মহাভারত
আদিপর্ব
ভাষাংশ>মহাভারত >মৌসলপর্ব্ব>ষষ্ঠ অধ্যায়
ষষ্ঠ অধ্যায়
যদুবংশধ্বংসে বসুদেবের বিলাপ
বৈশম্পায়ন
বলিলেন, হে মহারাজ! অনন্তর মহাত্মা অর্জ্জুন মনে মনে বাসুদেবের স্তব করিয়া
স্ত্রীগণকে আশ্বাসপ্রদানপূর্ব্বক মাতুলের সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে তাঁহার গৃহে
প্রবিষ্ট হইয়া দেখিলেন, মহাত্মা বসুদেব পুত্ত্রশোকে নিতান্ত সন্তপ্ত হইয়া শয়ান
রহিয়াছেন। তাঁহাকে তদবস্থ দেখিয়া ধনঞ্জয়ের দুঃখের আর পরিসীমা রহিল না। তখন তিনি
বাষ্পপূর্ণনয়নে রোদন করিতে করিতে তাঁহার চরণযুগল বন্দনা করিলেন।
মহাত্মা বসুদেব ভাগিনেয় অর্জ্জুনকে সমাগত দেখিয়া নিতান্ত
দৌর্ব্বল্যনিবন্ধন তাঁহার মস্তকাঘ্রাণ করিতে সমর্থ না হইয়া তাঁহাকে
আলিঙ্গনপূর্ব্বক পুত্ত্র, পৌত্ত্র, দৌহিত্র ও বান্ধবগণের নিমিত্ত রোদন করিতে করিতে
কহিলেন, “ধনঞ্জয়! যাহারা অসংখ্য ভূপতি ও দানবগণকে পরাজিত করিয়াছিল, আজি আমি
তাহাদিগকে না দেখিয়াও জীবিত রহিয়াছি! তুমি যে প্রদ্যুম্ন ও সাত্যকিকে প্রিয়শিষ্য
বলিয়া সর্ব্বদা প্রশংসা করিতে এবং যাহারা বৃষ্ণিবংশের অতিরথ বলিয়া বিখ্যাত ও
বাসুদেবের নিতান্ত প্রিয়পাত্র ছিল, এক্ষণে তাহাদিগেরই দুর্নীতিনিবন্ধন এই যদুকুলের
ক্ষয় হইয়াছে। অথবা উহাদের এ বিষয়ে দোষ কি? ব্রহ্মশাপই ইহার মূল কারণ।
“পূর্ব্বে যে কৃষ্ণ মহাবলপরাক্রান্ত কেশী, কংস, শিশুপাল,
নিষাদরাজ একলব্য, কাশিরাজ, কালিঙ্গগণ, মাগধগণ, গান্ধারগণ এবং প্রাচ্য, দাক্ষিণাত্য
ও পার্ব্বতীয় ভূপালগণকে নিহত করিয়াছিলেন, এক্ষণে তিনিও এই যদুকুল ক্ষয় হইতে
দেখিয়া উপেক্ষা করিয়াছেন। তুমি, দেবর্ষি নারদ ও অন্যান্য মহর্ষিগণ তোমরা সকলেই
যাঁহাকে সনাতন দেবদেব বলিয়া কীর্ত্তন করিয়া থাক, তিনি এক্ষণে স্বচক্ষে জ্ঞাতিবধ
প্রত্যক্ষ করিয়া উপেক্ষা করিলেন। বোধ হয়, গান্ধারী ও ঋষিগণের বাক্য অন্যথা করিতে
তাঁহার বাসনা হয় নাই।
“তোমার পৌত্র পরীক্ষিৎ অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্র দ্বারা দগ্ধ
হইলে, তিনিই তাঁহার জীবন দান করিয়াছিলেন, কিন্তু এক্ষণে স্বীয় পরিজনদিগকে রক্ষা
করিতে তাঁহার বাসনা হইল না। তাঁহার পুৎত্র, পৌৎত্র, সখা ও ভ্রাতৃগণ সকলে নিহত হইলে,
তিনি আমার নিকট আগমনপূর্ব্বক আমাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘পিতঃ! আজি এই যদুকুল
একবারে নিঃশেষিত হইল। আমার প্রিয় সখা অর্জ্জুন দ্বারকায় আগমন করিলে, আপনি তাঁহার
নিকট এই কুলক্ষয়ের বিষয় আনুপূর্ব্বিক কীর্ত্তন করিবেন। আমি অর্জ্জুনের নিকট দূত
প্রেরণ করিয়াছি। তিনি এই নিদারুণ সংবাদ শ্রবণ করিলে, কখনই হস্তিনায় অবস্থান করিতে
পারিবেন না। অর্জ্জুনের সহিত আমার কিছুমাত্র প্রভেদ নাই। অতএব ঐ মহাত্মা এ স্থানে
আগমন করিয়া যাহা কহিবেন, আপনি অবিচারিতচিত্তে তাহার অনুষ্ঠান করিবেন। তাঁহাদ্বারাই
আপনার ঔর্দ্ধ্বদেহিক কার্য্যসম্পন্ন এবং এই বালক ও রমণীগণের রক্ষা হইবে। তিনি এই
স্থান হইতে প্রতিগমন করিবমাত্র এই অসংখ্য প্রাচীর ও অট্টালিকাসম্পন্ন দ্বারকাপুরী
সমুদ্রজলে প্লাবিত হইয়া যাইবে। আমি এক্ষণে বলদেবের সহিত কোন পবিত্র স্থানে
সমুপস্থিত হইয়া কাল প্রতীক্ষায় অবস্থান করিব।’
“অচিন্ত্যপরাক্রম মহাত্মা হৃষীকেশ এই বলিয়া আমাকে বালকগণের
সহিত এই স্থানে রাখিয়া যে কোথায় গমন করিয়াছেন, কিছুই বলিতে পারি না। আমি নিতান্ত
শোকাকুল হইয়া দিবারাত্রি বলদেব, বাসুদেব ও জ্ঞাতিগণকে স্মরণ পূর্ব্বক অনাহারে
কালহরণ করিতেছি। আর আমার জীবন ধারণ ও ভোজন করিতে প্রবৃত্তি নাই। এক্ষণে সৌভাগ্যবশতঃ
তোমার সহিত আমার সাক্ষাৎকার লাভ হইল। অতএব তুমি অবিলম্বে বাসুদেবের বাক্যানুরূপ
কার্য্যের অনুষ্ঠান কর। এক্ষণে এই রাজ্য, স্ত্রী ও রত্নসমুদায় তোমার অধিকৃত হইল;
আমি অচিরাৎ তোমার সমক্ষেই প্রাণত্যাগ করিব।”