বিষের বাঁশী
কাজী নজরুল ইসলাম

                জাতের বজ্জাতি
                    [গান]

জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছ জুয়া!
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় মোয়া।

হুঁকোর জল আয় আর ভাতের হাঁড়ি ভাব্‌লি এতেই জাতির জান,
তাইত বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে একশ'-খান।
    ‌                     এখন দেখিস ভারত জোড়া
                         পচে আছিস বাসি মড়া,
মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কাহুয়া॥

জানিস নাকি ধর্ম সে যে বর্ম সম সহন-শীল,
তাকে কি ভাই ভাঙ্‌তে পারে ছোঁয়া ছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল!
                        যে জাত-ধর্ম ঠুন্‌কো এত,
                        আজ নয় কা'ল ভাঙবে সে তো,
যাক্ না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ, নাই পরোয়া॥

দিন-কানা সব দেখতে পাসনে দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে,
কেমন করে পিষছে তোদের পিশাচ জাতের জাঁতা-কলে।
                (তোরা) জাতের চাপে মারলি জাতি,
                           সূর্য ত্যজি নিলি বাতি,
(তোদের) জাত-ভগীরথ এনেছে জল জাত-বিজাতের জুতো-ধোয়া॥

মনু ঋষি অণুসমান বিপুল বিশ্বে যে বিধির,
বুঝলি না সেই বিধির বিধি, মনুর পায়েই নোয়াস শির।
                        ওরে মূর্খ ওরে জড়,
                        শাস্ত্র চেয়ে সত্য বড়ো,
(তোরা) চিনলিনে তা চিনির বলদ, সার হল তাই শাস্ত্র বওয়া॥

সকল জাতই সৃষ্টি যে তাঁর, এই বিশ্ব মায়ের বিশ্ব-ঘর,
মায়ের ছেলে সবাই সমান, তাঁর কাছে নাই আত্ম-পর।
                (তোরা) সৃষ্টিকে তাঁর ঘৃণা করে
                            স্রষ্টায় পূজিস জীবন ভরে
ভস্মে ঘৃত ঢালা সে যে বাছুর মেরে গাভি দোওয়া॥

বলতে পারিস, বিশ্ব-পিতা ভগবানের কোন সে জাত?
ছেলের তার লাগলে ছোঁয়া অশুচি হন জগন্নাথ?
                    নারায়ণের জাত যদি নাই
                    তোদের কেন জাতের বালাই?
(তোরা) ছেলের মুখে থুথু দিয়ে মার মুখে দিস ধূপের ধোঁয়া॥

ভগবানের ফৌজদারি-কোর্ট নাই সেখানে জাতবিচার,
(তোর) পতে টিকি টুপি টোপর সব সেথা ভাই একাক্কার।
                    জাত সে শিকেয় তোলা রবে,
                    কর্ম নিয়ে বিচার হবে,
(তাপর) বামুন চাঁড়াল এক গোয়ালে, নরক কিংবা স্বর্গে থোয়া॥

(এই)     আচার-বিচার বড়ো করে প্রাণ দেবতায় ক্ষুদ্র ভাবা,
(বাবা)    এই পাপেই আজ উঠতে বসতে সিঙ্গি-মামার খাচ্ছ থাবা।
তাই             নাইকো অন্ন নাইকো বস্ত্র,
                   নাইকো সম্মান, নাইকো অস্ত্র,
(এই)     জাত-জুয়াড়ির ভাগ্যে আছে আরও অশেষ দুঃখ-সওয়া॥

 

রচনাকাল ও স্থান: গানটির সুনির্দিষ্ট রচনা তারিখ জানা যায় না।  গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল বিজলী পত্রিকার '৪ শ্রাবণ ১৩৩০ বঙ্গাব্দ' সংখ্যায়। গানটির পাদটীকায় লিখা ছিল 'মাদারীপুর শান্তি-সেনা চারণ দল'-এর জন্য লিখিত অপ্রকাশিত নাটক থেকে'। ব্রহ্মমোহন ঠাকুর তাঁর 'নজরুল সঙ্গীত নির্দেশিকা গ্রন্থে' গানটির 'রচনার স্থান ও কাল' হিসেবে উল্লেখ করেছেন-'বহরমপুর জেলে ১৯২৩ সালের ১৮ই জুন থেকে ২০ জুলাই-এর মধ্যে লেখা'।