অগ্নি-বীণা
কাজীনজরুল ইসলাম
অগ্নি-বীণা
কামাল পাশা
[তখন শরৎ-সন্ধ্যা। আস্মানের আঙিনা তখন কার্বালা ময়দানের মতো খুনখারাবির রঙে রঙিন। সেদিনকার মহা-আহবে গ্রীক-সৈন্য সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হইহা গিয়াছে। তাহাদের অধিকাংশ সৈন্যই রণস্থলে হত অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। বাকি সব প্রাণপণে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিতেছে। তুরস্কের জাতীয় সৈন্যদলের কাণ্ডারী বিশ্বত্রাস মহাবাহু কামাল-পাশা মহাহর্ষে রণস্থল হইতে তাম্বুতে ফিরিতেছেন। বিজয়োন্মত্ত সৈন্যদল মহাকল্লোলে অম্বর-ধরণী কাঁপাইয়া তুলিতেছে। তাহাদের প্রত্যেকের বুকে পিঠে দুই জন করিয়া নিহত বা আহত সৈন্য বাঁধা। যাহারা ফিরিতেছে তাহাদেরও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গোলাগুলির আঘাতে, বেয়নটের খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত, পোষাক-পরিচ্ছদ ছিন্নভিন্ন, পা হইতে মাথা পর্যন্ত রক্তরঞ্জিত। তাহাদের কিন্তু সে দিকে ভ্রূক্ষেপও নাই। উদ্দাম বিজয়োন্মাদনার নেশায় মৃত্যু-কাতর রণক্লান্তি ভুলিয়া গিয়া তাহারা যেন খেপিয়া উঠিয়াছে। ভাঙা সঙ্গীনের আগায় রক্ত-ফেজ উড়াইয়া ভাঙা-খাটিয়া-আদি-দ্বারা-নির্মিত এক অভিনব চৌদলে কামালকে বসাইয়া বিষম হল্লা করিতে করিতে তাহারা মার্চ করিতেছে। ভূমিকম্পের সময় সাগর কল্লোলের মতো তাহাদের বিপুল বিজয়ধ্বনি আকাশে-বাতাসে যেন কেমন একটা ভীতি-কম্পনের সৃজন করিতেছে। বহু দূর হইতে সে রণ-তাণ্ডব নৃত্যের ও প্রবল ভেরী-তূরীর ঘন রোল শোনা যাইতেছে। অত্যধিক আনন্দে অনেকেরই ঘন ঘন রোমাঞ্চ হইতেছিল। অনেকেরই চোখ দিয়া অশ্রু গড়াইয়া পড়িতেছিল।]
[সৈন্য-বাহিনী দাঁড়াইয়া। হাবিলদার-মেজর তাহাদের মার্চ করাইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছিল। বিজয়োন্মত্ত সৈন্যগণ গাইতেছিল,–]
ঐ খেপেছে পাগ্লি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই, [হাবিলদার-মাজর মার্চের হুকুম করিল,-কুইক্ মার্চ!]
লেফ্ট! রাইট! লেফ্ট!!
[সৈন্যগণ গাহিতে গাহিতে মার্চ করিতে লাগিল] [হাবিলদার-মেজর;- লেফ্ট্! রাইট!]
সাব্বাস্ ভাই! সাব্বাস্ দিই, সাব্বাস্ তোর শম্শেরে। [লেফট্! রাইট! লেফ্ট্!]
খুব কিয়া ভাই খুব কিয়া! [হাবিলদার-মেজর;- সাবাস সিপাই! লেফ্ট্! রাইট্! লেফ্ট!]
শির হতে এই পাঁও-তক্ ভাই লাল-লালে-লাল খুন মেখে [লেফট্! রাইট! লেফ্ট্]
হিংসুটে ঐ জীবগুলো ভাই নাম ডুবালে সৈনিকের,
[হাবিলদার মেজর: রাইট্ হুইল্! লেফ্ট্ রাইট্! লেফ্ট্!
আজাদ মানুষ বন্দী করে, অধীন করে স্বাধীন দেশ,
[হাবিলদার-মেজর-সাবাস সিপাই! লেফ্ট্ রাইট্! লেফ্ট্!
ঐ খেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই! হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!
[হাবিলদার-মেজর;- লেফ্ট্ হুইল্! য়্যাজ্ য়ু ওয়্যার্!-
রাইট হুইল!–
দেখ্চ কি দোস্ত অমন করে? হৌ হৌ হৌ!
[হাবিলদার-মেজর-সাবাস সিপাই! লেফ্ট্! রাইট্! লেফ্ট্!]
আহা কচি ভাইরা আমার রে! [সাম্নে উপত্যকা। হাবিলদার মেজর :– লেফ্ট্ ফর্ম! সৈন্য- বাহিনীর মুখ হঠাৎ বামদিকে ফিরিয়া গেল! হাবিলদার মেজর :-ফর্ওয়ার্ড ! লেফ্ট্ ! রাইট্ ! লেফ্ট্ !]
