তারপর সেই ছাড়াছাড়ির ক্ষণটা বেদৌরা, তা কি মনে পড়ছে? আমি শিরাজের বুলবুলের সেই গানটা আবৃত্তি করছিলাম,
দেখনু সেদিন ফুল-বাগিচায় ফাগুন মাসের উষায়,
সদ্য-ফোটা পদ্মফুলের লুটিয়ে পরাগ-ভূষায়,
কাঁদচে ভ্রমর আপন মনে অঝোর নয়নে সে,
হঠাৎ আমার পড়ল বাধা কুসুম চয়নে যে!
কইনু, – ‘হাঁ ভাই ভ্রমর! তুমি কাঁদচ সে কোন্ দুখে
পেয়েও আজি তোমার প্রিয়া কমল-কলির বুকে?’
রাঙিয়ে তুলে কমল-বালায় অশ্রু-ভরা চুমোয়
বললে ভ্রমর, –‘ওগো কবি, এই তো কাঁদার সময়!
বাঞ্ছিতারে পেয়েই তো আজ এত দিনের পরে,
ব্যথা-ভরা মিলন-সুখে অঝোর ঝরা ঝরে।’
এমন সময় তোমার মামা এসে তোমায় জোর করে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল; আমার একটা কথাও বিশ্বাস করলে না। শুধু একটা উপেক্ষার হাসি হেসে জানিয়ে দিলে যে, সে থাকতে আমার মতো একটা ঘর-বাড়ি ছাড়া বয়াটে ছোকরার সঙ্গে বেদৌরার মিলন হতেই পারে না।...
আমার কান্না দেখে সে বললে যে, ইরানের পাগলা কবিদের ‘দিওয়ান’ পড়ে পড়ে আমিও পাগল হয়ে গিয়েছি। তোমার মিনতি দেখে সে বললে যে, আমি তোমাকে জাদু করেছি।
তারপর অনেক দিন ঘুরে ঘুরে কেটে গেল ওই ব্যাকুল-গতি ঝরনাটার ধারে। যখন চেতন হল তখনও বসন্ত-উৎসব তেমনই চলেছে, শুধু তুমিই নেই! দেখলুম, ক্রমেই তোমার আলতা-ছোবানো পায়ের পাতার পাতলা দাগগুলি নির্ঝরের কূলে কূলে মিলিয়ে আসছে, আর রেশমি চুড়ির ভাঙা টুকরোগুলি বালি-ঢাকা পড়ছে।
আমি কখনও মনের ভুলে এপারে দাঁড়িয়ে ডাকতুম, – বেদৌরা! – অনেকক্ষণ পরে পাথরের পাহাড়টা ডিঙিয়ে ওপার হতে কার একটা কান্না আসতে আসতে মাঝপথেই মিলিয়ে যেত – ‘রা – আঃ – আঃ!’ সারা বেলুচিস্তান আর আফগানিস্তানের পাহাড় জঙ্গলগুলোকে খুঁজে পেলুম, কিন্তু তোমার ঝরনা-পারের কুটিরটির খোঁজ পেলুম না।...
একদিন সকালে দেখলুম, খুব উন্মুক্ত একটা ময়দানে একা একজন পাগলা আশমান-মুখো হয়ে শুধু লাফ মারছে, আর সেই সঙ্গে হাত দুটো মুঠো করে কিছু ধরবার চেষ্টা করছে। আমার বড্ড হাসি পেল। শেষে বললুম – ‘হ্যাঁ ভাই উৎরিঙ্গে! তুমি কি তিড়িং তিড়িং করে লাফিয়ে আকাশ-ফড়িং ধরছ?’
সে আরও লাফাতে লাফাতে সুর করে বলতে লাগল –
এ-পার থেকে মারলাম ছুরি লাগল কলা গাছে,
হাঁটু বেয়ে রক্ত পড়ে চোখ গেল রে বাবাঃ।
এতে যে মরা মানুষেরও হাসি পায়। অত দুঃখেও আমি হোহো করে হেসে বললুম, – ‘তুমি কি কবি?’ সে খুব খুশি হয়ে চুল দুলিয়ে বললে – ‘হাঁ হাঁ, তাই!’ আমি বললুম, – ‘তা তোমার কবিতার মিল হল কই?’ সে বললে, – ‘তা নাই বা হল, হাঁটু দিয়ে তোর রক্ত পড়ল তো।’ এই বলেই সে আমার নবোদ্ভিন্ন শ্মশ্রুমণ্ডিত গালে চুম্বনের চোটে আমায় বিব্রত করে তুলে বললে, – ‘অনিলের নীল রংটাকে সুনীল আকাশ ভেবে ধরতে গেলে সে দূরে সরে গিয়ে বলে, – “ওগো, আমি আকাশ নই, আমি বাতাস, আমি শূন্য, আমায় ধরা যায় না। আমায় তোমরা পেয়েছ। তবুও যে পাইনি বলে ধরতে আস, সেটা তোমার জবর ভুল।”
এক নিমেষে আমার মুখের মুখর হাসি মূক হয়ে মিলিয়ে গেল। ভাবলাম, হাঁ ঠিকই তো। যাকে ভিতরে, অন্তরের অন্তরে পেয়েছি, তাকে খামখা বাইরের-পাওয়া পেতে এত বাড়াবাড়ি কেন? তাই সেদিন আমার পোড়ো-বাড়িতে শেষ কান্না কেঁদে বললুম, – ‘বেদৌরা! তোমায় আমি পেয়েছি আমার হৃদয়ে – আমার বুকের প্রতি রক্ত-কণিকায়।’ তারপর এই যে হিন্দুস্থানের অলিতে গলিতে ‘কমলিওয়ালে’ সেজে ফিরে এলুম, সে তো শুধু ওই এক ব্যথার সান্ত্বনাটা বুকে চেপেই। ভাবতুম, এমনি করে ঘুরে ঘুরেই আমার জনম কাটবে, কিন্তু তা আর হল কই? আবার সেই গোলেস্তানে ফিরে এলুম! সেখানে আমার মাটির কুঁড়ে মাটিতে মিশিয়ে গিয়েছে, কিন্তু তারই আর্দ্র বুকে যে তোমার ওই পদচিহ্ন আঁকা রয়েছে, তাই আমায় জানিয়ে দিল, যে, তুমি এখানে আমায় খুঁজতে এসে না পেয়ে শুধু কেঁদে ফিরেছ!
