মহাভারত
আদিপর্ব
ভাষাংশ>মহাভারত >মৌসলপর্ব্ব>সপ্তম অধ্যায়
সপ্তম অধ্যায়
অর্জ্জুনকর্ত্তৃক
যাদব-নরনারীরক্ষা-ব্যবস্থা
মহাত্মা
বসুদেব এই কথা কহিলে, শত্রুতাপন মহাবীর ধনঞ্জয় একান্ত বিমনায়মান হইয়া তাঁহাকে
সম্বোধন পূর্ব্বক কহিলেন, “মাতুল! আমি কোনক্রমেই এই কেশব ও অন্যান্য বীরগণপরিশূন্য
রাজধানী দর্শনে সমর্থ হইতেছি না। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির, ভীমসেন, নকুল, সহদেব,
দ্রৌপদী ও আমি আমরা সকলেই একাত্মা। এই যদুকুলক্ষয় শ্রবণ করিলে, আমার ন্যায়
তাঁহাদেরও যাহারপরনাই ক্লেশ হইবে। এক্ষণে মহারাজ যুধিষ্ঠিরেরও মর্ত্তলোক হইতে
প্রস্থান সময় সমুপস্থিত হইয়াছে। অতএব আর এ স্থানে অধিক দিন অবস্থান করা আমার উচিত
নহে। আমি অচিরাৎ বৃষ্ণিবংশীয় বালক ও বনিতাদিগকে লইয়া ইন্দ্রপ্রস্থে গমন করিব।”
মহাবীর ধনঞ্জয় মাতুলকে এই কথা কহিয়া দারুককে সম্বোধন করিয়া
কহিলেন, “দারুক! আমি বৃষ্ণিবংশীয় অমাত্যদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিতে বাসনা করি, অতএব
তুমি সত্বরে আমাকে তাঁহাদের নিকট লইয়া চল।” এই কথা কহিয়া তিনি দারুকের সহিত মহারথ
যাদবগণের নিমিত্ত শোক করিতে করিতে তাঁহাদের সভায় সমুপস্থিত হইলেন। অনন্তর তিনি
তথায় আসনপরিগ্রহ করিলে, অমাত্যগণ, প্রকৃতিমণ্ডল এবং ব্রাহ্মণগণ তাঁহাকে পরিবেষ্টন
করিয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর অর্জ্জুন সেই দীনচিত্ত মৃতকল্প
ব্যক্তিদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ! আমি অন্ধকদিগের
পরিবারদিগকে লইয়া ইন্দ্রপ্রস্থে গমন করিব। কৃষ্ণের পৌৎত্র বজ্র ঐ নগরে রাজা হইয়া
তোমাদিগকে প্রতিপালন করিবেন। এই নগর অচিরাৎ সমুদ্রজলে প্লাবিত হইবে। অতএব তোমরা
অবিলম্বে যান ও রত্নসমুদায় সুসজ্জিত কর। সপ্তম দিবসে সূর্য্যোদয়সময়ে আমাদিগকে এই
নগরের বহির্ভাগে অবস্থান করিতে হইবে। অতএব তোমরা আর বিলম্ব করিও না, শীঘ্র সুসজ্জিত
হও।”
বসুদেবের মৃত্যু–দেবকী প্রভৃতির সহমরণ
মহাত্মা ধনঞ্জয় এই কথা কহিলে, তাঁহারা সকলেই সত্বরে সুসজ্জিত হইতে লাগিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন শোকে একান্ত অভিভূত হইয়া কৃষ্ণের গৃহে সেই রজনী অতিবাহিত করিলেন। পরদিন প্রাতঃকালে প্রবলপ্রতাপ মহাত্মা বসুদেব যোগাবলম্বন পূর্ব্বক কলেবর পরিত্যাগ করিয়া উৎকৃষ্ট গতিলাভ করিলেন। তখন তাঁহার অন্তঃপুরমধ্যে ঘোরতর ক্রন্দনশব্দ সমুত্থিত হইয়া সমুদায় পুরী প্রতিধ্বনিত করিতে লাগিল। কামিনীগণ মাল্য ও আভরণ পরিত্যাগ পূর্ব্বক আলুলয়িতকেশে বক্ষঃস্থলে করাঘাত করিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। তখন মহাত্মা