হেনা (গল্প)
সিঁন নদীর ধারের তাম্বু, ফ্রান্স
এই দুটো দিনের আটচল্লিশ ঘন্টা খালি
লম্বা ঘুম দিয়ে কাটিয়ে দেওয়া গেল। এখন আবার ধড়া-চুড়ো পরে বেরোতে হবে খোদার সৃষ্টি
নাশ করতে। এই মানুষ-মারা বিদ্যে লড়াইটা ঠিক আমার মতো পাথর-বুকো কাঠখোট্টা লোকেরই
মনের মতো জিনিস।
আজ সেই বিদেশিনি কিশোরী আমাকে তাদের
বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। কী পরিষ্কার সুন্দর ফিটফাট বাড়িগুলো এদের! – মেয়েটা আমাকে খুব
ভালোবেসেছে। আমিও বেসেছি। আমাদের দেশ হলে বলত মেয়েটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে! কুড়ি একুশ
বছরের একজন যুবকের সঙ্গে একটা কুমারী কিশোরীর মেলা-মেশা আদৌ পছন্দ করত না!
ভালোবাসাটাকে কী কুৎসিত চক্ষে দেখেছে
আজকাল লোকেরা! মানুষ তো নয়, যেন শকুনি! – দুনিয়ায় এত পাপ! মানুষ এত ছোটো হল কী করে?
– তাদের মাথার উপর অমন উদার অসীম নীল আকাশ, আর তার নীচে মানুষ কী সংকীর্ণ, কী ছোটো!
আগুন, তুমি ঝরো – ঝম ঝম ঝম! খোদার
অভিশাপ, তুমি নেমে এসো ওই নদীর বুকে জমাট বরফের মতো হয়ে – ঝুপ ঝুপ ঝুপ! ইসারাফিলের
শিঙ্গা, তুমি বাজো সবকে নিঃসাড় করে দিয়ে – ওম ওম ওম! প্রলয়ের বজ্র, তুমি কামানের
গোলা আর বোমার মধ্যে দিয়ে ফাটো ঠিক মানুষের মগজের উপর – দ্রুম-দ্রুম-দ্রুম! আর
সমস্ত দুনিয়াটা – সমস্ত আকাশ উলটে ভেঙে পড়ো তাদের মাথায়, যারা ভালোবাসায় কলঙ্ক আনে,
ফুলকে অপবিত্র করে।
এখন যে সাজে সেজেছি, ঠিক এই রকম সাজে
যদি আমাদের দেশের একটা লোককে সাজিয়ে উলটে ফেলে দিই, তাহলে হাজার ধ্বস্তাধ্বস্তি
করেও সে আর উঠতে পারবে না। আমার নিজেরই হাসি পাচ্ছে আমার এখনকার এই গদাই-লশকরি
চেহারা দেখে!
আমার এক ‘ফাজিল’ বন্ধু বলেছেন – ‘কী
নিমকিন চেহারা!’ – আহা কী উপমার ছিরি! কে নাকি বলেছিল, – ‘ষাঁড়টা দেখতে যেন ঠিক
কাতলা মাছ!’
ফ্রান্স
প্যারিসের পাশের ঘন বন
কাল হঠাৎ এই মস্ত জঙ্গলটায় আসতে হল। কেন এ রকম পিছিয়ে আসতে হল তার
এতটুকুও জানতে পারলুম না! এ মিলিটারি লাইনের ওইটুকু সৌন্দর্য! তোমার উপর হুকুম হল,
‘ওই কাজটা করো!’ ‘কেন ও-রকম করব?’ তার কৈফিয়ত চাইবার কোনো অধিকার নেই তোমার। বাস –
হুকুম!
যদি বলি, ‘মৃত্যু যে ঘনিয়ে আসছে!’
অমনি বজ্রগম্ভীর স্বরে তার কড়া জবাব আসবে, – ‘যতক্ষণ তোমার নিশ্বাস আছে, ততক্ষণ কাজ
করে যাও; যদি চলতে চলতে তোমার ডান পায়ের উপর মৃত্যু হয়, তবে বাম পা পর্যন্ত চলো!’
আঃ এই হুকুম মানায়, এই জীবন-পণ
আনুগত্যে কত সে নিবিড় মাধুরী! বাজের মাঝে এ কী কোমলতা! যদি সমস্ত দুনিয়াটা এমনই
একটা (এবং কেবল একটা) সামরিক শক্তির অধীন হয়ে যেত, তা হলে এই মাটির জমিনই এমন একটা
সুন্দর স্থান হয়ে দাঁড়াত যাকে ‘জিন্নাতুল বাকিয়া’ (শ্রেষ্ঠতম স্বর্গ) বললেও লোক
তৃপ্ত হত না!