সেই পাগলটা আবার এসে জানিয়ে দিলে গেল যে, তুমি চমনে ফুটে শুকিয়ে যাচ্ছ।...
আমি এসেই তোমায় দূর হতে দেখে চিনেছি। তবে তুমি আমায় দেখে অমন করে ছুটে পালালে কেন? সে কী মাতালের মতো টলতে টলতে দৌড়ে লুকিয়ে পড়লে ওই খোর্মাখোর্মা : খেজুর। গাছগুলোর আড়ালে! সে কী অসংবৃত অশ্রু ঝরে পড়ছিল তোমার! আর কতই যে ব্যথিত অনুযোগ ভরে উঠেছিল সে করুণ দৃষ্টিতে!
কিন্তু কোথা গেলে তুমি? – বেদৌরা, তুমি কোথায়?...
কেন আমি মূর্ছিত হয়ে পড়লুম?
– ওঃ!
বেদৌরার কথা
বোস্তান
আঃ মাগো কী ব্যথিত পাণ্ডুর আকাশ! এই যে এত বৃষ্টি হয়ে গেল, ও অসীম আকাশের কান্না নয় তো? – না, না, এত উদার যে, সে কাঁদবে কেন? আর কাঁদলেও তার অশ্রু আমাদের সংকীর্ণ পাপ-পঙ্কিল চোখের জলের মতো বিস্বাদ আর উষ্ণ নয় তো! দেখছ, সে কত ঠান্ডা! ...
ওঃ কিন্তু আমি কী স্বপ্ন দেখছি? একেবারে এক দৌড়ে চমন থেকে এই বোস্তানে এসেছি! তা হোক, এতক্ষণে যেন জানটা ধড়ে এল। – আ মলো! এত হুঁকরে হুঁকরে বুক ফেটে কান্না আসছে কীসের? – মানুষের মনের মতো আর বালাই নেই। ওই জ্বালাতেই তো আমায় জ্বালিয়ে খেলে গো! – কী? তার দেখা পেয়েছি বলে এ-কান্না? – তাতে আর হয়েছে কী?
তিনি যে ফিরে আসবেনই, সে তো জানা কথা। কিন্তু এত দিনে কেন? এ অসময়ে কেন নাথ? এখন যে আমার মালতীর লতা রিক্তকুসুম! ওগো, এ মরণের তটে এ দুর্দিনে কী দিয়ে বাসর সাজাব? যদি এলেই তবে কেন দুদিন আগেই এলে না? তা হলে তো তোমায় এমন করে এড়িয়ে চলতে হত না !সেই দিনই – যেদিন আবার ওই চমনের শুকনো বাগানের ধারে তোমায় দেখতে পেয়েছিলাম – সেই দিনই তোমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতাম, – ‘এসো প্রিয়, ফিরে এসো!’ ওগো! হতভাগিনি – আমি যে হৃদয়ের সে পবিত্রতা রক্ষা করতে পারিনি! ওই শোনো দূরে আমার সমবেদনায় কী একটা জানোয়ার কাতরে উঠেছে – উঃ উঃ উঃ।
আমরা নারী, একটুতেই যত কেঁদে ভাসিয়ে দিতে পারি, পুরুষরা তা তো পারে না। তাদের বুকে যেন সব সময়েই কীসের পাথর চাপা। তাই যখন অনেক বেদনায় এই সংযমী পুরুষদের দুটি ফোঁটা অসংবরণীয় অশ্রু গড়িয়ে পড়ে, তখন তা দেখে না কেঁদে থাকতে পারে, এমন নারী তো আমি দেখি না! –
সেদিন যখন কত বছর পরে আমাদের চোখাচোখি হল, তখন কত মিনতি-অনুযোগ আর অভিমান মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছিল আমাদের চারটি চোখেরই সজল চাউনিতে! – হাঁ, আর কেমন ‘বেদৌরা’ বলে মাথা ঘুরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে সে ওই খেজুরের কাঁটা-ঝোপটায় পড়ে গেল! আঃ আঃ, তা দেখে পাষাণী-আমি কী করেই সে চোখ দুটো জোর করে দুই হাত দিয়ে চেপে এত দূর যেন কোনো অন্ধ অমানুষিক শক্তির বলে ছুটে এলাম?
পুরোনো কত স্মৃতিই আজ আমার বুকে ছেপে উঠছে! সেই গোলেস্তানে এক জোড়া বুলবুলেরই মতো মিলনেই অভিমান, মিলনেই বিচ্ছেদ-ব্যথা আর তারই প্রগাঢ় আনন্দে অজস্র অশ্রুপাত! তার চিন্তাটাও কত ব্যথিত-বিধুর! – তারপর সেই জুয়াচোরের জোর করে আমায় ছিনিয়ে নেওয়া দয়িতের বুক থেকে, – অনেক কষ্টে তার হাত এড়িয়ে প্রিয়ের অন্বেষণ! – ওঃ কি-ই না করেছি তাকে আবার পেতে! কই তখনও তো তিনি এলেন না!
তার পর ভিতরে-বাইরে সে কী দ্বন্দ্ব লেগে গেল! ভিতরে ওই এক তুসের আগুন ধিকিধিকি জ্বলতে লাগল, আর বাইরে? – বাইরে ফাগুনের উদাস বাতাস প্রাণে কামনার তীব্র আগুন জ্বালিয়ে দিলে! ঠিক সেই সময় কোথা থেকে ধূমকেতুর মতো সয়ফুল-মুলক এসে আমায় কান-ভাঙানি দিলে। – ভালোবাসায় কী বিরাট শান্ত স্নিগ্ধতা আর করুণ গাম্ভীর্য, ঠিক ভৈরবী রাগিণীর কড়ি-মধ্যমের মতো! আর এই বিশ্রী কামনাটা কত তীব্র – তীক্ষ্ণ – নির্মম! এই বাসনার ভোগে যে সুখ, সে হচ্ছে পৈশাচিক সুখ। এতে শুধু দীপক রাগিণীর মতো পুড়িয়েই দিয়ে যায় আমাদের! অথচ এই দীপকের আগুন একবার জ্বলে উঠবেই আমাদের জীবনের নব-ফাল্গুনে। সেই সময় স্নিগ্ধ মেঘ-মল্লারের মতো সান্ত্বনার একটা-কিছু পাশে না থাকলে সে যে জ্বলবেই – দীপক যে তাকে জ্বালাবেই!
তাই তো যেদিন
পুষ্পিত যৌবনের ভারে আমি ঢলে
পড়ছিলাম, আর একজন এসে আমায় যাচ্ঞা
করলে, তখন আমার এই বাহিরের
প্রবৃত্তিটা দমন করবার ক্ষমতাই যে
রইল না! তখন যে আমি অন্ধ। – ওগো
দেবতা, সেদিন তুমি কোথায় ছিলে?
কেউ যে এল না শাসন করতে তখন! হায়,
সেই দিনই আমার মৃত্যু হল। সেই
দিনই আমি ভিখারিনি হয়ে পথে বসলাম।
ওগো, আমার সেই অধঃপতনের দিনে চোখে
যে পুঞ্জীভূত অন্ধকারের নিবিড়
কালিমা একেবারে ঘন-জমাট হয়ে
বসেছিল, তখন, এখনকার মতো এতটুকুও
আলোক যে সে-অন্ধকারটাকে তাড়াতে
চেষ্টা করেনি। হয়তো একটি
রশ্মিরেখার ঈষৎপাতে সব অন্ধকার
সেদিন ছুটে পালাত। তা হলে দেখতে
গো, কে আমার সমস্ত হৃদয়-আসন জুড়ে
রাজাধিরাজ একচ্ছত্র সম্রাটের মতো
বসে আছে।
তবু যে আমার এ
অধঃপতন হল? তা
সেদিনও বুঝতে
পারিনি, আজও
বুঝতে পারছিনে,
কেমন যেন সব
গোলমাল হয়ে
যাচ্ছে! – কিন্তু
আমি যদি বলি,
আমার প্রেম –
বক্ষের গভীর
গোপন-তলে-নিহিত
মহান প্রেম, যা
সর্বদাই পবিত্র,
তা তেমনই পূত
অনবদ্য আছে আর
চিরকালই থাকবে,
তার গায়ে আঁচড়
কাটে বাইরের কোনো
অত্যাচার-অনাচারের
এমন ক্ষমতা নেই,
– তা হলে কে
বুঝবে? কেই বা
আমায় ক্ষমা করবে?
– তবু আমি বলব,
প্রেম চিরকালই
পবিত্র, দুর্জয়,
অমর; পাপ চিরকালই
কলুষ, দুর্বল আর
ক্ষণস্থায়ী।
আঃ – মা, কী অসহ্য বেদনা এই সারা বুকের পাঁজরে পাঁজরে!...উঃ... হাঁ কীসব ভুল বকছিলাম এতক্ষণ? ঠিক যেন খোওয়াব দেখছিলাম, না? ... পাপ ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু নদীর বান-ভাসির পর যেমন বান রেখে যায় একটা পলির আবরণ সারা নদীটার বুকে, তেমনই পাপ রেখে যায় সংকোচের পুরু একটা পর্দা; সেটা কিন্তু ক্ষণস্থায়ী নয়, সেটা হয়তো অনেকেরই সারা জীবন ধরে থাকে। পাপী নিজেকে সামলে নিয়ে হাজার ভালো করে চললেও ভাবে, আমার এ দুর্নাম তো সারাজীবন কাদা-লেপটা হয়ে লেগেই থাকবে! চাঁদের কলঙ্ক পূর্ণিমার জ্যোৎস্নাও যে ঢাকতে পারে না! এই পাপে অনুশোচনাটা কত বিষাক্ত – তীক্ষ্ম! ঠিক যেন একসঙ্গে হাজার হাজার ছুঁচ বিঁধছে বুকের প্রতি কোমল জায়গায়। ...
আবার আমার মনে পড়ছে সেই আমার বিপথে-টেনে-নেওয়া শয়তান সয়ফুল-মুলকের কথা। সে-ই তো যত ‘নষ্টগুড়ের খাজা’। এখন তাকে পেলে নখ দিয়ে ছিঁড়ে ফেলতাম!
আমারা নারী – মনে করি, এতটুকুতেই আমাদের হৃদয় অপবিত্র হয়ে গেল, আর অনুশোচনায় মনে মনে পুড়ে মরি। আমরা আরও ভাবি যে, হয়তো পুরুষদের অত সামান্যতে পাপ স্পর্শে না। আর তাদের মনে এত তীব্র অনুশোচনাও জাগে না। কিন্তু সেই যে সেদিন, যেদিন আমার বাসনার পিয়াস শুকিয়ে গিয়েছে, আর মধু ভেবে আকণ্ঠ হলাহল পানের তীব্র জ্বালায় ছটফট করচি, আর ঠিক সেই সময় সহসা বিরাট বিপুল হয়ে আমার ভিতরের প্রেমের পবিত্রতা অপ্রতিহত তেজে জেগে উঠেছে – সে-তেজ চোখ দিয়ে ঠিকরে বেরুচ্চে, – সেদিন – ঠিক সেইদিন – সয়ফুল-মুলক সহসা কীরকম ছোটো হয়ে গেল! একটা দুর্বার ঘৃণামিশ্রিত লজ্জার কালিমা তার মুখটাকে কেমন বিকৃত করে দিলে! সে দূর থেকে কেমন আমার দিকে একটা ভীত-চকিত দৃষ্টি ফেলে উপর দিকে দুহাত তুলে আর্তনাদ করে উঠল, – ‘খোদা! আমি জীবন দিয়ে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করব। তবে যেন সে-জীবন মঙ্গলার্থেই দিতে পারি, শুধু এইটুকু করো খোদা।’ তারপর কেমন সে উন্মাদের মতো ছুটে এসে আমার পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে বললে, – ‘দেবী, ক্ষমা করো এ শয়তানকে! দেবীর দেবীত্ব চিরকালই অটুট থাকে, বাইরের কলঙ্কে তা কলঙ্কিত হয় না, বরং সংঘর্ষের ফলে তা আরও মহান উজ্জ্বল হয়ে যায়! কিন্তু আমি? – আমি? – ওঃ, ওঃ, ওঃ!’ সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল। তার সে-ছোটা থেমেছে কিনা জানিনে।
কিন্তু এ কী? আবার আমার মনটা কেন আমাকে যেন ভাঙানি দিচ্ছে শুধু একবার দেখে আসতে যে, তিনি তেমনি করে সেই খেজুর-কাঁটার ঝোপে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছেন কি না। ... না, না, – এ প্রাণ-পোড়ানি আর সইতে পারিনে গো – আর সইতে পারিনে! হাঁ, তাঁর সঙ্গে দেখা করবই করব, একবার শেষ দেখা; তার পর বলব তাঁকে, – ‘ওগো, তোমার সে বেদৌরা আর নেই, – সে মরেছে, মরেছে। তার প্রাণ তোমারই সন্ধানে বেরিয়ে গিয়েছে! – তুমি তাকে বৃথা এমন করে খুঁজে বেড়াচ্ছ! বেদৌরা নেই – নেই – নেই।’
তার পর – তার পর? তার পরেও যদি তিনি আমায় চান, তা হলে কী বলব তাঁকে, কী করব তখন? – না, তখনও এমনই শক্ত কাঠ হয়ে বলব, – ‘ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না গো দেবতা, ছুঁয়ো না। আমার এ অপবিত্র দেহ ছুঁয়ে তোমার পবিত্রতার অবমাননা কোরো না!’
আঃ! মা গো! কী ব্যথা! বুকের ভিতরটা কে যেন ছুরি হেনে খান খান করে কেটে দিচ্ছে। ...
দারার কথা
গোলেস্তান
তুমি কি সেই গোলেস্তান? তবে আজ তুমি এত বিশ্রী কেন? তোমার ফুলে সে সৌন্দর্য নেই, শুধু তাতে নরকের নাড়ি-উঠে আসা পূতিগন্ধ! তোমার আকাশ আর তেমন উদার নয়, কে যেন তাকে পঙ্কিল ঘোলাটে করে দিয়েছে! তোমার মলয় বাতাসে যেন লক্ষ হাজার কাচের টুকরো লুকিয়ে রয়েছে! তোমার সারা গায়ে যেন বেদনা! ...
কী করলে বেদৌরা তুমি? – বেদৌরা! – নাঃ, এই যে ব্যথা দিলে তুমি, – এই যে প্রাণ-প্রিয়তমের কাছ থেকে পাওয়া নিদারুণ আঘাত, এতেও নিশ্চয়ই খোদার মঙ্গলেচ্ছা নিহিত আছে! আমি কখনই ভুলব না খোদা, যে, ‘তুমি নিশ্চয় মহান আর তোমার-দেওয়া সুখ-দুঃখ সব সমান ও মঙ্গলময়! তোমার কাজে অমঙ্গল থাকতে পারে না, আর তুমি ছাড়া ভবিষ্যতের খবর কেউ জানে না!’ ব্যথিতের বুকে এই সান্ত্বনা কী শান্তিময়! ...
আচ্ছা, তবু মন মানছে কই? কেন ভাবছি, এ নিশ্চয়ই আঘাত? – তৃষাতুর চাতক যখন ‘ফটিক জল ফটিক জল’ করে কেঁদে কেঁদে মেঘের কাছে এসে পৌঁছে, আর নিদারুণ মেঘ তার বুকে বজ্র হেনে দিয়ে বিদ্যুৎ-হাসি হাসে, তখন কেন মনে করি, এ মেঘের বড়োই নিষ্ঠুরতা? – কেন?