অর্জ্জুন সেই বসুদেবের মৃতদেহ বহুমূল্য নরযানে আরোপিত করিয়া অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইলেন। দ্বারকাবাসিগণ দুঃখশোকে একান্ত অভিভূত হইয়া, তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল। ভৃত্যগণ শ্বেতচ্ছত্র ও যাজকগণ প্রদীপ্ত পাবক লইয়া সেই শিবিকাযানের অগ্রে অগ্রে গমন করিতে আরম্ভ করিলেন। দেবকী, ভদ্রা, রোহিণী ও মদিরা নামে বসুদেবের পত্নীচতুষ্টয় তাঁহার সহমৃতা হইবার মানসে দিব্য অলঙ্কারে বিভূষিত ও অসংখ্য কামিনীগণে পরিবেষ্টিত হইয়া তাঁহার অনুগামিনী হইলেন। ঐ সময় জীবদ্দশায় যে স্থান বসুদেবের মনোরম ছিল, বান্ধবগণ সেই স্থানে তাঁহাকে উপনীত করিয়া তাঁহার প্রেতকৃত্য সম্পাদন করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন তাঁহার দেবকীপ্রভৃতি পত্নীচতুষ্টয় তাঁহাকে প্রজ্বলিত চিতাতে আরোপিত দেখিয়া তদপুরি সমারূঢ় হইলেন।
বসুদেব ও রামকৃষ্ণের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া
মহাত্মা
অর্জ্জুন চন্দনাদি বিবিধ সুগন্ধকাষ্ঠদ্বারা পত্নীসমবেত বসুদেবের দাহকার্য্য সম্পাদন
করিতে লাগিলেন। ঐ সময় সেই প্রজ্বলিত চিতানলের শব্দ, সামবেত্তাদিগের বেদাধ্যয়ন ও
অন্যান্য মানবগণের রোদনধ্বনিপ্রভাবে পরিবর্দ্ধিত হইয়া সেই স্থান প্রতিধ্বনিত করিতে
লাগিল। অনন্তর তিনি বজ্র প্রভৃতি যদুবংশীয় কুমারগণ ও কামিনীগণের সহিত সমবেত হইয়া
বসুদেবের উদকক্রিয়া সম্পাদন করিলেন।
এইরূপে বসুদেবের ঔর্দ্ধ্বদেহিক কার্য্য সম্পাদন হইলে,
পরমধার্ম্মিক ধনঞ্জয় যে স্থলে বৃষ্ণিবংশীয়েরা বিনষ্ট হইয়াছিলেন, সেই স্থানে
সমুপস্থিত হইলেন। তখন সেই ব্রহ্মশাপগ্রস্ত মুসলনিহত বৃষ্ণিগণকে নিপতিত সন্দর্শন
করিয়া তাঁহার দুঃখের আর পরিসীমা রহিল না। তখন তিনি জ্যেষ্ঠতানুসারে তাহাদিগের
সকলের উদকক্রিয়া সম্পাদন করিয়া অন্বেষণদ্বারা বলদেব ও বাসুদেবের শরীরদ্বয়
আহরণপূর্ব্বক চিতানলে ভস্মসাৎ করিলেন।
যাদবনারীগণসহ অর্জ্জুনের হস্তিনাযাত্রা
মহাত্মা অর্জ্জুন এইরূপে শাস্ত্রানুসারে বৃষ্ণিবংশীয়দিগের প্রেতকার্য্যসম্পাদন করিয়া সপ্তমদিবসে রথারোহণে ইন্দ্রপ্রস্থাভিমুখে যাত্রা করিলেন। তখন বৃষ্ণিবংশীয় কামিনীগণ শোকার্ত্ত হইয়া রোদন করিতে করিতে অশ্ব, গো, গর্দ্দভ ও উষ্ট্রসমাযুক্ত রথে আরোহণপূর্ব্বক তাঁহার অনুগমনে প্রবৃত্ত হইলেন। ভৃত্য অশ্বারোহী ও রথীগণ এবং পুরবাসী ও জনপদবাসী লোকসমুদয় অর্জ্জুনের আজ্ঞানুসারে বৃদ্ধ, বালক ও কামিনীগণকে পরিবেষ্টন করিয়া গমন করিতে লাগিল। গজারোহিগণ পর্ব্বতাকার গজসমুদায়ে আরোহণপূর্ব্বক ধাবমান হইল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এবং বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয় বালকগণ, বাসুদেবের ষোড়শ সহস্র পত্নী ও পৌত্ত্র বজ্রকে অগ্রসর করিয়া গমন করিতে লাগিলেন। ঐ সময় ভোজ, বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশের যে কত অনাথা কামিনী পার্থের সহিত গমন করিয়াছিলেন, তাহার আর সংখ্যা নাই। এইরূপে মহারথ অর্জ্জুন সেই যদুবংশীয় অসংখ্য লোক সমভিব্যাহারে দ্বারকা নগর হইতে বহির্গত হইলেন।
সমুদ্রের দ্বারকাপুরীগ্রাস
দ্বারকাবাসী লোকসমুদায় নগর হইতে নির্গত হইলে পর, মহাত্মা অর্জ্জুন উঁহাদের সহিত ঐ বিবিধ রত্নপরিপূর্ণ নগরের যে অংশ অতিক্রম করিতে লাগিলেন, সেই অংশ অচিরাৎ সমুদ্রজলে প্লাবিত হইতে লাগিল। তখন দ্বারকাবাসী লোকসমুদায় সেই অদ্ভূত ব্যাপারসন্দর্শনে নিতান্ত চমৎকৃত হইয়া ‘দৈবের কি আশ্চর্য্য ঘটনা’ এই কথা বলিতে বলিতে দ্রুতপদে ধাবমান হইল। অনন্তর মহাবীর ধনঞ্জয় সেই যদুবংশীয় কামিনীগণ ও অন্যান্য যোধগণসমভিব্যাহারে ক্রমে ক্রমে নদীতীর, রমণীয় কানন ও পর্ব্বতপ্রদেশে অবস্থান করিতে লাগিলেন। কিয়দ্দিন পরে তিনি অতি সমৃদ্ধিসম্পন্ন পঞ্চনদ দেশে সমুপস্থিত হইয়া পশু ও ধান্যপরিপূর্ণ প্রদেশে অবস্থিতি করিলেন। ঐ স্থানে দস্যুগণ ধনঞ্জয় একাকী সেই অনাথা যদুকুলকামিনীগণকে লইয়া যাইতেছেন দেখিয়া, অর্থলোভে তাঁহাদিগকে আক্রমণ করিতে বাসনা করিয়া পরস্পর এইরূপ মন্ত্রণা করিল যে, “ধনঞ্জয় একাকী কতকগুলি বৃদ্ধ, বালক ও বনিতাসমভিব্যাহারে গমন করিতেছে। উহার অনুগামী যোধগণেরও তাদৃশ ক্ষমতা নাই। অতএব চল, আমরা উহাদিগকে আক্রমণ করিয়া উহাদের ধনরত্নসমুদায় অপহরণ করি।”
দস্যুগণকর্ত্তৃক দ্বারকারমণী-আক্রমণ
এইরূপ পরামর্শ করিয়া সেই দস্যুগণ লগুড়হস্তে সিংহনাদশব্দে দ্বারকাবাসী লোকদিগকে বিত্রাসিত করিয়া তথায় উপস্থিত হইল। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় অনুচরগণের সহিত তাহাদের অভিমুখীন হইয়া তাহাদিগকে কহিলেন, দস্যুগণ! যদি তোমাদিগের জীবিত থাকিবার বাসনা থাকে, তাহা হইলে অচিরাৎ প্রতিনিবৃত্ত হও, নচেৎ আমি নিশ্চয়ই শরনিকর দ্বারা তোমাদিগকে নিহত করিব। পাণ্ডুনন্দন এইরূপে তাহাদিগকে ভয়প্রদর্শন করিলেও তাহারা তাঁহার বাক্য অগ্রাহ্য করিয়া দ্বারকাবাসী লোকদিগকে আক্রমণ করিল।
রমণীগণের উদ্ধারে অর্জ্জুনের অসামর্থ্য
তখন মহাবীর
ধনঞ্জয় রোষভরে স্বীয় গাণ্ডীব শরাসনে জ্যারোপণ করিতে উদ্যত হইলেন, কিন্তু তৎকালে ঐ
কার্য্য তাঁহার নিতান্ত কষ্টকর বোধ হইতে লাগিল। পরিশেষে তিনি অতি কষ্টে সেই শরাসনে
জ্যারোপণ করিয়া দিব্যাস্ত্রসমুদায় চিন্তা করিতে লাগিলেন, কিন্তু ঐ সময় কোন ক্রমে
সেই অস্ত্রসমুদায় তাঁহার স্মৃতিপথে সমুদিত হইল না। তিনি স্বীয় ভুজবীর্য্যের হানি
