প্রথম অধ্যায়
দ্রোণাভিষেকপর্ব্বাধ্যায়–কৌরবকর্ত্তব্যপ্রশ্ন
নারায়ণ, নরোত্তম নর ও দেবী সরস্বতীকে নমস্কার করিয়া জয় উচ্চারণ করিবে।
জনমেজয় কহিলেন; ভগবন্! সত্ত্ব [সারবত্তা], ওজস্বিতা [বলবত্তা–শক্তি],
বল, ধীরত্ব ও পরাক্রমে অদ্বিতীয় ভীষ্ম নিহত হইয়াছেন শ্রবণ করিয়া রাজা ধৃতরাষ্ট
করিলেন? তাঁহার পুৎত্র দুর্য্যোধন, ভীষ্ম, দ্রোণপ্রমুখ রথিগণের সাহায্যে
মহাধনুর্দ্ধর পাণ্ডবগণকে পরাজিত করিয়া রাজ্য ভোগের অভিলাষী হইয়াছিলেন, ধনুর্দ্ধগণের
কেতুস্বরূপ সেই ভীষ্ম নিহত হইলে তিনিই বা কি করিয়াছিলেন? সমুদয় কীত্তন করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন্! রাজা ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম নিহত
হইয়াছেন শুনিয়া চিন্তা ও শোকে এরূপ আকুল হইয়াছিলেন যে, কিছুতেই শান্তিলাভ করিতে না
পারিয়া অনবরত সেই দুঃখই চিন্তা করিতে লাগিলেন। এমন সময় রজনী সমুপস্থিত হইল; সঞ্জয়ও
শিবির হইতে হস্তিনাপুরে ধৃতরাষ্ট্র-সমীপে আগমন করিলেন। পুৎত্রগণের জয়ার্থ রাজা
ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্মের নিধন-সংবাদশ্রবণ অবধি বিষণ্ণ হৃদয় হইয়া বিলাপ করিতেছিলেন,
সঞ্জয়কে প্রাপ্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ''সঞ্জয়! কালপ্রেরিত কৌরবগণ ভীষণ পরাক্রম
মহাত্মা ভীষ্মের নিধনে শোকসাগর মগ্ন হইয়া কি করিতে ইচ্ছা করিলেন এবং ভূপালগণই বা কি
করিয়াছিলেন? সমুদয় কীর্ত্তন কর। মহাত্মা পাণ্ডবগণের সেনাসকল ভুবনত্রয়েরও ভয় উৎপাদন
করিতে পারে!"
সঞ্জয় কহিলেন, "হে মহারাজ! অনন্যমনে শ্রবণ করুন। সত্যপরাক্রম
ভীষ্ম নিহত হইলে কৌরব ও পাণ্ডবগণ পৃথক পৃথক চিন্তা করিতে লাগিলেন; কৌরবগণ বিস্ময় ও
পাণ্ডবগণ হর্ষসহকারে ক্ষাত্রধর্ম্ম অনুসারে পিতামহকে প্রণিপাতপূর্ব্বক
সন্নতপর্ব্ব শরজালে তাঁহার উপাধানসমেত শয্যা প্রস্তুত করিয়া চতুর্দ্দিকে রক্ষক
নিযুক্ত করিলেন এবং পরস্পর সম্ভাষণ ও ভীষ্মের অনুমতি গ্রহণপূর্ব্বক তাঁহাকে
প্রদক্ষিণ করিয়া কালপ্রেরিত হইয়া কোপলোহিতলোচনে পরস্পর দৃষ্টিপাতপূর্ব্বক
পুনর্ব্বার যুদ্ধের নিমিত্ত গমন করিলেন। অনন্তর উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণ তূর্য্য ও
ভেরী-নিনাদসহকারে বহির্গত হইল। পরদিন প্রভাতে কৌরবগণ অমর্ষপরবশ ও কালোপহতমানস
[অদৃষ্টবশে মতিভ্রংশ] হইয়া মহাত্মা ভীষ্মের হিতকর বাক্যে অনাদর করিয়া
শস্ত্রগ্রহণপূ্র্ব্বক সত্বর গমন করিতে লাগিলেন।
"মহারাজ! মৃত্যুকর্ত্তৃক আহূত কৌরব ও ভূপালগণ আপনার
দুর্য্যোধনের অজ্ঞানতায় এবং ভীষ্মের বধে শ্বাপদসঙ্কুল বনে অশরণ [অরক্ষিত] অজ ও
মেষসমূহের ন্যায় নিতান্ত দুর্ম্মনায়মান হইয়া উঠিলেন। যেমন মহার্ণবে চতুর্দ্দিক্
হইতে বায়ু প্রবাহিত হইয়া জীর্ণ নৌকাকে আহত করে, সেইরূপ মহাবীর পাণ্ডবগণ
নক্ষত্রবিহীন দ্যুলোকের [তারালোকের] ন্যায়, বায়ুহীন আকাশের ন্যায়, শস্যশূন্য
পৃথিবীর ন্যায়, সংস্কারহীন বাক্যের ন্যায়, বলহীন অসুরসেনার ন্যায়, বিধবা বরবর্ণিনীর