কিন্তু এত দিনেও নিজের স্বরূপ জানতে পারলুম না! আগে মনে করতুম, আমি কতো বড়ো – কতো উচ্চ! আজ দেখছি, সাধারণ মানুষের চেয়ে আমি এক রত্তিও বড়ো নই! আমারও মন তাদের মতো অমনই সংকীর্ণতা আর নীচতায় ভরা। নইলে আমি বেদৌরার এ দোষ সরল মনে ক্ষমা করতে পারলুম না কেন? হোক না কেন যতই বড়ো সে দোষ! বাহিরটা তার নষ্ট হয়েছে বটে, কিন্তু ভিতরটা যে তেমনই পবিত্র আর শুভ্র রয়েছে! অনেকে যে ভিতরটা অপবিত্র করে বাহিরটা পবিত্র রাখবার চেষ্টা করে, সেইটাই হচ্ছে বড়ো দোষ। কিন্তু এই যে বেদৌরার সহজ সরলতায় তার ভিতরটা পবিত্র রয়েছে জেনেও তাকে প্রাণ খুলে ক্ষমা করতে পারলুম না, সে দোষ তো আমারই; কেননা আমি এখনও অনেক ছোটো। জোর করে বড়ো হওয়ার জন্যে একবার ক্ষমা করতে ইচ্ছে হয়েছিল বটে, কিন্তু তা তো হতে পারে না। সে যে হৃদয় হতে নয়! নাঃ, আমাকে পুড়ে খাঁটি হতে হবে। খুব দূরে থেকে যদি মনটাকে ঠিক করতে পারি, তবেই আবার ফিরব, নইলে নয়। – ওঃ কী নীচ আমি! প্রথমে বেদৌরার মুখ থেকে তার এই পতনের কথা শুনে আমিও তো একেবারে নরক-কুণ্ডে গিয়ে পৌঁছেছিলুম। মনে করেছিলুম আমিও এমনি করে আমার সুপ্ত কামনায় ঘৃতাহুতি দিয়ে বেদৌরার উপর শোধ নেব। তারপর নরকের দ্বার থেকে কেমন করে হাত ধরে অশ্রু মুছিয়ে আমায় কে যেন ফিরিয়ে আনলে! সে বেশ শান্ত স্বরেই বললে, – ‘এ প্রতিশোধ তো বেদৌরার উপর নয় ভাই, এ প্রতিশোধ তোমার নিজের উপর!’ ভাবলুম, তাই তো, অভিমানের ব্যথায় ব্যথিত হয়ে এ কী, আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলুম! আমি আবার ফিরলুম। তার পর বেদৌরাকে বলে এলুম, – ‘বেদৌরা! যদি কোনো দিন হৃদয় হতে ক্ষমা করবার ক্ষমতা হয়, তবেই আবার দেখা হবে, নইলে এই আমাদের চির-বিদায়! মুখে জোর করে ক্ষমা করলুম বলে তোমায় গ্রহণ করে আমি তো একটা মিথ্যাকে বরণ করে নিতে পারিনে। আমি চাই, প্রেমের অঞ্জন আমার এই মনের কালিমা মুছিয়ে দিক।’ বেদৌরা অশ্রু-ভরা হাসি হেসে বললে, – ‘ফিরতেই হবে প্রিয়তম, ফিরতেই যে হবে তোমায়! এ সংশয় দু-দিনেই কেটে যাবে। তখন দেখবে, আমাদের সেই ভালোবাসা কেমন ধৌত শুভ্র বেশে আরও গাঢ় পূত হয়ে দেখা দিয়েছে! আমি তোমারই প্রতীক্ষায় গোলেস্তানের এই ক্ষীণ ঝরনাটার ধারে বসে গান আর মালা গাঁথব। আর তা যে তোমায় পরতেই হবে। ব্যথার পূজা ব্যর্থ হওয়ার নয় প্রিয়! ...
কোথায় যাই এখন,
আর সে কোন্ পথে?
ওগো আমার পথের
চিরসাথি, কোথায়
তুমি? –
* * *
আমি সেই শয়তান, আমি সেই পাপী, যে এক দেবীকে বিপথে চালিয়েছিল। – ভাবলুম, এই ভুবনব্যাপী যুদ্ধে যে-কোনো দিকে যোগ দিয়ে যত শিগগির পারি এই পাপ-জীবনের অবসান করে দিই। তারপর? তারপর আর কী? যা সব পাপীদের হয়, আমারও হবে।
পাপী যদি সাজা পায়, তা হলে সে এই বলে শান্তি পায় যে তার উপর অবিচার করা হচ্ছে না, এই শাস্তিই যে তার প্রাপ্য। কিন্তু শাস্তি না পেলে ভিতরের বিবেকের যে দংশন, তা নরক-যন্ত্রণার চেয়ে অনেক বেশি ভয়ানক।
যা ভাবলুম, তা আর হল কই! ঘুরতে ঘুরতে শেষে এই মুক্তিসেবক সৈন্যদলের দলে যোগ দিলুম। এ পরদেশিকে তাদের দলে আসতে দেখে এই সৈন্যদল খুব উৎফুল্ল হয়েছে। এরা মনে করছে, এদের এই মহান নিঃস্বার্থ ইচ্ছা বিশ্বের অন্তরে অন্তরে শক্তি সঞ্চয় করছে। আমায় আদর করে এদের দলে নিয়ে এরা বুঝিয়ে দিলে যে কত মহাপ্রাণতা আর পবিত্র নিঃস্বার্থপরতা-প্রণোদিত হয়ে তারা উৎপীড়িত বিশ্ববাসীর পক্ষ নিয়ে অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, – এবং আমিও সেই মহান ব্যক্তিসংঘের একজন। আমার কালো বুকে অনেকটা তৃপ্তির আলোক পেলুম! –
খোদা, আজ আমি বুঝতে পারলুম, পাপীকেও তুমি ঘৃণা কর না, দয়া কর। তার জন্যেও সব পথই খোলা রেখে দিয়েছ। পাপীর জীবনেরও দরকার আছে। তা দিয়েও মঙ্গলের সলতে জ্বালানো যায়। সে ঘৃণ্য অস্পৃশ্য নয়!
কিন্তু সহসা এ কী দেখলুম? দারা কোথা থেকে এখানে এল? সেদিন তাকে অনেক জিজ্ঞেস করায় সে বললে, – ‘এর চেয়ে ভালো কাজ আর দুনিয়ায় খুঁজে পেলুম না, তাই এ-দলে এসেছি।’ আঘাত খেয়ে খেয়ে কত বিরাট গম্ভীর হয়ে গিয়েছে সে! আমাকে ক্ষমা চাইতেই হবে যে এই বেদনাতুর যুবকের কাছে; নইলে আমার কোথাও ক্ষমা নেই। এর প্রাণে এই ব্যথার আগুন জ্বালিয়েছি তো আমিই, একে গৃহহীন করেছি তো আমিই।
কী অচিন্ত্য অপূর্ব অসমসাহসিকতা নিয়ে যুদ্ধ করছে দারা। সবাই ভাবছে, এত অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রাণের প্রতি ভ্রুক্ষেপও না করে বিশ্ববাসীর মঙ্গলের জন্যে হাসতে হাসতে যে এমন করে বুকের রক্ত দিচ্ছে, সে বাস্তবিকই বীর, আর তাদের জাতিও বীরের জাতি! এমন দিন নেই, যেদিন একটা-না-একটা আঘাত আর চোট খেয়েছে সে। সেদিকে কিন্তু দৃষ্টিই নেই তার। সে যেন অগাধ অসীম এক যুদ্ধ-পিপাসা নিয়ে প্রচণ্ড বেগে মৃত্যুর মতো কঠোর হয়ে অন্যায়কে আক্রমণ করছে। যতক্ষণ এতটুকুও জ্ঞান থাকে তার, ততক্ষণ কার সাধ্য তাকে যুদ্ধস্থল থেকে ফেরায়! – কী একরোখা জেদ! আমি কিন্তু বুঝতে পারছি, এ সংগ্রাম তার বাইরের জন্যে নয়, এ যে ভিতরের ব্যথার বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভিযান। আমি জানি, হয় এর ফল অতি বিষময়, নতুবা খুবই শান্তসুন্দর!
কদিন থেকে বোমা আর উড়োজাহাজ হয়েছে এর সঙ্গী। বাইরে ভিতরে এত আঘাত এত বেদনা অম্লান বদনে সহ্য করে কী করে একাদিক্রমে যুদ্ধ জয় করছে এই উন্মাদ যুবক! ভয়টাকে যেন এ আরব সাগরে বিসর্জন দিয়ে এসেছে! আজ সে একজন সেনাপতি। কিন্তু এ কী অতৃপ্তি এখনও তার মুখে বুকে জাগছে! রোজই জখম হচ্ছে, কিন্তু তাকে হাসপাতালে পাঠায় কার সাধ্য? গোলন্দাজ সৈনিককে ঘুমাবার ছুটি দিয়ে ভাঙা-হাতেই সে কামান দাগছে। সেনাপতি হলেও সাধারণ সৈনিকের মতো তার হাতে গ্রিনেডের আর বোমার থলি, পিঠে তরল আগুনের ভালোতি, আর হাতে রিভলভার তো আছেই। রক্ত বইয়ে, লোককে হত্যা করে তার যে কী আনন্দ, সে আর কী বলব! সে বলছে, – পরাধীন লোক যত কমে ততই মঙ্গল।
আমি অবাক হচ্ছি,
এ সত্যি-সত্যিই
পাগল হয়ে যায়নি
তো!
* * *
এ কী করলে খোদা? এ কী করলে? এত আঘাতের পরেও হতভাগা দারাকে অন্ধ আর বধির করে দিলে? এই পৈশাচিক যুদ্ধ-তৃষ্ণার ফলে যে এই রকমই একটা কিছু হবে, তা আমি অনেক আগে থেকেই ভয় করছিলাম! আচ্ছা করুণাময়, তোমার লীলা আমরা বুঝতে পারিনে বটে, কিন্তু এই যে নিরাপরাধ যুবকের চোখ দুটো বোমার আগুনে অন্ধ আর কান দুটো বধির করে দিলে, আর আমার মতো পাপী শয়তানের গায়ে এতটুকু আঁচড় লাগল না, এতেও কি বলব যে, তোমার মঙ্গল-ইচ্ছা লুকানো রয়েছে? কী সে মঙ্গল, এ অন্ধকে দেখাও প্রভু, দেখাও! এ অন্ধের দাঁড়াবার যষ্টিও যে ভেঙে দিয়েছি আমি। তবে কি আমার বাহিরটা অক্ষত রেখে ভিতরটাকে এমনই ছিন্ন-ভিন্ন আর ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকবে? ওগো ন্যায়ের কর্তা! এই কি আমার দণ্ড, এই বিশ্বব্যাপী অশান্তি? ...