ও দিব্যাস্ত্রসমুদায়ের অস্মরণনিবন্ধন নিতান্ত লজ্জিত হইলেন। ঐ সময়
বৃষ্ণিবংশীয়দিগের হস্তী, অশ্ব ও রথারোহী যোধগণও সেই দস্যুগণকে নিবারণ করিবার
নিমিত্ত বিশেষ যত্ন করিতে লাগিল, কিন্তু কোন ক্রমেই কৃতকার্য্য হইতে সমর্থ হইল না।
দস্যুগণ যে দিকে গমন করিতে লাগিল, মহাবীর অর্জ্জুন যত্ন পূর্ব্বক সেই দিক্ রক্ষা
করিতে আরম্ভ করিলেন। কিন্তু কিছুতেই তাহাদিগকে নিবারণ করিতে পারিলেন না।
অনন্তর দস্যুগণ সৈন্যগণের সমক্ষেই অবলাদিগকে অপহরণ করিতে লাগিল
এবং কোন কোন কামিনী ইচ্ছা পূর্ব্বক তাহাদিগের সহিত গমন করিতে আরম্ভ করিল। মহাত্মা
অর্জ্জুন তদ্দর্শনে নিতান্ত উদ্বিগ্ন বৃষ্ণিবংশীয়দিগের ভৃত্যগণের সহিত মিলিত হইয়া
তূণীর হইতে শরসমুদায় নিষ্কাশন পূর্ব্বক দস্যুগণের প্রতি নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন।
তখন তাঁহার অক্ষয় তূণীরের মধ্যস্থ বাণসমুদায়ও ক্ষণকালের মধ্যে ক্ষয়প্রাপ্ত হইল।
শরসমুদায় নিঃশেষ হইলে, পাণ্ডুনন্দন নিতান্ত দুঃখিত হইয়া শরাসনের অগ্রভাগ দ্বারা
দস্যুগণকে প্রহার করিতে লাগিলেন। কিন্তু কিছুতেই তাহাদিগকে নিরাকৃত করিতে পারিলেন
না। পরিশেষে সেই দস্যুগণ তাঁহার সম্মুখ হইতেই বৃষ্ণি ও অন্ধকদিগের অতি উৎকৃষ্ট
কামিনীগণকে অপহরণ করিয়া পলায়ন করিল। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় দিব্যাস্ত্র, ভুজবীর্য্য
ও তূণীরস্থ শরসমুদায়ের ক্ষয়নিবন্ধন নিতান্ত বিমনায়মান হইয়া দৈবদুর্ব্বিপাক
স্মরণপূর্ব্বক প্রতিনিবৃত্ত হইলেন।
বজ্রের হস্তে ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্যভার-অর্পণ
অনন্তর তিনি সেই হৃতাবশিষ্ট কামিনীগণ ও রত্নরাশি সমভিব্যাহারে কুরুক্ষেত্রে সমুপস্থিত হইয়া হার্দ্দিক্যতনয় ও ভোজকুলকামিনীগণকে মার্ত্তিকাবর্ত নগরে, অবশিষ্ট বালক, বৃদ্ধ ও বনিতাগণকে ইন্দ্রপ্রস্থে এবং সাত্যকিপুত্ত্রকে সরস্বতীনগরীতে সন্নিবেশিত করিলেন। ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্যভার কৃষ্ণের পৌত্ত্র বজ্রের প্রতি সমর্পিত হইল। ঐ সময় অক্রূরের পত্নীগণ প্রব্রজ্যাগ্রহণে উদ্যত হইলে, বজ্র বারংবার তাঁহাদিগকে নিষেধ করিতে লাগিলেন; কিন্তু কিছুতেই তাঁহারা প্রতিনিবৃত্ত হইলেন না। রুক্মিণী, গান্ধারী, শৈব্যা, হৈমবতী ও দেবী জাম্ববতী ইঁহারা সকলে হুতাশনে প্রবেশপূর্ব্বক প্রাণত্যাগ করিলেন। কৃষ্ণের অন্যান্য পত্নীগণ তপস্যা করিবার মানসে অরণ্যে প্রবিষ্ট হইয়া ফলমূল ভোজন পূর্ব্বক হিমালয় অতিক্রম করিয়া কলাপগ্রামে উপস্থিত হইলেন। অনন্তর মহাত্মা ধনঞ্জয় দ্বারকাবাসী লোকদিগকে যথোপযুক্ত স্থানবিভাগ প্রদান করিয়া বজ্রের হস্তে সমর্পণ করিলেন।