কী শৃঙ্খলা এই ব্রিটিশ জাতিটার
কাজে-কর্মে কায়দা-কানুনে, তাই তারা আজ এত বড়ো। উপর দিকে চাইতে গিয়ে আমাদের মাথার
পাগড়ি পড়ে গেলেও তাদের মাথাটা দেখতে পাব না! মোটামুটি বলতে গেলে তাদের এই
দুনিয়া-জোড়া রাজত্বিটা একটা মস্তো বড়ো ঘড়ি, আর সেটা খুবই ঠিক চলছে, কেননা তার
সেকেন্ডের কাঁটা থেকে ঘন্টার কাঁটা পর্যন্ত সব তাতে বড্ডো কড়া বাঁধাবাঁধি একটা
নিয়ম। সেটা আবার রোজই ‘অয়েল্ড’ হচ্ছে তার কোথাও একটু জং ধরে না।
আমরাই নিয়ে গেলুম জার্মানদের
‘হিন্ডেনবার্গ লাইন’ পর্যন্ত খেদিয়ে, আবার আমাদেরই এতটা পিছিয়ে যেতে হল! – ঘড়িটা যে
তৈরি করেছে, সে জানে কোন্ কাঁটার কোন্খানে কী কাজ, কিন্তু কাঁটা কিছু বুঝতে পারে
না। তবু তাকে কাজ করে যেতে হবে, কেননা, একটা স্প্রিং অনবরত তার পেছন থেকে তাকে
গুঁতো মারছে!
এমনই একটা বিরাট কঠিন শৃঙ্খল, মস্ত
বাঁধাবাঁধি আমাদের খুবই দরকার। আমাদের এই ‘বেঁড়ে’ জাতটাকে এমনই খুব পিঠ-মোড়া করে
বেঁধে দোরস্ত না করলে এর ভবিষ্যতে আর উঠে দাঁড়াবার কোনো ভরসা নেই! দেশের সবাই মোড়ল
হলে কী আর কাজ চলে!
ওঃ, এত দূরেও আমাদের উপর গোলাবৃষ্টি!
এ যেন একটা ভূতুড়ে কাণ্ড। কোথায় কোন্ সুদূরে লড়াই হচ্ছে, আর এখানে কী করে এই জঙ্গলে
গোলা আসছে?
হাতি যখন ভাবে, তার চেয়ে বড়ো জানোয়ার
আর নেই, তখন ছোট্ট একটি মশা তার মগজে কামড়ে কীরকম ঘায়েল করে দেয় তাকে।
এখানে এই গাছ-পালার আড়ালে একটা
স্নিগ্ধ ছায়ার অন্ধকারে বেশ থাকা যাচ্ছে, কিন্তু এমনই একটু অন্ধকারের জন্যে আমার
জানটা বড্ড বেশি আকুলি-বিকুলি করে উঠেছিল!
হায়! এই অন্ধকারে এলে কত কথাই মনে
পড়ে আমার আবার – নাঃ! যাই একবার গাছে চড়ে দেখি আশে পাশে কোথাও দুশমন লুকিয়ে আছে
কিনা।
আহ, গাছ
থেকে ওই দূরে বরফে-ঢাকা নদীটা কী সুন্দর। আবার ওই গোলার ঘায়ে ভাঙা মস্ত বাড়িগুলো কী
বিশ্রী হাঁ করে আছে! এই সব
ভাঙা-গড়া দেখে আমার সেই ছোট্টবেলাকার কথা মনে পড়ে। তখন আমরা খুব ঘটা করে ধূলোবালির
ঘর বানাতুম। তারপর খেলা শেষ হলে সেগুলোকে পা দিয়ে ভেঙে দিতুম, আর সমস্বরে ভাঙার গান
গাইতুম, –
‘হাতের সুখে বানালুম
পায়ের সুখে ভাঙলুম!’
অনেক দূরে ওই
কামানের গোলাগুলো পড়ছে আর এখান থেকে দেখাচ্ছে যেন আশমানের বুক থেকে তারাগুলো খসে
খসে পড়ছে!
ওঃ, কী বোঁ বোঁ শব্দ! ওই যে মস্ত
উড়োজাহাজ কী ভয়ানক জোরে ঘুরছে, উঠছে আর নামছে! ঠিক যেন একটা চিলেঘুড়িকে খেলোয়াড়
গোঁতা মারছে। ওটা আমাদেরই। জার্মানদের জেপেলিনগুলো দূরে থেকে দেখায় যেন একটা বড়ো
শুঁয়োপোকা উড়ে যাচ্ছে।
যাক, আমার ‘হ্যাভারস্যাক’ থেকে একটু
আচার বের করে খাওয়া যাক। সেই বিদেশিনি মেয়েটি আজ কত দূরে, কিন্তু তার ছোঁয়া যেন
এখনও লেগে রয়েছে এই ফলের আচারে! – দূর ছাই! যত সব বাজে কথা মনে হয় কেন? খামোখা সাত
ভূতের বেদনা এসে জানটা কচলে কচলে দিয়ে যায়!
হা–হা–হা–হাঃ, বন্ধু আমার পাশের
গাছটায় ঘুমোবার চেষ্টা করছেন দেখছি, ওই যে দিব্যি কোমরবন্ধটা দিয়ে নিজেকে একটা
ডালের সঙ্গে বেশ শক্ত করে বেঁধেছেন। একবার পড়েন যদি ঝুপ করে ওই নীচের জলটায়, তাহলে
বেড়ে একটা রগড় হয় কিন্তু! পড়িস আল্লা করে – এই সড়াৎ দু–ম্!...
দেব নাকি তার কানের গোড়া দিয়ে শোঁ
করে একটা পিস্তলের গুলি ছেড়ে? আহা-হা, না, না ঘুমুক বেচারা! আমার মতন এমন পোড়া-চোখ
তো আর কারুর নেই যে, ঘুম আসবে না, আর এমন পোড়া মনও কারুর নেই, যে সারা দুনিয়ার কথা
ভেবে মাথা ধরাবে!
রাত্রি হয়েছে, – অনেকটা হবে। ভোর
পর্যন্ত এমনি করেই কুঁকড়ো অবতার হয়ে থাকতে হবে। ... বুড়ো কালে (অবশ্য, যদি ততদিন
বেঁচে থাকি!) এইসব কথা আর খাটুনির স্মৃতি কী মধুর হয়ে দেখা দেবে!
মেঘ ছিঁড়ে পূর্ণিমার আগের দিনের
চাঁদের জ্যোছনা কেমন ছিটে-ফোঁটা হয়ে পড়ছে সারা বনটার বুকে! এখন সমস্ত বনটাকে একটা
চিতাবাঘের মতো দেখাচ্ছে!
কালো ভারী জমাট মেঘগুলো আমার মাথার
দু-হাত উপর দিয়ে আস্তে আস্তে কোথায় ভেসে উধাও হয়ে যাচ্ছে, আর তারই দু -এক ফোঁটা
শীতল জল আমার মাথায় পড়ছে টপ-টপ-টপ! কী করুণ শীতল সে জমাট মেঘের দু-ফোঁটা জল! আঃ!
চাঁদটা একবার ঢাকা যাচ্ছে, আবার শাঁ
করে বেরিয়ে আর একটা মেঘে সেঁধিয়ে পড়ছে! এ যেন বাদশাহজাদার শিশমহলের সুন্দরীদের সাথে
লুকোচুরি খেলা। কে ছুটছে? চাঁদ, না মেঘ? আমি বলব ‘মেঘ’, একটি সরল ছোট্ট শিশু বলবে
‘চাঁদ’। কার কথা সত্যি? –
আহা, কী সুন্দর আলো-ছায়া!
দূরে ওটা কি একটা পাখি অমন করে
ডাকছে? এ দেশের পাখিগুলোর সুর কেমন একটা মধুর অলসতায় ভরা! শুনতে যেন নেশা ধরে।
এই আলো ছায়ায় আমার কত কথাই না মনে
পড়ছে! ওঃ তার চিন্তাটা কী ব্যথায় ভরা! –
আমার মনে পড়ছে আমি বললুম, – ‘হেনা,
তোমায় বড্ডো ভালোবাসি।’
সে, – হেনা তার কস্তুরীর মতো কালো
পশমিনা অলকগোছা দুলিয়ে দুলিয়ে বললে, – ‘সোহরাব , আমি যে এখনও তোমায় ভালোবাসতে
পারিনি!
সেদিন জাফরানের ফুলে যেন ‘খুন-খুশরোজ
’ খেলা হচ্ছিল বেলুচিস্তানের ময়দানে!
আমি আনমনে আখরোটের ছোট্ট একটা ডাল
ভেঙে কাছের দেবদারু গাছ থেকে কতকগুলো ঝুমকো ফুল পেড়ে হেনার পায়ের কাছে ফেলে দিলুম!
স্তাম্বুলি -সুরমা-মাখা তার কালো
আঁখির পাতা ঝরে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল! তার মেহেদি-ছোবানো হাতের চেয়েও লাল হয়ে
উঠেছিল তার মুখটা!
একটা কাঁচা মনক্কার থোকা ছিঁড়ে নিয়ে
অদূরের কেয়াঝোপের বুলবুলিটার দিকে ছুঁড়ে দিলুম। সে গান বন্ধ করে উড়ে গেল।
মানুষ যেটা ভাবে সব চেয়ে কাছে,
সেইটাই হচ্ছে সব চেয়ে দূরে! এ একটা মস্ত বড়ো প্রহেলিকা
হেনা ! হেনা!! আপশোশ!!!