আগুন যেমন ধাতুকে খাঁটি করে; দুঃখ তেমনি আত্মাকে একেবারে আয়নার
মতো সাফ করে দেয়। কিন্তু তাই বলে মনের সব কষ্টই দুঃখ নামে অভিহিত হতে পারে
না। মোটামুটি দেখতে গেলে দুঃখ দু'রকমের। একটি হচ্ছে নিজের কষ্টের জন্য দুঃখ
পাওয়া, অন্যটি হচ্ছে, অন্যের কষ্টে দুঃখ অনুভব করা। এই দুই দুঃখই কষ্ট দেয়;
কিন্তু তারা একরকমের নয়।
আমি হয়তো আমার প্রিয়তম জিনিসটাকে হারিয়েছি, কিংবা আমি যা চাই তা
পাই না, এইরকম সবের জন্যে যে কষ্ট পাওয়া, সেই হচ্ছে নিজের জন্যে দুঃখ। এর
ফল, আত্মাভিমান এবং আত্মসুখের বৃদ্ধি। অন্যের দুঃখ দেখে নিজের দুঃখ মনে পড়া
আর তার প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হওয়া, ক্রমে নিজের কষ্টকে তুচ্ছ করে এই পরের
কষ্টটাকে বড় করে দেখা, এইসব মহৎ অনুভবের ফল হচ্ছে আত্মার, প্রাণের প্রসারতা লাভ। একদিন এক বিধবা
তার মরা ছেলেকে বুকে নিয়ে গৌতম বুদ্ধের কাছে কেঁদে
পড়ল যে তার ঐ একমাত্র মৃত পুত্রকে বাঁচিয়ে দিতে হবে। বুদ্ধদেব বললেন,-দুঃখ নেই
শিক নেই- এমন কোনো ঘর হতে কয়েকটি বিল্বপত্র যদি এনে দিতে পারো
তাহলে তোমার ছেলেকে, বাঁচিয়ে দেবো। 'বিধবা অনেক, খুঁজেও দুঃখ-শোকের ছোঁয়া
লাগেনি এমন কোনো,.ঘর দেখতে পেল না। তাই তিন-দিন পরে যখন এই পুত্রহারা
জননী ফিরে এল, তখন সে বিশ্বের দুঃখ-কষ্টের মাঝে নিজের দুঃখের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে, আর তার
ঐ সসীম বুকেই অসীমের বীণের গুমরে-ওঠা বেদনার নিবিড় শাস্তি নেমে এসেছে! সে তখন আর
নিজের সন্তানের জন্য দুঃখ করছে না; তার মাতৃস্নেহ সারা
বিশ্বে তখন ছড়িয়ে পড়েছে।
অন্যের দুঃখ-বেদনা অনুভব করাই হচ্ছে মহত্তর ব্যথার অনুভব। কেননা ব্যথার ব্যথীর এ
ব্যথায় কোনো উদ্দেশ্য বা স্বার্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। তার কারণ, এ হচ্ছে সেই ব্যথা, যার অনুভব হয় নিজের বুকের বেদনা মনে পড়ে আত্মার, ধর্ম এমনি
বিস্ময়কর যে, এই পরের ব্যথায় ব্যথিত হওয়াতেও সে এমন.একটি নিবিড় আনন্দের
আভাস পায়, যেন রক্তমর্মর বুকে বর্নাধারার একটি স্নিগ্ধ দীঘল রখা।
এ সেই দুঃখ যা পয়গম্বরগণ বিশ্বমানবের অন্তরে অন্তর মিশিয়ে অনুভব
করেছিলেন। এর বেদনা -এর আনন্দ প্রকাশের ভাষা নেই। এ-ই হচ্ছে সেই সাধনা, যা
মানুষকে দেবত্বে উন্নীত করে। এই বেদনার গভীর আন্তরিকতাতেই ত্যাগের নির্বিকার
প্রশান্তি, এই চির-ব্যথার বনেই আনন্দ-স্পর্শমণি খুঁজে পাওয়া যায়।
সকলেই এ অমৃতময় দুঃখ অনুভব করতে পারে না। মহত্তর আত্মা যাঁদের,
ভুক্তভোগী যাঁরা, শুধু তাঁরাই এ হেয়ালির মর্ম বোঝেন। এ চায় কল্পনা আর মানব-মনের
বিস্ময়কর বোধশক্তি। তাই এ পথের ভাগ্যবান পথিক তাঁরাই যাদের হাতে গভীর জ্ঞান আর উঁচু
প্রাণের পাথেয় আছে।
অনেক রকমের দুঃখ-কষ্ট আমাদের ঘিরে রয়েছে এবং তার অনেকগুলিরই
প্রতিকার অসম্ভব। যখন আমরা আপন বুকের বেদন দিয়ে সারা বিশ্বের ব্যথা
নিজের
করে নিতে পারি, কেবল তখনই আমাদের আত্মা উন্নত প্রসারিত হয়। তখনই আমরা
সত্যকে চিনি, সুন্দরকে উপলব্ধি করি -আর তাই তখন আমাদের আনন্দ ত্যাগে, পরের
জন্যে কেঁদে, বিশ্বের ব্যথিতের জন্য জান কোরবান করে।"
বঙ্গীয় মুসলমান
সাহিত্য পত্রিকার বৈশাখ ১৩২৭ সংখ্যায় তিনটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। নজরুল এই
পত্রিকার জন্য 'ইংলিশম্যান; পত্রিকার ম্যাগাজিন সেকশান থেকে এই নিবন্ধটি অনুবাদ
করেছিলেন।