দোলন-চাঁপা
কাজী নজরুল ইসলাম
অভিশাপ
যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে!
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে–
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
ছবি আমার বুকে বেঁধে
পাগল হয়ে কেঁদে কেঁদে
ফিরবে মরু কানন গিরি,
সাগর আকাশ বাতাস চিরি
যেদিন আমায় খুঁজবে–
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
স্বপন ভেঙে নিশুত রাতে জাগবে হঠাৎ চমকে
কাহার যেন চেনা-ছোঁওয়ায় উঠবে ও-বুকে ছমকে,–
জাগবে হঠাৎ চমকে!
ভাববে বুঝি আমিই এসে
বসনু বুকের কোলটি ঘেঁষে,
ধরতে গিয়ে দেখবে যখন–
শূন্য শয্যা! মিথ্যা স্বপন!
বেদ্নাতে চোখ বুঁজবে–
বুঝবে সেদিন বুজবে।
গাইতে বসে কণ্ঠ ছিঁড়ে আসবে যখন কান্না,
বলবে সবাই–
'সেই যে পথিক তার
শেখানো গান না?–'
আসবে ভেঙে কান্না!
পড়বে মনে আমার সোহাগ,
কণ্ঠে তোমার কাঁদবে বেহাগ!
পড়বে মনে অনেক ফাঁকি.
অশ্রু-হারা কঠিন আঁখি
ঘন ঘন মুছবে–
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
আবার যেদিন শিউলি ফুটে ভরবে তোমার অঙ্গন,
তুলতে সে-ফুল গাঁথতে মালা কাঁপবে তোমার কঙ্কণ–
কাঁদবে কুটির-অঙ্গন!
শিউলি-ঢাকা মোর সমাধি
পড়বে মনে, উঠবে কাঁদি!
বুকের মালা করবে জ্বালা
চোখের জলে সেদিন বালা
মুখের হাসি ঘুচবে–
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
আসবে আবার আশিন-হাওয়া, শিশির-ছেঁচা রাত্রি,
থাকবে সবাই – থাকবে না এই মরণ-পথের যাত্রীই!
আসবে শিশির-রাত্রি!
থাকবে পাশে বন্ধু-স্বজন,
থাকবে রাতে বাহুর বাঁধন,
বঁধুর বুকের পরশনে
আমার পরশ আনবে মনে–
বিষিয়ে ও-বুক উঠবে–
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
আসবে আবার শীতের রাতি, আসবে নাকো আর সে–
তোমার সুখে পড়ত বাধা থাকলে যে-জন পার্শ্বে,
আসবে নাকো আর সে!
পড়বে
মনে, মোর বাহুতে
মাথা
থুয়ে যে-দিন শুতে,
মুখ
ফিরিয়ে থাকতে ঘৃণায়!–
সেই
স্মৃতি নিত ঐ বিছানায়
কাঁটা হয়ে ফুটবে–
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
আবার গাঙে আসবে জোয়ার, দুলবে তরী রঙ্গে,
সেই তরীতে হয়তো কেহ থাকবে তোমার সঙ্গে–
দুলবে তরী রঙ্গে,
পড়বে মনে, সে
কোন রাতে
এক তরীতে ছিলে সাথে,
এমনি গাঙে ছিল
জোয়ার,
নদীর দু’ধার এমনি
আঁধার
তেমনি তরী ছুটবে–
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
তোমার সখার আসবে যেদিন এমনি কারা-বন্ধ,
আমার মতন কেঁদে কেঁদে হয়ত হবে অন্ধ–
সখার কারা-বন্ধ!
বন্ধু তোমার হানবে হেলা,
ভাঙবে তোমার সুখের মেলা;
দীর্ঘ বেলা কাটবে না আর,
বইতে প্রাণের শান্তি এ-ভার
মরণ-সনে যুঝবে–
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
ফুটবে আবার দোলন-চাঁপা চৈতী-রাতের চাঁদনি,
আকাশ-ছাওয়া তারায় তারায় বাজবে আমার কাঁদ্নি
চৈতী-রাতের চাঁদনি।
ঋতুর পরে ফিরবে ঋতু,
সেদিন–
হে মোর
সোহাগ-ভীতু!
চাইবে কেঁদে নীল নভো-গায়,
আমার মতন চোখ ভরে চায়
যে-তারা তায় খুঁজবে–
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
আসবে ঝড়, নাচবে তুফান, টুটবে সকল বন্ধন,
কাঁপবে কুটীর সেদিন ত্রাসে, জাগবে বুকে ক্রন্দন–
টুটবে যবে বন্ধন!
পড়বে মনে, নেই সে সাথে
বাঁধতে বুকে দুঃখ-রাতে।–
আপনি গালে যাচবে চুমা,
চাইবে আদর, মাগ্বে ছোঁওয়া,
আপনি যেচে চুমবে–
বুঝবে সেদিন বুঝবে।
আমার বুকের যে কাঁটা-ঘা তোমায় ব্যথা হানত,
সেই আঘাতই যাচবে আবার হয়ত হ’য়ে শ্রান্ত–
আসবে তখন পান্থ।
হয়ত তখন আমার কোলে,
সোহাগ-লোভে পড়বে ঢলে,
আপনি সেদিন সেধে কেঁদে
চাপবে বুকে বাহুয় বেঁধে,
চরণ চুমে পূজবে–
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
রচনা ও প্রকাশকাল:
কল্লোল পত্রিকার শ্রাবণ ১৩৩০ সংখ্যায় 'অভিশাপ' শিরোনামে প্রথম প্রকাশিত
হয়েছিল।