আস্মানের ঐ আঙরাখা [সাম্নে উপত্যকা– হঠাৎ যেন পথ হারাইয়া ফেলিয়াছে। হাবিলদার-মেজর পথ খুঁজিতে লাগিল। হুকুম দিয়া গেল– 'মার্ক্ টাইম্।' সৈন্যরা এক স্থানেই দাঁড়াইয়া পা আছড়াইতে লাগিল–]
দ্রাম্! দ্রাম্! দ্রাম!
[হাবিলদার-মেজর পথ খুঁজিয়া ফিরিয়া অর্ডার দিল-ফর্ওয়ার্ড! লেফ্ট্
হুইল্–
সাচ্চা ছিল সৈন্য যারা শহীদ হলো মরে। [বলিয়াই কটিদেশ হইতে ছোরা খুলিয়া হাতের রক্ত লইয়া দেখাইল]
ত্রঁরাই বলেন হবেন রাজা! [হাবিলদার মেজর;- সাবাস সিপাই!]
এই তো চাই! এই তো চাই!
[কতকগুলি লোক অশ্রুপূর্ণ নয়নে এই দৃশ্য দেখিবার জন্য ছুটিয়া আসিতেছিল।
মার্ দিয়া ভাই মার্ দিয়া! [হাবিলদার-মেজর;-সাবাস জোয়ান! লেফ্ট্! রাইট্!]
জোর্সে চলো পা মিলিয়ে,
ঐ খেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই, |
[সৈন্যদল এক নগরের পার্শ্ব দিয়া চলিতে লাগিল। নগর-বাসিনীরা ঝরকা হইতে মুখ বাড়াইয়া এই মহান দৃশ্য দেখিতেছিল; তাহদের চোখ-মুখ আনন্দাশ্রুতে আপ্লুত। আজ বধূর মুখের বোরকা খসিয়া পড়িয়াছে। ফুল ছড়াইয়া হাত দুলাইয়া তাহারা বিজয়ী বীরদের অভ্যর্থনা করিতেছিল। সৈন্যগণ চীৎকার করিয়া উঠিল।]
ঐ শুনেছিস্? ঝর্কাতে সব বল্ছে ডেকে বৌ-দলে, [হাবিলদার-মেজর:- লেফ্ট্ ফর্ম্! লেফ্ট্! রাইট! লেফ্ট্!-ফরওয়ার্ড্!] |
[বাহিনীর মুখ হঠাৎ বামদিকে ফিরিয়া গেল। পার্শ্বেই পরিখার সারি। পরিখা-ভর্তি নিহত সৈন্যের দল পচিতেছে এবং কতকগুলি অ-সামরিক নগরবাসী তাহা ডিঙাইয়া ডিঙাইয়া চলিতেছে।]
ইস্! দেখেছিস! ঐ কারা ভাই সাম্লে চলেন পা, |
[সম্মুখে সঙ্কীর্ণ ভগ্ন সেতু। হাবিলদার-মেজর অর্ডার দিল-'ফর্ম্ ইন্টু সিঙ্গল্ লাইন'। এক একজন করিয়া বুকের পিঠের নিহত ও আহত ভাইদের চাপিয়া ধরিয়া অতি সন্তর্পণে 'স্লো মার্চ' করিয়া পার হইতে লাগিল।]
সত্যি কিন্তু ভাই!
হতভাগা রে! |
[নিহত সৈন্যদের নামাইয়া রাখিয়া দিয়া সেতু পার হইয়া আবার জোরে মার্চ করিতে করিতে তাহাদের রক্ত গরম হইয়া উঠিল।]
ঠিক বলেছ দোস্ত তুমি! |
[এইবার তাহাদের তাম্বু দেখা গেল। মহাবীর আনোয়ার পাশা বহু সৈন্যসামন্ত ও সৈনিকদের আত্মীয়-স্বজন লইয়া বিজয়ী বীরদের অভ্যর্থনা করিতে আসিতেছেন দেখিয়া সৈন্যগণ আনন্দে আত্মহারা হইয়া 'ডবল মার্চ' করিতে লাগিল]
হুর্রো হো!
[কামাল পাশাকে কোলে করিয়া নাচিতে লাগিল]
কে ভাই? হাঁ হাঁ, সালাম! [সেনাপতির অর্ডার আসিল]
'সাবাস! থামো! হো! হো! |
[এক নিমিষে সমস্ত কল-রোল নিস্তব্ধ হইয়া গেল। তখনো কি তারায় তারায় যেন ঐ বিজয় গীতির হারা-সুর বাজিয়া বাজিয়া ক্রমে ক্ষীণ হইতে ক্ষীণ হইয়া মিলিয়া গেল–]
ঐ খেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই! |
রচনা ও প্রকাশকাল:
উপাসনা পত্রিকার 'আশ্বিন ১৩২৮'
সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। ধূমকেতু
পত্রিকার [২৬ ভাদ্র ১৩২৯, মঙ্গলবার ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২২]
সংখ্যায় কবিতাটির অংশবিশেষ ছাপা হয়েছিল।