ন্যায়, শুষ্কতোয়া তরঙ্গিণীর ন্যায়, বৃকগণকর্ত্তৃক রুদ্ধ ও হতযূথপ মৃগীর ন্যায়,
শরভকর্ত্তৃক হতসিংহ গিরিকন্দরের ন্যায়, ভীষ্মহীন সেই ভারতী সেনাকে নির্ভর-নিপীড়িত
করিয়াছিলেন! সেই সেনার অন্তর্গত অশ্ব, রথ ও গজসকল ব্যাকুল, অধিকাংশই বিপন্ন এবং
সকলেই দীন ও ভীত হইয়াছিল; এমন কি, ভিন্ন ভিন্ন ভূপাল ও সৈনিকগণ ভীষ্ম ব্যতিরেকে যেন
পাতালে নিমগ্ন হইতে লাগিল।
দুর্য্যোধনপ্রমুখ কৌরবগণের কর্ণ-স্মরণ
"অনন্তর কৌরবগণ ভীষ্মসদৃশ কর্ণকে স্মরণ করিলেন। যেমন গৃহী-ব্যক্তির
মন সাধু অতিথির প্রতি ও আপদ্গ্রস্ত ব্যক্তির মন বন্ধুর প্রতি ধাবমান হয়, তদ্রূপ
কৌরবগণের মন কর্ণের প্রতিই ধাবমান হইল। তখন পার্থিবগণ সূতপুৎত্র কর্ণ আপনাদের
হিতকারী মনে করিয়া কর্ণ! কর্ণ!' বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিলেন এবং কহিলেন, 'মহাযশা:
কর্ণ তাঁহার অমাত্য ও বন্ধুগণ দশ দিন যুদ্ধ করেন নাই, অতএব অবিলম্বে তাঁহাকেই আহবান
কর।' মহাবাহু কর্ণ রথীর তুল্য, রথাতিরথগণের অগ্রগণ্য, শূরগণের সম্মত এবং যম, কুবের,
বরুণ ও ইন্দ্রের সহিত যুদ্ধ করিতেও সমর্থ; তথাপি ভীষ্ম বলবিক্রমশালী রথিগণের গণনা
সময়ে তাঁহাকে অর্দ্ধরথ বলিয়া গণনা করিয়াছিলেন; তিনি সেই ক্রোধে ভীষ্মকে কহিয়াছিলেন,
'হে ভীষ্ম! তুমি জীবিত থাকিতে আমি কদাচ যুদ্ধ করিব না! মহাযুদ্ধে পাণ্ডবগণ তোমার
হস্তে নিহত হইলে, আমি দুর্য্যোধনের অনুজ্ঞা লইয়া অরণ্যে গমন করিব অথবা তুমি
পাণ্ডবগণের হস্তে নিহত হইয়া স্বর্গপ্রাপ্ত হইলে, আমি একরথে তোমার অভিমত [প্রশংসিত]
রথিগণকে সংহার করিব।' এই কথা বলিয়া মহাযশাঃ কর্ণ দুর্য্যোধনের সম্মতিক্রমে দশ দিন
যুদ্ধ করেন নাই। অমিতবিক্রম ভীষ্মই যুধিষ্ঠিরের যোদ্ধৃগণকে সংহার করিয়াছিলেন। তিনি
নিহত হইলে যেমন তিতীর্ষু [নদী প্রভৃতি হইতে উত্তরণ অভিসারী] ব্যক্তি ভেলককে স্মরণ
করে, সেইরূপ আপনার পুৎত্রগণ কর্ণকে স্মরণ করিলেন। আপনার পুৎত্র সৈন্য ও ভুপালগণ 'হা
কর্ণ! এই সমুচিত সময়', এই বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিলেন। কর্ণ অস্ত্রে পরশুরামের
শিক্ষিত ও দুর্নিবার্য্য-পরাক্রম; এই নিমিত্ত যেমন বিপদ্কালে সকলের মন বন্ধুর
প্রতি ধাবমান হয়, সেইরূপ আমাদিগের মন কর্ণের প্রতি ধাবমান হইল। যেমন গোবিন্দ
দেবগণকে নিরন্তর মহাভয় হইতে রক্ষা করেন, সেইরূপ তিনি আমাদিগকে এই মহাভয় হইতে
পরিত্রাণ করিতে সমর্থ হইবেন।"
সঞ্জয় এইরূপ পুনঃ পুনঃ কর্ণের কথা কীর্ত্তন করিতেছেন, এমন সময়
ধৃতরাষ্ট্র ভুজঙ্গের ন্যায় নিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক সঞ্জয়কে কহিলেন, "হে সঞ্জয়!
দুর্য্যোধনপ্রমুখ তোমরা সকলে নিতান্ত কাতর ও একান্ত ত্রস্ত হইয়া যে কর্ণকে স্মরণ
এবং তাঁহার সহিত যে সাক্ষাৎ করিয়াছিলে, তাহা ত তিনি মিথ্যা করেন নাই? কৌরবগণের
আশ্রয় ভীষ্ম নিহত হইলে তোমাদিগের যে ক্ষতি হইয়াছিল, শরীরত্যাগশীল, সত্যবিক্রম,
ধনুর্দ্ধরাগ্রগণ্য কর্ণ ত তাহা পুরণ করিয়াছিলেন? তিনি শত্রুগণকে ভীত ও আমার
পুৎত্রগণের জয়াশা সফল করিতে ত পশ্চাৎপদ হয়েন নাই?"