* * *
আজ আমাদের ঈপ্সিত এই প্রধান জয়োল্লাসের দিনেও আমাদের জয়-পতাকাটা রাজ-অট্টালিকার শিরে থর থর করে কাঁপছে! বিজয়-ভেরিতে জয়নাদের পরিবর্তে যেন জান-মোচড়ানো শ্রান্ত ‘ওয়ালটজ’-রাগিণীর আর্ত সুর হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বেরোচ্ছে! তূর্য-বাদকের স্বর ঘন ঘন ভেঙে যাচ্ছে! – আজ অন্ধ সেনানী দারার বিদায়ের দিন। অন্ধ-বধির আহত দারা যখন আমার কাঁধে ভর করে সৈনিকদের সামনে দাঁড়াল, তখন সমস্ত মুক্তি সেবক সেনার নয়ন দিয়ে হু হু করে অশ্রুর বন্যা ছুটেছে! আমাদের কঠোর সৈনিকদের কান্না যে কত মর্মন্তুদ, তা বোঝাবার ভাষা নেই। মুক্তিসেবক-সৈন্যাধ্যক্ষ বললেন, – তাঁর স্বর বারংবার অশ্রুজড়িত হয়ে যাচ্ছিল, – ‘ভাই দারাবি! আমাদের মধ্যে ‘ভিক্টোরিয়া ক্রস’ ‘মিলিটারি ক্রস’ প্রভৃতি পুরস্কার দেওয়া হয় না, কেননা আমরা নিজে নিজেই তো আমাদের কাজকে পুরস্কৃত করতে পারিনে। আমাদের বীরত্বের, ত্যাগের পুরস্কার বিশ্ববাসীর কল্যাণ; কিন্তু যারা তোমার মতো এই রকম বীরত্ব আর পবিত্র নিঃস্বার্থ ত্যাগ দেখায়, আমরা শুধু তাদেরই বীর বলি! সৈন্যাধ্যক্ষ পুনরায় ঢোক গিলে আর কোটের আস্তিনে তাঁর অবাধ্য অশ্রু-ফোঁটা কটি মুছে নিয়ে বললেন – ‘তুমি অন্ধ হয়েছ, তুমি বধির হয়েছ, তোমার সারা অঙ্গে জখমের কঠোর চিহ্ন, – আমরা বলব, এই তোমার বীরত্বের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার! অনাহূত তুমি বিশ্বের মঙ্গল-কামনায় প্রাণ দিতে এসেছিলে, তার বিনিময়ে খোদা নিজ হাতে যা দিয়েছেন, – হোক না কেন তা বাইরের চোখে নির্মম – তার বড়ো পুরস্কার মানুষ আমরা কী দেব ভাই? ‘খোদা নিশ্চয়ই মহান এবং তিনি ভালো কাজের জন্যে লোকদের পুরস্কৃত করেন!’ – এ যে তোমাদেরই পবিত্র কোরানের বাণী! অতএব হে বীর সেনানী, হয়তো তোমার এই অন্ধত্ব আর বধিরতার বুকেই সব শান্তি সব সুখ সুপ্ত রয়েছে! খোদা তোমায় শান্তি দিন!’ দারা তার দৃষ্টিহীন চোখ দুটি দিয়ে যতদূর সাধ্য সৈনিকগণকে দেখবার ব্যর্থ চেষ্টা করে অশ্রুচাপা কণ্ঠে শুধু বলতে পেরেছিল, –‘বিদায়, পবিত্র বীর ভাইরা আমার!’
আমি অন্ধ দারার সঙ্গে আবার এই গোলেস্তানেই এলাম! আর এই তো আমার ব্যর্থ জীবনের সান্ত্বনা, এই নির্বিকার বীরের সেবা! দারা আমায় ক্ষমা করেছে, আমায় সখা বলে কোল দিয়েছে! এতদিনে না এই হতভাগ্য যুবকের রিক্ত জীবন সার্থকতার পুষ্পে পুষ্পিত হয়ে উঠল! এতদিনে না সত্যিকার ভালোবাসায় তাকে ওই অসীম আকাশের মতোই অনন্ত উদার করে দিলে! রাস্তায় আসতে আসতে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, – ‘আচ্ছা ভাই, তুমি বেদৌরাকে ক্ষমা করেছ?’ সে কান্না-ভরা হাসি হেসে সাধকশ্রেষ্ঠ প্রেমিক রুমীর এই গজলটা গাইলে – ‘ওগো প্রিয়তম! তুমি যত বেদনার শিলা দিয়ে আমার বুকে আঘাত করেছ, আমি তাই দিয়ে যে প্রেমের মহান-মসজিদ তৈরি করেছি!’
আমার বিশ্বাস, শিশুদের চেয়ে সরল আর কিছু নেই দুনিয়ায়। দারাও প্রেমের মহিমায় যেন অমনই সরল শিশু হয়ে পড়েছে। তার মুখে কেমন সহজ হাসি, আবার কেমন অসংকোচ কান্না! তা কিন্তু অতি বড়ো পাষাণকেও কাঁদায়! আমি সেদিন হাসতে হাসতে বললাম, – ‘হাঁ ভাই, এই যে অন্ধ আর বধির হলে, এতে মঙ্গলময়ের কোনো মঙ্গলের আভাস পাচ্ছ কি?’ সে বললে, – ‘ওরে বোকা, এই যে তোদের আজ ক্ষমা করতে পেরেছি – এই যে আমার মনের সব গ্লানি সব ক্লেদ ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে গিয়েছে, সে এই অন্ধ হয়েছি বলেই তো, – এই বাইরের চোখ দুটোকে কানা করে আর শ্রবণ দুটোকে বধির করেই তো! অন্ধেরও একটা দৃষ্টি আছে, সে হচ্ছে অর্ন্তদৃষ্টি যা অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি। এখন আমি দেখছি দুনিয়া-ভরা শুধু প্রিয়ার রূপ আর তারই হাসির অনন্ত আলো! আর এই কালা কান দুটো দিয়ে কী শুনছি, জানিস? শুধু তার কানে-কানে-বলা গোপন-প্রেমালাপের মঞ্জু গুঞ্জন আর চরণ-ভরা মঞ্জীরের রুনু-ঝুনু বোল! – আমি যে এই নিয়েই মশগুল!’ বলেই অভিভূত হয়ে সে গান ধরলে, –
‘যদি আর কারে ভালোবাস, যদি আর ফিরে নাহি আস,
তবে তুমি যাহা চাও, তাই যেন পাও, আমি যত দুখ পাই গো!
আমার পরান যাহা চায়, তুমি তাই তুমি তাই গো,
তোমা ছাড়া মোর এ জগতে আর কেহ নাই কিছু নাই গো!’ –
কানাড়া রাগিণীর কোমল গান্ধারে আর নিখাদে যেন তার সমস্ত আবিষ্ট বেদনা মূর্তি ধরে মোচড় খেয়ে খেয়ে কেঁদে যাচ্ছিল! – কিন্তু কত শান্ত স্নিগ্ধ বিরাট নির্ভরতা আর ত্যাগ এই গানে!
