অগ্রন্থিত প্রবন্ধ
নজরুল ইসলাম, কাজী


মুসলিম সংস্কৃতি-চর্চা

[১৯২৯ খিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম এডুকেশন সোসাইটির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে অনুষ্ঠানের সভাপতি কবি কাজী
নজরুল ইসলাম এই অভিভাষণ প্রদান করেন ]
 

আজ আপনাদের কাছে দাঁড়িয়ে সবচেয়ে আগে মনে হচ্ছে কবির একটা লাইন,- “ঝড় আসে নিমিষের ভুল!' সেদিনের পশ্চিমে-ঝড় যখন এসেছিল বদ্ধ দ্বারের জিঞ্জিরে নাড়া দিতে, সেদিন যখন সে বহিরাঙ্গনে দাঁড়িয়ে গেয়েছিল-

                    ‌'কারাগারে দ্বারী গেলে
                    তখনি কি মুক্তি মেলে?
                    আপনি তুমি ভেতর থেকে
                    চেপে আছ কোনখানে।'

তখন আপনারা তাঁকে বরণ করেছিলেন খাঞ্চা-ভরা সওগাত, রেকাবি-ভরা শিরনি কাঁটা ঢাকা পড়ে গেছিল। আপনাদের শিরোপার ভারে তার শির সেদিন আপনি নুয়ে পড়েছিল। সে-র শুধু যে তার সশ্রদ্ধ সালাম নিবেদন করা ছাড়া প্রতিদানে কিছুই দিয়ে যেতে পারেনি।

আজ সে আবার এসেছে সেই পরিচিত দুয়ারে ফুলরে লোভে নয়, মালার আশায় নয়, তার সুরণতীর্থ জিয়ারত করতে। সেবারে সে বলেছিল-
                খুলব দুয়ার মত্ত বলে,
                তোদের বুকের পাষাণ-তলে
                বন্দিনী যে ঝর্নাধারা
                                মুক্তি দেবো মুক্তি তায়।
                হারিয়ে গেছে দোরের চাবি,
                তাই কেঁদে কি লোক হাসাবি?
                আঘাত হেনে খুলব দুয়ার,
                                আয় যাবি কে সঙ্গে আয়।
                দ্বারের মায়া করে তোরা
                বন্দি রবি নিজ কারায়?
                নাই কো চাবি, হাত আছে তোর,
                                খুলব দুয়ার তার সে ঘায়।

    সেই ঝড় আবার এসেছে- হয়তো বা তেমনি নিমেষের ভুলেই। এবার সেই ঝোড়ো হাওয়া 'পুবের হাওয়া" হয়ে। তার রূপ সুর দুই-ই হয়তো বদলে গেছে। আজ হয়তো সে বলতে চায়-
                “ঘা দিয়ে দ্বার খুলব না গো
                গান গেয়ে দ্বার খোলাবো।'

    সেবার যে এসেছিল তরবারির বোঝা নিয়ে, এবার সে এসেছে ফুল ফোটানোর মন্ত্র শিখে।
    এমনই হয়। ফালগুনের মলয়-সমীর বৈশাখে দেখা দেয় কালবৈশাখী-রূপে, শ্রাবণে সে-ই আসে পুবের হাওয়া হয়ে। হৈমস্তীর আঁচল ভরে ওঠে তারি শিশিরাশ্রুতে, আঁচল দুলে ওঠে তারই হিমেল হাওয়ায়। পউষে তারি দীর্ঘশ্বাস পাতা ঝারায়।
                                            *              *           *
    ফুল ফোটানোই আমার ধর্ম। তরবারি হয়তো আমার হাতে বোঝা, কিন্তু তাই বলে তাকে আমি ফেলেও দেইনি। আমি গোধূলি বেলায় রাখাল ছেলের সাথে বাঁশি বাজাই, ফজরে মুয়াজ্জিনের সুরে সুর মিলিয়ে আজান দেই, আবার দীপ্ত মধ্যাহ্নে খর তরবার নিয়ে রণভূমে ঝাঁপিয়ে পড়ি। তখন আমার খেলার বাঁশি হয়ে ওঠে যুদ্ধের বিষাণ, রণশিঙ্গা।

    সুর আমার সুন্দরের জন্য, আর তরবারি সুন্দরের অবমাননা করে যে- সেই অসুরের জন্য।
    কিন্তু কিছু বলবার আগে আমি স্মরণ করি সেই বিরাট পুরুষকে যার কীর্তি শুধু তাঁকে মহিমান্বিত করেনি, আপনাদের চট্টলবাসী মুসলমানদের- তথা বাংলার সারা মুসলিম সমাজকে নর-নারী-নিবিশেষে মহিমান্বিত করেছে। তিনি আপনাদেরই এবং আমাদেরও পুণ্যশ্লোক মরহুম খানবাহাদুর আবদুল আজিজ সাহেব। শাহজাহানের তাজমহল গড়ে উঠেছিল শুধু মমতাজের ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে- তাজমহল সুন্দর। কিন্তু এই আত্মুভোলা পুরুষের তাজমহল গড়ে উঠেছে সকল কালের সকল মানুষের বেদনাকে কেন্দ্র করে। এ তাজমহল শুধু
beautiful  নয়, এ sublime মহিমাময় !

