খোকা-খুকিদের হাঁটতে দেখা বাপ-মায়ের বড্ডো বেশি আনন্দদায়ক। তাই তাঁরা যত
শিগগির পারেন খোকা-খুকিদের হাঁটা শেখাবার জন্যে যেন উঠে-পড়ে লেগে যান; আমি
অনেক ঘরে দেখেছি যে, ছেলের মা তার প্রতিভূ স্বরূপ অন্য দুটি ছেলের দ্বারা তাঁর
খোকাকে হাঁটা শেখাবার ভার দিয়েছেন; আর ছেলে দুটিও খোকার দু ডানায় ধরে টেনে-
হিঁচড়ে তাকে একরকম হাওয়ার মতোই বেগে চালাতে চেষ্টা করছে: শিশুর এতে ঘোর কষ্টকর আপত্তি থাকলেও তারা তা গ্রাহ্য না করে দস্তুরমতো নিজেদের কর্তব্য করে
যায়। এ যেন ঠিক সেই কাহিনীর 'হালালজাদা-হারামজাদার' মতো আর কি? কিন্তু এ
রকম 'ধরপাকড়কে আল্লাহু আকবর" এর ফল যে কত খারাপ, তাই বলছি। প্রথমেই
তো স্বভাবের বিরুদ্ধে এরকম ধস্তাধস্তি করাই আমাদের জবর ভুল। কেননা, দেখবেন- যে-ই শিশুদের পায়ের মাংসপেশি ভর করে দাঁড়াবার বা চলবার মতো শক্ত হয়েছে, অমনি তারা নিজে নিজেই দাঁড়াতে এবং ক্রমে হাঁটতে চেষ্টা করবে। এ সময়ে বরং
বেচারাদের একটু সাহায্য করতে পারেন, কিন্তু বস্তুত এসবেরও কোনো দরকার নেই।
প্রথমে শিশুরা আপনি কোনো জিনিস ধরে দাঁড়াবে, তারপর 'চলি চলি পা পা' করে
বাঁকাভাবে একটির পর একটি পা ফেলবে। (এ চলা যেন অনেকটা পল্টনের সিপাহিদের স্লো মার্চের মতো।) ক্যাঁকড়ার মতো এ চলার বিকৃতি ক্রমে আপনি শুধরে যাবে। তবে
ছেলের মাদের এইটুকু লক্ষ্য রাখা উচিত যে দুষ্টু ছেলে যেন পড়ে না যায় বা কোনো
আঘাত না পায়। শিশুদের ভর করে দাঁড়াবার জন্যে আজকাল একরকম 'স্ট্যান্ড'
বেরিয়েছে -দেখতে অনেকটা মাছধরা 'পলুই;এর মতো। এই ক্ষুদ্র জীবগুলির পক্ষে তা
খুব উপকারী আর দরকারি! কেননা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লে এরা ওর ভেতরে
বেশ বাবুর মতো বসে আরাম করতেও পারে, আবার যখন ইচ্ছা হবে তখনই উঠে
হাঁটতেও পারে। অনেক সময় বাপ-মায়ে বুঝতে পারে না ছেলে কখন ক্লান্ত হয়ে
পড়েছে, আর এতেই শিশুদের সমূহ ক্ষতি হয়। অনেক ছেলে-মেয়ের পা ধনুর মতো
বাঁকা হতে দেখেছি, আর এ হয় মা-বাপেরই দোষে। কারণ, ছেলে-মেয়ের হাঁটবার
ক্ষমতা হবার আগেই তাঁরা জোর করে তাদের হাঁটাতে শেখাবেন। কী জুলুম ! ধরুন, যদি
শিশুদের পায়ের হাড় আর মাংশপেশি দেহের ভার সইবার মতো শক্ত না হয়, তাহলে
তাদের জোর করে দাঁড় করাতে গেলে বা হাঁটাতে গেলে তাদের কচি হাড় বেঁকে যাবে না
কি? স্নেহের এরকম জবরদস্তির গজবে পড়ে অনেক বেচারার পা জন্মের মতো ব্যাঁকা
হয়ে যায়! এমন অনেক শিশু দেখা যায়, যাদের হাঁটতে সাধারণের চেয়ে একটু বেশি
সময় লাগে। তাই বলে তাদিগে জলদি হাঁটা শেখাবার জন্যে যে কুস্তাকুস্তি করতে হবে,
এর কোনো মানে নেই। যখন উপযুক্ত হবে, তখন সে আপনিই হাঁটবে। এসব তার
প্রকৃতি-মায়ের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। কারণ, তার বড় সুদক্ষ ধাত্রী আর ছেলেদের
নেই। আর যদি নিতান্তই কোনো শিশুর হাটতে বড্ডো বেশি দেরি লাগে, তাহলে কোনো ভালো ভাক্তারকে দেখাবেন।
কেননা খুব সম্ভব শিশুদের খাবারের মধ্যে মাংসপেশির আর
হাড়ের শক্ত হওয়ার জন্যে যে রকম সারবান জিনিসের দরকার হয়তো আপনার বয়াদ্দ
খাবারে তা থাকে না। অতএব দু-তিন মাস দেরি হলে তাকে জোরজবরদস্তি করে
হাঁটবার কোনো দরকার নেই। যখন জন্মেছে, তখন প্রকৃতি তাকে হাঁটাবেই। মনে
রাখবেন, প্রকৃতি আপনাদের মাদের চেয়ে কম স্রেহময়ী নয়।
বঙ্গীয় মুসলমান
সাহিত্য পত্রিকার বৈশাখ ১৩২৭ সংখ্যায় তিনটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। নজরুল এই
পত্রিকার জন্য 'ইংলিশম্যান; পত্রিকার ম্যাগাজিন সেকশান থেকে এই নিবন্ধটি অনুবাদ
করেছিলেন।