ঝিঙেফুল   বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার 'শ্রাবণ 
					১৩২৮' সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। 
 
কাজী নজরুল ইসলাম
			
				
					               মা
	
															           
					যেখানেতে দেখি যাহা
					           
					মা-এর মতন আহা
										একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,
					           
					মায়ের মতন এত
					           
					আদর সোহাগ সে তো
										আর কোনোখানে কেহ পাইবে না ভাই।
  
					
					           
					হেরিলে মায়ের মুখ
					           
					দূরে যায় সব দুখ,
										মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান,
					           
					মায়ের শীতল কোলে
					           
					সকল যাতনা ভোলে
					
					কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।
					           
					কত করি উৎপাত
					           
					আবদার দিন রাত,
										সব সন হাসি মুখে, ওরে সে যে মা!
					
					           
					আমাদের মুখ চেয়ে
					           
					নিজে রন নাহি খেয়ে,
										শত দোষে দোষী তবু মা তো ত্যজে না।
  
					
					           
					ছিনু খোকা এতটুকু,
					           
					একটুতে ছোটো বুক
										যখন ভাঙিয়া যেত, মা-ই সে তখন
					           
					বুকে করে নিশিদিন
					           
					আরাম-বিরামহীন
										দোলা দিয়ে শুধাতেন, ‘কী হল খোকন?’
  
					
					           
					আহা সে কতই রাতি
					           
					শিয়রে জ্বালায়ে বাতি
										একটু অসুখ হলে জাগেন মাতা,
					           
					সবকিছু ভুলে গিয়ে
					           
					কেবল আমারে নিয়ে
										কত আকুলতা যেন জগন্মাতা।
  
					
					           
					যখন জনম নিনু
					           
					কত অসহায় ছিনু,
										কাঁদা ছাড়া নাহি জানিতাম কোনো কিছু,
					           
					ওঠা বসা দূরে যাক –
					           
					মুখে নাহি ছিল বাক,
										চাহনি ফিরিত শুধু মা-র পিছু পিছু!
  
					
					           
					তখন সে মা আমার
					           
					চুমু খেয়ে বারবার
										চাপিতেন বুকে, শুধু একটি চাওয়ায়
					           
					বুঝিয়া নিতেন যত
					           
					আমার কী ব্যথা হত,
					বলো কে এমন স্নেহে বুকটি ছাওয়ায়!
					
					           
					তারপর কত দুখে
					           
					আমারে ধরিয়া বুকে
					করিয়া তুলেছে মাতা দেখো কত বড়ো,
					           
					কত না সুন্দর
					           
					এ দেহ এ অন্তর
					সব মোরা ভাই বোন হেথা যত পড়।
  
					
					           
					পাঠশালা হতে যবে
					           
					ঘরে ফিরি যাব সবে,
					কত না আদরে কোলে তুলি নেবে মাতা,
					           
					খাবার ধরিয়া মুখে
					           
					শুধাবেন কত সুখে
					‘কত আজ লেখা হল, পড়া কত পাতা?’
  
					
					           
					পড়ে লেখা ভালো হলে
					           
					দেখেছ সে কত ছলে
					ঘরে ঘরে মা আমার কত নাম করে!
					           
					বলে, ‘মোর খোকামণি।
					           
					হিরা-মানিকের খনি,
					এমনটি নাই কারও!’ শুনে বুক ভরে!
  
					
					           
					গা-টি গরম হলে
					           
					মা সে চোখের জলে
					ভেসে বলে, ‘ওরে জাদু কী হয়েচে বল!’
					           
					কত দেবতার ‘থানে’
					           
					পিরে মা মানত মানে –
					মাতা ছাড়া নাই কারও চোকে এত জল।
  
					
					           
					যখন ঘুমায় থাকি
					           
					জাগে রে কাহার আঁখি
					আমার শিয়রে, আহা কীসে হবে ঘুম!
    
					           
					তাই কত ছড়া গানে
					           
					ঘুম-পাড়ানিরে আনে,
বলে, 
					‘ঘুম! দিয়ে যা রে খুকু-চোখে চুম!’
  
					
					           
					দিবানিশি ভাবনা
					           
					কীসে ক্লেশ পাব না,
					কীসে সে মানুষ হব, বড়ো হব কীসে;
					           
					বুক ভরে ওঠে মার
					           
					ছেলেরই গরবে তাঁর,
					সব দুখ সুখ হয় মায়ের আশিসে।
  
					
					           
					আয় তবে ভাই বোন,
					           
					আয় সবে আয় শোন
					গাই গান, পদধূলি শিরে লয়ে মা-র;
					
					           
					মার বড়ো কেউ নাই –
					           
					কেউ নাই কেউ নাই!
					নত করি বল সবে ‘মা আমার! মা আমার!’