জিঞ্জির
অঘ্রাণের সওগাত
কাজী নজরুল ইসলাম
ঋতুর খাঞ্চা ভরিয়া এল কি ধরণির সওগাত?
নবীন ধানের আঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হল মাৎ।
‘গিন্নি-পাগল’চালের ফিরনি
তশতরি ভরে নবীনা গিন্নি
হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে, খুশিতে কাঁপিছে হাত।
শিরনি বাঁধেন বড়ো বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেসমাত!
মিয়া ও বিবিতে বড়ো ভাব আজি খামারে ধরে না ধান।
বিছানা করিতে ছোট বিবি রাতে চাপা সুরে গাহে গান!
‘শাশবিবি’ কন, “আহা, আসে নাই
কতদিন হল মেজলা জামাই।”
ছোট মেয়ে কয়, “আম্মা গো, রোজ কাঁদে মেজো বুবুজান!”
দলিজের পান সাজিয়া সাজিয়া সেজো-বিবি লবেজান!
হল্লা করিয়া ফিরিছে পাড়ায় দস্যি ছেলের দল।
ময়নামতীর শাড়ি-পরা মেয়ে গয়নাতে ঝলমল!
নতুন পৈঁচি-বাজুবন্দ পরে
চাষা-বউ কথা কয় না গুমোরে,
জারিগান আর গাজির গানেতে সারা গ্রাম চঞ্চল!
বউ করে পিঠা ‘পুর’-দেওয়া মিঠা, দেখে জিভে সরে জল!
মাঠের সাগরে জোয়ারের পরে লেগেছে ভাটির টান।
রাখাল ছেলের বিদায়-বাঁশিতে ঝুরিছে আমন ধান!
কৃষক-কণ্ঠে ভাটিয়ালি সুর
রোয়ে রোয়ে মরে বিদায়-বিধুর!
ধান ভানে বউ, দুলে দুলে ওঠে রূপ-তরঙ্গে বান!
বধূর পায়ের পরশে পেয়েছে কাঠের ঢেঁকিও প্রাণ!
হেমন্ত-গায় হেলান দিয়ে গো রৌদ্র পোহায় শীত!
কিরণ-ধারায় ঝরিয়া পড়িছে সূর্য – আলো-সরিৎ!
দিগন্তে যেন তুর্কি কুমারী
কুয়াশা-নেকাব রেখেছে উতারি।
চাঁদের প্রদীপ জ্বালাইয়া নিশি জাগিছে একা নিশীথ!
নতুনের পথ চেয়ে চেয়ে হল হরিত পাতারা পীত।
নবীনের লাল ঝাণ্ডা উড়ায়ে আসিতেছে কিশলয়,
রক্ত-নিশান নহে যে রে ওরা রিক্ত শাখার জয়!
‘মুজদা’ এনেছে অগ্রহায়ণ –
আসে নওরোজ খোলো গো তোরণ!
গোলা ভরে রাখো সারা বছরের হাসি-ভরা সঞ্চয়।
বাসি বিছানায় জাগিতেছে শিশু সুন্দর নির্ভয়!
কলিকাতা
১০ কার্তিক ১৩৩৩