অগ্রন্থিত
প্রবন্ধ
নজরুল ইসলাম, কাজী
পোলিটিকাল তুবড়ি বাজি
কানপুরে বড়দিনের ছুটিতে
All Indian Political Tubri Competition
হয়ে গেল। জাতির সমস্যা সমাধানের জন্য ৩০টি কনফারেন্স বসেছিল। নিখিল ভারতীয় প্রেত-
তত্ত্ব সভা হ'তে আরম্ভ করে সোভিযট রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পর্যন্ত হ'য়ে গেছে।
এই হট্টগোলের মধ্যে সুখের বিষয় শ্রমিক ও কৃষকের কথা সকলেই তুলেছেন। শ্রীমতী
সরোজিনী দেবী লাঙলের জয়গান করেছেন।
The immemorial twin symbol of the plough and the spinning wheel
as the central text of the teaching that shall liberate our unhappy peasantry
from the crushing misery and terror of hunger, ignocance and disease'.
।
লাঙল এবং চরকাকে কেন্দ্র করে আমাদের পল্লী-সংগঠনের আয়োজন করতে হয়- লাঙলের সঙ্গে সঙ্গে ভূমি-স্বত্বের কথা
অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত এবং ভূমি-স্বত্বের সঙ্গে ভারতীয় স্বরাজের প্রতিষ্ঠার এত নিকট সম্বন্ধ যে সে সমস্যার সমাধান না হ'লে
স্বরাজ আসতেই পারে না। তাই প্রজাস্বত্ব আইনের আলোচনার সময় সমস্ত নেতারা কি করেন, আমরা দেখবার জন্য উৎসুক আছি।
যারা বলেন স্বরাজ হলে ওসব ঠিক হবে- তাঁরা গোড়াতেই ভুল করেন।
'সাম্যবাদীদলের কনফারেন্সের সভাপতি শ্রীযুত শিঙ্গরভেলু ঠিকই বলেছেন যে,
শ্রমিক ও কৃষকের সাহায্য ব্যতীত যে কংগ্রেস বলহীন এবং সে কংগ্রেসের দ্বারা স্বরাজ
আসতে পারে না, তা গত পাঁচ বছরের আন্দোলনের ইতিহাসে প্রমাণ হয়ে গেছে। কেবল
১৯২১ সালে যখন গণ-ঐরাবত ত্যাগী রাজদুলাল মহাত্মাকে কাঁধে চড়িয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে
অভিযান করেছিল, তখন লর্ড রেডিং বলেছিলেন,
"Let us as eqals,forgiving and
forgetting the past,in a round table conference to devise a constitution for
India" ।
তখন সমানে সমানে কোলাকুলি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আর এখন এসেমব্লির
সামান্য প্রার্থনার জবাব দিতেও গবরমেন্ট প্রয়োজন বোধ করে শা। : '
পণ্ডিত মতিলাল ভয় দেখিয়েছেন ফেব্রুয়ারীর মধ্যে জবাব না দিলে স্বারাজীরা ব্যবস্থাপক সভা ত্যাগ করে
সিন্ধু হতে ব্রহ্মপুত্র এবং কৈলাস হতে কন্যাকুমারী পর্যন্ত তোলপাড় করবেন। তবে কাউন্সিলে পদগুলি যাতে শূন্য না হয়,
কিম্বা ফাঁকতালে আমলাতন্ত্র ট্যাক্স বাড়িয়ে না দেয়, সেজন্য সভ্যগণ মধ্যে মধ্যে উপস্থিত হবেন। সিভিল
ডিসওবিডিয়েন্স শেষ অস্ত্র হবে- কিন্তু সেটা যখন করার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না,
তখন দেশকে তার জন্যে তৈরি করাই কাজ হবে। মহাত্মার অসহঘোগ আন্দোলনের
ভিত্তি direct action, আর বর্তমান কংগ্রেস-নীতির ভিত্তি constitutionalism বিরোধ
এইখানে, বিরোধ মতিলাল জয়াকর কেলকারে নয়। প্রথম জাতীয় নীতির মুলে শুধু
জনসাধারণের সাহায্য চাই, দ্বিতয়ি নীতির মূলে এই বুর্জোয়া ভদ্র-সম্প্রদায়ের
হাত। যে শক্তি আমলাতস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করার জন্য সঞ্চিত হয়েছিল, মহাত্মা বারদৌলিতে
তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, তাই আজ অভ্যন্তরিক বাদ-বিসংবাদে সেই শক্তির
অপপ্রয়োগ হচ্ছে। হিন্দু-মুসলিম, ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ, 'ধনিক-শ্রমিক, জমিদার-প্রজা,
নোচেঞ্জার প্রো-চেঞ্জার, এই সমস্ত দলাদলির মূলে ঐ একই কারণ। সতীদেহ টুকরো
টুকরো হয়েআজ ভারতের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। রুদ্রের এ রোষ কবে থামবে জানি না।
কৃষক ও শ্রমিককে সঙ্ঘবদ্ধ না করে, তাদের প্রয়োজনে তাদের অধিকারে জনগণকে
সচেতন না করে আর আমাদের লম্বা লম্বা কথা কওয়া উচিত নয়। পণ্ডিত মতিলালের
মতলব দেশের লোককে চমক লাগিয়ে দিয়ে ফিরে ইলেক্শনে আবার দলবেঁধে
কাউন্সিলে প্রবেশ করা? কিন্তু অতঃপর? মহাত্মার এক বৎসরের স্বরাজের ধাক্কা
এখনও আমরা সামলাতে পারিনি, আর চমক লাগানোর প্রয়োজন কি? পণ্ডিতজীর
রেজোলিউশন পড়ে আমাদের মনে হয় সেই লোকটার জলে ডোবার কথা। সে সংসার-জ্বালায়
জ্বলেপুড়ে বিরক্ত হয়ে জলে ডুবে মরবে বলে ঠিক করল। কিন্ত ঘাটে যাওয়ার
আগে গামছা খানি ও তেল চাইল। তেলমাথা ও গামছার কথা যে না ভুলেছে, সে যে
জলে ডুবে মরবে না এটা বেশ বোঝা যায়।
শুধু পোলিটিকাল তৃবড়ি বাজিতে কি হবে? কাগজে আমরা লিখতে প্যরি, দেশ কানপুরের
দিকে চেয়ে আছে, great speech, momentous seasion কিন্তু এ-সবই
অভিনয়ের শেষ রাত্রির বিজ্ঞাপনের মতো। দেশের জনস্বাধারণের মাথা কচ্ছপের মতো
শরীরের ভিতর ঢুকে গেছে। এখন সেই মাথা বের করতে দেহটাকে কাটতে গেলে চলবে
না। জলে ছেড়ে দিলেই সে আবার স্বচ্ছন্দভাব ধারণ করবে। প্রতিদিনের যে অভাবে সে
এমন হয়ে মরছে, জন সাধারণকে সেই অভাবের প্রতিকারের মধ্য দিয়ে-আরার সজাগ
করতে হবে- সে কঠিন সাধনার তারিখ নাই; ৩১শে ডিসেম্বর ১৯২৩ বা ফেব্রুয়ারি শেষ
১৯২৬-এর ভিতর তাকে সীমাবদ্ধ করলে চলবে না।
বৎসরাস্তে কানপুরে আমাদের পোলিটিকাল চড়ক-পূজা, শেষ হল। ফিরে এসে
দুই একজন বাদে নেতারা ওকালতি, ডাক্তারি, ব্যারিস্টারি এবং অন্যান্য ব্যবসায়ে মন
দিবেন এবং যিনি বড় দয়ালু তিনি সপ্তাহান্তে হয়তো এক একবার দেশ-উদ্ধারে মনোযোগ
দিবেন। কই দেশবন্ধুর মতো সেই সর্বগ্রাসী স্বদেশপ্রেম, কই সেই জ্বালা- আজ-
রাজনীতি ক্ষেত্রে কেবল ফাঁকিবাজি, সঞ্চিত ধনের গাদায় বসে, অথবা পাবলিক ফাণ্ডের
অপহরণে, অথবা প্রজার রক্ত শোষণ করে যে নিশ্চিন্ত আছে, আজ তারই নেতাগিরির
দিন। যে সর্বস্ব ত্যাগ ক'রে দেশের সেবা করে সে নিশ্চয়ই উপায়হীন, কিংবা গবর্ষেন্টের
টাকা খায়। স্বরাজসাধনার শক্তিবলে আয়ত্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ আজ লোভীর-মধুচক্রে
পরিপত, পোলিটিক্যাল মোহান্তের দল রাজনীতির পুণ্য তীর্থে যথেচ্ছাচারে দীপ্তমান। নন্দীতৃঙ্গীর
দল তাদের শিঙা বাজিয়ে আকাশ ফাটিয়ে শিবাদলের কোলাহুলে শ্মশান দেশ মুখরিত।
ভগীরথের শঙ্খধ্বনি আর ত্যাগ-সুরধুনীকে মর্ত্যে নিয়ে আসছেন না-
শ্মশান-কুকুরদের কাড়াকাড়ি-গীতিতে আজ রোগশোকে মৃহ্যমান নিস্তব্ধ০ দেশকে প্রাণবান
ব'লে প্রতিভাত করছে।
আজ এই শবসাধনায় তরুণ বাংলার ডাক পড়েছে- এস ভাই, তোমাদের
মরণজয়ী পণ আর একবার শক্তি-পীঠ বাংলাকে পবিত্র করুক। নেতাদের স্তোকবাক্যে
ভুলো না- তোমাদের কাঁধে চড়ে যাঁরা নিজেদের উচু দেখান, সিন্দাবাদের নাবিকের সেই
বোঝা ফেলে দাও। তৃবড়িবাজি দেখে মুগ্ধ হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থেকো না
তোমার দুর্গম অমানিশার পথে ওই আলো কেবল চোখে ধাঁধা লাগায়। একটা পিস্তল বা
বোমার আওয়াজে তুমি স্তব্ধ হয়ে-দাঁড়িও না- ওর চেয়ে ঢের বড় শক্তি তোমার
অপেক্ষায় সঞ্চিত হয়ে আছে, তুমি নবযুগের রামের মতো সেই শক্তিকে পায়াণী
অহল্যার ন্যায় প্রাণের স্পর্শে মুক্তিদান করো! গণআন্দোলনের চলমান শক্তি এই
নিরস্ত্রীকৃত প্রাণহীনের দেশে বিপ্লবের বন্যা এনে দিক, যুগান্তরের সঞ্চিত.জঞ্জাল সব
ভেসে যাক।
জড় জীব তাঁর চড়কে ঘুরিয়া হলো বেভুল
তথাপি পড়ে না পাগল শিবের মাথার ফুল!
বল সন্ন্যাসী, মুখ ফুটে বল,
কে কোথা ডূবিয়া খেয়েছিস জ্বল?
রক্ত-নয়ন ডুবিছে তপন না পেয়ে কূল।
দিন যায়, কেন পড়ে না শিবের মাথার ফুল!
লাঙল ,
প্রথম খণ্ড। তৃতীয় সংখ্যা,
২৩শে পৌষ ১৩৩২