চক্রবাক
কাজী নজরুল ইসলাম
১৪০০ সাল
(কবি-সম্রাট রবীন্দ্রনাথের ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’পড়িয়া)
আজি হতে শত বর্ষ আগে
কে কবি, স্মরণ তুমি করেছিলে আমাদেরে
শত অনুরাগে,
আজি হতে শত বর্ষ আগে!
ধেয়ানি গো, রহস্য-দুলাল!
উতারি ঘোমটাখানি তোমার আঁখির আগে
কবে এল সুদূর আড়াল?
অনাগত আমাদের দখিন-দুয়ারি
বাতায়ন খুলি তুমি, হে গোপন হে স্বপনচারী,
এসেছিলে বসন্তের গন্ধবহ-সাথে,
শত বর্ষ পরে যথা তোমার কবিতাখানি
পড়িতেছি রাতে!
নেহারিলে বেদনা-উজ্জ্বল আঁখি নীরে,
আনমনা প্রজাপতি নীরব পাখায়
উদাসীন, গেলে ধীরে ফিরে!
আজি মোরা শত বর্ষ পরে
যৌবন-বেদনা-রাঙা তোমার কবিতাখানি
পড়িতেছি অনুরাগ-ভরে।
জড়িত জাগর ঘুমে শিথিল শয়নে
শুনিতেছে প্রিয়া মোর তোমার ইঙ্গিতে-গান
সজল নয়নে!
আজও হায়
বারে বারে খুলে যায়
দক্ষিণের রুদ্ধ বাতায়ন,
গুমরি গুমরি কাঁদে উচাটন বসন্ত-পবন
মনে মনে বনে বনে পল্লব-মর্মরে,
কবরীর অশ্রুজল বেণী-খসা ফুল-দল
পড়ে ঝরে ঝরে!
ঝিরিঝিরি কাঁপে কালো নয়ন-পল্লব,
মধুপের মুখ হতে কাড়িয়া মধুপী পিয়ে পরাগ-আসব!
কপোতের চঞ্চুপুটে কপোতীর হারায়
কূজন,
পরিয়াছে বনবধূ যৌবন-আরক্তিম কিংশুক-বসন!
রহিয়া রহিয়া আজও ধরণির হিয়া
সমীর-উচ্ছ্বাসে যেন ওঠে
নিশ্বসিয়া!
তোমা হতে শত বর্ষ পরে –
তোমার কবিতাখানি পড়িতেছি, হে কবীন্দ্র,
অনুরাগ-ভরে!
আজি এই মদালসা ফাগুন-নিশীথে
তোমার ইঙ্গিতে জাগে তোমার সংগীতে!
চতুরালি, ধরিয়াছি তোমার চাতুরি!
করি চুরি
আসিয়াছ আমাদের দুরন্ত যৌবনে,
কাব্য হয়ে, গান হয়ে, সিক্তকণ্ঠে রঙিলা স্বপনে।
আজিকার যত ফুল – বিহঙ্গের যত গান
যত রক্ত-রাগ
তব অনুরাগ হতে, হে চির-কিশোর কবি,
আনিয়াছে ভাগ!
আজি নব-বসন্তের প্রভাত বেলায়
গান হয়ে মাতিয়াছ আমাদের
যৌবন-মেলায়!
আনন্দ-দুলাল ওগো হে চির অমর!
তরুণ তরুণী মোরা জাগিতেছি আজি তব
মাধবী বাসর!
যত গান গাহিয়াছ ফুল-ফোটা রাতে –
সব গুলি তার
একবার – তা-পর আবার
প্রিয়া গাহে, আমি গাহি, আমি গাহি প্রিয়া গাহে সাথে!
গান-শেষে অর্ধরাতে স্বপনেতে শুনি
কাঁদে প্রিয়া, “ওগো কবি ওগো বন্ধু ওগো মোর গুণী –”
স্বপ্ন যায় থামি,
দেখি, বন্ধু আসিয়াছ প্রিয়ার নয়ন-পাতে
অশ্রু হয়ে নামি!
মনে লাগে, শত বর্ষ আগে
তুমি জাগো – তব সাথে আরো কেহ জাগে
দূরে কোন ঝিলিমিলি-তলে
লুলিত অঞ্চলে।
তোমার ইঙ্গিতখানি সংগীতের করুণ পাখায়
উড়ে যেতে যেতে সেই বাতায়নে ক্ষণিক তাকায়,
ছুঁয়ে যায় আঁখি-জল-রেখা,
নুয়ে যায় অলক-কুসুম,
তারপর যায় হারাইয়া, –তুমি একা বসিয়া নিঝ্ঝুম!
সে কাহার আঁখি-নীর-শিশির লাগিয়া
মুকুলিকা বাণী তব কোনোটি বা ওঠে মুঞ্জরিয়া,
কোনোটি বা তখনও গুঞ্জরি ফেরে মনে
গোপনে স্বপনে!
সহসা খুলিয়া গেল দ্বার,
আজিকার বসন্ত-প্রভাতখানি দাঁড়াল করিয়া নমস্কার!
শতবর্ষ আগেকার তোমারই সে বাসন্তিকা দূতি
আজি নব নবীনেরে জানায় আকুতি!...
হে কবি-শাহান-শাহ্ ! তোমারে দেখিনি মোরা,
সৃজিয়াছ যে তাজমহল –
শ্বেতচন্দনের ফোঁটা কালের কপালে ঝলমল –
বিস্ময়ে-বিমুগ্ধ মোরা তাই শুধু
হেরি,
যৌবনেরে অভিশাপি –“কেন তুই শতবর্ষ করিলি রে দেরি?
হায়, মোরা আজ
মোমতাজে দেখিনি, শুধু দেখিতেছি তাজ!”
শত বর্ষ পরে আজি, হে-কবি-সম্রাট!
এসেছে নূতন কবি – করিতেছে তব নান্দীপাঠ!
উদয়াস্ত জুড়ি আজও তব
কত না বন্দনা-ঋক ধ্বনিয়া উঠিছে নব নব।
তোমারই সে হারা-সুরখানি
নববেণু-কুঞ্জ-ছায়ে বিকশিয়া তোলে নব বাণী।
আজি তব বরে
শত বেণু-বীনা বাজে আমাদের ঘরে।
তবুও পুরে না হিয়া ভরে নাকো
প্রাণ,
শতবর্ষ সাঁতরিয়া ভেসে আসে স্বপ্নে তব গান।
মনে হয়, কবি,
আজও আছ অস্তপাট আলো করি
আমাদেরই রবি!
আজি হতে শত বর্ষ আগে
যে-অভিবাদন তুমি করেছিলে নবীনেরে
রাঙা অনুরাগে,
সে-অভিবাদনখানি আজি ফিরে চলে
প্রণামি-কমল হয়ে তব পদতলে!
মনে হয়, আসিয়াছ অপূর্বের রূপে
ওগো পূর্ণ, আমাদেরই মাঝে চুপে চুপে!
আজি এই অপূর্ণের কম্প্র কণ্ঠস্বরে
তোমারই বসন্তগান গাহি তব বসন্ত-বাসরে –
তোমা হতে শত বর্ষ পরে!