    ব্যক্তিগত জীবনে আমি তাঁকে জানবার সুবিধা পাইনি। চাঁদ দেখিনি, কিন্তু সমুদ্রের জোয়ার দেখেছি। জোয়ার শুধু পূর্ণিমার চাঁদই জাগায় না, মৃত্যুর অমাবস্যার অন্তরালে ঢাকা পড়ে যে চাঁদ- সেও জোয়ার জাগায়। তাঁকে দেখিনি কিন্তু তাকে অনুভব করেছি এবং আজো করছি আপনাদের জাগরণের মাঝে- আমাদের নারী-জাগরণের উদয়-বেলায়।
    এমনি করে এক একটা সর্বভোলা সর্ত্যাগী মানুষ আসে আমাদের মাঝে। আমাদের স্বার্থের কালো চশমা দিয়ে তখন তাঁকে দেখি মলিন করে, তাঁকে বলি, হয় পাগল নয় স্বার্থপর। কোকিল যখন আসে বাগে বাহারের খোশ-খবরি নিয়ে, কর্তব্যপরায়ণ কাক তখন দল বেঁধে তাকে তাড়া করে। তার গানকে তারা মনে করে উৎপাত। অভিমানী কোকিল বসন্ত শেষে উড়ে যায় নতুন বুলবুলিস্তানের সন্ধানে, তখন সারা কানন জুড়ে জাগে বিরাট একটা অভাববোধ, পেয়ে হারানোর তীব্র বেদনা।
    পাখি উড়ে যায়- তারপর আসে সেই সুদিন যার আগমনী গান সে গেয়েছিল। তখন সেই সুদিনের সুন্দর আলোকে সুরণ করি সেই সকলের-আগে-জাগা গানের পাখিকে। কিন্তু পাখি তখন থাকে না কো, থাকে পাখির স্বর।
    আমি তাঁরই মতো গানের পাখি- আপনাদের এই স্মুরণ-বেলায় আমিও এসেছি তাই তীর্থযাত্রী হয়ে তাঁকেই স্মরণ করতে- যিনি আমাদের বহু আগে জেগেছিলেন। তাঁর পাক কদমে আমার হাজার সালাম।
    তিনি আজ আমার সালাম নিবেদনের বহু ঊর্ধে, বহু দূরে; তবু এ ভরসা রাখি যে আমার এই অকুলে ভাসিয়ে দেওয়া ফুল তাঁর চরণ ছুঁয়ে ধন্য হবেই। আমি জানি, এ বিশ্বে কোনো কিছুই নশ্বর নয়, কোনো কিছুই হারায় না কোনোদিন। যে-রূপে যে-লোকেই হোক তিনি আছেন এবং আমার এই ভাসিয়ে দেওয়া সালামি-ফুলও সেই না জানার অকুলে কুল পাবেই পাবে।
    আমরা বড় কাউকে যখন হারাই, তখন তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করি-তাঁর সৃষ্টিকে তাঁর সাধনাকে শ্রদ্ধা করে, তাঁকে বাঁচিয়ে রেখে। যে বিরাট আত্মার নৈকট্য থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি, তার দুঃখ বহু পরিমাণে ভুলতে পারব, যদি তারই অসমাপ্ত সাধনাকে আমাদের সাধনা বলে গ্রহণ করতে পারি। চট্টলের “আজিজ” নাই, কিন্তু বাংলার আজিজরা- দুলাল ছেলেরা আজো বেঁচে আছে- তাদেরই মধ্যে তাঁকে ফিরে পাব
পরিপূর্ণরূপে, এই হোক আপনাদের- এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের সাধনা ! এর চেয়ে বড় প্রার্থনা আমার নেই।
    তাঁর কাজ তিনি করে গেছেন। তীর 'বাহারে'র মতো বাহার হয়তো বা থাকতেও পারে, কিন্তু তার “নাহারে'র মতো নাহার আপনাদের চট্টলের মুসলমানের ঘরে কয়টি আছে আমার জানা নেই।
    তিনি সুর ধরিয়ে দিয়ে গেছেন, এখন একে 'সমে' পৌছে দেওয়া আপনাদের কাজ। উত্তাদ নেই, শিষ্যরা তো আছেন। একজন উস্তাদের অভাব কি শত শিষ্যেও পূরণ করতে পারবে না?
    বন্ধুবান্ধব অনেকের কাছেই শুনেছি আপনাদের উস্তাদের লক্ষ্য ছিল অসীম, আশা ছিল বিপুল, আকাঙ্ক্ষা ছিল বিরাট।।
    সাগর যাদের চরণ ধোয়ায়, পর্বতমালা যাদের শিয়রের বিনিদ প্রহরী, নদী-নি্করিণী যাদের সেবিকা, অগ্নিগিরি যাদের বুকের ওপর, উচ্ছল জলপ্রপাত যাদের অবিনাশী প্রাণধারা, কানন-কুঞ্জ যাদের শ্রী-নিকেতন, বন্য-হিংস্র শার্দুল-সর্প যাদের নিত্য সহচর, তারা সেই মহান পুরুষের বিরাট দায়িত্বকে গ্রহণ করতে ভয় করে একথা আর যে বলে বলুক, আমি বলব না।
    অপনাদের শিক্ষা-সমিতিতে এসেছি আমি আর একটি উদ্দেশ্য নিয়ে। সে হচ্ছে, আপনাদের সমিতির মারফতে বাংলার সমগ্র মুসলিম সমাজের বিশেষ করে ধনী ও শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কাছে,- আমি যে মহান স্বপ্ন দিবা-রাত্রি ধরে দেখছি,- তা-ই বলে যাওয়া। এ স্বপ্ন যে একা আমারই তা নয়। এই স্বপ্ন বাংলার তরুণ মুসলিমের, প্রবুদ্ধ ভারতের, এ স্বপ্ন বিংশ শতাব্দীর নব-নবীনের। আমি চাই, আপনাদের এই পার্বত্য উপত্যকায় সে স্বপ্ন রূপ ধরে উঠুক।
    আমি চাই, এই পর্বতের বিবর থেকে বেরিয়ে আসুক তাজা তরুণ মুসলিম, যেমন করে শীতের শেষে বেরিয়ে আসে জরার খোলস ছেড়ে বিষধর ভূজঙ্গের দল। বিশ্বের এই নব অভ্যুদয়-দিনে সকলের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে চলুক আমার নিদ্রোত্থিত ভাইরা।
    আপনাদের সমিতির উদ্দেশ্য হোক, আদাওতি করে আসন জয় করা নয়- দাওত দিয়ে মনের সিংহাসন অধিকার করা।
    আপনাদের ইসলামাবাদ হোক ওরিয়েন্টাল কালচারের পীঠস্থান- আরফাত ময়দান। দেশ-বিদেশের তীর্থ-যাত্রী এসে এখানে ভিড় করুক আজ নব জাগ্রত বিশ্বের কাছে বহু ঝণী আমরা, সে ঋণ আজ শুধু শোধই করব না- ঋণ দানও করব, আমরা আমাদের দানে জগতকে ঝণী করব- এই হোক আপনাদের চরম সাধনা। হাতের তালু আমাদের শূন্য পানেই তুলে ধরেছি এতদিন, সে লজ্জা আজ আমরা পরিশোধ করব। আজ আমাদের হাত উপুড় করবার দিন এসেছে। তা যদি না পারি সমুদ্র বেশি দূরে নয়, আমাদের এ-লজ্জার পরিসমাপ্তি যেন তারি অতল জলে হয়ে যায় চিরদিনের তরে!
    আমি বলি, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের মতো আমাদেরও কালচারের, সভ্যতার, জ্ঞানের সেন্টার বা কেন্দ্রভূমির ভিত্তি স্থাপনের মহৎ ভার আপনারা গ্রহণ করুন- আমাদের মতো শত শত তরুণ খাদেম তাদের সকল শক্তি আশা-আকাঙ্ক্ষা জীবন অঞ্জলির মতো করে আপনাদের সে উদ্যমের পায়ে অর্থ্য দেবে।
    প্রকৃতির এই লীলাভূমি সত্যি সত্যিই বুলবুলিস্তানে পরিণত হোক- ইরানের শিরাজের মতো। শত শত সাদি, হাফিজ, খৈয়াম, রুমি, জামি, শমশি-তবরেজ এই শিরাজবাগে- এই বুলবুলিস্তানে জন্ম গ্রহণ করুক। সেই দাওতের আমন্ত্রণের গুরুভার আপনারা গ্রহণ করুন। আপনারা রুদ্‌কির মতো আপনাদের বন্ধ প্রাণধারাকে মুক্তি দিন।
    আমি এইরূপ “কালচারাল সেন্টারের" প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি নানা কারণে। একটি কারণ তার রাজনৈতিক।
    পলিটিক্সের নাম শুনে কেউ যেন চমকে উঠবেন না। আমি জানি, আপনাদের এই সমিতি রাজনীতি আলোচনার স্থান নয়, তবু যেটুকু না বললে নয়, আমি শুধু ততটুকুই বলব এবং সেটুকু কারুর কাছেই ভয়াবহ হয়ে উঠবে না। আমি তাই একটু খুলে বলব মাত্র।
    ভারত যে আজ পরাধীন এবং আজো যে স্বাধীনতার পথে তার যাত্রা শুরু হয়নি- শুধু আয়োজনেরই ঘটা হচ্ছে এবং ঘটও ভাঙছে- তার একমাত্র কারণ আমাদের হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের প্রতি হিংসা ও অশ্রদ্ধা। আমরা মুসলমানেরা আমাদেরই প্রতিবেশী হিন্দুর উন্নতি দেখে হিংসা করি, আর হিন্দুরা আমাদের অবনত দেখে আমাদের অশ্বদ্ধা করে। ইংরেজের শাসন সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে এই যে, তার
শিক্ষা-দীক্ষার চমক দিয়ে সে আমাদের এমনই চমকিত করে রেখেছে যে, আমাদের এই দুই জাতির কেউ কারুর শিক্ষা-দীক্ষা সভ্যতার মহিমার খবর রাখিনে। হিন্দু আমাদের অপরিচ্ছন্ন অশিক্ষিত কৃষাণ-মজুরদের- (আর, তাদের সংখ্যাই আমাদের জাতের মধ্যে
বেশি) দেখে মনে করে, মুসলমান মাত্রই এই রকম নোংরা, এমনি মূর্খ, গোড়া। হয়তো বা এরা যথা পরম তথা পরম্‌। দরিদ্র মূর্খ কালিমদ্দি মিয়াই তার কাছে এ্যাভারেজ মুসলমানের মাপকাঠি।
    জ্ঞানে-বিজ্ঞানে শিল্পে-সঙ্গীতে সাহিত্যে মুসলমানের বিরাট দানের কথা হয় তারা জানেই না, কিবা শুনলেও আমাদের কেউ তাদের সামনে তার সত্যকার ইতিহাস ধরে দেখাতে পারে না বলে বিশ্বাস করে না; মনে করেও শুধু কাহিনী। হয়ত একদিন ছিল, যখন হিন্দুরা মুসলমানদের অশ্রদ্ধা করত না। তখন রাজভাষা State Language ছিল ফার্সি, কাজেই হিন্দুরা বাধ্য হয়ে ফার্সি শিখতেন- এখন যেমন আমরা ইংরেজি শিখি। আর ফার্সি জানার ফলে তাঁরা বিশ্বসভ্যতায় দানের কথা ভালো করেই জানতেন। কাজেই সে সময় অর্থাৎ ইংরেজ আসার পূর্ব পর্যন্ত কোন নওয়াব বাদশার প্রতি বিরূপ হয়ে উঠলেও সমগ্র মুসলমান জাতি বা ধর্মের উপর বিরূপ হয়ে ওঠেননি। শিবাজি প্রতাপ যুদ্ধ করেছিল আওরঙ্গজেব আকবরের বিরুদ্ধে, ধর্ম বা ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে নয়। তখনকার সেই অশ্রদ্ধা ছিল ব্যক্তির
বিরুদ্ধে  Person  এর against এ_ গোষ্ঠীর বা সমগ্র জাতটার ওপর একেবারেই নয়।
    কিন্তু আজ আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি এই যে, আমরা সবচেয়ে কাছের মানুষটিকেই সবচেয়ে কম করে জানি। আমরা ইংরাজের কৃপায়, ইংরাজি, গ্রিক, ল্যাটিন, হিরু থেকে শুরু করে ফেঞ্চ, জার্মান, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, চেক, স্ক্যানডিনেভিয়ান, চিন, জাপানি, হনলুলু, গ্রিনউইচের ভাষা জানি, ইতিহাস জানি, তাদের সভ্যতার খবর নিই, কিন্ত আমারই ঘরের গায়ে গা লাগিয়ে যে প্রতিবেশীর ঘর তারই কোনো খবর রাখিনে বা রাখার চেষ্টাও করিনে। বরং এ না জানার গর্ব করি বুক
ফুলিয়ে। একেই বলে বোধ হয়, peny wise pound foolish!
    হিন্দু আরবি, ফার্সি, উর্দু জানে না, অথচ আমাদের শাস্ত্-সভ্যতা জ্ঞান-বিজ্ঞান সব কিছুর ইতিহাস আমাদের ঘরের বিবিদের মতই ঐ তিন ভাষার হেরেমে বন্দি। বিবিদের হেরেমের প্রাচীর বরং একটু করে ভাঙতে শুরু হয়েছে, ওদের মুখের বোরকাও খুলছে, কিন্তু এ তিন ভাষার প্রাচীর বা বোরকা-মুক্ত হল না আমাদের অতীত ইতিহাস, আমাদের দানের মহিমা। অতএব, অন্য ধর্মাবলম্বীদের আমাদের কোনো কিছু জানে না বলে দোষ দেবার অধিকার আমাদের নেই। অবশ্য আমরাও অনুস্বারের সঙ্গীন ও বিসর্গের কাঁটা বেড়া ডিঙিয়ে সংস্কৃতের দুর্গে প্রবেশ করতে পারিনে বা তার চেষ্টাও করিনে। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু তবু কতকটা কিনারা করেছে সে সমস্যার। তারা প্রাদেশিক ভাষায় তাদের সকল কিছু অনুবাদ করে ফেলেছে। সংস্কৃতের সঙ্গীন-উচানো দুর্গ থেকে রূপ-কুমারীকে গোপনে মুক্তিদান করেছে। তার ভবনের আলো আজ ভূবনের হয়ে উঠেছে।
    মাতৃভাষায় সে সবের অনুবাদ হয়ে এই ফল হয়েছে যে, অন্তত বাংলার মুসলমানেরা হিন্দুর কালচার, শাস্ত্র, সভ্যতা প্রভৃতির সঙ্গে যত পরিচিত, তার শতাংশের একাংশও পরিচিত নয় সে তার নিজের ধর্ম, সভ্যতা ইত্যাদির সাথে।
    কোনো মুসলমান যদি তার সভ্যতা ইতিহাস ধর্মশাস্ত্র কোনো কিছু জানতে চায় তাহলে তাকে আরবি-ফার্সি বা উর্দুর দেওয়াল টপকাবার জন্য আগে ভালো করে কসরৎ শিখতে হবে। ইংরেজি ভাষায় ইসলামের ফিরিঙ্গি রূপ দেখতে হবে। কিন্তু সাধারণ মুসলমান বাংলাও ভালো করে শেখে না, তার আবার আরবি-ফার্সি! কাজেই ন মণ তেলও আসে না, রাধাও নাচে না। আর ধারা ও ভাষা শেখেন, তাঁদের অবস্থা 'পড়ে ফার্সি বেচে তেল।' আর তাদের অনেকেই শেখেনও সেরেফ হালুয়া-রুটির জন্য। কয়জন মওলানা সাহেব আমাদের মাতৃভাষার পাত্রে আরবি-ফার্সির সমুদ্র মন্থন করে অমৃত এনে দিয়েছেন জানি না। সে অমৃত তারা একা পান করেই 'খোদার খাসি' হয়েছেন।
    কিন্তু এ খোদার খাসি দিয়ে আর কতদিন চলবে? তাই আপনাদের অনুরোধ করতে এসেছি-এবং আপনাদের মারফতে বাংলার সকল চিন্তাশীল মুসলমানদেরও অনুরোধ করছি, আপনাদের শক্তি আছে, অর্থ আছে- যদি পারেন মাতৃভাষায় আপনাদের সাহিত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ইতিহাস-সভ্যতার অনুবাদ ও অনুশীলনের কেন্দ্রভূমির যেখানে হোক প্রতিষ্ঠা করুন। তা না পারলে অনর্থক ধর্ম ধর্ম বলে ইসলাম বলে চিৎকার করবেন না।
    আমাদের next door neighbour-এর মন থেকে আমাদের প্রতি এই অশ্রদ্ধা দূর হবে এই এক উপায়ে, আর তবেই ভারতের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত হবে। সমস্ত সাম্প্রদায়িকতার মাতলামিরও অবসান হবে সেইদিন, যেদিন হিন্দু মুসলমান পরস্পর পরস্পরকে পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা নিয়ে আলিঙ্গন করতে পারবে। সেদিন যে competition হবে সে competition হবে cultured মনের chivalrous competition-- sportsman like competition.

বুলবুল
ফালগুন, ১৩৪৩