অগ্নি-বীণা
কাজীনজরুল ইসলাম

আগমনী


কি         রণ-বাজা বাজে ঘন ঘন-
ঝন           রনরন রন ঝনঝন!
সেকি         দমকি দমকি
                ধমকি ধমকি
দামা দ্রিমি দ্রিমি গমকি গমকি
                ওঠে চোটে, চোটে,
                ছোটে লোটে ফোটে!
বহ্নি-ফিনিক         চমকি         চমকি
                ঢাল-তলোয়ারে খনখন!
কি         রণ-বাজা বাজে ঘন ঘন-
               
ঝন           রনরন রন ঝনঝন!

হৈ             হৈ রব
            ভৈরব
হাঁকে         লাখে লাখে
ঝাঁকে         ঝাঁকে ঝাঁকে
লাল           গৈরিক-গায় সৈনিক ধায় তালে তালে
ওই            পালে পালে,
                        ধরা কাঁপে দাপে।
                জাঁকে   মহাকাল কাঁপে থরথর!
                রণে     কড়কড়কাড়া খাঁড়া-ঘাত,
শির           পিষে হাঁকে রথ-ঘর্ঘরধ্বনি ঘরঘর!
'গুরু          গরগর' বোলে ভেরি তূরী।
'হর           হরহর'
করি          চীৎকার ছোটে সুরাসুর-সেনা হনহন!
ওঠে         ন্‌ঝা ঝাপটি দাপটি সাপটি
               হু-হু- হু-হু-হু-হু শনশন!
ছোটে       সুরাসুর-সেনা হনহন।

তাতা        থৈ থৈ খল খল খল
নাচে         রণ-রঙ্গিণী সঙ্গিনী সাথে,
               ধকধক জ্বলে জ্বলজ্বল!
বুকে         মুখে চোখে রোষ-হুতাশন!
               রোস কথা শোন!

           ডম্বরু-ঢোলে ডিমিডিমি বোলে,
               ব্যোম মরুৎ স-অম্বর দোলে,
               ম-বরুণ কী কল-কল্লোলে চলে উতরোলে
               ধ্বংসে মাতিয়া         তাথিয়া তাথিয়া
               নাচিয়া রঙ্গে, চরণ ভঙ্গে
               সৃষ্টি সে টলে টলমল!
ওকি        বিজয়ধ্বনি সিন্ধু গরজে কলকল কল কলকল!
            ওঠে     কোলাহল
            কূট      হলাহল
            ছোটে   মন্থনে পুন রক্ত-উদধি
                       ফেনাবিষ ক্ষরে গলগল!
টলে      নির্বিকার সে বিধাত্রীরও গো
            সিংহ-আসন টলমল!
কার      আকাশ-জোড়া ও আনত নয়ানে
            করুণা-অশ্রু ছলছল!

বাজে     মৃত-সুরাসুর-পাঁজরে ঝাঁঝর ঝমঝম,
নাচে     ধূর্জটি সাথে প্রমথ ববম বমবম!
লাল     লালে লাল ওড়ে ঈশানে নিশান যুদ্ধের,
ওঠে     ওংকার,     রণ-ডঙ্কার,
নাদে     ওম্ ওম্ মহাশঙ্খ-বিষাণ রুদ্রের।
            ছোটে         রক্ত ফোয়ারা বহ্নির বান রে!
            কোটি         বীরপ্রাণ
            ক্ষণে           নির্বাণ
তবু        শত সূর্যের জ্বালাময় রোষ
                        গমকে শিরায় গমগম।
ভয়ে       রক্ত-পাগল প্রেত-পিশাচেরও
                        শিরদাঁড়া করে চনচন !
যত         ডাকিনী-যোগিনী বিস্ময়াহতা,
                        নিশীথিনী ভয়ে থমথম।
বাজে     মৃত সুরাসুর-পাঁজরে ঝাঁঝর ঝমঝম!

ঐ         অসুর-পশুর মিথ্যা দৈত্য-সেনা যত
হত        আহত করে রে দেব সত্য।
            স্বর্গ. মর্ত, পাতাল, মাতাল রক্ত সুরায়;
                    ত্রস্ত বিধাতা
মস্ত পাগলো পিনাক-পাণি স-ত্রিশূল প্রলয়-হস্ত ঘুরায়!
                                    ক্ষিপ্ত সবাই রক্ত-সুরায় !

            চিতার উপরে চিতা সারি সারি,
                            চারিপাশে তারি
            ডাকে কুক্কুর গৃধিনী শৃগাল!
            প্রলয়-দোলায় দুলিছে ত্রিকাল!
            প্রলয়-দোলায় দুলিছে ত্রিকাল!!

আজ     রণ-রঙ্গিণী জগতমাতার দেখ্‌ মহারণ,
            দশদিকে তাঁর দশ হাতে বাজে দশ প্রহরণ !
                        পদতলে লুটে মহিষাসূর,
            মহামাতা এ সিংহ-বাহিনী জানায় আজিকে বিম্ববাসীকে-
            শাশ্বত নহে দানব-শক্তি, পায়ে পিষে যায় শির পশুর !

                        নাই দানব
                        নাই অসুর-
                        চাইনে সুর,
                        চাই মানব!'
                    বরাভয়-বাণী এ রে কার
                    শুনি, নহে হৈ রৈ এবার!

                        ওঠ রে ওঠ্,
                        ছোট্‌রে ছোট্!
                        শান্ত মন,
                        ক্ষান্ত রণ!-

                        খোল্‌ তোরণ,
                        চল্ বরণ কর্‌ব মা'য়
                        ডর্‌ব কায়?
                ধরব পা'য় কার্‌ সে আর,
                বিশ্ব-মা'ই পার্শ্বে যার?
আজ    আকাশ-ডোবানো নেহারি তাঁহারি চাওয়া,
ঐ        শেফালিকা-তলে কে বালিকা চলে?
           কেশের গন্ধ আনিছে আশিন-হাওয়া!
           এসেছে রে সাথে উৎপলাক্ষী চপলা কুমারী কমলা ঐ,
                    সরসিজ-নিভ শুভ্র বালিকা
           এল             বীণা-পাণি অমলা ঐ!

                        এসেছে গণেশ,
                        এসেছে মহেশ, বাস্‌রে বাস্‌!
                        জোর উছাস্!!
            এল সুন্দর সুর-সেনাপতি,
            সব মুখ এ যে চেনা-চেনা অতি!
            বাস্‌ রে বাস্‌     জোর উছাস্!!

            হিমালয়! জাগো ! ওঠো আজি,
                        তব সীমা লয় হোক।
            ভুলে যাও শোক-_চোখে জল ব'ক
            শান্তির-আজি শাস্তি-নিলয় এ আলয় হোক !
                    ঘরে ঘরে আজি দীপ জ্বলুক!
                    মা'র আবাহন-গীত্‌ চলুক!
                        দীপ জ্বলুক!
                        গীত চলুক! !
আজ     কাঁপুক মানব-কলকল্লোলে কিশলয় সম নিখিল ব্যোম্‌!
                        স্বা-গতম্‌!
                        স্বা-গতম্!!
                        মা-তরম্‌!
                        মা-তরম্!!
ঐ ঐ ঐ     বিশ্ব কণ্ঠ
বন্দনা-বাণী লুণ্ঠ_বন্দে মাতরম্‌!!!'


রচনা ও প্রকাশকাল:
উপাসনা পত্রিকার 'আশ্বিন ১৩২৮' সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল  ধূমকেতু পত্রিকার প্রথম বর্ষ। দ্বাদশ সংখ্যা ৯ আশ্বিন ১৩২৯, মঙ্গলবার ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২] কবিতাটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল।