হেনা (গল্প)
হিন্ডেনবার্গ লাইন
ওঃ! আবার কোথায় এসেছি! এটা যে একটা পাতালপুরি, – দেও আর পরিদের
রাজ্যি, তা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিনে! যুদ্ধের ট্রেঞ্চ যে একটা বড়ো শহরের মতো
এরকম ঘর-বাড়িওয়ালা হবে, তা কি কেউ অনুমান করতে পেরেছিল? জমিনের এত নীচে কী বিরাট
কাণ্ড! এও একটা পৃথিবীর মস্ত বড়ো আশ্চর্য! দিব্যি বাংলার নওয়াবের মতো থাকা যাচ্ছে
কিন্তু এখানে!...
এ শান্তির জন্যে তো আসিনি এখানে! আমি
তো সুখ চাইনি! আমি চেয়েছি শুধু ক্লেশ, শুধু ব্যথা, শুধু আঘাত! এ আরামের জীবন আমার
পোষাবে না বাপু! তাহলে আমাকে অন্য পথ দেখতে হবে। ও যেন ঠিক ‘টকের ভয়ে পালিয়ে এসে
তেঁতুলতলায় বাসা।’
উঁহুঁ, – আমি কাজ চাই! নিজেকে ডুবিয়ে
রাখতে চাই। এ কী অস্বস্তির আরাম!
আচ্ছা, আগুনে পুড়ে নাকি লোহাও ইস্পাত
হয়ে যায়। মানুষ কী হয়? শুধু ‘ব্যাপটাইজড’?
আবার মনটা ছাড়া পেয়ে আমার সেই আঙুর
আর বেদানা গাছে ভরা ঘরটার দৌড় মেরেছে! আবার মনে পড়ছে সেই কথা! ...
‘হেনা, আমি যাচ্ছি মুক্ত দেশের আগুনে
ঝাঁপিয়ে পড়তে! যার ভিতরে আগুন, আমি চাই তার বাইরেও আগুন জ্বলুক! আর হয়তো আসব না।
তবে আমার সম্বল কী? পাথেয় কই? আমি কী নিয়ে সেই অচিন দেশে থাকব?’
আমার হাতের মুঠোয় হেনার হেনারঞ্জিত
হাত দুটি কিশলয়ের মতো কেঁপে কেঁপে উঠল। সে স্পষ্টই বললে, – ‘এ তো তোমার জীবনের
সার্থকতা নয় সোহরাব! এ তোমার রক্তের উষ্ণতা! এ কী মিথ্যাকে আঁকড়ে ধরতে যাচ্ছ! এখনও
বোঝ! – আমি তোমায় আজও ভালবাসতে পারিনি।’
সব খালি! সব শূন্য! খাঁ – খাঁ – খাঁ!
একটা জোর দমকা বাতাস ঘন ঝাউ গাছে বাধা পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, – আঃ – আঃ – আঃ!
যখন কোয়েটা থেকে আমাদের ১২৭ নম্বর
বেলুচি রেজিমেন্টের প্রথম ‘ব্যাটেলিয়ন’যাত্রা করলে এই দেশে আসবার জন্যে, তখন আমার
বন্ধু একজন যুবক বাঙালি ডাক্তার সেব গাছের তলায় বসে গাচ্ছিল, –
‘এখন ফিরাবে তারে কীসের ছলে,
বিদায় করেছ যারে নয়ন-জলে। –
আজি মধু সমীরণে
নিশীথে কুসুম-বনে,
তারে কি পড়েছে মনে বকুল-তলে,
এখন ফিরাবে হায় কীসের ছলে!
মধুনিশি পূর্ণিমার
ফিরে আসে বার বার
সে জন ফিরে না আর যে গেছে চলে!
এখন ফিরাবে আর কীসের ছলে!’
কী দুর্বল আমি। সাধে কী আসতে চাইনি এখানে! ওগো, এরকম নওয়াবি-জীবন আমার চলবে না!
হিন্ডেনবার্গ লাইন
কী করি, কাজ না থাকলেও আমায় কাজ খুঁজে নিতে হয়। কাল রাত্তিরে
প্রায় দু-মাইল শুধু হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে ওদের অনেক তার কেটে দিয়ে এসেছি। কেউ এতটুকু
টের পায়নি।
আমার ‘কমান্ডিং অফিসার’ সাহেব
বলেছেন, ‘তুমকো বাহাদুরি মিল যায়েগা।’
আজ আমি ‘হাবিলদার’ হলুম।
এ মন্দ খেলা নয় তো! –
আবার সেই বিদেশিনির সঙ্গে দেখা
হয়েছিল। এই দুবছরে কত বেশি সুন্দর হয়ে গেছে সে! সেদিন সে সোজাসুজি বললে যে, (যদি
আমার আপত্তি না থাকে) সে আমায় তার সঙ্গী-রূপে পেতে চায়! আমি বললুম, – ‘না, তা হতেই
পারে না।’
মনে মনে বললুম, – ‘অন্ধের লাঠি একবার
হারায়। আবার? আর না, যা যা খেয়েছি, তাই সামলানো দায়।’
বিদেশিনির নীল চোখ দুটা যে কীরকম জলে
ভরে উঠেছিল, আর বুকটা তার কীরকম ফুলে ফুলে উঠেছিল, তা আমার মতো পাষাণকেও
কাঁদিয়েছিল!
তারপর সে নিজেকে সামলে নিয়ে বললে, –
‘তবে আমাকে ভালোবাসতে দেবে তো? অন্তত ভাই-এর মতো ...’
আমি বেওয়ারিশ মাল। অতএব খুব আগ্রহ
দেখিয়ে বললুম, – ‘নিশ্চয়, নিশ্চয়!’ তার পর তার ভাষার ‘অডিএ’ (বিদায়) বলে সে যে সেই
গিয়েছে, আর আসেনি! আমার শুধু মনে হচ্ছে, – ‘সে জন ফিরে না আর যে গেছে চলে! ...’
ওঃ –
যা হোক, আজ গুর্খাদের পেয়ে বেশ থাকা
গেছে কিন্তু। গুর্খাগুলো এখনও যেন এক একটা শিশু । দুনিয়ার মানুষ যে এত সরল হতে
পারে, তা আমার বিশ্বাসই ছিল না। এই গুর্খা আর তাদের ভায়রা-ভাই ‘গাড়োয়াল’, এই দুটো
জাতই আবার যুদ্ধের সময় কীরকম ভীষণ হয়ে ওঠে! তখন প্রত্যেকে যেন এক-একটা ‘শেরে
বব্বর’! এদের ‘খুক্রি’ দেখলে এখনও জার্মানরা রাইফেল ছেড়ে পালায়। এই দুটো জাত যদি
না থাকত, তাহলে আজ এতদূর এগুতে পারতুম না আমরা। তাদের মাত্র কয় জন আর বেঁচে আছে।
রেজিমেন্টকে রেজিমেন্ট একেবারে সাবাড়! অথচ যে দু-চার জন বেঁচে আছে, তারাই কীরকম
হাসছে খেলছে! যেন কিছুই হয়নি।
ওরা যে মস্ত একটা কাজ করেছে, এইটেই
কেউ এখনও ওদের বুঝিয়ে উঠতে পারেনি! আর ওই অত লম্বা-চওড়া শিখগুলো, তারা কী
বিশ্বাসঘাতকতাই না করেছে! নিজের হাতে নিজে গুলি মেরে হাসপাতালে গিয়েছে।
বাহবা! ট্রেঞ্চের ভিতর একটা
ব্যাটালিয়ন ‘মার্চ’ হচ্ছে। ফ্রান্সের মধুর ব্যান্ডের তালে তালে কী সুন্দর পা-গুলো
পড়ছে আমাদের! লেফট – রাইট – লেফট! ঝপ – ঝপ – ঝপ। এই হাজার লোকের পা এক সঙ্গেই উঠছে,
এক সঙ্গেই পড়ছে! কী সুন্দর!
বেলুচিস্তান
কোয়েটার দ্রাক্ষাকুঞ্জস্থিত
আমার ছোট্ট কুটির
এ কী হল? আজ এই আখরোট আর নাশপাতির বাগানে বসে বসে তাই ভাবছি!
আমাদের সব ভারতীয় সৈন্য দেশে ফিরে
এল, আমিও এলুম। কিন্তু সে দুটো বছর কী সুখেই কেটেছে
আজ এই স্বচ্ছ নীল একটু-আগে-বৃষ্টির
জলে-ধোয়া আশমানটি দেখছি, আর মনে পড়ছে সেই ফরাসি তরুণীটির ফাঁক ফাঁক নীল চোখ দুটি।
পাহাড়ে ওই চমরী মৃগ দেখে তার সেই থোকা থোকা কোঁকড়ান রেশমি চুলগুলো মনে পড়ছে। আর ওই
যে পাকা আঙুর ঢল ঢল করছে, অমনি স্বচ্ছ তার চোখের জল।
আমি ‘আফসার’ হয়ে ‘সর্দার বাহাদুর’
খেতাব পেলুম। সাহেব আমায় কিছুতেই ছাড়বে না। – হায়, কে বুঝবে আর কাকেই বা বোঝাব, ওগো
আমি বাঁধন কিনতে আসিনি। সিন্ধুপারে কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে নিয়েও যাইনি। ও শুধু নিজেকে
পুড়িয়ে খাঁটি করে নিতে, – নিজেকে চাপা দিতে! –
আবার এইখানটাতেই, যেখানে কখনও আসব না
মনে করেছিলুম, আসতে হল। এ কী নাড়ির টান! ... আমার কেউ নেই, কিছু নেই, তবু কেন রয়ে
রয়ে মনে হচ্ছে, – না, এইখানেই সব আছে। এ কার মূঢ় অন্ধ সান্ত্বনা? –
কারুর কিচ্ছু করিনি, আমারও কেউ
কিচ্ছু করেনি, তবে কেন এখানে আসছিলুম না? – সে একটা অব্যক্ত বেদনার অভিমান, – সেটা
প্রকাশ করতে পারছিনে।
হেনা! হেনা! – সাবাস! কেউ কোথাও নেই,
তবুও ওধার থেকে বাতাসে ভেসে আসছে ও কী শব্দ, – ‘না,–না–না।’
পাহাড় কেটে নির্ঝরটা তেমনই বইছে,
কেবল যার মেহেদি-রাঙানো পদ-রেখা এখনও ওর পাথরের বুকে লেখা রয়েছে, সেই হেনা আর নেই।
এখানে ছোটো-খাটো কত জিনিস পড়ে রয়েছে, যাতে তার কোমল হাতের ছোঁয়ার গন্ধ এখনও পাচ্ছি।
হেনা! হেনা! হেনা! আবার প্রতিধ্বনি,
নাঃ–নাঃ–নাঃ!
* * *
পেশোয়ার
পেয়েছি, পেয়েছি! আজ তার দেখা পেয়েছি! হেনা! হেনা! – তোমাকে আজ
দেখেছি এইখানে, এই পেশোয়ারে! তবে কেন মিথ্যা দিয়ে এত বড়ো একটা সত্যকে এখনও ঢেকে
রেখেছ?
সে আমায় লুকিয়ে দেখেছে আর কেঁদেছে।
... কিছু বলেনি, শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছে আর কেঁদেছে।...
এরকম দেখায় যে অশ্রু প্রাণের শ্রেষ্ঠ
ভাষা। সে আজও বললে, – ‘সে আমায় ভালোবাসতে পারেনি।...
ওই ‘না’ কথাটা বলবার সময়, সে কী করুণ
একটা কান্না তার গলা থেকে বেরিয়ে ভোরের বাতাসটাকে ব্যথিয়ে তুলেছিল!
দুনিয়ার সবচেয়ে মস্ত হেঁয়ালি হচ্ছে –
মেয়েদের মন!
ডাক্কা ক্যাম্প
কাবুল
যখন মানুষের মতো মানুষ আমির হাবিবুল্লাহ খাঁ শহিদ হয়েছেন শুনলুম,
তখন আমার মনে হল এত দিনে হিন্দুকুশের চূড়াটা ভেঙে পড়ল! সুলেমান পর্বত জড়সুদ্ধ
উখড়িয়ে গেল।
ভাবতে লাগলুম, আমার কী করা উচিত? দশ
দিন ধরে ভাবলুম। বড্ড শক্ত কথা!
নাঃ, আমিরের হয়ে যুদ্ধ করাই ঠিক মনে
করলুম। কেন? এ ‘কেন’র উত্তর নেই। তবুও আমি সরল মনে বলছি, ইংরেজ আমার শত্রু নয়। সে
আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু। যদি বলি, আমার আবার এ যুদ্ধে আসার কারণ একটা দুর্বলকে রক্ষা
করবার জন্যে প্রাণ আহুতি দেওয়া, তা হলেও ঠিক উত্তর হয় না।
আমার অনেক খামখেয়ালির অর্থ আমি নিজেই
বুঝি না!
সেদিন ভোরে ডালিম ফুলের গায়ে কে আগুন
লাগিয়ে দিয়েছিল! ওঃ, সে যেন আমারই মতো আরও অনেকের বুকের খুন-খারাবি! ...
উদার আকাশটা কেঁদে কেঁদে একটুর জন্যে
থেমেছে। তার চোখটা এখনও খুব ঘোলা, আবার সে কাঁদবে। কার সে বিয়োগ-ব্যথায় বিধুর
কোয়েলিটাও কেঁদে কেঁদে চোখ লাল করঞ্জ করে ফেলেছিল, আর তার উহুঁ – উহুঁ, শব্দ
প্রভাতের ভিজে বাতাসে টোল খাইয়ে দিচ্ছিল! শুকনো নদীটার ও-পারে বসে কে সানাইতে
আশোয়ারি রাগিণী ভাঁজছিল। তার মিড়ে মিড়ে কত যে চাপা হৃদয়ের কান্না কেঁপে কেঁপে
উঠছিল, তা সবচেয়ে বেশি বুঝছিলুম আমি। মেহেদি ফুলের তীব্র গন্ধে আমাকে মাতাল করে
তুলেছিল।
আমি বললুম, – ‘হেনা, আমিরের হয়ে
যুদ্ধে যাচ্ছি। আর আসব না। বাঁচলেও আর আসব না।’
সে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বললে, –
‘সোহরাব প্রিয়তম! তাই যাও! – আজ যে আমার বলবার সময় হয়েছে, তোমায় কত ভালোবাসি! – আজ
আর আমার অন্তরের সত্যিকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে আশেককে কষ্ট দেব না।’
আমি বুঝলুম, সে বীরাঙ্গনা, আফগানের
মেয়ে। যদিও আফগান হয়েও আমি শুধু পরদেশির জীবন যাপন করেই বেড়িয়েছি, তবু এখন নিজের
দেশের পায়ে আমার জীবনটা উৎসর্গ করি, এই সে চাচ্ছিল।
ওঃ, রমণী তুমি! কী করে তবে নিজেকে
এমন করে চাপা দিয়ে রেখেছিলে হেনা?
কী অটল ধৈর্যশক্তি তোমার! কোমলপ্রাণা
রমণী সময়ে কত কঠিন হতে পারে।...
হেনা! হেনা!!
কাবুল
পাঁচ পাঁচটা গুলি এখনও আমার দেহে ঢুকে রয়েছে! যতক্ষণ না সম্পূর্ণ
জ্ঞান হারিয়েছিলুম, ততক্ষণ সৈন্যদের কী শক্ত করেই রেখেছিলুম!
খোদা! আমার বুকের রক্তে আমার দেশকে
রক্ষা করেছি, একে যদি শহিদ হওয়া বলে, তবে আমি শহিদ হয়েছি। জীবনের শেষ মুহূর্ত
পর্যন্ত আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি!
আমি চলে এলুম। হেনা ছায়ার মতো আমার
পিছু পিছু ছুটল! এত ভালোবাসা, পাহাড়-ফাটা উদ্দাম জনস্রোতের মতো এত প্রেম কী করে
বুকের পাঁজর দিয়ে আটকে রেখেছিল হেনা? ...
আমির তাঁর ঘরে আমার আসন দিয়েছেন। আজ
আমি তাঁর সেনাদলের একজন সর্দার।
আর হেনা! হেনা? – ওই যে সে আমায়
আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েছে; ... এখনও তার বুক কীসের ভয়ে কেঁপে উঠছে! এখনও বাতাস ছাপিয়ে
তার নিশ্বাসে উঠছে একটা মস্ত অতৃপ্তির বেদনা!
আহা, আমার মতো অভাগাও বড্ডো বেশি জখম
হয়েছে! – ঘুমিয়েছে, ঘুমোক! – না, না, দুই জনেই ঘুমোব! এত বড়ো তৃপ্তির ঘুম থেকে
জাগিয়ে আর বেদনা দিয়ো না খোদা!
হেনা! হেনা! – না – না!! –আঃ!!! ...