ভাষাংশ
বেদব্যাস বিরচিত
কালীপ্রসন্ন সিংহ অনূদিত
মহাভারত
অনুসরণ : তুলি-কলম। জ্যৈষ্ঠ, ১৩৯৪। জুন, ১৯৮৭।
দ্রোণপর্ব্ব
দ্বিতীয়
অধ্যায়
ভীষ্মনিধনশ্রবণে কণের বিলাপ
সঞ্জয় কহিলেন, "মহারাজ! মহারথ ভীষ্ম নিহত হইয়াছে শ্রবণ করিয়া মহাবীর কর্ণ অগাধসলিলনিমগ্ন নৌকাসদৃশ কৌরব সৈন্যগণকে সহোদরের ন্যায় উদ্ধার করিবেন এবং পিতা যেমন পুৎত্রকে রক্ষা করেন, সেইরূপ তিনি বিপদ্গ্রস্ত কৌরবসেনাকে পরিত্রাণ করিবেন বলিয়া তাঁহাদিগের নিকট গমন করিয়া কহিলেন, —হে সৈন্যগণ! চন্দ্রমা যেমন নিরন্তর শশচিহ্নে অঙ্কিত, সেইরূপ যিনি ধৃতি, বুদ্ধি, পরাক্রম, ওজস্বিতা, সত্য, দম, সমুদয় বীরগুণ, দিব্য-অস্ত্র, নম্রতা, হ্রী, প্রিয়বাদিতা ও কৃতজ্ঞতায় নিরন্তর অলঙ্কৃত এবং দ্বিজগণের শত্রুনিপাতন, সেই ভীষ্ম যদি বিনাশ প্রাপ্ত হইলেন, তবে এক্ষণে স্পষ্টই প্রতীতি হইতেছে যে, সমুদয় যোদ্ধাই নিহত হইয়াছেন। যখন মহাব্রত ভীষ্ম নিহত হইয়াছেন, তখন কালি যে সূ্র্য্যোদয় হইবে, ইহা কেহ নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারে না; অতএব কর্ম্মের নিয়ত সম্বন্ধনিবন্ধন ইহলোকে কোন বস্তুই অবিনাশী নহে। বসুর ন্যায় প্রভাবসম্পন্ন ও বসুতেজে সমুৎপন্ন ভীষ্ম বসুগণকেই প্রাপ্ত হইয়াছেন; এক্ষণে ধন, পুৎত্র, পৃথিবী, কৌরবগণ ও এই সকল সৈন্যের নিমিত্ত শোক কর।"
কৌরবসৈন্যগেণর প্রতি কর্ণের উৎসাহপ্রদান
সঞ্জয় কহিলেন, "মহাপ্রভব ভীষ্ম নিপাতিত ও কৌরবগণ পরাজিত হইলে কর্ণ দুষ্মনা হইয়া
গলদশ্রুলোচন সকলকে সাতিশয় আশ্বাস প্রদান করিতে লাগিলেন। আপনার পুৎত্র ও সৈনিকগণ
কর্ণের বাক্য শ্রবণ করিয়া পরস্পর চীৎকার করিতে আরম্ভ করিলেন; তাঁহাদিগের নয়ন হইতে
চীৎকারের অনুরূপ শোকজল বিগলিত হইতে লাগিল।
"পুনর্ব্বার মহাযুদ্ধ আরধ্ব হইলে সৈন্যগণ পার্থিবগণের নিয়োগানুসারে সিংহনাদ পরিত্যাগ
করিলে মহারথশ্রেষ্ঠ কর্ণ আহ্লাদকর বাক্যে রথিগণকে কহিলেন, 'হে পার্থিবগণ! এই অনিত্য
জগতে সকলই নিরন্তর মৃত্যুমুখে ধাবমান হইতেছে চিন্তা করিয়া আমি সকলকেই অস্থায়ী
দেখিতেছি; দেখুন, আপনারা বিদ্যমান থাকিতেও গিরিসদৃশ কুরুপ্রধান ভীষ্ম কি প্রকারে
নিপাতিত হইলেন? মহাবীর ভীষ্ম ভূতলে পতিত হইয়া গগন-পতিত দিবাকরের ন্যায় লক্ষিত
হইতেছেন, প্রধান প্রধান বীরগণ নিহত হইয়াছেন; সৈন্যগণ নির্ভর-নিপীড়িত হইয়াছে। শত্রুগণ
তাহাদিগের উৎসাহ বিনষ্ট করিয়াছে; তাহারা একেবারে অনাথ হইয়া রহিয়াছে; এ সময়ে অন্য
পার্থিবগণ ধনঞ্জয়কে সহ্য করিতে সমর্থ হইবেন না; বৃক্ষগণ কি পর্ব্বতবাহী সমীরণের বেগ সহ্য
করিতে পারে? অতএব আমি মহাত্মা ভীষ্মের ন্যায় সমরে এই কুরুসৈন্যকে পরিপালন করিব।
এক্ষণে আমার প্রতি ঈদৃশ ভার সমর্পিত হইল, এই জগৎ অনিত্য বোধ হইতেছে এবং রণবীর ভীষ্ম
নিপাতিত হইয়াছেন, অতএব কি নিমিত্তই বা আমার ভয় না হইবে? সে যাহা হউক, আমি এই
মহাযুদ্ধে বিচরণপূর্ব্বক পাণ্ডবগণকে শমনসদনে প্রেরণ করিয়া জগতে যশই পরম ধন, এই ভাবিয়া
অবস্থান করিব অথবা তাহাদিগের হস্তে প্রাণ পরিত্যাগ করিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে শয়ন করিব।
যুধিষ্ঠির ধৈর্য্য, বুদ্ধি, ধর্ম্ম ও উৎসাহসম্পন্ন; বৃকোদর শতমাতঙ্গতুল্য বিক্রমশালী;
অর্জ্জুন দেবরাজের আত্মজ ও যুবা; অতএব পাণ্ডব সৈন্যগণকে জয় করা অমরগণেরও অনায়াসসাধ্য
নহে যমোপম যমজ নকুল ও সহদেব এবং সাত্যকিসমেত দেবকীসূত যে সৈন্যে আছেন, তাহা
কৃতান্তের মুখস্বরূপ; কোন কাপুরুষই তাহার সম্মুধীন হইলে বিনিবৃত্ত হইতে পারিবে না;
মনস্বিগণ তপস্যা দ্বারাই অত্যুগ্র তপস্যা নিবারিত করেন এবং বলদ্বারাই বলকে প্রতিহত
করিয়া থাকেন।'
যুদ্ধসজ্জায় সুসজ্জিত কণের ভীষ্মসমীপে গমন
"স্বীয় সারথিকে সম্বোধন করিয়া কর্ণ কহিলেন, 'হে সূত! আমার মন শত্রুনিবারণে ও স্বপক্ষ
সংরক্ষণে কৃতনিশ্চয় হইয়াছে। আজি আমি শত্রুগণের প্রভাব প্রতিহত করিয়া গমনমাত্র
তাহাদিগকে পরাজিত করিব। মিত্রদ্রোহ আমার সহ্য হয় না, সৈন্য ভগ্ন হইলে যিনি মিলিত
হইবেন, তিনিই আমার মিত্র। হয় আমি এই সৎপুরুষোচিত আর্য্যকম্ম সম্পাদন করিব, না হয়
প্রাণ পরিত্যাগ করিয়া ভীষ্মের অনুগামী হইব; হয় সমুদয় শত্রু বিনাশ করিব, না হয়
শত্রুহস্তে নিহত হইয়া বীরলোক প্রাপ্ত হইব। আমি জানি, স্ত্রী ও কুমারগণ ক্রন্দন ও
মুক্তকণ্ঠে বিলাপ করিলে এবং ধার্ত্তরাষ্ট্রের পৌরুষ পরাহত হইলে ঐরূপ কার্য্যই আমার
কর্ত্তব্য; অতত্রব আজি রাজা দু্র্য্যোধনের শত্রুগণকে পরাজিত করিব; এই সুঘোর সমরে প্রাণপণে
কৌরবগণের রক্ষাপূর্ব্বক সমুদয় শত্রু নিহত করিয়া দুর্য্যোধনকে রাজ্যদান করিব। এক্ষণে
সুবর্ণময় মণিরত্নবিভূষিত বিচিত্র কবচ, সূ্য্যপ্রভ শিরস্ত্রাণ, অগ্নি, বিষ,
ভুজঙ্গতুল্য ধনু ও শরাসন এবং ষোড়শ তূণীর [ষোলটা তূন] বন্ধন করিয়া দাও; দিব্য-ধনু, শর, মহতী গদা
ও সুবর্ণখচিত শর আহরণ কর; এই সুবর্ণময়ী নাগকক্ষা ও ইন্দীবরপ্রভাসম্পন্ন দিব্য-ধ্বজ
সূক্ষ্ণ বস্ত্রে মার্জ্জিত করিয়া জালসমবেত বিচিত্র মালার সহিত আনয়ন কর; আরও কতকগুলি
শ্বেতাভ্রসঙ্কাশ হৃষ্টপুষ্ট অশ্ব মন্ত্রপূতজলে স্নান করাইয়া তপ্তকাঞ্চন-ভূষণে ভূষিত
করিয়া অনতি বিলম্বে আনয়ন কর; হেমমালা ও চন্দ্রসূর্যসদৃশ রথসমূহবিভূষিত, সমরোচিত
উপকরণসম্পন্ন, বাহনসংযোজিত রথ শীঘ্র আবর্ত্তিত কর; বেগসহ বিচিত্র চাপ,
শত্রুসংহারোপযোগী উৎকৃষ্ট জ্যা, শরপরিপূর্ণ প্রকাণ্ড তৃণীর ও গাত্রাবরণসকল সজ্জিত কর;
প্রস্থানকালোচিত [যুদ্ধযাত্রাকালোপযোগী] কাংস্য ও হেমঘট [স্বর্ণকুম্ভ] দধি-পরিপূর্ণ করিয়া আনয়ন কর; মালা আনয়ন করিয়া অঙ্গে
বন্ধন কর এবং জয়ভেরীসকল বাদ্য কর।
"হে সূত! যে স্থানে আর্জ্জুন, বৃকোদর, যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেব আছে, শীঘ্র তথায় গমন
কর, আমি তাহাদিগকে সংহার করিব অথবা তাহাদের হস্তে নিহত হইয়া ভীষ্মের সহিত মিলিত
হইব। যে সৈন্যে সত্যধৃতি যুধিষ্ঠির, ভীমসেন, অর্জ্জুন, সাত্যকি, বাসুদেব ও সৃঞ্জয়গণ
অবস্থান করিতেছেন, তাহা জয় করা ভূপালগণের সাধ্যায়ত্ত নহে। যদি সর্ব্বসংহারকর্ত্তা
কৃতান্ত অপ্রমত্ত হইয়া ধনঞ্জয়কে রক্ষা করেন, তথাপি তাহাকে বিনাশ করিব অথবা ভীষ্মের
পথ ধরিয়া যমসমীপে উপস্থিত হইব। এক্ষণে আমি সেই সৈন্যগণের মধ্যে অবশ্যাই গমন করিব;
আমার এই সকল সহায় মিত্রদ্রোহী, ভক্তিবিহীন বা পাপাত্মা নহেন।'
"অনন্তর সুবণ, মুক্তা, মণি ও রত্নখচিত রথ সুসজ্জিত এবং পতাকা ও বায়ুর ন্যায় বেগবান্
অশ্বসকল সংযোজিত হইল। যেমন দেবগণ দেবরাজাকে পূজা করিয়া থাকেন, সেইরূপ কুরুগণ
মহাত্মা কর্ণকে সৎকার করিলেন। হুতাশনপ্রভ কর্ণ অনলসদৃশ মেঘস্বন রথে আরোহণ করিয়া
বিমানারূঢ় বাসবের ন্যায় শোভাপ্রাপ্ত হইলেন এবং যে স্থানে ভরতশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম
বিনাশপ্রাপ্ত হইয়াছেন, তথায় গমন করিতে লাগিলেন।"