জিঞ্জির
কাজী নজরুল ইসলাম
ঈদ-মোবারক
শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে গা,
কত বালুচরে কত আঁখি-ধারা ঝরায়ে গো,
বরষের পরে আসিলে ঈদ!
ভুখারির দ্বারে সওগাত বয়ে রিজওয়ানের,
কণ্টক-বনে আশ্বাস এনে গুল-বাগের,
সাকিরে
‘জামের’ দিলে তাগিদ!
খুশির পাপিয়া পিউ পিউ গাহে দিগ্বিদিক,
বধূ জাগে আজ নিশীথ-বাসরে নির্ণিমিখ!
কোথা ফুলদানি, কাঁদিছে ফুল!
সুদূর প্রবাসে ঘুম নাহি আসে কার সখার,
মনে পড়ে শুধু সোঁদা-সোঁদা বাস এলো খোঁপার,
আকুল কবরী উলঝলুল!!
ওগো কাল সাঁঝে দ্বিতীয় চাঁদের ইশারা কোন
মুজদা এনেছে, সুখে ডগমগ মুকুলি মন!
আশাবরি-সুরে ঝুরে সানাই।
আতর সুবাসে কাতর হল গো পাথর-দিল,
দিলে দিলে আজ বন্ধকি দেনা – নাই দলিল,
কবুলিয়তের নাই বালাই॥
আজিকে এজিদে হাসেন হোসেন গলাগলি,
দোজখে ভেশতে ফুলে ও আগুনে ঢলাঢলি,
শিরী ফরহাদে জড়াজড়ি।
সাপিনির মতো বেঁধেছে লায়লি কায়েসে গো,
বাহুর বন্ধে চোখ বুঁজে বঁধু আয়েসে গো!
গালে গালে চুমু গড়াগড়ি॥
দাউ দাউ জ্বলে আজি স্ফূর্তির জাহান্নাম,
শয়তান আজ ভেশতে বিলায় শারাব-জাম,
দুশমন দোস্ত এক-জামাত!
আজি আরফাত-ময়দান পাতা গাঁয়ে গাঁয়ে,
কোলাকুলি করে বাদশা-ফকিরে ভায়ে ভায়ে,
কাবা ধরে নাচে ‘লাত-মানাত’॥
আজি ইসলামি-ডঙ্কা গরজে ভরি জাহান,
নাই বড়ো ছোটো – সকল মানুষ এক সমান,
রাজা প্রজা নয় কারও কেহ।
কে আমির তুমি নওয়ার বাদশা বালাখানায়?
সকল কালের কলঙ্ক তুমি; জাগালে হায়
ইসলামে তুমি সন্দেহ॥
ইসলাম বলে, সকলের তরে মোরা সবাই,
সুখ-দুখ সম-ভাগ করে নেব সকলে ভাই,
নাই অধিকার সঞ্চয়ের!
কারও আঁখি-জলে কারও ঝাড়ে কি রে জ্বলিবে দীপ?
দুজনার হবে বুলন্দ-নসিব, লাখে লাখে হবে বদনসিব?
এ নহে বিধান ইসলামের॥
ঈদ-অল-ফিতর আনিয়াছে তাই নববিধান,
ওগো সঞ্চয়ী, উদ্বৃত্ত যা করিবে দান,
ক্ষুধার অন্ন হোক তোমার!
ভোগের পেয়ালা উপচায়ে পড়ে তব হাতে,
তৃষ্ণাতুরের হিসসা আছে ও পিয়ালাতে,
দিয়া ভোগ করো, বীর, দেদার॥
বুক খালি করে আপনারে আজ দাও জাকাত,
কোরো না হিসাবি, আজি হিসাবের অঙ্কপাত!
একদিন করো ভুল হিসাব।
দিলে দিলে আজ খুনসুড়ি করে দিললগি,
আজিকে ছায়েলা-লায়েলা-চুমায় লাল যোগী!
জামশেদ বেঁচে চায় শারাব॥
পথে পথে আজ হাঁকিব বন্ধু, ঈদ-মোবারক! আসসালাম!
ঠোঁটে ঠোঁটে আজ বিলাব শিরনি ফুল-কালাম!
বিলিয়ে দেওয়ার আজিকে ঈদ!
আমার দানের অনুরাগে-রাঙা ঈদগা রে!
সকলের হাতে দিয়ে দিয়ে আজ আপনারে –
দেহ নয়, দিল হবে শহীদ॥
কলিকাতা
১৯ চৈত্র, ১৩৩৩