সবচেয়ে আমার বেশি আশ্চর্য বোধ হচ্ছে যে, বেদৌরাও আমাকে ক্ষমা করেছে, অথচ তার এ-বলায় এতটুকু কৃত্রিমতা বা অস্বাভাবিকতা নেই। এ যেন প্রাণ হতে ক্ষমা করে বলা!
খোদা, তুমি মহান! ‘যার কেউ নেই তুমি তার আছ।’ এই প্রেমিকদের সোনার কাঠির স্পর্শে আমি যে আমি, তারও আর কোনো গ্লানি নেই, সংকোচ নেই।
আজ এই বিনা কাজের আনন্দ, – ওঃ তা কত মধুর আর সুন্দর!
বেদৌরার কথা
গোলেস্তান
(নির্ঝরের অপর পার)
তিনি আমায় ক্ষমা করেছেন একেবারে প্রাণ খুলে হৃদয় হতে! এবার এ-ক্ষমায় এতটুকু দীনতা নেই। এ যে হবেই, তাতো আমি জানতামই, আর তাই যে এমন করে আমার প্রতীক্ষার সকাল-সাঁঝগুলি আনন্দেই কেটে গিয়েছে! আমার এই আশায় বসে-থাকা দিনগুলির, বিরলে-গাঁথা ফুলহারগুলি আর বেদনাবারিসিক্ত বিরহ-গানগুলি তাঁরই পায়ে ঢেলে দিয়েছি। তিনি তা গলায় তুলে তার বিনিময়ে যা দিয়েছেন, সেই তো গো তাঁর আমায়-দেওয়া ব্যথার দান!
তিনি বললেন, – ‘বেদৌরা! কামনা আর প্রেম, এ দুটো হচ্ছে সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। কামনা একটা প্রবল সাময়িক উত্তেজনা আর প্রেম হচ্ছে ধীর, প্রশান্ত ও চিরন্তন। কামনার প্রবৃত্তি বা তার নিবৃত্তিতে হৃদয়ের দাগ-কাটা ভালোবাসাকে যে ঢাকতেই পারে না, এ হচ্ছে ধ্রুব সত্য। এই রকম বিড়ম্বিত যে বেচারারা এই কথাটা একটু তলিয়ে দেখে ধীরভাবে বিশ্বাস করে না, তারা মস্ত ভুল করে, আর তাদের মতো হতভাগ্য অশান্তির জীবনও আর কারুর নেই। – বাদলার দিনে কালো মেঘগুলো সূর্যকে গ্রাস করতে যতই চেষ্টা করুক, তা কিন্তু পারে না। তবে তাকে খানিকক্ষণের জন্যে আড়াল করে থাকে মাত্র। কেননা সূর্য থাকে মেঘের নাগাল পাওয়ার সে অনেক দূরে। কোন্ ফাঁকে আর সে কেমন করে যে অত মেঘের পুরু স্তর ছিঁড়ে রবির কিরণ দুনিয়ার বুকে প্রতিফলিত হয়, তা মেঘও ভেবে পায় না, আর আমরাও জানতে চেষ্টা করিনে। তার পর মেঘ কেটে গেলেই সূর্য হাসতে থাকে আরও উজ্জ্বল হয়ে। কারণ তাতে তো সূর্যের কোনো অনিষ্টই হয় না, – সে জানে, সে যেমন আছে তেমনই অটুট থাকবেই; ক্ষতি যা তোমার আমার – এ দুনিয়ার। তাই বলে কি বাদলের মেঘ আসবে না? সে এসে আকাশ ছাইবে না? সে আসবেই, ও যে স্বভাব; তাকে কেউ রুখতে পারবে না। তবে অত বাদলেও সূর্যকিরণ পেতে হলে মেঘ ছাড়িয়ে উঠতে হয়। সেটা তেমন সোজা নয়, আর তা দরকারও করে না – কামনাটা হচ্ছে ঠিক এই বাদলের মতো; আর প্রেম জ্বলছে হৃদয়ে ওই রবিরই মতো একইভাবে সমান ঔজ্জ্বল্যে!
‘কামনায় হয়তো তোমার বাহিরটা নষ্ট করেছে, কিন্তু ভিতরটা নষ্ট তো করতে পারেনি। তাছাড়া, ও না হলে যে তুমি আমাকে এত বেশি করে চিনতে না, এত বড়ো করে পেতে না। বাইরের বাতাস প্রেমের শিখা নিবাতে পারে না, আরও উজ্জ্বল করে দেয়। আর আমার অন্ধত্ব ও বধিরতা? ওর জন্যে কেঁদো না বেদৌরা, এগুলো থাকলে তো আমি তোমায় আর পেতাম না!’
পুষ্পিত সেব গাছ থেকে অশ্রুচাপা কণ্ঠে ‘পিয়া পিয়া’ করে বুলবুলগুলো উড়ে গেল।
তিনি আবার বললেন, – ‘দেখ বেদৌরা, আজ আমাদের শেষ বাসর-শয্যা হবে। তার পর রবির উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তুমি চলে যাবে নির্ঝরটার ও-পারে, আর আমি থাকব এ-পারে। এই দু-পারের থেকে আমাদের দুজনেরই বিরহ-গীতি দুইজনকে ব্যথিয়ে তুলবে। আর ওই ব্যথার আনন্দেই আমরা দুজনে দুজনকে আরও বড়ো – আরও বড়ো করে পাব!’
সেই দিন থেকে আমি নির্ঝরটার এ-পারে।
আমারও অশ্রু-ভরা দীর্ঘশ্বাস হুহু করে ওঠে, যখন মৌন-বিষাদে-নীরব সন্ধ্যায় তাঁর ভারী চাপা কণ্ঠ ছেপে রাগিণী ও-পার হতে কাঁদতে কাঁদতে এ-পারে এসে বলে, –
আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন,
আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন!